রংধনু - পর্ব ১৪ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


বোনকে দেখে কিছুটা ম্লান হাসে নিশাদ।সাঁঝ যেন সাহস পায় ভাইয়ের কাছে আসতে।নিশাদ বইয়ের থেকে মুখ তুলে সাঁঝকে আড়চোখে দেখে বলল,

''কি বলবি?"

সাঁঝ পা টিপে টিপে হেঁটে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়।নিশাদ এবার সাঁঝের দিকে ফিরে বসে।বেলা ওদের সাথে নেই একমাসে পরিনত হয়েছে।বাসার পুরো পরিবেশটাই যেন থমথমে হয়ে গেছে।বাসায় আব্বা আর নিশাদ প্রয়োজন ছাড়াই কারোর সাথে কোনপ্রকার কথা বলেনা।সাঁঝের সাথে তেমন একটা কথা না বললে ও প্রয়োজনে খুঁটিনাটি কথা বলে। সাঁঝ বাবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি।লুকিয়ে লুকিয়ে আপার সাথে আদনান আর ও কথা বলতো।ওরা শুনেছে আপার শাশুড়ী ও নাকি খুব ভালো।আপাকে মেনে নিয়েছে এবং আদর ও করে।আর বিভান ভাইতো ভীষন খেয়াল রাখে আপার।ইকরাম রাহমানের বাসায় অন্ধকার ছাঁয়া নেমে এসেছিলো বেলার চলে যাওয়ার পর থেকে।দিন দিন বাহিরের মানুষের কটু কথা বেড়েই যাচ্ছিলো।নিশাদ কে ও যেতে আসতে কথা শুনতে হচ্ছিলো।সেদিন তো ইকরাম রাহমান ঘরে ফিরে বলেই দিলেন,

''বেলা আমাদের সবার জন্য মরে গেছে।ওর নাম কেউ নিবিনা।যেডাই নিবি আমার ঘর ছাইড়া চইলা যাবি।"

বাবার কথায় সবাই ভীষন অবাক।মা তো কেঁদেই দিয়েছিলেন।আসলে কান্না টা এখন প্রত্যেকদিনকার সঙ্গী মায়ের।আব্বা বেলা কে একদমই দেখতে পারেননা এখন।ওর নাম ও সহ্য করতে পারেনা।সাঁঝ চাইছিলো অন্তত ভাইকে বুঝাতে।ভাই বুঝলে আব্বার বুঝতে সময় লাগবেনা।সেই আশায় ভাইয়ের দরজায় এসেছিলো সাঁঝ।সাঁঝকে চুপ থাকতে দেখে নিশাদ রেগে উঠে দাঁড়ায়।তারপর বলতে শুরু করলো, 

''যদি এই আশা নিয়ে বসে থাকিস তুই আমাকে বুঝাবি আর আমি আব্বার অবাধ্য হয়ে মিস বেলার সাথে কথা বলবো।ওর বিয়ে মেনে নিবো।তাহলে সেটা তোর ভুল ধারনা।মিস বেলা আর তার জামাইয়ের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।"

কথা গুলো বলে বেরিয়ে যেতে চাইলে সাঁঝ নিশাদের হাত ধরে আটকায়।তারপর বলল,

''ভাইয়া আপা যা করেছে ঠিক করেছে।ভুল করেনি সে।বিভান ভাইয়ের মতো বেস্ট লাইফ পার্টনার আপার জন্য আর কেউ হতে পারতোনা।আর কথা রইলো ইদরীস সাহেবের।তার সাথে বিয়ে হলে এতোদিনে আপার লাশ ঘরে আসতো।জানিস ইদরীস সাহেবকে তোরা যতোটাই ভালো দেখেছিলি সে ততোটাই জঘন্য নোংরা লোক।তার পুরা পরিবার ফ্রড।সে আপাকে আর আমাদের ক্ষতি করতে পারেনি একমাত্র একজন লোকের জন্য।সে বিভান ভাই।"

সাঁঝের কথায় প্রচন্ড রেগে যায় সাথে সাথে অবাক ও হয় নিশাদ।সাঁঝের সামনে এসে বলল,

''কি বাজে বকিস?"
''জি ভাই।জানিস ইদরীস ভাই আপাকে বন্দিনী করে রাখতে চেয়েছিল।সেখানে আপাকে খুব অত্যাচার করতো।হয়ত আপা কে মেরে ও ফেলতো।কারন বিভান ভাইয়ের কথা জেনে গিয়েছিলো তারা।আপার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে বিভান ভাই ইদরীসের সব খবর নিতে শুরু করেছিলো।ইদরীসের কাজই এমন।এক এক মেয়েকে বিয়ে করে তারপর তাদের অত্যাচার করে ঘরে রেখে।তারপর একসময় মেরে ফেলে।আপার সাথে ও তাইই হতো।আর আপা তোদের বলেনি কারন তোরা বিয়ে ভাঙ্গতে চাইলে ইদরীস আর তার ফেমিলি আমাদের ক্ষতি করতো।কিন্তু বিভান ভাই তাদের জেলে পাঠিয়ে দিয়ে সব সামলে নিয়েছিলো নাহলে এতোদিনে এমন থাকতে পারতামনা আমরা।"

সাঁঝের কথা শেষ হতেই নিশাদ বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।ইদরীসের বাবার নম্বরে কল দিতে থাকে।কয়েকবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়।নিশাদ শুনতে পায় অপরপাশ থেকে কেউ বলল,

''ধানমন্ডি থানা থেকে বলছি।কে আপনি?"
''আমি ইদরীস হক আর তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।কই ওনারা?"
''রিমান্ডে আছে।ওনাদের কেন চান?"
''রিমান্ডে কেন? কি করেছে তারা?"
''আরে জানেননা?ওনারা কতো অপকর্ম করে বেড়াচ্ছিলো।বিয়ে করে করে মেয়েদের খুন করতো অত্যাচার করে।তারপরই একজন ভারতীয় লোক তাদের ধরিয়ে দিয়েছে।আমরা অনেক বছর যাবৎ এদের খুঁজছিলাম।'

নিশাদ কিছু বলতে পারেনা।ফোন কেঁটে ফুটপাতের ওপর বসে পড়ে।মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে।নিজের বড়বোনের সাথে কতোটা খারাপ ব্যাবহার করেছিলো সে।বিভান ভাইকে ও অপমান করেছিল।কিন্তু সে কি এমন ব্যাবহারের যোগ্য ছিলো?ওদের পুরো পরিবারকে ইদরীসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে বিভান।আর পরিনামে কি পেলো অপমান।বড় জামাই হিসেবে কোন পরিচিতিই পায়নি।নিশাদের মন খুব খারাপ হয়ে যায়।কিভাবে কথা বলবে আপার সাথে?সেদিন তো খুব বেয়াদবি ও করেছিলো।কতোটা কষ্টই না পেয়েছিলো আপা।যেখানে আপা আর ওর সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো সেখানে আপাকে ও দূর করে দিয়েছিলো।অচেনা ব্যাক্তির মতো কথা বলেছিলো।বিভানদের ঘরে প্রায় পনের দিনের মতো পেরিয়ে গেলো।বন্দনা আখতারকে দেখাই যায়না।ওনি নিজের মতো থাকে।বেলার থাকা আর না থাকার কোন খবর নেই যেন ওনার।বিভানের সাথে ও তেমন কথা বলেননা।বিভান অফিস থেকে ফিরে এসে রুমে আসে।রুমে বেলাকে না পেয়ে কিছুটা অবাক হয়।কিছু কিছু হিন্দি শিখেছে বেলার।সেটা চলার মতো।বিভান ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে।বেলা টেবিলে খাবার সাজিয়ে মৃদু হেসে বিভানের দিকে তাকায়।
________________________________________
বিভান এসে বেলার হাত ধরে কাছে টেনে ওর গালে চুমু খেতেই বেলা বিভানের বুকে হাত রেখে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

''সার্ভেন্টসরা আছে।"

বিভান হেসে চেয়ারে বসে বলল,

''খেয়েছো?"
''না।মা ও খায়নি এখনো।ডাকতে গিয়েছিলাম কিন্তু দরজা বন্ধ ছিলো।"
''তা তুমি খেয়ে নিতে?"
''কি বলেন বিভান।মা খায়নি আমি কিভাবে খাবো?"

বিভান রেগে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।তারপর বলল,

''বেলা তোমার কাজ গুলো একদম ভালো লাগেনা।যে খাওয়ার খাবে।তোমার এতো ভাবতে হবেনা।তোমার টা তুমি খাবা। "

বেলা ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে এসে বলল,

''এমন করছেন কেন?এভাবে রিএ্যাক্ট করার কি হলো?"
''বেলা বললাম তো নিজের খাবার খেয়ে নেবে।বসো খেতে।"
''মাকে ডাকুননা।"
''বেলা বুঝতে পারছোনা।সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।"

বেলা মাথা নিচু করে নেয়।বিভান ওকে জোর করে বসিয়ে খাইয়ে দিলো।বিকেলে বিভান আর বেলা শুয়ে পড়ে কিছুসময়ের জন্য।তখনই বেলার নম্বরে কল আসে।বেলা ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুসময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।বিভান চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো

'' কল রিসিভ করো বেলা।"

বেলার গলা ধরে আসে।ও কান্না সামলে বলল,

''জি ধরছি।"

বেলা কল রিসিভ করে চোখ মুছে বলল,

''হ্যালো ন নিশাদ"

নিশাদ ফুটপাতের ওপর বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।তারপর হাত দিয়ে দুচোখের পানি মুছে বলল,

''আপা!!!

নিশাদ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।বেলা ও কাঁদতে শুরু করে।বিভান উঠে বসে বেলার কান্না শুনে।নিশাদ কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

''আপা মাফ করে দিস আমাকে।বুঝতে পারিনি।"

কান্নার মাঝে ও বেলার মুখে হাসির ঝিলিক ফুঁটে উঠে।নিশাদ ও হাসতে থাকে অশ্রুজড়িত চোখে।নিশাদ বলল,

''কেমন আছিস আপা?"
''ভালো।তোরা কেমন আছিস?"
''এখন ভালো লাগছে।বিভান ভাই কেমন আছে?"

বেলার ভীষন ভালো লাগতে শুরু করে।নিশাদ বিভান কে ভাই ডাকছে।তারমানে বিভানকে ও মেনে নিয়েছে।বেলা হেসে বলল,

''ভালো আছে ওনি।আব্বা কিছু বলেছে?"

নিশাদের মুখের হাসি চলে যায়।লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল,

''না আপা।আব্বা এখনো জানেনা।তবে খুব জলদি তোকে কল দেবে আব্বা।সব ঠিক হয়ে যাবে।"

বেলার সাথে অনেকটাসময় নিয়ে কথা বলে নিশাদ।বিভানের সাথে ও বলেছিলো।সেদিনটা বেশ ভালোই গেলো ওদের।সন্ধ্যায় কোন এক কাজে বেরিয়ে গিয়েছিলো।বেলা ঘরের কিছু কাজ সেরে নেয়।অনেকটা রাত করে ঘরে ফিরে বিভান।খাটে বসেছিলো বেলা।বিভান কে দেখে বেলা বলল,

''এত সময় লাগলো যে?"
''হুম।"

বিভান বলল,

''তুমি একটু বের হও।আমি কিছু কাজ করবো।"

বেলা ম্লান হেসে বলল,

''আমাকে বের হতে হবে কেন?"
''বেলা আমার কাজ আছে।প্লিজ বের হও।"

বেলা ম্লান হেসে বেরিয়ে যায়।কিছুক্ষন পর বেলার ডাক পড়ে রুম থেকে।বেলার দিকে ফুলের পাপড়ি 
ওর দিকে ছিটাতে থাকে বিভান।বেলা হেসে স্বামীর দিকে তাকায়।পুরো রুম ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজানো।ভীষন সুন্দর লাগছিলো রুমটাকে।বিভান বেলার কাছে এসে ওর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

''যাও পরে আসো।আমি দেখবো।"

বেলার মুখ লজ্জায় ভরে আসে।কাঁপা হাতে ব্যাগটা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোয়।বিভান খাটে এসে বসে।বেলা বাথরুমে এসে প্যাকেটটির ভেতর থেকে সাদা জর্জেট সিল্কের শাড়ী বের করে আনে।বেলা শাড়ীটা পরে নেয়।ব্লাউজের গলাটা একদম নেটের।বেলা গায়ে শাড়ীটা জড়িয়ে হেসে দেয় লজ্জা মাখা মুখে।হালকা সাজ নিয়ে বেরিয়ে আসে।বিভান খাটে বসে ফুলের পাপড়ি হাতে নিয়ে দেখছিলো।বাথরুমের দরজার শব্দ হতেই বিভান সামনে তাকিয়ে বেলাকে দেখতে পায়।বেলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।বিভান কাছে এসে দাঁড়ায় বেলার।একহাতে ওর চিবুক ধরে মুখ টা তুলে ধরে বেলার।বেলা নিচে উঁবু হয়ে বিভানের পা ধরে সালাম দিতেই বিভান ওকে তুলে ধরে।বেলার কেন যেন শরীর খুব কাঁপছে।বিভান মৃদু হাসে বেলার লজ্জা ভরা চাহনি দেখে।তারপর বেলার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বেলার অধরযুগল স্পর্শ করে বেলার ওষ্ঠজোড়া।বেলার ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপছিলো।বিভান সরে এসে বেলাকে কোলে তুলে নেয়।বেলার বুক যেন ধুক করে উঠে।বিভান হেসে বেলাকে খাটের দিকে নিয়ে আসে।খাটে বসিয়ে দিয়ে বেলার পাশে বসে পড়ে বিভান।বেলা ঠিকমতো বসতে পারছেনা।ওর গা কাঁপছে।বিভান এক হাত বাড়িয়ে বেলার শাড়ীর আঁচল ওর কাঁধ থেকে সরাতে থাকে।আর বেলার অপর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দেয়।বেলার পুরো শরীর কাঁপছে।বেলার কাঁধ থেকে শাড়ী সরে গেছে।বেলা বিভানকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে।বিভান বেলাকে শুইয়ে দিয়ে ওর পায়ের কাছে এসে বসে।বেলার পায়ে একটা নুপুর পরিয়ে দেয়।বেলার মুখে সন্তুষ্টির হাসি।বিভান এবার উপরে এসে বেলার দিকে উঁবু হয়।তারপর গলায় ভরাট চুমু দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

''May i?"

বেলার নিশ্বাস ভারি হয়ে পড়ছে।গলা কাঁপছে।চোখ বুজে কাঁপা গলায় বলল,

''I'm all yours."

বিভান প্রেমের হাসি দিয়ে বেলাকে নিয়ে ভালবাসার সাগরে ডুবে যায়।আজ বিবাহের দীর্ঘ  একমাস পর একে  অপরকে আপন করে পেলো।এই বন্ধন শুধু দেহের না দুটো হৃদয়ের দুটো আত্মার।

!!!!

বিয়ের ছয়মাসের মাথায় শেখ পরিবারে এলো নতুন অতিথি আসার খবর। বিভান ভীষন খুশি।পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিতরন করলো।এতিম খানা বৃদ্ধাশ্রম, মাদ্রাসা ও বাদ যায়নি।বেলার প্রতি খেয়াল খুব রাখছিলো বিভান প্রথম দুমাস।বেলার প্রেগন্যান্সির সময় থেকে বন্দনা আখতার ভালো ব্যাবহার করতেন বেলার সাথে।ওর খুঁটিনাটি খেয়াল রাখতেন বিভান থাকা কালীন।এদিকে বেলার মা হওয়ার খবর বাংলাদেশে ও পৌছে যায়।মা নিশাদ আদনান সাঁঝ সবাই খুশি একমাত্র আব্বা ছাড়া।ওনি জানতেনই না বেলার মা হওয়ার খবর।কিন্তু সুখ বেশি দিন টেকেনি।সেদিন বিভান অফিসে চলে গিয়েছিলো খুব সকাল।বেলার পাঁচমাস চলছিলো তখন। সেদিন রাতে বিভান আর ও জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিলো।বেলাকে খুব বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিলো।বিভান বেলার ভারি হয়ে আসা পেটে হাত ছুঁইয়ে বলল,

''কি হলো?মন খারাপ?"

বেলার কন্ঠে অস্বস্তির ভাব।কিছুটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

''খুব ভয় করে আমার।পাঁচমাস যখন থেকে শুরু হয়েছে খুব ভয় করে আমার।"

বিভানের মুখে চিন্তার ছাপ।অবাক হয়ে বলল,

''কিসের ভয় বেলা?"
''সব ঠিক থাকবে তো?"
''ইনশাল্লাহ ঠিক থাকবে।কি হয়েছে তোমার?"
''জানি না বিভান।কাল অফিসে যেয়েননা প্লিজ।"

বেলার গালে হাত রেখে বিভান বলল,

''বেলা কাল অনেক ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে।জানোই তো একটা প্রজেক্ট এর ওপর কাজ করছি।কিভাবে থাকবো বলো?মা তো আছেই।"

বেলার দুশ্চিন্তা শেষই হতে চায়না। বিভান বেলাকে বুকে টেনে নিয়ে ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

''বেলা তোমার যখন লাগবে আমাকে কল দেবে।আমি ছুঁটে চলে আসবো।অফিসে থাকলে নিজে ও রিল্যাক্স থাকতে পারিনা।তোমার চিন্তা লেগে থাকে।"

বিভানকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বেলা বলল,

''আপনাকে কাল খুব দরকার আমার।তবে ঠিক আছে।কাজটা ও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিশ্চিন্তে চলে যেয়েন।আমি ঠিক আছি।"

বেলাকে সামনে এনে ওর চিবুক ধরে  মুখ তুলে  ধরে বিভান।তারপর মুচকি হেসে বলল,

''সত্যি?"
''হুম।"

বিভান বেলার কপালে চুমু দিয়ে আবার ও বুকে টেনে নেয়।পরদিন সকালেই যেন সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো।বেলা নিচে নামার জন্য সিড়িতে পা বাড়ায়।পিছনে বন্দনা আখতার এসে বলেন,

''জলদি নামো বেলা আমার কাজ আছে।"

বেলা মাথা ঝাঁকিয়ে জলদি নামার চেষ্টা করছে কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে ওর।বন্দনা আখতার রেগে গিয়ে ওর পিঠে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,

''নামিস না কেন?"

বেলা কিছু বলার সুযোগ পেলোনা।তাল সামলাতে না পেরে পা ফঁসকে সিড়ি থেকে পড়ে গেলো।প্রত্যেকটা সিড়ির মাথায় রক্তের ছাপ।বেলা নিচে পড়ে শেষ সিড়ির সাথে বাড়ি জ্ঞান হারায়।বন্দনা আখতার কিছু না বলেই বেরিয়ে যান।বেলার চারপাশে রক্তের বন্যা বইছে।এদিকে বেলার এ অবস্থা দেখে বিভানকে কল দেয় একজন কাজের লোক।বেলার কথা শুনে বিভান ছুঁটে চলে আসে ঘরে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে।কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।বাবুটা ওদের ছেড়ে চলে যায়।বেলার পিঠের দুটো প্রচন্ড আঘাত পায়।ডাক্তার জানায় বেলার মা হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম।কন্সিভ করলে ও মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা আশি পার্সেন্ট।বিভান খুব কষ্ট পায়।বেলার হাত ধরে কাঁদতে থাকে।বেলার জ্ঞান ফেরার পর বিভান জানতে পারে বেলা পা পিছলে পড়ে গেছে।বন্দনা আখতার ও হাসপাতালে আসেন।তবে বেলাকে অপয়া অলক্ষী বলে গালিগালাজ করেছিলেন।তবে বিভান মাকে সামলে নেয়।বেলার এই দুর্ঘটনার খবর বাংলাদেশে পৌছুতেই আম্মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।নিশাদ বিভানকে খুব সান্তনা দেয়।তবে এমন কষ্টের তো সান্তনা হয়না।বেলা খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো।বন্দনা আখতার ওকে দেখলে গালা গালি করতেন।কিন্তু হজম করে নিতো।কথা  গুলো এক কান দুকান হতে দিতোনা।এর পর অনেক গুলো সময় পেরিয়ে যায়।বেলা কখনোই কন্সিভ করতে পারেনি।মাঝে দুবার করলে ও মিসক্যারেজ হয়েগিয়েছিলো।এভাবে তের বছর চলে যায় ওদের জীবন থেকে।বেলার চোখের কোনে পানি জমে আসে।পেটে আলতো করে হাত রেখে কেঁদে উঠে নিঃশব্দে।আজ ছত্রিশ বছর বয়সে ও মা হতে পারেনি।বিভানকে ও বাবা হবার সুখ দিতে পারেনি।লোকটা আজ ও জানেনা সেদিন কি হয়েছিলো।কিভাবে অনাগত সন্তান কে হারিয়েছিলো।এ কথা গুলো জানলে বিভান তার মাকে সম্মান করতে পারবেনা।বরং ঘৃনা করতে শুরু করবে।সেটা বেলা চায়না।একমাত্র ছেলে বিভান তার শাশুড়ী মায়ের।অনেক কষ্টে ছেলে কে বড় করেছিলেন ওনি।এ কষ্টের কাছে সব কষ্ট তুচ্ছ।এরই মাঝে বেলার দুহাত হাত প্রচন্ড ভাবে জ্বলতে শুরু করে।বিভান পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে।বেলা উঠে বাথরুমে চলে আসে।হাত কলের নিচে দিয়ে পানি ছেড়ে দেয়।অনেকটা সময় চলে যায়।বেলা পানি বন্ধ করে বেরিয়ে আসে।এখন যেন আরো বেশি জ্বলছে।বেলা কোনমতে বিছানায় শুয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করে।নিশাদ সাঁঝকে ডেকে পাঠায় ওর রুমে।সাঁঝ দরজায় আসতেই নিশাদ বলল, 

''এক কাপ চা করে দিবি?"

সাঁঝ আচ্ছা বলে পাকঘরে চলে যায়।নিশাদ খাটে বসে সংবাদপত্র পড়ছে।তখনই দেখলো কিছু চাকরীর বিজ্ঞাপন।নিশাদ খেয়াল করলো আদনানের কোয়ালিশন অনুযায়ী এই পদ ওর জন্য বেশ ভালো।ভালো একটা কোম্পানীর বিজ্ঞাপন। নিশাদ কল দিলো ওর ছোট বেলার বন্ধু ফাহমিনকে। 
_______________________________________
ফাহমিন পেশায় একজন ডাক্তার।তবে এই কোম্পানীতে ওর ভাই চাকরী করে।দুবার রিং হওয়ার পর ফাহমিন কল রিসিভ করে।নিশাদ বলল,

''ভালো আছিস?"
''এই আছি।কাল জার্মান থেকে ফিরলাম তোর ভাবি সহ।"
''জার্মান কেন গিয়েছিলি?"
''আর বলিস না তোর ভাবির খুব যেতে হচ্ছিলো।ও নাকি ঘুরে আসতে চায়।তা তোর কোন জব টব হলো?"
''হ্যা হয়েছে।সিদ্দিক গ্রুপ লিমিটেড।"
''ওহ কি পোস্ট?"
''এ্যাসিস্ট্যান্টের এসিস্ট্যান্ট। "
''ওহ।বেতন কেমন পাস?"
''ত্রিশ হাজার।"
''তোদের চলে এই টাকা দিয়ে?"
''আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছি।আচ্ছা ফাহিম সালমান এন্ড ব্রাদার্স কোম্পানিতে  জব করে।ওখানে জয়েন করার নিয়ম বলতো।"
''কেন রে কার জন্য?"
''আদনান।বেচারা জব খুঁজছিলো খুব।এখন দেখলাম বিজ্ঞাপন দিলো এই কোম্পানি। তাই ভাবলাম তোর থেকে জেনে নেই।"
''দেখ রাগ করিস না।এটা তোরা এফোর্ট করতে পারবিনা।"

নিশাদের প্রচন্ড রাগ হয়।ও কোনমতে নিজেকে সামলে বলল,

''এফোর্ট করতে পারি কিনা সেটা পরের ব্যাপার।আর এফোর্ট করতে না পারলে ও অন্তত কারো কাছে হাত পাতবো না ওকে?বলতে হবে না তোকে কিছু।আমি গিয়ে জেনে নেবো।"

নিশাদ কল কেঁটে রাগে ফুঁসতে থাকে।এরই মাঝে আদনান রুমে প্রবেশ করে বলল,

''কার সাথে কথা বলছিলি ভাই?"
''ফাহমিন আছেনা?"
''ওহ।কি বলে?"
''আদনান প্লিজ কিছু বলিস না।সাঁঝ কে বল দ্রুত চা দেয়ার জন্য।একটু বেরুবো আমি।"

আদনান বেরিয়ে গেলো।যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলল,

''সাঁঝ ভাইয়ার চা দে।"

পাকঘর থেকে সাঁঝের চিৎকার ভেসে এলো,

''আনতেছি।তুই খাবি?"
''না এখন না।ভাইয়া বেরুবে।"

সাঁঝ চটকরে চা বানিয়ে নিশাদ কে দিয়ে এলো।
চা খেয়ে বেরিয়ে আসে নিশাদ।ভীষন গরম পড়েছে।আর খুব রোদ ও।একটা কম্পিউটারের দোকানে ঢুকলো নিশাদ।সেখানে সারি সারি কম্পিউটার সাজানো সাথে ফ্রি ওয়াইফাই।নিশাদ একটাতে বসে কোম্পানীর নাম সার্চ করে।সব কিছু ঘেঁটে নেয়।সাথে এ্যাড্রেস টা ও নোট করে ফেললো।সব কাজ সেড়ে বেরিয়ে আসে নিশাদ।শার্ট বেয়ে ঘাম ঝড়ছে।
নিশাদ ঘরের পথে রওনা হলো।কি এক জীবন ওদের। বন্ধুরাও ছাড়েনা কথা শুনাতে।বাহিরের মানুষ তো শুনাবেই।বাসার গেটে ঢুকতেই ফোন বেজে উঠে নিশাদের।ফোন বের করে দেখলো ওর বন্ধু ইমতিয়াজ কল করেছে।নিশাদ কল রিসিভ করতেই ইমতিয়াজ বলল,

''আছিস?"
''না থাকলে কল রিসিভ করলো কে?"
''বাদ দে।বাসায় একটা পার্টি আছে।আমার ছোটবোন ইদ্রির জন্মদিন।"
''আচ্ছা ইদ্রি না সুইডেনে ছিলো?"
''গতকাল ফিরে এলো।"
''ওহ কবে যাবে আবার?"
''ও জেদ করছে যাবেনা।এখন কি করতে পারি বল?"
''হুম।ছোটবোনদের আবদার গুলোই এমন।"
''দেখ যাই বলিস তুই আসবি।আমি আর কোন বন্ধুকে আসতে বলিনি তুই ছাড়া।"
''দেখ আমার অফিস আছে।"
''অফিস কি রাতে?ফাজলামি করবিনা।তুই আসবি এটাই ফাইনাল।"
''ওর কি পছন্দ?"
''শোন গিফ্ট দেয়ার কথা চিন্তা ও করবিনা।"
''কি বলিস?ও তো আমার ও ছোট বোনের মতো।"
''দেখ গিফ্ট আনার কথা চিন্তা ও করিসনা।জাস্ট দোয়া দিবি ওকে।"
''শিওর।"

ঘরে ঢুকেই কল কাঁটে নিশাদ।বাহিরের রোদের তাপ ওর পুরো শরীরকে ঘামে ভিজিয়ে দিয়েছে।মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা।মনে হয় মাইগ্রেন শুরু হয়ে যাবে।নিশাদ তড়িঘড়ি করে গোসলের জন্য রেডি হতে থাকে।গোসল সেড়ে রুমে আসতেই প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়।দুহাতে কপাল চেঁপে বিছানায় শুয়ে পড়ে নিশাদ।এদিকে ছেলেকে এসময়ে গোসল করতে দেখে অবাক হন জুলেখা বানু।সকালেই তো গোসল করেছিলো তাহলে এখন কি হলো হঠাৎ?রুমে এসে দেখেন নিশাদ বিছানায় শুয়ে এপাশে ওপাশ করছে দুহাতে কপাল চেঁপে ধরে।জুলেখা বানু ছেলের পাশে বসে পড়েন।গায়ে হাত রেখে বললেন,

''কিরে আব্বা?মাথা ব্যাথা করেনি?"
''আম্মা মাইগ্রেনের ব্যাথা।আদনান কে বলো ট্যাবলেট নিয়ে আসতে।প্লিজ!!!"
''আইচ্ছা কইতাছি।তুই শুইয়া থাক।"

বলেই বেরিয়ে যান জুলেখা বানু।আদনানকে পাঠিয়ে দেন ডিসপেনসারিতে।লাবনী এসে ভাইয়ের কপাল চাপতে শুরু করে।হঠাৎ লাবনী বলল,

''বড় ভাইয়া তোর গা তো খুব গরম।"
''জ্বর মেইবি।আমার ড্রয়ারে থার্মোমিটার টা আছে যা নিয়ে আয়।"
''ওকে।"

লাবনী দৌড়ে থার্মোমিটার এনে নিশাদের মুখে রাখে।কিছুক্ষন পর নিশাদ সেটা বের করে দেখলো ১০১ জ্বর।লাবনী বলল,

''তোর এতো রোদে বের হওয়া ঠিক হয়নি ভাইয়া।"
''আরে এসব কিছুনা।মাথাটা চিপে দে একটু।"

লাবনী কোন কথা ছাড়াই নিশাদের মাথা চেঁপে দিতে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন