নিশাদের যাওয়ার পানে অনেকটা সময় যাবৎ চেয়ে থাকতে থাকতে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে ইদ্রির।কান্নার দমকে গাল নাক ফুলে আসতে থাকে।কান্না থামানোর জন্য চোখ মুছে একটু হাসার চেষ্টা করলো।কোনরকমে নিজেকে দমানোর চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু সেটা কোনভাবেই হয়ে উঠেনি।দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।আজ পর্যন্ত আব্বু আম্মু ভাইয়া কখনো ধমক ও দেয়নি।মারা তো দূরের কথা।কোনমতে কান্না সামলে চোখে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে আসে ও।মাথায় ঘোমটা দিয়ে গাল ঢেকে নেয়।ডান গালে মেরেছে নিশ্চয়ই দাগ বসে গিয়েছে।তারপর গাড়িতে বসে কিমতির নম্বরে কল দেয়।দুবার রিং হতেই কিমতি কল রিসিভ করে।ইদ্রি গলা পরিষ্কার করে বলল,
''শোন ওর যেন কি কাজ এসে গেছে।তাই আমরা চলে যাচ্ছি।ওদের আমার পক্ষ থেকে সরি বলে দিস।"
''ঠিক আছে।ভাইয়া এমন করছিলো কেন?তুই ঠিক আছিস?"
''ঠিক আছি।ওর আসলে এসব পছন্দ না।একটু রিজার্ভ মাইন্ডেড তো।"
ইদ্রির কান্না আসতে চাইছে।তবুও কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়।কিমতি বলল,
''দোস্ত ভাইয়া আসলেই অনেক জোস তোর বর্ননার চেয়ে ও বেশি।তোদের একসাথে সুন্দর লাগছিলো।"
ইদ্রি কান্নার বেগ সামলাতে না পেরে বলল,
''পরে কল দিচ্ছি।"
বলেই কল কেঁটে কাঁদতে শুরু করে ইদ্রি।তাকে খুব ভালবেসে ফেলেছে ইদ্রি।অনেক বেশি।ওনাকে ভালবেসে যদি ও নির্লজ্জ হয় তাহলে তো তাই ভালো।লোকটাকে তবু ও চায়।হোক বান্ধুবীদের সামনে অপমান তবু ও চায়।ইদ্রি চোখের পানি মুছে জানালার বাহিরে তাকায়।বারবার কান্নার দমকে গলা ব্যাথা হয়ে আসছে।ঘরে পৌছেই মায়ের সামনে পড়ে ইদ্রি।সৈয়দা বেগম মেয়েকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
''তোর কি হলো?চেহারার বারোটা বেজে আছে কেন?"
ইদ্রি নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল,
''মা সিনেমা অনেক প্যাথেটিক ছিলো তাই।"
ইদ্রি রুমে চলে যেতে চায় মাকে পার করে।সৈয়দা বেগম পিছন থেকে বললেন,
''কতোবার না করছিলাম এসব সিনেমা না দেখতে।কি যে করস তুই?আর যদি দেখছিস থাপড়ায় গাল ফাটায় ফেলবো।"
ইদ্রি কোন কথা না বলেই দৌড়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।তারপর এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।মাথার ওপর থেকে ঘোমটা ফেলে দেয়।ডান গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে একেবারে।ইদ্রি চুল দিয়ে গাল ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।কাঁদতে জানালার পর্দা টেনে ছিড়ে ফেলতে শুরু করে।রুমের শোপিজ গুলো টেনে টেনে ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করে।ফ্লোরের ওপর বসে কাঁদতে থাকে।শাড়ীর আঁচল এক পাশে পড়ে রয়েছে।দরজার বাহিরে রানু খালা, মা নক করে ওকে ডাকছিলো।মা বলছিলো,
''ইদ্রি কি হলো মা তোর?এমন কেন করছিস?প্লিজ মা দরজা খোল।"
ইদ্রির জবাবের বদলে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।ওনি আবার ও ডাকতে থাকেন,
''ইদ্রি দরজা খোল না মা। আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে।"
রানু খালা ও বলছিলেন,
''ইদ্রি আম্মাজান দরজা খুলো।আয়হায়রে রুমের তো বারোটা বাইজ্জা ফালাইছো।হাত পাও কাঁটবো।দরজা খুলো।
কিন্তু ওদের ডাকে কোন সায় দেয়নি ইদ্রি।
এদিকে ইমতিয়াজ এতো শব্দে ওপর থেকে নিচে নেমে আসে।ইদ্রির রুমের সামনে মা আর বুয়াকে দেখে বলল,
''ওর কি হলো মা?"
সৈয়দা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
''দেখনা আব্বু পাগলামি করতেছে।কি হলো মেয়েটার?সিনেমা দেখে এসেই এমন করতেছে।"
ইমতিয়াজ ভ্রু কুঁচকায় মায়ের কথায়।অবাক হয়ে বলল,
''সিনেমা দেখে?"
''হ্যা এটাই তো বলল।"
ইমতিয়াজ মা আর বুয়াকে সরিয়ে দরজায় নক করতে করতে জোরে চিৎকার করে বলতে থাকলো,
''ইদ্রি দরজা খোল। কি হলো তোর?"
ভাইয়ের ডাকে ইদ্রি চিৎকার করে বলল,
''ভাইয়া প্লিজ লিভ মি এলন!!!প্লিজ!!!"
ইমতিয়াজ আবার ও চিৎকার করে বলল,
''একদম না। এমন করছিস কেন তুই?কেউ কিছু বলছে?"
''না বলেনি কেউ কিছু বলেনি।প্লিজ ছাড়ো।যাও তোমরা।"
ইমতিয়াজ হাল ছেড়ে বলল,
''পরে আসবো।শুনবো তোর কি হয়েছে।"
ইদ্রি আবার ও কাঁদতে থাকে।
.........................নিশাদ ঘরে ঢুকেই নিজের রুমে চলে যায়।রুমের দরজা আটকে শার্ট টেনে খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।এই মুহূর্তে গোসলের খুব বেশি প্রয়োজন।ঝড়নার নিচে ঢুকে চোখ বুজে পুরো ঘটনাটাকে মনে করতে থাকে।চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু গুলো ঝড়নার পানির সাথে মিশে যেতে থাকে।পুরো ঘটনাটা যেন ওর পুরো শরীর থেকে ওর মাথার মাঝ বরাবর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।গোসল থেকে বেরিয়ে এসে রুমের দরজা খুলে খাটে বসে নিশাদ।দরজা খুলতেই জুলেখা বানু এসে বললেন,
''কিরে আব্বা ঠিক আছোস?"
নিশাদ মায়ের দিকে তাকায়।চোখজোড়া অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে।যেকোন সময়ে মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠতে পারে।নিশাদ মাথা চেঁপে বলল,
''আম্মা সাঁঝ কে বলো চা করে দিতে।"
''সাঁঝ আর হুমায়রা বাহিরে গেছে।আমি কইরা দেই।"
''আইচ্ছা।"
জুলেখা বানু চা বানাতে চলে গেলেন।নিশাদ খাটে শুয়ে পড়ে।ব্যাথা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে।জুলেখা বানু চা নিয়ে দেখলেন নিশাদ মাথা চেঁপে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।জুলেখা বানু ছেলে কে দেখে অস্থির হয়ে পড়েন।টেবিলে চা রেখে ছেলেকে সোজা করে শুইয়ে দিতে চেষ্টা করতে করতে বললেন,
''সোজা হ আব্বা দেহিতো।কি হইছে আব্বা?"
''আম্মা আমার মাথা ফেঁটে যাইতেছে।"
জুলেখা বানু ওকে কোনরকম সোজা করে শুইয়ে বললেন,
''আব্বা ও আব্বা তর কি মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠছেনি?
''হ আম্মা।"
ব্যাথায় কাতরাতে থাকা নিশাদ অস্ফুটস্বরে বলল।আম্মা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
''তুই যে ট্যাবলেট খাস নাম কি?".
''টাফনিল।"
ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বলল নিশাদ।জুলেখা বানু নিজের বাটন ফোনে ইকরাম রাহমানের নম্বর বের করে সেটায় কল দেন।ইকরাম রাহমান কল রিসিভ করতেই জুলেখা বানু বললেন,
''হুনো টাফনিল নিয়া আহো।"
''নিশাদের ব্যাথা উঠলো নাকি আবার?"
''হ।জলদি করো।"
''হুনো একটা কাম করো বরফ রুমালে লইয়া ওর ঘাড়ে চাঁপ দিতে থাকো হালকা কইরা আমি আইতাছি।"
জুলেখা বানু কল কেঁটে নিশাদ কে বললেন,
''আব্বা কষ্ট কইরা বয়।আদার চা টা খাইয়া ল।আমি আইতাছি।"
নিশাদ বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সেখানে চুমুক দিতে থাকে।জুলেখা বানু উঠে চলে গেলেন পাকঘরে।ফ্রিজ থেকে বরফের তিনটে টুকরো শাড়ীর আঁচলে নিয়ে ছেলের কাছে এসে বসেন।তারপর ওর কাঁধে আলতো করে চাঁপতে থাকেন।
নিশাদ চা শেষ করে মায়ের দিকে তাকায়।ওর অনেক খারাপ লাগছে।হঠাৎ মাকে জড়িয়ে ধরে।ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে।কান্না আসতে চেয়ে ও থেমে গেলো মাঝপথে।দুহাতে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিশাদ।জুলেখা বানু ছেলের এভাবে জড়িয়ে ধরায় অবাক হয়ে বলেন,
''কি হইছে আব্বা?"
''আম্মা আমি আজকে আইছিলাম দুনিয়াত তাইনা?"
জুলেখা বানুর ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠে।ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
''হ আব্বা। জানোস এ দিনে আইছিলি।কতো সুন্দর হইছিলি জানোস?তোর আব্বায় কতো খুশি আছিলো।বেলার আড়াই বছর আছিল।মাইয়াডা নিজেই কতো খুশি আছিলো।"
''আম্মা তোমরা আমারে অনেক ভালবাসো তাইনা?"
''অবশ্যই আমার বড় পোলা তুই।পাঁচ ভাইবোনের দেখা শুনা করতাছোস।তার থাইক্কা বড় কথা আমি মা বুঝছোস আব্বা?"
.......................সাঁঝ আর হুমায়রা কেক কিনতে।আসলো।সাঁঝের ফোনে বারবার সাইমনের কল আসছে।এনিয়ে দশবারের মতো এসেছে।সাঁঝ বলল,
''হুমু একটু দাঁড়া আমি ওয়াশরুম থেকে আসি।"
হুমায়রা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায় বোনের দিকে।রেগে বলল,
''তোর হাগার ও টাইম নাই না?"
সাঁঝ রেগে বলল,
''থাপড়ামু।আমি আসতেছি।"
সাঁঝ দৌড়ে এসে এককোনায় দাঁড়িয়ে সাইমনের কল রিসিভ করতেই সাইমন রেগে বলল,
''কই থাকো?"
''জাহান্নামে।জানেন না কই থাকি?"
সাঁঝ চটে যায়।সাইমন সাঁঝ কে রেগে যেতে দেখে বলল,
''ম্যাডাম উল্টো রেগে যাচ্ছো কেন?"
''এতো কল করার কি হলো?ধরছিনা বুঝা উচিৎ আপনার আমি বাহিরে আছি।"
''কই গেলা আবার?"
''কেক কিনতে।বায়।"
''এই ওয়েট। কিসের কেক?"
''ভাইয়ার জন্মদিন।বায়।"
''এত বায় বায় করছো কেন?বুঝেছি সেদিনকার ইনকমপ্লিট কাজ টা কমপ্লিট করতে হবে।"
''উফ লুচ্চা কোথাকার।রাখ।"
সঝ রেগে ফোন কেঁটে বোনের কাছে চলে এলো।হুমায়রা রেগে বলল,
''হাগা শেষ?"
''আবার?"
চেঁচিয়ে উঠলো সাঁঝ।হুমায়রা হেসে বলল,
''চকলেট কেক নিবি।"
''ডার্ক ফরেস্ট আছে ভাইয়া?"
দোকানি কে জিজ্ঞেস করে সাঁঝ।
দোকানদার ডার্ক ফরেস্ট কেক দেখিয়ে বলল,
''ম্যাম এটা ১২০০ টাকা।"
''ওকে এটায় লিখে দেন শুভ জন্মদিন বড় ভাইয়া।"
দোকানদার লিখতে থাকে।কেকের টাকা মিটিয়ে সাঁঝ আর হুমায়রা বেরিয়ে আসে।সব মোটামুটি কমপ্লিট।দুজনের পা শেষ ব্যাথায়।এখন ঘরে পৌছুতে পারলে একটু ঘুমোবে ওরা।
...........................সেদিন সকালে বিভানের অফিসে চলে যাওয়ার পর বেলা নিজের নাস্তা ছেঁকতে থাকে।অবশ্য বাবুর জন্য খিচুরি রান্না করেছে আর সাথে ডিম ভাজা।মেয়েটা ঘুমাচ্ছে এখন ও।বেলা রুটি ছেঁকে রুমে এসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে খাটে এসে বসলো।কেমন দু পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।বেলা ওর মাথা হাতিয়ে দিতে দিতে বলল,
''আম্মু উঠো।সকাল হয়ে গেছে সোনা।"
বাবু নড়তে থাকে তবে আবার ও ঘুমিয়ে যায়।বেলা মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে নিয়ে বলল,
''এই আম্মু উঠো।খেতে হবে না বাবা?
বাবু ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমন্ত গলায় বলল,
''মা পেতাব কব্বো।"
বেলা উঠে দৌড়ে ওকে বাথরুমে নিয়ে গেলো।এদিকে বিভান অফিসে পৌছে ভাবলো বাংলাদেশে বাবুর কথা জানাতে হবে।এই ভেবে নিশাদ কে কল দেয়।কিন্তু ফোন বন্ধ আসছে।বিভান এর পর আদনানকে কল দেয়।
আদনান ফোন রিসিভ করতেই বিভান বলল,
''ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিলো।"
''জি ভাইয়া বলেন।"
''শুনো কাল অফিস থেকে ফেরার পথে একটা মেয়ে বাবুকে দেখলাম।বয়স তিন চারের বেশি হবেনা।ফুল বিক্রি করছিলো।আমি বাসায় নিয়ে আসছি ওকে।জানোইতো তোমার বোন কতোটা অবসেসড একটা বাবুর জন্য।আর আমি ও তো....."
বিভান কিছু বলার আগেই আদনান হেসে বলল,
''ভাইয়া খুব ভাল করছেন।আপনাদের আসলেই ওকে দরকার ছিলো।খুব ভাললাগতেছে। মেয়ের নাম কি?"
''রাখা হয়নি।আজ দেখি।"
''ভাইয়া বাসায় বলেছেন?নাকি আমিই প্রথম?"
''তুমিই প্রথম।"
''তাহলে বলবেননা।আজ ভাইয়ার জন্মদিন।ভিডিও কলে কথা হবে।"
''ওকে।তাহলে কি সারপ্রাইজ হাহ?"
''জি ভাইয়া।"
''ওকে।"
বিভানের আজ অবশ্য হাফ ডে কাজ।বিকেলেই বাসায় যেতে পারবে ও।শুক্রবার বলেই হাফ ডে।এদিকে বেলা মেয়েকে খাইয়ে দিতে থাকে।বাচ্চাটা যেন অত্যন্ত তৃপ্ততার সাথে খাচ্ছিলো সেটা বেলার বুঝতে দেরি হয়নি।আরো একবার ও নিয়ে ছিলো অবশ্য।বেলা মেয়েকে নিয়ে ছাদে চলে যায়।বাচ্চাদের ভিটামিন ডি খুব দরকার। সে যে বয়সের হোকনা কেন?
!!!!
সময়ের সাথে সাথে মাইগ্রেনের ব্যাথা কিছুটা ম্লান হতে থাকে।গভীর নিদ্রায় চোখ বুজে আসে নিশাদের।সেই মুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ সাঁঝ আর হুমায়রার।জুলেখা বানু মেয়েদের দেখে বললেন,
''আইছোস নি?"
সাঁঝ একটু নিচু হয়ে জুতো খুলছিলো।জুতো খুলার মুহূর্তে বলল,
''ভাইয়া আসছে?"
জুলেখা বানু হাত মুছতে বললেন,
''আইছে।ফোলাডা মইরা যাইতেছিলো।অহন ঘুমাইছে।"
হুমায়রা প্যাকোট সোফার ওপর রেখে ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
''আম্মা কি কও?কি হইছে ভাইয়ার?"
ততক্ষনে সাঁঝ উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকায়।জুলেখা বানু বললেন,
''কত্তুন আইছিলো জানি মাইগ্রেনের ব্যাথা উইড্ডা কাতরাইতাছিলো বিছনার মইধ্যে।
হুমায়রা মন খারাপ করে বলল,
''আজ কে ও মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠতে হইলো।"
সাঁঝ হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বলল,
''কেকটা ফ্রিজে রেখে আয়।আমি ওজু করে নেই। তুই ও আয় জলদি।"
হুমায়রা আচ্ছা বলে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায়।সাঁঝ উড়না ঠিক করতে করতে বলল,
''এখন কেমন আছে ভাইয়া?"
''আছে।তোর আব্বায় ট্যাবলেট আইন্না দিছে।"
''ওহ।আইচ্ছা আমি নামাজ পইড়া নেই।আদনান ভাই আসছে?"
''না হেই যে গেলো আইলোই না।"
''আইচ্ছা আইবো।তুমি ভাইবোনা।"
বলে সাঁঝ রুমে চলে গেলো।জুলেখা বানু মেয়েদের জন্য ভাত গরম করতে গেলেন।সাঁঝ আর হুমায়রা যোহরের নামাজ শেষ করে এসে খেয়ে নেয়।জুলেখা বানু সাঁঝকে বললেন,
''খাওন শেষে ভাইয়ারা ডাকি দিস।খাইয়া নাইলে আবার ঘুমাইবো।"
''আইচ্ছা।"
খাওয়া শেষ করে হুমায়রা বলল,
''আমি একটু ঘুমায় নেই।পা ব্যাথায় টনটন করতেছে।"
সাঁঝ ওর কথার উত্তর না দিয়ে নিশাদের রুমে চলে আসে।নিশাদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।সাঁঝ ভাইয়ের পাশে বসে নিশাদের কাঁধ হালকা নেড়ে ডাকতে থাকে।নিশাদ একটু নড়ে চড়ে ঘমন্ত কন্ঠে বলছিলো,
''যখন খাইতে হবে খাবো।আমার ভালো।লাগতেছেনা এখন যা।"
''ভাইয়া একটু খেয়ে আবার ঘুমা।ভাত তরকারি গরম করছে আম্মা।"
''পরে খাবো আমি।ঘুমাইতে দে।
''ভাইয়া আম্মা ঘুমাবে।তুই উঠে একটু খেয়ে নেয়।"
আর ঘুমাতে পারেনি নিশাদ।খাটের ওপর ভর দিয়ে উঠে বসে।সাঁঝ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''তুই ভাত খা আমি আবার চা দিবো।"
''চা না।মাথাটা একটু মাসাজ করে দিস।"
'' ওকে ভাইয়া।"
নিশাদ মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসে।তবে মুখে খাবার নিতে পারলে ও গিলতে পারছেনা।বুক কেমন বন্ধ হয়ে আসছে।অজানা যন্ত্রনা ওকে জাপটে ধরেছে।ভাত নাড়ছে এক হাতে অপর হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে কপালের দুপাশ চেঁপে ধরে আছে।সাঁঝ পাকঘরে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসে ডাইনিংরুমে।ভাইকে ভাত নাড়াতে দেখে বলল,
''ভাইয়া গরম গরম খেয়ে নে।তাহলে মাথা ব্যাথা কমবে।"
নিশাদ কিছু না বলে খেতে থাকে খুব কষ্টে।তবে পুরো ব্যাপারটা ওর মাথায় ঘুরছে।সেই মুহূর্তটা যখন ইদ্রি বলছিলো ওকে ভালবাসে আর ও ইদ্রির গালে চড় বসিয়েছিলো।সেই মুহূর্তটা কি খুব আনন্দ ঘন ছিলো?রাগের গভীরে কষ্টের যন্ত্রনাটা ও তো ওর ওপর চেঁপে বসা রাগটার মতোই গভীর ছিলো।চড় দিয়ে চলে আসার সময় কি একটা বার ও পারতোনা পিছে ফিরে মায়া ভরা মুখটা দেখতে।পারতোনা বুকে জড়িয়ে নিতে মারের বদলে?না পারতোনা। ওর দ্বারা সম্ভব না।কারন ইদ্রির বয়স ওর বয়সের পার্থক্য।আসলে কি বয়সটাই মূল?ইদ্রি কি পারতো ওর মধ্যবিত্ত পরিবারকে আপন করে নিতে?পারতো এসিহীন রুমে উষ্ণতায় ভরা রাত্রি যাপন করতে? পারতো একহাজার পনেরশত টাকার সূতির শাড়ী গায়ে জড়াতে?কথা গুলো ভাবতে ভাবতে নিশাদের পুরো শরীর কেঁপে উঠে।হঠাৎ সাঁঝের চোখের সামনেই ভাতের প্লেটের ওপর বমি করে ভাসিয়ে দিলো নিশাদ।সাঁঝ চায়ের কাপ রেখে দৌড়ে এসে নিশাদের পিছে দাঁড়িয়ে ওর মাথা দুদিক থেকে চেঁপে ধরলো।আরো কয়েকবার বমি করে নিশাদ উঠে দাঁড়ায়।বমির থেকে চোখ সরিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল
''তুই গিয়ে বিশ্রাম কর।আমি ফ্রেশ হয়ে এগুলো পরিষ্কার করছি।"
সাঁঝ বলল,
''না ভাইয়া তুই মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়।আমি দেখছি।"
সাঁঝের কথায় নিশাদ মাথা নেড়ে বলল,
''উহুম।তুই এগুলো ধরিসনা।গিয়ে রেস্ট কর।"
সাঁঝ নিশাদকে তাড়া করতে করতে বলল,
''কিছু হবেনা।তুই গিয়ে শুয়ে থাক।আমি এসে মাথা চেঁপে দিচ্ছি।"
নিশাদ অনেকবার না করার পর ও সাঁঝ শুনলো।উল্টো ওকে রুমে পাঠিয়ে দিলো।বমি পরিষ্কার করে সাঁঝ গোসল সেড়ে নিশাদের রুমে এসে ওর মাথা চাঁপতে শুরু করে।
.................সেদিন বিকেলে ঘরে চলে আসে বিভান।ঘরের দরজার সামনে থেকেই মেয়ের ছোট্ট কন্ঠের তীক্ষ্ম চিৎকারে মা ডাক শুনতে পেরে একটু হাসলো বিভান।কাল এসেছে আর তারপর থেকেই গলা ফাঁটিয়ে মাকে ডাকছে।ওকে ও তো বাবা ডেকেছিলো।মেয়ের প্রতি এক অজানা মায়া অনুভব করতে পারে বিভান।মেয়ের সাথে শুয়েছিলো বেলা।কলিংবেল শুনতে পেয়ে মেয়েকে বলল,
''আমি দেখে আসি কে আসলো।তুমি ঘুমাও মা।"
বাবু বেলার গাল ধরে খেলছিলো।মাকে চলে যেতে দেখে মুখ ফুলিয়ে বলল,
''না দাবেনা।আমি ও দাবো।"
''বাবু তুমি শুয়ে থাকো।মা এক্ষুনি আসছি।"
''না,,,,,,।
বেলা এবার অস্ফুটস্বরে বলল,
''চলোরে বাবা।তারপর ও চিল্লাইস না।"
মেয়েকে কোলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসে বেলা।দরজা খুলতেই বিভানকে দেখে অনেকটা অবাক হলে ও বেশ খুশিই হয়।অন্তত তিনজনে একসাথে থাকবে পুরো বিকেলটা।বিভানকে দেখে মেয়ে জোরে চিৎকার করে বাবা ডেকে বিভানের কোলে আসতে চাইলো।বিভান মেয়েকে থামিয়ে বলল,
''আগে ফ্রেশ হয়ে তারপর কোলে নিবো।"
তারপর বেলার দিকে চেয়ে বলল,
''বাংলাদেশে কথা হয়েছিলো?"
বেলা ভ্রু কুঁচকালো।অবাক হয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
''মানে?সব ঠিক আছে তো?"
বিভান জুতার ফিতা খুলতে খুলতে বলল,
''সবই ঠিক আছে।তবে তুমি কি কিছু ভুলে যাচ্ছো?"
বেলা আরেকটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
''কি?"
''আজ নিশাদের জন্মদিন।"
বেলা চমকে উঠে।ওদের দুজনের জন্মদিন একই মাসেই আসে।তারপর ও বেলা কি করে ভুলে গেলো?বিভান এবার জুতা ঠিকমতো রেখে বলল,
''যাইহোক ফোন দিও না।পাঁচটায় ভিডিও কলে যাবো।"
বেলা কিছু না বলে ম্লান হাসলো।লোকটা ওর সাথে যতোটাই রেগে থাকুক না কেন ঠিকই ওদের খবর নেয়।মেয়েকে নিয়ে রুমে আসে বেলা। বিভান গোসলে ঢুকে গেছে।
সাড়ে চারটা
বেলা বিভান মেয়েকে নিয়ে খাটে বসে আছে।বিভান বালিশে আধশোয়া।বাবু গিয়ে ওর বুকে এসে বিভানের মুখের দিকে চেয়ে হাসলো।বিভান হেসে বলল,
''আমার আম্মুটার একটা নাম রাখা দরকার তাইনা?"
বেলা হাস্যোজ্বল মুখে বিভানের দিকে তাকায়।মেয়ে হেসে বলল,
''আমাল নাম লাখবে কেন?"
''তোমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে তো।"
''না আমি ইতকুলে দাবোনা।"
''কেন মা পড়াশুনা করবেনা?"
মেয়ের পেটে কাতুকুত দিয়ে জিজ্ঞেস করে বেলা।জবাবে বাবু গলা ফাঁটা হাসি।বিভান বলল,
''তারপর ও নাম রাখতে হবে।কিছু দিয়ে তো ডাকতে হবে।"
বেলা মুচকি হেসে মেয়ের চুল হাতিয়ে দিতে দিতে বলল,
''হুম ঠিক বলেছো।কি রাখবে নাম?"
বিভান ম্লান হেসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
''পূর্না।আমার ঘরকে পরিপূর্ন করার জন্য।"
বেলা হেসে মেয়েকে নিজের কোলে টেনে বলল,
''শুধু এতোটুকু রাখলে হবেনা।স্কুলে কি ডাকবে আম্মুকে?বিভাবতী আমার।"
বলেই মেয়ের দুগালে চুমু দিলো বেলা।বিভান অবাক হয়ে বলল,
''বিভাবতী!!!এটা কবে রাখলে?"
বেলা সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে বলল,
''এখনি।"
বিভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
''ঠিক আছে তাহলে।বিভাবতী শেখ পূর্না।"
........................ এদিকে সেদিন মার্কেট থেকে ফেরার পথে হঠাৎ প্রিয়াশার সাথে দেখা আদনানের।প্রিয়াশা হেঁটে আসছিলো আদনানের দিকে।দুজনের চোখাচোখি হতেই প্রিয়াশা একটু হেসে আদনানের কাছে এসে বলল,
''ভালো আছেন স্যার?"
''এইতো।তা কই যাচ্ছিলেন?"
প্রিয়াশা ম্লান হেসে বলল,
''হাসপাতালে ছিলাম।এখন বাসায় ফিরছি।"
আদনান কিছু বলতে গিয়ে ওর চোখ পড়ে প্রিয়াশার হাতের সাদা ব্যান্ডেজে।আদনান একটু অবাক হয়ে বলল,
''সব ঠিক আছে?"
''জি স্যার।কেন?"
''আপনার হাতের ব্যান্ডেজ।"
''ওহ ছোট্ট এক্সিডেন্ট।"
''ওহ।তাহলে আমি যাই বাসায়।নিজের খেয়াল রাখবেন।"
প্রিয়াশা হেসে বলল,
''জি স্যার।"
আদনান লাবনীকে নিয়ে রিক্সায় উঠে যায়।লাবনী প্রিয়াশাকে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে দেখে অবাক লাবনী।জিজ্ঞেস করে বসলো,
মেয়েটা কে ছিলো?"
''আমার অফিসের।কেন রে?"
''এমনি।"
দুজনেই চুপ।আদনানকে অবাক করে দিয়ে লাবনী আবার বলল,
''ভাইয়া মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দর।"
আদনান কিছু না বলে বোনের দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলো।
এদিকে ওরা ঘরে পৌছে হুমায়রা আর সাঁঝ সহ ঘর সাজায়।সাড়ে পাঁচটায় নিশাদ কে উঠিয়ে বসার ঘরে নিয়ে আসে ওরা।পুরো ঘর দেখে কিছু বলতে যাবে তখনই সবাই জোরে চিৎকার করে বলল,
''শুভ জন্মদিন ভাইয়া!!"
নিশাদ ম্লান হেসে ধীরে বলল,
''সবাইকে ধন্যবাদ।কখন করলি এতকিছু?"
আদনান আর সাঁঝ বলল,
''সারপ্রাইজ ছিলো।আজ সকালেই সব করলাম।"
নিশাদ চারিদিকে তাকিয়ে সবাইকে দেখলো।আদনান বলল,
''ভাইয়া আয় কেক টা কাঁট।"
নিশাদ অসুস্থ কন্ঠে বলল,
''তোরাই কেঁটে নেয়।"
আদনান ভাইয়ার হাত ধরে টেবিলের কাছে নিয়ে এলো।তারপর বলল,
''ভাই কখনো কিছু করতে পারিনি।এটা গিফ্ট হিসেবে নে।"
নিশাদ ম্লান হেসে বলল,
''অবশ্যই।
কেক কাঁটা হয়।বাবা মা আর বাকি সবাইকে কেক খাইয়ে দেয় নিশাদ।আদনান সাঁঝ কে টেনে অন্য রুমে নিয়ে বকল,
''আব্বা ছাড়া সবাই কে আমার রুমে ডেকে আন।কথা আছে।"