আজ রংধনু নিবাস কোলাহল পূর্ন। সুখকর বাতাস বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে।আজ যেন সাতটা রং এ পরিপূর্ন ইকরাম রাহমানের এই বাড়িটি। সকল দ্বন্দ ভুলে আজ সাঁঝ সাইমনের খুশিতে সবাই এক হয়েছে।সাঁঝের অনামিকা আঙ্গুলটায় আংটি পরিয়ে হাতটিকে কয়েক সেকেন্ড ধরে রেখেছিলো সাইমন। অনূভব করছিলো কাউকে খুব আপন করে পাওয়ার তীব্র আনন্দ।ভেতরটা আজ বড্ড কাঁপছে সাইমনের।চোখ বুজে নিয়ে নিজের উত্তেজনা কে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করতে থাকে সাইমন। সাঁঝ অনূভব করছিলো সাইমনের হাত কাঁপছে ঘেমে যাচ্ছে।বিভান পাশ থেকে বলল,
''আর ইউ ওকে সাইমন?পানি দিবো?"
হবু ভায়রার কন্ঠে সাইমন ওপরে তাকায়।তারপর বিচলিত কন্ঠে বলল,
''ধন্যবাদ ভাইয়া আমি ঠিক আছি।"
সাঁঝের হাত ছেড়ে দিলো সাইমন।বিভান সাঁঝের হাতে আংটি ধরিয়ে ইশারা করলো সাইমনকে পরিয়ে দিতে।লজ্জা পেয়ে কাঁপা হাতে দুলাভাইয়ের হাত থেকে আংটিটা নিয়ে সাইমনের আঙ্গুলে পরিয়ে দেয়। এদিকে আংটিটা অনামিকা আঙ্গুলে ঢুকার সাথে সাথে সাইমনের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেলো।এতবছর যাবৎ ওর হৃদয়ে যে ঘা ছিলো সেটা সেড়ে উঠেছে।আংটিবদলের সাথে সাথে চারপাশ থেকে অনেকগুলো করতালি বেজে উঠে।সাাইমন মৃদু হাসলো নিচে তাকিয়ে তারপর ফিসফিসিয়ে সাঁঝকে প্রশ্ন করলো,
''আজকের সারপ্রাইজের জন্য কি উপহার দেবে আমায়?
সাঁঝ প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নামিয়ে রাখলো।পাশ থেকে মিতুল সাঁঝের গলা জড়িয়ে বলল,
''আজ তো তোমাকে অধিকার নিয়ে ভাবি ডাকতে পারবো তাইনা?"
সাঁঝ মিটমিট করে হেসে গেলো।ততক্ষনে পাশের বেকারি থেকে কেক নিয়ে ফিরলো আদনান।নিশাদ টাকা দিয়ে আনিয়ে নিয়েছে।বেলা কেক টা বের করে ওদের সামনে রাখলো।আর বারবার হুমায়রাকে খুঁজছিলো ভিতরে তাকিয়ে। কেকটার ওপর লেখা ছিলো, ''ওয়েলকাম টু ফেমিলি সাইমন"...সাঁঝ আর সাইমন দুজন মিলে কেক কাঁটলো।তারপর রাতের খাবার সেড়ে পাশাপাশি বিভিন্ন গল্পের মধ্য দিয়ে বিদায় নিলো নতুন অতিথিরা।সাঁঝ রুমে চলে এলো শাড়ী পাল্টাতে।সাথে বেলা ও চলে এলো।সাঁঝের শাড়ী থেকে পিন গুলো খুলতে খুলতে বেলা জিজ্ঞেস করলো,
''কেমন লাগছে সাঁঝ?প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে গেলি।"
কাঁপা গলায় সাঁঝ বলল,
''জানিনা আপা।বলতে পারবো না অনুভূতিটা কেমন।"
সাঁঝের শাড়ীর পিন খুলে নিয়ে বেলা সেগুলোকে ছোট্ট বক্সে রেখে দিলো।সাঁঝ শাড়ী পরেই একটা স্যালোয়ার কামিজ নিয়ে বাথরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।বেলা নিজের মুখটা আয়নায় দেখে নিয়ে নিজেও কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নিলো।
রাত এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট।ড্রয়িংরুমে বড় একটু মাদুর বিছানো হয়েছে।বেলা সাঁঝ মিলে খাবারের বাটি প্লেট গুলো আনতে থাকে একে একে।ড্রয়িংরুম থেকে ছোট্ট পূর্নার চিৎকার শোনা যাচ্ছে।সেই যে নানার কোলে উঠলো এখনো নামতে পারেনি।লাবনী আর কুঞ্জন বাবার দুপাশে বসে পূর্নাকো আদর করে এটা ওটা বলছে।পূর্না ঠোঁট ফুলিয়ে নিজের হিন্দি ভাষায় বলল,
''মাল কাতে দাবো।"
লাবনী বলছিলো,
''না আম্মু আজকে মা নাই।আজকে আমাদের সাথে থাকো বেবি।"
পূর্না না করছিলো আর পা ঝাপটাচ্ছিলো।বিভান বলল,
''আম্মু ওনি তোমার নানা। কোলে থাকো ওনার।আর কাঁদছো কেন?ছোট খালামনি আদর করছে তো।"
পূর্না চুপ করে খালা মামার কথা শুনতে লাগলো।খাবার মাদুরের ওপর রাখা শেষ হতেই সবাই একসাথে বসে যায় খাওয়ার জন্য।তখনই হুমায়রার আগমন।চুলগুলো ঝুঁটিতে বাঁধা ওর। গায়ে নীল ফতুয়া আর পরনে স্কার্ট।বড় বোন আর দুলাভাইকে দেখে কিছুটা ইতস্তত হয়ে স্মীত হেসে বলল,
''আসসালামু আলাইকুম আপা কি খবর?ভাইয়া ভালো আছেন?"
বিভান মৃদু হেসে ফেলে শালীর কথায়।তারপর বলল,
''ভালোই তবে এতক্ষন কই ছিলে?আমরা কিন্তু এসেছি অনেক আগে।"
হুমায়রা বলল,
''পড়ছিলাম ভাইয়া।"
বেলা কিছু বলল না তবে মৃদু হেসে বলল,
''পড়াশুনা কেমন চলছে?"
''এই তো আপা ভালো।"
হুমায়রা মাদুরের ওপর বসে পড়ে।বেলা বলল,
''আজ তোদের খাওয়ায় দিবো আমি।"
সাথে সাথে লাবনী আর কুঞ্জন বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো।নিশাদ আদনান সাঁঝ হাসছিলো।বেলা প্লেটে খাবার বেড়ে নিজ হাতে ভাইবোনদের তুলে খাইয়ে দিতে শুরু করে।খাওয়ানোর মাঝেই ওদের সবার চোখের কোনা ভরে এলো।অনেক বছর পর আজ বড়বোনের হাতে খাওয়ার স্বাদ গ্রহন করছে ওরা। কুঞ্জন খাওয়ার ফাঁকে বিভানের দিকে তাকায়।বিভান নিশাদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছে।কুঞ্জন গলা পরিষ্কার করে বলল,
''ভাইয়া আপনার ও কি বৌয়ের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে?বলতে পারেন আমরা মাইন্ড করবোনা।"
বিভান হেসে বলল,
"'আমি খাবো না রে।তোমরা খাও।আজ অনেকবছর পর বোনের হাতে খাচ্ছো না?"
কুঞ্জন মাথা ঝাঁকায়।এদিকে পূর্নার অবস্থা বেশামাল।নানার হাতে না পারতে ও খেতে হচ্ছে ওকে।ইকরাম রাহমান বলছেন,
''আরেকটু খাও নানু মনি।"
পূর্না কান্নজড়িত কন্ঠে বলছিলো,
''আপনি কি বলতেন কিত্তু বুত্তিনা। মাল আতে কাবো।"
ইকরাম রাহমান কিছু বুঝতে পারেননি।তবুও চেষ্টা করতে থাকেন নাতনীকে খাওয়ানোর।বেলা মেয়েকে জোর করতে দেখে বলল,
''আম্মু নানার হাতে খেয়ে নাও।"
পূর্না বাধ্য মেয়ের মতো নানার হাতে খেতে থাকে।খাওয়া শেষে সবাই একসাথে বসে গল্প করছিলো।গল্পের এক পর্যায়ে নিশাদ বলল,
''আপা আমার সাথে একটু আয় কথা আছে।"
বিভান ওদের দেখছিলো তবে কিছু বলেনি।বেলা বলল,
''চল তাহলে।"
নিশাদ আর বেলা উঠে নিশাদের রুমে চলে এলো। নিশাদ কম্পিউটার টেবিলে হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
''কেমন আছোস আপা?"
''ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তোর প্রমোশনের খবর শুনে অনেক ভালো লাগছে।আর একসাথে এত গুলো সারপ্রাইজ পাবো ভাবিনি।"
নিশাদ হেসে বলল,
''আপা সরি অনেক কিছু হয়েছে যা তোকে জানাতে পারিনি।"
''আরেহ সমস্যা নাই।এখন তো জানলাম তাতেই চলবে।"
নিশাদের চেহারাটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে আসে।ধরে আসা গলায় বলল,
''তের বছর আগে যা করেছিলাম মাফ করে দিস আপা।"
বলেই বেলাকে জড়িয়ে ধরে নিশাদ।বাঁধ ভাঙ্গা কন্নায় ভেঙ্গে পড়ে দুইভাই বোন।বেলা ভাইয়ের পিঠে হাত রেখে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
''হইছে।কাঁদতে হবেনা।তুই ভাই হিসেবে আমার ভালো টাই ভেবেছিলি।আমি ও এমনটাই করতাম।"
বাথরুম থেকে ভাইবোনের কান্নার শব্দে সাঁঝের চোখ ভরে আসে।নিঃশব্দে কেঁদে উঠে সাঁঝ।নিশাদ বোন থেকে সরে এসে চোখ মুছে নিয়ে বলল,
'''আপা একটা কথা ছিলো।"
বেলা চোখ মুছে বলল,
''কি বল।"
''আপা ইমতিয়াজের কথা মনে আছে তোর?"
''হ্যা তোর বেস্টফ্রেন্ড ইমতিয়াজ না?"
''জি আপা।ওর একটা ছোট বোন আছে কুঞ্জনের বয়সী।"
বেলা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
''হ্যা।সেটা জানি।অনেক ছোট ছিলো তখন।"
''জি আপা।ওর সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছে।আই মিন ওকে ভালবাসি আর ও নিজে ও আমাকে ভালবাসে।"
বেলা হেসে ফেললো। বলতে লাগলো,
''বাহ বাচ্চা পটিয়ে ফেলেছিস।যাই হোক খুশি হলাম অনেক।তা ওর নাম কি জানি?"
''ইদ্রি আপা।"
''নাম ও বেশ সুন্দর।"
হঠাৎ বেলা চুপ হয়ে গেলো।ভাবছিলো হুমায়রার এমন বদলে যাওয়া আচার আচরন নিয়ে।নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাকায়।জানতে চাইলো,
''সব ঠিক আছে?"
''আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম।জানিনা তুই দেখেছিস কিনা?"
বোনের কথায় নিশাদ কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বলল,
''কি আপা?"
''হুমায়রা কে কেমন যেন লাগছে।মানে ও সারাটাদিন সামনে আসেনি।দেখেছিস?সাঁঝকে দেখতে এলো আংটি পরালো ও ছিলোনা।ওর কি কোন এফেয়ার আছে? জানিস কিছু?"
নিশাদ থমথমে কন্ঠে বলল,
''আপা ও একটু এমনই।"
''সেটা না নিশাদ।অন্তত এমন একটা সময়ে থাকবেনা ও?বোনকে দেখতে আসছে।ওর থাকার কথা ছিলো।আর আমাদের দেখে ওর কিন্তু তেমন রিয়্যাকশান ছিলোনা।হুমায়রা তো এমন ছিলোনা।"
নিশাদ চিন্তায় পড়ে যায়।আপা ভুল বলছেনা।আসলেই হুমায়রার আচরন অদ্ভুত লাগছে।নিশাদ বলল,
''আপা তুই একটু দেখিস তো ওকে।বের করতে পারিস কিনা?বয়স কম কি ভুল ভাল করে বসে কে জানে?"
''আমি ওকে নিয়ে বসবো সাঁঝের বিয়ের কর।তুই চিন্তা করিসনা।"
নিশাদ হেসে বেলা কে নিয়ে চলে এলো ড্রয়িংরুমে। জুলেখা বানু বললেন,
''কেমন হুইতবি তোরা?জামাই আইছে।"
সাঁঝ বলল,
''আমার রুমে আপারা ঘুমাক।"
বেলা নাকচ করে বলল,
''আরে নাহ। একটা কাজ করি আমরা চার বোন এখানে বিছানা করে ঘুমাই।বিভান নাহয় নিশাদের রুমে ঘুমাক।"
বেলা নিশাদের দিকে চেয়ে বলল,
''তোর সমস্যা হবে?"
নিশাদ মাথা নেড়ে বলল,
''না আপা ঠিক আছে।"
বেলা সাঁঝকে বলল,
''তোশক আর কাঁথার ব্যাবস্থা কর।এখানে বিছাবো।"
সাঁঝ বলল,
''আপা আমাদের তোশকটা বেশ বড়। ঐটাই নিয়ে আসি।"
''আচ্ছা চল নিয়ে আসি।"
মাঝ থেকে আদনান বলল,
''আপা তুইনা।কুঞ্জন যা তোশক নিয়ে আয়।"
কুঞ্জন দৌড়ে গেলো সাঁঝের রুমে তোশক নিয়ে আসতে।
নিশাদ বিভান কে বলল,
''ভাইয়া অনেক রাত হলো।চলেন ঘুমাতে যাই।আপনি আজ অনেক করছেন।তারওপর লম্বা জার্নি করে আসছেন।আসেন ঘুমাই।কুঞ্জন অলরেডি সব ঠিক করে আসছে।"
বিভান হাই তুলতে তুলতে বলল,
''সমস্যা নাই।তোমাদের কাল অফিস আছে। আমি তোমার আপাকে নিয়ে বিয়ের সেন্টার খুঁজতে যাবো।আশেপাশে দেখবো ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে কিনা।"
''ওকে ভাইয়া চলেন তাহলে।"
নিশাদ ওর রুমে যাওয়ার মুহূর্তে দেখলো ইকরাম রাহমান সাঁঝের রুমে।পূর্না ওনার কোলে ঘুমে কাতর।সারাদিনের ছটফটানি শেষে না পেরে নানার কোলেই ঘুম দিলো পূর্না। বেলা পূর্নার জিনিসপত্র বাবাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।নিশাদ আর বিভান মৃদু হেসে রুমে চলে গেলো।বিভান শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।নিশাদ ফোন থেকে ইমতিয়াজের নম্বর বের করে কল দিলো।অপরপাশ থেকে ইমতিয়াজের কন্ঠস্বর শোনা গেলো।কল ধরেই ইমতিয়াজ বলল,
''কিরে সাঁঝকে কেমন দেখলো?"
নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''কিভাবে জানলি?"
''তুই কি ভুলে গেলি বাসায় বিবিসি নিউজ আছে একটা।"
নিশাদ হেসে ফেললো।ইমতিয়াজ বলল,
''ইদ্রি বলেছে।তা কি অবস্থা?সব ঠিক হলো?"
''আলহামদুলিল্লাহ আংটি পরিয়ে গেলো।"
বুকটা কেঁপে উঠে ইমতিয়াজের।ওর মনে হচ্ছিলো হয়ত ও বাঁচতে পারবেনা তবে সেটা মিথ্যা হয়ে গেলো ও এখনো বেঁচে আছে সাঁঝকে ছাড়া যা কিছু দিন আগে ও দুঃসাধ্য মনে হচ্ছিলো ওর কাছে।তবে বেঁচে আছে ও এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে।ইমতিয়াজের বুক ফেড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। ভালবাসার মানুষকে না পাওয়া মানে মরে যাওয়া নয়।বরং হৃদয়ে যে ঘা তৈরি হয় সেটা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকা।ইমতিয়াজ অনূভব করছে ওর হৃদয়ে ঘায়ের দাগটা রয়ে গেছে।এখন আর সেখানে রক্তক্ষরণ হয়না তবে দীর্ঘশ্বাসটা রয়েই গেলো।
!!!!
গভীর রাতে চলছে গুনগুনিয়ে আলাপ আলোচনা।মাঝে মধ্যে কিছু দমফাঁটা হাসির শব্দ।ইতোমধ্যে জুলেখা বানু দুবার বকে গেছে মেয়েদের তারপরও ওদের হাসি থামছেনা।বেলা বরাবরই বলে গেছে আস্তে হাস তোরা।কিন্তু থামায় কে ওদের এই হাসি?ওদিকে নিশাদ ওদের হাসির আওয়াজে ঘুমিয়ে ও জেগে গেলো।হাতের ঘড়িটা চেক করে দেখলো দেড়টা বাজে।পাশে বিভান ভাই বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। বেশ ক্লান্তই দেখাচ্ছে ওনাকে।নিশ্চয়ই খুব দৌড়াদৌড়ির ওপর যেতে হয়েছিলো ওনাকে।নিশাদ উঠে বসে তারপর বিভানের দিকে আরেকবার তাকিয়ে বিছানার থেকে নেমে আসে।হেঁটে হেঁটে ড্রয়িংরুমের সামনে এসে থামে।মাঝে বেলা শুয়ে আছে।লাবনী আর সাঁঝ দুপাশে অপরপাশে হুমায়রা অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে।নিশাদ খেয়াল করলো সাঁঝ আর লাবনী দুজনে পাল্লা দিয়ে হেসে চলেছে।মাঝে বেলা মুখ টিপে হাসছে।র বারবার বলছিলো,
''এই আস্তে হাস সাঁঝ লাবনী।ওরা উঠে যাবে।কি বলবে মানুষ?"
সাঁঝ আর লাবনী কোন ভাবে হাসি থামাতে পারছেনা।হঠাৎ ওদের অবাক করে দিয়ে নিশাদ সামনে এসে বসতেই তিনজনে উঠে বসে।নিশাদ মৃদু হেসে বলতে লাগলো,
''এভাবে হাসছিস আব্বার কথা শুনতে পেলাম আসার সময়ে।"
বেলা হাসি মুখে বলল,
''এগুলারে কিছু বলা যায়না হাসতে হাসতে শেষ।তোর কি ঘুম ভেঙ্গে গেলো নাকি?"
''আরে সমস্যা নাই আপা। আমি ও তোদের সাথে কিছুটা সময় কাঁটাই।সারাজীবন তো ঘুমিয়েই গেলাম।"
চারভাইবোনে আড্ডা জমে উঠলো।বেলার ভারতের গল্প গুলো শুনে যাচ্ছিলো ওরা।একমুহূর্তে বেলা কেঁদে ফেলে শাশুড়ীর সাথে ঘটা কথাগুলো বলতে গিয়ে। ও বলছিলো,
''জানিস একটা মুহূর্তে মনে হতে থাকে যে আর টিকতে পারবোনা।মুখে যা আসতো তাই বলতো।পার্টিতে ও অপমান করা ছাড়েনি।"
নিশাদ বোনের চোখ মুছে বলল,
''ভাই খুব ভাল মানুষ আপা সেজন্যই তোকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে।ওনির তো বাবা নেই।"
বেলা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।সাঁঝ আর লাবনীও ওকে জড়িয়ে ধরে।ওদের চোখ ভিজে এসেছিলো বোনের কথায়।আড্ডা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি।বেলা নিশাদকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো । কারন ওদের তো অফিস আছে।লাবনী আর সাঁঝকে ও জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ও। সকালে নামাজ পড়তে উঠে বেলা।দেখলো বিভান নামাজ পড়ছে।সালাম ফিরিয়ে স্ত্রীকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
''বেশ শীত পড়ছে।তোমাদের ঠান্ডা লাগেনি?"
''একটু তো লেগেছেই। ওটায় কিছু হয়না। আপনি ঘুমিয়ে যান।আমার একটু কাজ আছে।"
ভ্রু কুঁচকালো বিভান,
''কি করবে তুমি?"
''ভাবছি আজ নাস্তা বানিয়ে নেই।"
''হুম তা বানাও। ওরা ও হয়ত তোমার রান্না মিস করে।"
বিভান আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে নিশাদের পাশে।বেলা ঘর গুছিয়ে ঝাড়ু দিয়ে নেয়।আজ অনেক বছর পর কাজ গুলো করতে পারছেও।আবার ও যেন সেই আগের দিনগুলোয় চলে গেলো ও। নাস্তা বানাতে শুরু করে বেলা।পাশে চা বসিয়ে রুটি ছেঁকছিলো।সকাল সাতটা পচিশ বাজছে।হঠাৎ বেলা শুনতে পেলো পিছন থেকে কারোর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।তবে কান্নাটা অপরিচিত নয়।পূর্নার কান্না ছিলো।বেলা পিছনে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা দুহাতে মুখ ডলে কাঁদছে।বেলার বেশ মায়া লাগলো।পূর্না কাঁদতে কাঁদে নিজের শিশুসুলভ কন্ঠে বলল,
''আমাকে ঐ লাগি বুলোল তাতে গুম পালিয়েতো কেন?"
বেলা এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলল,
''এভাবে বলেনা মা।তোমার নানা ভাই হয়।কষ্ট পাবে শুনলে।কতো আদর করে তোমাকে। "
পূর্না মায়ের কাঁধে মুখ রেখে কাঁদতে থাকে।বেলা বলল,
''ঘুমাবানা তুমি?"
''বাবাল তাতে গুমাবো।"
বেলা মেয়ের গালে চুমু দিয়ে নিশাদের রুমে গিয়ে দেখলো বিভান আর ওর মাঝে বেশ জায়গা।এখনো ঘুমোয়নি বিভান।বেলাকে দেখে ফিসফিস করে বলল,
''ও এখানে কেন?"
''কাল আব্বার সাথে ঘুমিয়েছিলো।এখন কাঁদছে। ওকে আপনাদের সাথে ঘুম পাড়িয়ে দিন।"
বিভান মেয়েকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতে শুরু করে।বেলা চলে আসে সেখান থেকে।সাড়ে আটটায় বেলার হুঁশ হলো আদনান নিশাদসাঁঝ কেউই ঘুম থেকে উঠছেনা।ওদের তো অফিস আছে।বেলা রুটি গুলো হটপটে রেখে সেটাকে লক করে দিয়ে ওদের ডাকতে শুরু করে।কিন্তু তিনজনের একজন ও উঠেনা বরং নাক ডেকে ঘুম।আদনান তো বলেই দিয়েছিলো,
''আপা আজ যাবোনা।বিকেলে তোদের নিয়ে ঘুরতে যাবো।"
বেলা বুঝে গেলো ওদের একজনের ও অফিসে যাবার ইচ্ছে নেই।স্প্রে বোতলে পানি ঢুকিয়ে নিশাদের রুমে এসে ওর চোখে পানির স্প্রে দিতেই ঝটপট চোখ খুলে নিশাদ।এতক্ষন ভাগনীকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলো।চোখে পানির ঝাপটা লাগতেই চোখ খুলে বোনকে দেখে বলল,
''কি হইছে আপা?"
বেলা ভাইকে টেনে উঠিয়ে বলল,
''জলদি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে অফিসে যা।"
নিশাদ মন খারাপ করে বসে রইলো।এভাবে বাকি দুজনকে উঠালো বেলা।ইতোমধ্যে সবাই উঠে গেলো। টেবিলে সাজানো নাস্তা দেখে সবাই অবাক।পাশাপাশি বেশ খুশিও।
আজ সবাই তেরবছর পর বেলার হাতের খাবারের স্বাদ গ্রহন করতে পারছে।নিশাদ তো টিফিনে ও একটু নাস্তা নিয়ে গেলো।সবাই চলে যাওয়ার পর পূর্না কে গোসল করিয়ে দেয় বেলা।নিজে ও ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে যায়।জুলেখা বানু মেয়ে কে রেডি হতে দেখে কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বলল,
''কই যাস?"
''সাঁঝের বিয়ের জন্য সেন্টার খুঁজতে যাবো আম্মা।পূর্নাকে দেখে রাইখো।"
''হেইডা করুমই।একলা যাবিনি?"
''না ওনি ও যাবে। "
''আইচ্ছা জলদি চইলা আইস।"
''আচ্ছা আম্মা। "
বেলা রেডি হয়ে বিভানের সাথে বেরিয়ে পড়ে।এদিকে মা বাবাকে বেরিয়ে যেতে দেখে পূর্না কান্না করতে শুরু করে।নানু নানা কারো কোলেই থাকছিলোনা।জুলেখা বানু কোন কাজ করতে ও পারছিলেননা।কুঞ্জন বুঝতে পেরে ভাগনীকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এতক্ষনে ওর কান্না থেমে চোখজোড়ায় বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়।কারন এখানকার সবই ওর জন্য বেশ নতুন।সবার কথাও কেমন যেন।হাঁটতে হাঁটতে ভাগনীর সাথে বিভিন্ন মজা করতে থাকে কুঞ্জন। মুহূর্তের মাঝেই ছোট মামার সাথে পূর্নার বেশ ভালো সখ্যতা গড়ে উঠে।
পূর্নাকে কোলে নিয়ে টিএসসিতে চলে যায় কুঞ্জন। সেখানে শীতের মৌসুমে কনসার্ট হয় বেশ কিছু।পূর্না সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
''এতা কি গান মামা?"
ভাগনীর তুলতুলে গালে চুমু দিয়ে কুঞ্জন বলল,
''হ্যা আমার আম্মাজান এটা গান হচ্ছে।"
''আমাল গান কুব বালো লাগে।"
কুঞ্জন ভাগনীকে আদর দিয়ে ওকে গান শোনানোয় ব্যাস্ত হয়ে গেলো।অপরদিকে নিশাদ লাঞ্চটাইমে নিজের কেবিনে কাজ করছিলো।ডিসেম্বর মাস বলেই কাজের এতো চাপ।কাজের মাঝেই নিশাদের কানে এলো একটা পরিচিত মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো।অবাক চোখে সামনে তাকায় নিশাদ।ইদ্রি রেগে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলছে,
''এতোটা অসচেতন কেন নিজের প্রতি?"
নিশাদ খানিকটা চমকে উঠে। মেয়েটা এসময়ে এখানে?হাতে একটা ব্যাগ ও রয়েছে ইদ্রির।নিশাদ কিছু বলার আগেই ওর টেবিলের ওপর ব্যাগটা রেখে ল্যাপটপটা ঠেলে বন্ধ করে দেয় ইদ্রি।তারপর বলল,
''চুপচাপ কোন বাক্য ব্যায় না করে খেয়ে নিন আমার সাথে।"
নিশাদ কিছুটা চমকে উঠে।মেয়েটা ধমকাচ্ছে ওকে খাওয়ার জন্য?
নিশাদ ধীরে বলল,
''ইদ্রি কি হয়েছে তোমার?"
ইদ্রি নিশাদের হাত টেনে উঠিয়ে সেোফায় এনে বসিয়ে দিলো।তারপর প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে সেগুলো মাখাতে মাখাতে বলছিলো,
''আপনার লাঞ্চ টাইম আরো আধঘন্টা আগে শুরু হয়েছিলো।এখনো খান নাই কেন?"
বলেই একলোকমা নিশাদের মুখে ঠেলে দিলো।ইদ্রির কন্ঠে অভিমান রাগ ক্ষোভ বিদ্যমান।
নিশাদের মুখে বড় লোকমা দিতে থাকে ইদ্রি।ভাতটুকু খুব কষ্টে গিলে নিলো নিশাদ।খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে নিশাদের পাশে এসে বসে ইদ্রি।তারপর নরম কন্ঠে বলতে লাগলো,
''আপুকে কেমন দেখলো কাল?"
''আংটি পরিয়ে গেলো।কাল বড় আপা এসেছিলো না জানিয়ে।"
ইদ্রির চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে এলো।উৎসাহী কন্ঠে বলল,
''বাবুটাও এসেছে?"
নিশাদ মৃদু হেসে মাথা ওপর নিচ ঝাঁকালো।ইদ্রি উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
''দেখি?"
নিশাদ ফোনের গ্যালারীতে ঢুকে বাবার সাথে পূর্নার ছবি টা বের করে ইদ্রির সামনে ধরে।মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ইদ্রি বলল,
''ইশ কি সুন্দর!!!একটু যদি আদর করতে পারতাম!!......"
নিশাদ ফোন সরিয়ে বলল,
''কলেজ যাওনি?"
''আজ বন্ধ তো।শনিবারে থাকেনা।"
''ওহ।"
ইদ্রি উৎসুক কন্ঠে বলো উঠলো,
''আপনারা কবে আমাকে দেখতে আসবেন?"
প্রিয়তমার কথায় সেদিকে তাকায় নিশাদ।জ্বলজ্বল করছে ওর চোখজোড়া।তারপর ইদ্রির মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলল,
''আরেকটু বড় হও।"
সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ওরা।বেলা নাস্তা রেডি করে সবার সাথে এসে বসে।জুলেখা বানু চেঁচাচ্ছিলেন বলে,
''এই মাইয়াডা আইয়োনের পর থিক্কা কাম করতিয়াছে।থাবড়ায় তোর গাল ফাডায় ফালামু।"
বেলাকে বকা দিচ্ছে শুনে বিভান হাসছিলো।নিশাদ বিভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
''ভাই সেন্টার পেয়েছেন?"
বিভান চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
''হ্যা পেয়েছি।বসুন্ধরা সিটির অপজিটে সামুরায় কনভেনশন সেন্টারটা বেশ ভালো লেগেছে।ওদের অনুষ্ঠান লেগে থাকে।আমি সাঁঝের বিয়ের কথা বলার পর তারা বলল,
''ত্রিশ তারিখে গিয়ে বুক করে আসতে।"
''আচ্ছা।"
বিভান চা শেষ করে বলল,
''বাবাকে বলো আমরা একসাথে মসজিদে এশার নামাজ পড়ে আসি।"
নিশাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বাবার রুমে চলে যায়।বিভান পাঞ্জাবী পরে নেয়।ইকরাম রাহমান সহ ওরা চারজন নামাজের জন্য বেরিয়ে পড়ে।নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসে ওরা।গতকালের মতো কুঞ্জন আবার ও আচার কিনে এনে বিভানের সামনে ধরে বলল,
''ভাইয়া খাবেন?বেশ মজা।"
নিশাদ চোখ রাঙ্গিয়ে ধমকের সুরে বলল,
''এই ওনাকে এগুলো কি দিচ্ছিস পেট খারাপ করবে।"
বিভান কুঞ্জনকে বকা দিচ্ছে শুনে আচারটা নিয়ে বলল,
''সমস্যা নেই আঁচার খাই আমি।বেশ পছন্দ আমার।"
বলেই প্যাকেটে মুখ লাগালো বিভান।