__প্রিয়তাকে বাড়ি নিয়ে সিস্টার আর ডাক্তাররা বেডে শুয়ে সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে।
প্রিয়তা আসতেই সবাই এগিয়ে এসেছে।সালমা বেগম আর জুহি দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।নাদিয়াও প্রিয়তার নিথর দেহটির দিকে তাকালেই যেনো বুক কেঁপে উঠে।রিসাদ চুপ হয়ে নাদিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়তার আসার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
নিবিড় আর মাহিদ প্রিয়তার সাথে এসেছে।
শেফালীও নিজের চোখ মুছছে।দাদী এগিয়ে এসে,প্রিয়তার গাল ছুঁয়ে, মাইয়াডার হঠাৎ এমন হইবো ভাবতেও পারি নাই।ক্যান হইলো কিসের জন্য হইলো কিছু জানি না। দেখ নাদু! মাইয়াডারে কতো নিষ্পাপ লাগতাছে। কত বকাবকি করছোস মাইয়াডারে।আর এহন দেখ সবাইরে ছাইড়া চইলা যাইতাছে।
ডাক্তার নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে, উনাকে কোথায় রাখবেন? আপনার কোথায় আমরা রোগীকে নিয়ে এসেছি।না হলে এসব রুগী আই সি ইউতেই থাকা ভালো।উনার কিন্তু এখন স্পেশাল কেয়ার নিতে হবে।
যতদিন না উনার জ্ঞান না ফিরে ততদিন উনার দিকে নজর রাখতে হবে।আমরা বাড়িতেই সব ব্যবস্থা করে দিবো।
সালমা বেগম মুখ মুছে,তাহলে আমার রুমে দিন।আমি আমার মেয়ের সেবা করবো।
নিবিড় নিজেকে একটু সামলিয়ে, না! ওকে আমার রুমে দিন।মাহিদ ম্যাডামকে উপরে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।
প্রিয়তাকে নিবিড়ের রুমেই দেওয়া হয়েছে। সবাই যে যার রুমে রেস্ট নিচ্ছে।সিস্টারদের নিবিড় শেফালীকে রুম দেখিয়ে দিতে বলে,
-আপনারা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি ওর পাশে আছি।
সিস্টাররা হাসি মুখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
নিবিড় এসে প্রিয়তার পাশে বসে একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিয়ে,অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছলছল চোখে।
অনেক অভিমান আমার উপর তোমার তাই না বুড়ী?
তাই তো রাগ করে চোখ বন্ধ করে আছো।
কিন্তু কতদিন থাকবে তুমি আমাকে এইভাবে ছেড়ে?
তোমার বকবকানি না শুনলে আমার যে কিছু ভালো লাগে না।
আসলে আমার জন্যই আজ তোনার এই অবস্থা। কিন্তু বুড়ী আমি কি করবো বলো? বোনকে তো আমি ফেলে দিতে পারি না। মা চলে গেছে বোন আমার সব ছিলো।সে বোনটার ভাগ্য যে এতো খারাপ হবে আমি কখনো ভাবিনি।ভেবেছিলাম ভালোবেসে বিয়ে করেছে হয়তো সুখেই আছে।কিন্তু আমার বোন সুখে নেই জেনেও কীভাবে লোকটার সাথে বোনটাকে চলে যেতে দিই বলো? তাই তো সেদিন বোন কে যেতে দিইনি।দিয়েছি তোমাকে।এতো কিছু করেও না পারলাম তোমকে ভালো রাখতে না পারলাম বোনকে।
নিবিড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তুমি রাগ করেই আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছো তাই না? কিন্তু নিবিড় তোমায় যেতে দিবে না।আজ থেকে আমার নতুন চ্যালেঞ্জ তোমাকে সুস্থ করার।তোমাকে সুস্থ করার বুজেছো তুমি?
নাদিয়া আস্তে আস্তে এসে নিবিড়ের কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই, নিবিড় শান্ত গলায় বললো,আপু তুই চেয়েছিলি না ও এই বাড়ি থেকে চলে যাক? দেখ ও সত্যিই আমার উপর অভিমান করে চলে যাচ্ছে। নিজে তো যাচ্ছে যাচ্ছে সাথে বাচ্চাটাকেও।বাচ্চাটার জন্য আমার দুঃখ নেই,কিন্তু এই মানুষটা, সেও কি আমার কাছে ফিরবে না?
অবশ্য তোর জন্য ভালো হয়েছে তাই না? আপু তুই খুশি হয়েছিস?
নাদিয়া কাঁদো কাঁদো গলায়, ভাই আমি চাইনি প্রিয়তার এমন কিছু হোক।হে মেয়েটার উপর আমার রাগ ছিলো,তাই বলে আমি ওর খারাপ চাইনি।
নিবিড় কিচ্ছু বললো না।চুপ হয়ে উঠে চলে গেলো চোখ মুছতে মুছতে।
প্রিয়তার মা আর রিয়া এসেছে।প্রিয়তাকে দেখে চোখ মুছে নিচ্ছেন নুর জাহান বেগম। জুহিও প্রিয়তার পাশ থেকে নড়তে চাইছে না।নিবিড় রুমে আসতেই, নুর জাহান বেগম, করুন গলায় বললো,বাবা আমার মেয়েটার এই অবস্থা কীভাবে হলো?
নিবিড় কিছু না বলে চুপ করে অন্য দিকে ফিরে আছে।
-আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। চুপ করে থাকলেই কি সব উত্তর পাওয়া যায়?
-মা উত্তর দেওয়ার একটা সময় আছে।আর আপনাকে সে সময় অনুযায়ী উত্তরটা দিবো।
নুর জাহান বেগম কথা বাড়ালেন না।নিবিড়ের কোথায় তিনি অনেক কিছু বুজতে পেরেও চুপ করে আছে।
নিবিড় আরও কিছু বলতে যাবে তখন নাদিয়া আর রিসাদ রুমে ঢুকেই, ভাই আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।কাল থেকে কিছু খাসনি এখন অল্প কিছু খেয়ে নে।
রিসাদকে দেখে প্রিয়তার মা বড়সড় ধাক্কা খেলো।অবাক হয়ে রিসাদের সামনে গিয়ে, তুমি এখানে?
নাদিয়া প্রিয়তার মায়ের কথা শুনে,আন্টি ও আমার হাজবেন্ড। আপনি চিনেন নাকি?
কথাটা শুনেই নিবিড় এসে,মা রিসাদকে চিনবে কি করে।খাবারটা নিয়ে তুই এখান থেকে যা।আর উনাদেরকেও নিয়ে যা আমাদের গেস্ট রুমটা খুলে দে।
রিসাদ নিবিড়ের কথায় একটু অবাক হলো,নিবিড় কি কথা ঘুরাতে চাইছে? নিবিড় জেনে ঘুরাচ্ছে নাকি না জেনে?
নাদিয়া নুর জাহান বেগম আর রিয়াকে নিয়ে চলে গেলেন।রিসাদ যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই,অনেক ভালোবাসো প্রিয়তাকে?
কথাটা শুনেই রিসাদ থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরলো।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের দিকে।
একটা কথা কি জানো? আমি নিজেই খাল কেটে কুমির নিয়ে এসেছি।
রিসাদ ঢোক গিলে, মানে?হঠাৎ এসব কথা?
নিবিড় রিসাদকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে,নাটক তুই আমার বোনের সাথে দেখা আমার সাথে নয়।
তুই কী ভেবেছিস? আমার বোন তোর কথায় গলে যায় বলে আমিও যাবো?
নিবিড় তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে, ভুল ভেবেছিস।
আসলে তোর জন্য আমি ফাঁদ পেতেছিলাম। আর তুই ভুল করেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছিস।তুই নিজেকে যতটা চালাক ভাবিস তার থেকেও তুই বোকা।কথাটা বলেই নিবিড় নিজের চেয়ারে পা উপর পা দিয়ে বসে,তুই নিবিড় ইসলামের সাথে টেক্কা দিতে এসেছিস? তুই কী ভেবেছিস নিবিড়ের সাথে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা তোর আছে?যদি এইটা ভেবে থাকিস ভুল ভাবছিস। নিবিড় এমনি এমনি এই জাগায় এসে পৌঁছেনি। এই একত্রিশ বছর বয়সে সফল বিজনেসম্যান হওয়াটা এতোটাও সোজা নয়।তুই কী ভেবেছিস আমার বউয়ের পিছনে লাগবি আর আমি জানতে পারবো না? তোকে নিয়ে তো আমার সন্দেহ সেদিনই হয়েছে যেদিন দেখলাম তুই আর প্রিয়তা ড্রইংরুমে কথা বলছিস।কিন্তু আমিও প্রিয়তাকে বুজতে দিইনি তোকে আমি সন্দেহ করছি।
রিসাদ এগিয়ে নিবিড়ের সামনে এসে,নিবিড় তুমি এসব কি বলছো? আমি তো কিছুই বুজতে পারছি না।
-শেটাপ, জাস্ট শেটাপ!পঞ্চশ লক্ষ টাকা তুই কি করেছিস সেটা আমি জানি।প্রিয়তাকে নিয়ে থাকবি বলে প্লাট কিনেছিস। কিন্তু পাশের প্লাটের নেইম প্লেটটা তোর চোখে পড়েনি?প্রিয়তাকে এসএমএস দিয়ে ভয় দেখিয়েছিস, সেটাও আমার জানা।তোর কারণে ওর এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে এটাও আমার অজানা নয়।তুই কী ভাবছিস এতো কিছু জেনেও আমি এতো শান্ত কি করে?
নিবিড় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে,মানুষ পাহাড় পরিমান গুনহা করলেও আল্লাহ নিজে যখন ধৈর্য ধরে থাকে তার পাপী বান্দাদের হাশরের দিন শাস্তি দিবেন সেখানে তো আমি মানুষ। তুই ধৈর্য ধরে চিন্তা করতে থাক তোর শাস্তিটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে।আর তুই আল্লাহর কাছে দোয়া কর নিবিড় যেনো নিজে হাতে তোকে শাস্তিটা দিলেও সেটা যেনো কম হয়।
রিসাদ কি বলবে বুজতে পারছে না।নিবিড়ের সামনে আর একমুহূর্তের জন্য দাঁড়ালো না।
কেটে গেলো কয়েকটা দিন।প্রিয়তার এখনো জ্ঞান নেই।
সকালে মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ আদায় করে নিবিড় বাড়ি ঢুকেই দেখে নাজিফা বেগম সোফায় বসে আছে আর নাদিয়া সামনে দাঁড়িয়ে।
নিবিড় ভিতরে ঢুকেই,আপু উনি এতো সকাল এখানে কেনো?
নাজিফা বেগম তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে নিবিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে, আমি তোর মা, তোর বিপদের দিনে আমি তোর পাশে থাকবো না?
-মা! আপনি আমার মা হোন এইটা তো আমি জানতাম না।আমার মা তো মায়ের রুমেই আছে।
-নিবিড় তুই আমায় ক্ষমা করে দে।মানুষ তো ভুল করে তাই না? আমিও ভুল করেছি।
-যে মানুষ না জেনে ভুল করে তাকে মাপ করা যায়।আর যে জেনে ভুল করে তাকে কি করে মাপ করা যায়?প্লিজ আপনি আর এই বাড়িতে আসবেন না।আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
নিবিড় কথাটা বলেই উপরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই নাজিফা জড়িয়ে ধরে,বাবা আমি তো বলছি না আমি এই বাড়িতে থাকবো।আমি শুধু আমার সন্তানদের চোখের দেখা দেখতে চাই।
-সন্তান! কে আপনার সন্তান? এইবাড়িতে সালমা বেগের সন্তানই থাকে কেবল।আর কেউ না।আর কত নিচে নামাবেন নিজেকে? লজ্জা হওয়া উচিত আপনার।আপনার জাগায় আমি থাকলে জীবনেও চেহারা দেখাতে আসতাম না।
নাজিফা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন।নিজেকে সামলাতে পারছেন না।নিবিড় উপরে যাওয়ার সময় নাদিয়াকে বলে গেলো নাজিফা বেগমকে বিদায় করার জন্য।নাদিয়া এগিয়ে এসে নাজিফা বেগমের চোখের পানি মুছে,আপনি চলে যান।ভাই যাকে একবার ঘৃণার চোখে দেখে তার দিকে ফিরেও তাকায় না।আপনার কান্না ওর কান পর্যন্ত কখনোই পৌঁছাবে না।
-নাদিয়া তুই আমায় ক্ষমা করেছিস তো?
নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে,আপনি বাড়ি যান।আর প্লিজ কখনো আসবেন না।আমার ভাই নিজেকে এইভাবে সামলাবে আমি বুজতেই পারিনি।আপনি এইসময় ওর মনের আঘাতটা আর বাড়াবেন না।
নাদিয়া কথাটা বলেই আর দাঁড়ালো না।নিজের রুমে চলে গেলো।সালমা বেগম দূর থেকে দেখে নিজের চোখের পানি মুছে নিবিড়ের রুমে গেলো প্রিয়তাকে দেখতে।
নিবিড় প্রিয়তার পাশেই বসে কান্না করছে।নিজের মুখটা প্রিয়তার মুখের উপর নিয়ে, বুড়ী আর কতদিন ঘুমাবে? তোমার কি সত্যিই ইচ্ছে করে না তোমার এই রাক্ষসটার বুকে মাথা রাখতে।নিবিড় চোখ থেকে ঝরে যাওয়া পানির ফোটা প্রিয়তার কপালের উপর পড়তেই শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গিয়েছে প্রিয়তার।পা গুলো নাড়াচ্ছে। সালমা বেগম এসেও হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে। নিবিড় প্রিয়তার অবস্থা দেখেই তড়িঘড়ি করে ডাক্তারকে ফোন দিলো।
সিস্টার এসেই, ডাক্তারকে ফোন দিয়েছেন?
নিবিড় শান্ত গলায় বললো, হুম।সিস্টার ওর কষ্ট হচ্ছে অনেক তাই না?
সিস্টার কিছু বললো না চুপ করেই আছে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে। সিস্টার মনে মনে ভাবছে, আমি যা আন্দাজ করছি তা যদি সত্যিই হয় তাহলে মিস্টার নিবিড় আপনি জিতে গেছেন।
ডাক্তার এসে প্রিয়তাকে দেখে,আলহামদুলিল্লাহ মিস্টার নিবিড় আপনার ওয়াইফের তো জ্ঞান ফিরে এসেছে।
নিবিড় অবাক হয়ে, হোয়াট? কিন্তু এইটা কিভাবে সম্ভব?আর জ্ঞান ফিরলে ও তো এখনো তাকাচ্ছে না।
-আপনি একটু শান্ত হয়ে অপেক্ষা করুন।দেখবেন বিকেলের মধ্যেই রুগী আপনাদের সাথে কথাও বলবে।যদি আল্লাহ চান।
নিবিড় ডাক্তারের কথা শুনে চোখ মুখ মুছে মা শুনেছো? প্রিয়তা নাকি আমার সাথে কথা বলবে?
সালমা বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে, আল্লাহ তোর ডাক নিশ্চয়ই শুনেছে।আমার যে ছেলে ঠিক মতো নামাজ পড়তো না সে ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে তার বুড়ীর জন্য দোয়া করছে, প্রিয়তার অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই নফল রোজা রাখছে। তাকে তো আল্লাহ নিরাশ করবেন না।
তার বুড়ীকে যে ফিরে আসতেই হতো তার কাছে।