তৃষ্ণা - পর্ব ৩২ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


ছেলের ঘর থেকে হতাশ মুখে বেরিয়ে এলেন বাবা। মাহিব রুম অন্ধকার করে বসে রইলো। সন্ধ্যের পর হয়তো একটু গিটার নিয়ে বসে। কিছুক্ষণ গিটার বাজায়, এরপর আবার শুয়ে থাকে। অন্ধকারে কারো ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাহিবের কেমন যেন লাগতে শুরু করে। একাকীত্ব চারিদিক থেকে এসে চেপে ধরে ভীষণভাবে। ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকতে থাকে মাহিব। 

জীবনটা তিক্ত হয়ে উঠছে দিনদিন। ঘরে বসে থাকতেও ভালো লাগে না। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। মাহিবকে আজকাল কোনো একটা অনুশোচনা তীব্রভাবে চেপে ধরে। কেন যেন নিজের মাঝে এক ধরণের অপরাধবোধ জেগে ওঠে। এ অপরাধবোধ কিসের? নিজেকে প্রশ্ন করতেই অংশীর মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাহিব অস্থির হয়ে ওঠে। ভেতরটা দগ্ধ হচ্ছে পুরনো যন্ত্রণায়। তার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।

অংশীর কথাই তবে ঠিক মিলে গেলো। ও একদিন বলেছিলো মানুষের মস্তিষ্ক কখনো তার পাপ ভুলতে পারে না। একসময় মস্তিষ্ক ঠিকই দহন করতে থাকবে। আজকাল মাহিবের তাই হচ্ছে। অংশীর প্রতি করা অন্যায়কে মনে করে নিজের মাঝে এক ধরণের অপরাধ বোধ জেগে উঠছে। তবে এ অপরাধের চেয়েও বেশি পীড়া দিচ্ছে সেই সন্তান যাকে মাহিব নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলো। কেবলই মনে হচ্ছে, ও সন্তান তো আমার। তবে ওকে আমি কেন মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম? শুধুমাত্র আনন্দের জন্য? নিজের ওপর ধিক্কার জন্মাতে লাগলো মাহিবের। কষ্টে হৃদপিন্ড ছিঁড়ে যেতে চাইলো। 

রাতে শুয়ে শুয়ে নিজের অতীতের কথা ভাবে মাহিব। একটার পর একটা মেয়ের সাথে জড়িয়েছে বলেই হয়তো আজকাল কাউকে ভালো লাগে না। সবাইকে কেমন ন্যাকা মনে হয়। সবার ভালোবাসা কিংবা ভালো কথাগুলোকেও মেকি মনেহয়। অংশীর মত একটা নিষ্পাপ মেয়েকে শহরে এনে একা ছেড়ে দেয়ার মত অন্যায়টা করা ঠিক হয়নি। কেন এই ভুল করেছিলো মাহিব?

নিজের ভুলের জন্য নিজেকেই ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। সময় ঠিক সময়েই তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। যেমন এখন প্রতিনিয়ত নিজে নিজেই পুড়তে হচ্ছে। কষ্টগুলো কেমন যেন খাপছাড়া। কখনো বুকে আঘাত করে তো কখনো মাথায়। 

আজকাল ঘুমের ঘোরে অংশীর মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। মেয়েটা কোথায় আছে কে জানে। কি নিষ্পাপ পবিত্র একটা মুখ ছিলো মেয়েটার। কত চঞ্চল, মিষ্টি ছিলো। অথচ মেয়েটার সবকিছু ওলট পালট করে দিয়েছে এই মাহিব। ভাবতেই কেমন যেন স্বার্থপর মনেহয় নিজেকে। অংশীর সাথে একবার দেখা করা দরকার। হয়তো ও এখন আর একা নেই, নিশ্চয় ওর জীবনে কেউ এসে গেছে। তবুও তো মাফ চাওয়ার সৌভাগ্য হবে। একবার অংশীর কাছে যেতেই হবে। 

অর্ধেক রাত অব্দি ছটফট করে অবশেষে থাকতে না পেরে বেরিয়ে পড়লো মাহিব। জীবনের এ পরিণতি হবারই ছিলো। আজ একমাত্র অংশীকেই পাশে প্রয়োজন। অংশীর কাছে ক্ষমা না চাইলে এ পাপ থেকে নিস্তার নেই।   অংশীর দোকানের সামনে এসে ফুটপাতে বসে রইলো। সকাল হলে নিশ্চয় দোকান খুলবে অংশী। তখন দেখা হবে, সেই ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। 

আচ্ছা, দেখা হওয়ার পর মাহিব কি করবে প্রথমে? অংশীকে জড়িয়ে ধরবে? জড়িয়ে ধরলে ও কি রাগ করবে? না জড়িয়ে ধরা যাবে না। অংশীর পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়বে মাহিব। হাত জোর ক্ষমা চাইবে ওর কাছে। অংশী হয়তো কয়েকটা কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেবে। সব চুপ করে শুনবে মাহিব। কোনো প্রতিবাদ করবে না। অংশীর কথা শেষ হয়ে গেলেই ওকে জাপটে ধরে বুকের সাথে পিষে ফেলবে মাহিব। অংশীকে আর কিছু বলার সুযোগ ই দেবে না। অংশী যদি রাগ করে? করুক। তবুও ওকে একবার জড়িয়ে ধরবে মাহিব। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনটাকে নিভাতে হবে তো। ইস, কখন যে আসবে অংশী! এতদিনের জমে থাকা কষ্টগুলোকে আর ভালো লাগছে না মাহিবের। অংশী এসে যেন সমস্ত কষ্টের অবসান ঘটায়। 

মাহিব রাস্তায় বসে ছটফট করতে লাগলো। সকাল হতে আরো কত বাকি! সময় বুঝি ঘড়ির কাঁটায় আটকে আছে। একটুও এগোচ্ছে না। অংশীর বাড়ি চিনলে সেখানেই চলে যেতো ও। কিন্তু সেদিন বাড়ির ঠিকানা নেয়া হয়নি। তাতে কি? দোকানে আসলে এবার বাড়ির ঠিকানাও নেবে মাহিব। 

অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে চোখে ঘুম নেমে এলো। উঠে রাস্তায় পায়চারি করতে লাগলো যাতে ঘুম না আসে। এদিক সেদিক ছোটাছুটি করেও শান্তি হচ্ছে না মাহিবের। গাড়িতে গিয়ে বসে রইলো। 

সকালের আলো ফুটলে মাহিব চাতক পাখির মত চেয়ে রইলো পথ ধরে। কিন্তু কোনোদিক থেকেই অংশীকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। অংশী ভেতরে হয়তো ঘুমিয়ে আছে এই ভেবে দোকানের শাটারে শব্দ করে ডাকতে লাগলো মাহিব। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, কে?

মাহিব উত্তর পেয়ে স্বস্তি পেলো। বললো, 'আমি মাহিব। ভেতরে কে?'

দোকানের শাটার কিছুটা তুলে এক বয়স্ক লোক মাথা বের করে দিলো, 'কে আপনি?'

মাহিব অস্থির হয়ে বললো, 'এটা যার দোকান আমি তার খোঁজে এসেছি।'

- 'এটা আমার দোকান।'

- 'কি বলেন? এখানে তো একটা মেয়ে ছিলো আগে।'

- 'মাইয়া মানসের খোঁজ ক্যান? আমি জানিনা সেইসব। মালিকের সাথে কথা বলেন গিয়া।'

মাহিবের মনে আঘাত লাগলো। মালিকের নাম্বার নিয়ে তখনই কল দিলো। কয়েকবার রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলো না। হতাশ হয়ে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় কিছুক্ষণ ড্রাইভ করতে লাগলো। ক্রমাগত বেলা বাড়ছে, সেইসাথে অস্থিরতাও বারছে মাহিবের। দশটার পর আবারও ফোন দিলো দোকানের মালিকের নাম্বারে। লোকটা রিসিভ করে বললো, 'হ্যালো..'

মাহিব অংশীর ব্যাপারে বিস্তারিত বললো। সব শুনে দোকানদার বললো অংশী দেড় বছর আগেই এই দোকান ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। মাহিবের মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। মনে পড়ে গেলো সেই দিনের কথা। এরপরই হয়তো অপমান নিতে না পেরে চলে গেছে অংশী। কোথায় গেছে ও!

মাহিব সোজা প্রীতমের বাসায় চলে এলো। প্রীতমের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ওর ঘরের ভেতরে চলে এলো। মাহিব এর আগে কখনো এভাবে আসে নি। প্রীতম চোখ কচলে উঠে বসলো। মাহিব বিছানার কাছে এসে হাঁটুগেরে বসে প্রীতমের হাত ধরে বললো, 'ভাই, আমার একটা উপকার কর। প্লিজ সত্যিটা বল, প্লিজ?'

প্রীতম অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বললো, 'কি বলবো?'

- 'অংশী কোথায় আছে?'

অবাক হলো প্রীতম। এতদিন পরে অংশীর খোঁজ!

মাহিব বললো, 'ভাই, প্লিজ, দোহাই লাগে। বল অংশী কোথায় আছে?'

- 'জানি না আমি।'

- 'জানিস তুই। অংশী কোথায় আছে বল? প্লিজ প্রীতম।'

- 'সত্যিই আমি জানিনা। ওর সাথে আমার যোগাযোগ নেই দু বছরের বেশি হবে।'

- 'কি বলিস? সত্যি?'

- ‘হ্যাঁ। আমি জানি না ও কোথায়। কখনো ফোনও দেইনি।'

- 'কেন?'

চুপ করে রইলো প্রীতম। অংশীকে ধীরেধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল ও। কোথায় আছে জানে না, এমনকি অংশীর নাম্বারে কখনো কলও দেয়নি। প্রীতম অংশীর ফোন নাম্বার বের করে কল দিয়ে দেখলো নাম্বার বন্ধ। 

অবাক হয়ে মাহিবের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। মাহিবের চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। কত রাত ঘুমায় না বোঝাই যাচ্ছে। কি হাল হয়েছে বেচারার। প্রীতমের আফসোস করতে ইচ্ছে করলো। 

মাহিব বললো, ‘এখন আমি কি করে খুঁজে পাবো ওকে? আমি যে অন্যায় করেছি তার শাস্তি আমি পাচ্ছি। অংশীর সাথে যোগাযোগ করতে হবে আমাকে। আমি ক্ষমা চাইবো ওর কাছে।'

প্রীতম বিছানা ছেড়ে উঠে একটা জামা গায়ে জড়িয়ে হললো, 'আসো আমার সাথে।'

প্রীতম ওর বন্ধুর বাসায় চলে এলো, আগে এ বাসায় অংশী থাকতো। কিন্তু এখানে এসেও হতাশ হতে হলো। অংশী অনেকদিন আগেই এ বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ওর নাকি শহরে থাকতে ভালো লাগছে না তাই পাহাড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

কথাটা শুনে মাহিব ও প্রীতম একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। পাহাড়ে! কোথায় গেছে আন্টি সেটা স্পষ্ট বলতে পারলেন না। উনি শুধু পাহাড়ের কথাই বললেন। মাহিব হতাশাগ্রস্ত মনে ফিরে এলো সেখান থেকে। 

এর আগে ভীষণ কষ্টেও কান্না পায় নি ওর। আজ খুব কান্না আসছে ভেতর থেকে। অংশী সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে। এই নিদারুণ কষ্টটা মাহিবের তৃষ্ণা আরো বাড়িয়ে দিলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন