রংধনু - পর্ব ২২ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


বিভানের দিকে একবার তাকায় বেলা।ও তো চলে এলো কিন্তু মায়ের সাথে মুখোমুখি কি করে হবে ও ঘরে ফেরার পর?কিন্তু না এসে ও পারতো না।লোকটাকে একা কি করে পাঠাতো জুলির সাথে তাও এবার কতগুলো দিনের জন্য।ভাগ্যে যা আছে তাই হবে ঘরে ফেরার পর।কথা গুলো ভেবেই বিভানের গালে ঠোঁট ছোঁয়ায় বেলা।লোকটা ওর শক্তি ওর ধৈর্য,ওর সব।বিভান বেলার দিকে একবার তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বেলার কাঁধ স্পর্শ করে কাছে টেনে আনে।এয়ারপোর্টে এসে থামার পর জুলি বিভানকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বেলার সামনে। বেলাকে জুলি এখনো খেয়াল করেনি।কিন্তু বেলা ঠিকই দেখেছে।বিভান সরিয়ে দেয় জুলিকে ধাক্কা দিয়ে।বলতে থাকলো,

''নিজের সীমায় থাকতে বলেছিলাম না?তোমার সাথে যাচ্ছি শুধু তোমার নিরাপত্তার জন্য যা তোমাকে না দিলে ও চলে।বেলা আসো সামনে এগোই।"

কিছুটা জোরে কথাটা বলে বিভান।বেলা আসতেই ওর হাত ধরে বিভান এগিয়ে যায়।জুলি সেখানে দাঁড়িয়ে রেগে জ্বলে যাচ্ছিলো।এয়ারপোর্টের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করে তিনজনে এসে তিনটে চেয়ারে বসে।তবে জুলির থেকে একটু দুরুত্বে বসেছে বিভান।বেলাকে জড়িয়ে ধরে কথা বলছিলো বিভান।জুলি ওদের রেগে দেখছে।নির্দিষ্ট সময়ে ওরা বিমানে উঠে বসলো।জুলির সিট আলাদা ওদের থেকে।ঘন্টাখানেক জার্নির পর ওরা এসে পৌছুলো লখনৌ।বিভান অনেক বড় ব্যাবসায়ী হওয়ার কারনে ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে ওর চেনা পরিচিত লোক আছে।যার একটি হলো লখনৌ।এখানকার গোল্ডেন টিউলিপ হোটেলে ওদের জন্য দুটো রুম বুক করা হয়েছে।বিভানের একজন বিজনেস পার্টনার এখানকার ম্যানেজার।হোটেলে ঢুকতেই সুকান্ত দাস এসে বিভান কে জড়িয়ে ধরে বলল,

''সালাম মিঃ বিভান কেমন আছেন?"
''ভালো আপনি?"
''এইতো।ভবি ও এসেছে দেখছি।"

বেলাকে দেখিয়ে বলল লোকটা।বিভান হ্যা সূচক ভাবে মাথা নাড়ায়।লোকটা বলল,

''একটু রুম দিয়েছি আপনাদের ডাবল বেড, এয়ার কন্ডিশানড,ব্যালকনি আছে খুব বড় সাথে একটু জাকুজি।গরম পানি আসবে ওটায় গোসল করতে পারবেন।আরেকটা হলো বেশি বড় না সিঙ্গেল খাট আর এসি ও আছে।"

রুমের বর্ননা শুনে খুব রেগে গেলো জুলি।নিজেরা কি হানিমুন করতে এসেছে নাকি?বিভান রুমের চাবি নিয়ে বেলা আর জুলিকে নিয়ে লিফ্টে উঠে গেলো।জুলি রেগে বলল,

''আমি এসেছিলাম প্রোজেক্টের কাজে।তোমাদের ঢং দেখতে না।"

বিভান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

''তোমার কাজ।আমাদের তো না।তুমি কাজ করবা আমরা কি তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা পাহাড়া দিবো?"
''বিভান তুমি খুব রুড হচ্ছো।"

বিভান এবার রেগে বলল,

''গলা নামিয়ে কথা বলো।তোমার সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই আমার।বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমরা এক্ষুনি চলে যাবো আর তোমাকে এই হোটেল থেকে ও বের করে দেয়া হবে।তখন কই যাবে?"

জুলি চুপ হয়ে গেলো।বিভান হেসে বেলাকে দেখে।বেলা চুপ করে আছে।জুলি ফিসফিস করে বলছে,

''নিজেরা লাক্সারি রুমে থাকবে আর আমাকে দিলো কুড়ে ঘর।"

বিভান বেলার দিকে তাকিয়ে ওকে শুনিয়ে বলল,

''যার সামর্থ্য যেমন সে তেমন রুমে থাকবে।চাইলে আমাদের রুমে ও থাকতে পারে।তবে তার তো কোন লজ্জা নেই।আমাদের আছে।আমাদের প্রাইভেসি আছে।"

বেলা বিভানের কথায় বেশ লজ্জা পায় তবে জুলির চেহারা দেখে হেসে বিভানের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
এদিকে সিয়াম চলে যাওয়ার পর সাঁঝ হাফ ছাড়ে।বারবার আড় চোখে সাইমন কে দেখছিলো আর নিচে তাকাচ্ছিলো।সাাইমন ও কিছু না বলে মন দিয়ে খাচ্ছে।সাঁঝ আর অপেক্ষা করতে না পেরে বলল,

''ভাইয়ার সাথে কেন দেখা করালেন?"
''বিয়ে করবো বলে।"

কথা টা আচমকা বলে উঠে সাইমন।সাঁঝ চমকে উঠে।কিছুটা ভয় পেয়ে বলল,

''জি?"

সাইমন খাওয়া ছেড়ে হেসে দিলো।তারপর সাঁঝের দিকে চেয়ে বলল,

''ভয় পেয়ে গেছো না?ভাই আমার সাথে তোমাকে দেখেছিলো তাই কথা বলতে চাইলো।"
''ওহ।"

সাইমন হঠাৎ সাঁঝের হাত ছুঁয়ে দেয়।সাঁঝ কিছুটা কেঁপে উঠে।হাত সরাতে চাইলে সাইমন শক্ত করে ওর হাত ধরে।তারপর বলল,

''যদি সত্যিই বিয়ে করি?"

সাঁঝ লোকটার চোখের দিকে তাকায়।কি বলবে ও বুঝতে পারছেনা। লোকটা হাসছে ও না। সাঁঝের কেমন যেন লাগছে খুব অস্থির লাগছে।সাঁঝ উঠে দাঁড়ায় বলল,

''ঘরে পৌছুতে হবে আমার।বের হবো।"

সাইমন ও উঠে দাঁড়ায়।তারপর বলল,

''চলো।"

সাইমন খাওয়ার বিল দিয়ে বেরিয়ে আসে সাঁঝকে নিয়ে।রাস্তায় আর কথা বলেনি সাঁঝ।সাইমন ও তেমন ঘাঁটায় নাই।কথাটা আসলে ও কেন বলল নিজে ও জানেনা।
এদিকে নিশাদ ইদ্রিকে পড়িয়ে বেরিয়ে আসে।কপাল ঘেমে ভিজে গেছে।গায়ের শার্টটাও চিপচিপে ভেজা।নিশাদ বাসের জন্য দাঁড়িয়ে বেলার নম্বরে কল দেয়।তবে কল রিসিভ হচ্ছেনা।নিশাদ ফোন পকেটে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।হঠাৎ দুটো ছেলেকে দেখে ওর পরিচিত মনে হলো।ছেলে গুলো রাসেল আর ইরাজ।ওরা কুঞ্জনের ক্লাশমেট। তবে নিশাদের খুব বেশি খারাপ লাগলো যখন দেখতে পায় ছেলে গুলো সিগারেট টানছে।নিশাদ ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

''তোমরা বাসায় না গিয়ে এখানে সিগারেট টানছো কেন?তোমাদের বাবা মা কে বিচার দিবো।"
রাসেল ছেলেটা বলল,

''আরে ভাই নিজের ঘর সামলান।যান এখান থেকে।গ্যাঞ্জাম কইরেননা।"

নিশাদের ভীষন রাগ হলো।ছেলেটার গালে চড় বসিয়ে বলল,

''এই জন্য কুঞ্জনকে বলেছিলাম তোদের সাথে যেন না মিশে।তোরা বেয়াদব জানতাম কিন্তু বড় দের সাথে ও ঠিকমতো কথা বলিসনা জানতাম না।"

ইরাজ রেগে গিয়ে বলল,

''আপনি ওকে কেন মারলেন?নিজের ভাইকে ঠিক করতে পারেননা আর আমাদের শুধরাচ্ছেন।"

নিশাদ চেঁচিয়ে বলল,

''আমার ভাইয়ের সাথে নিজেদের মিলাবিনা।কুঞ্জন অনেক ভাল তোদের থেকে।"
''ওহ আপনি কিছু জানেননা তাহলে।আপনার ভাই ও সিগারেট খায়।এমনকি ধরা পড়েছিকো।টিসি থেকে বেঁচে গেছে শুধু আপনার কারনে।ম্যাডামদের তো আবার আপনার জন্য অনেক মায়া।"

নিশাদ অনেক রেগে গিয়ে রাসেলের শার্টের কলার চেঁপে বলল,

''নিজেদের দোষ লুকাতে আমার ভাইকে টানছিস?বড্ড বেয়াদব তোরা।"

ইরাজ বলল,

''ভাই নিজের মুখ খারাপ না করে আমাদের কলেজের দপ্তরী কল দেন।সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।"

নিশাদ কিছু বলতে পারেনা বাস চলে আসে।
বাসে উঠে আজ বসার জায়গা ও পেলো জানালার পাশে।নিশাদ বসে পড়ে।চোখজোড়া কেন যেন ভিজে যাচ্ছে।কেমন অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে বুকে।দুহাতের ওপর মুখ চেঁপে বসে থাকে নিশাদ।নিজের ভাইয়ের ওপর বিশ্বাস আছে তবে এ বয়সটাই বড্ড খারাপ।বাসের ঝাঁকানির সাথে নিশাদের শরীরটাও কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।হয়ত ওর কাঁদার কারনেই এমন হচ্ছে।সেদিন সন্ধ্যা ঘরে ফিরে কারোর সাথেই কথা বলেনি নিশাদ।রুমে ঢুকে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলো।আম্মা অনেক বার ডেকে গিয়েছিলো খেতে যাওয়ার জন্য।কিন্তু নিশাদ বারংবার  বলেছিলো আম্মা খিদা নাই।ঘুমাবো আমি।জুলেখা বানু ছেলেকে এভাবে শুয়ে পড়তে দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে ছেলের পাশে এসে বসেন।তারপর হাত দিয়ে ওর মুখ ছুঁয়ে দিতেই ওর চোখ গাল ভিজা পেয়ে বলেন,

''কিরে আব্বু কান্দোস কেন?"
''না আম্মা।মুখ ধুয়ে আসছি।কান্দবো কেন?তুমি যায়া খায়া নাও।"
''আমার হাতে খায়া লও আব্বা।"
''বুঝার চেষ্টা করো।খিদা পায় নাই।"
''কি খাইছোস যে তোর খিদা নাই।"
''ইমতিয়াজরা খাওয়াইছে তাই।"
''আমার কসম দিয়া কও খাইছোস।"
''আম্মা আমার এখন ভাল লাগতেছেনা।বিশ্বাস করোনা কেন?যাও তুমি।মাথা ধরছে আমার।"

জুলেখা বানু উঠে চলে গেলেন।তখনই বেলার কল আসে নিশাদের নম্বরে।নিশাদ ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়।বেলা সালামের উত্তর দিয়ে বলল,

''কেমন আছোস?"
''ভালো আপা।তোর কি খবর?"
''আলহামদুলিল্লাহ। সবাই কেমন আছে?আব্বা আম্মার কি খবর?"
''সবাই ভালো আছে।আব্বা ও।"
''হুম।কল ধরিনি তখন।আমরা লখনৌ আসছি।আমার এক ননদের প্রোজেক্টের কাজে বিভান এসেছিলেন।তাই আমি ও আসলাম।"
''ওহ।কবে আসলি?"
''আজ বিকেলে।"
''হুম।ভাই কেমন আছে?"
''আলহামদুলিল্লাহ। খাইছিস?"
''খিদা নাই আপা।"
''নিশাদ তোর কথা গুলো কেমন শোনাচ্ছে।সব ঠিক আছে তো?"
''সব ঠিক আছে।একটু টায়ার্ড আর কি। "
''ওহ তাহলে ঘুমা।আমি রাখি।আমরা নিচে যাবো ডিনার সাড়তে।"
''ওকে।গুড নাইট আপা।পরে কথা হবে।"
''গুড নাইট।"

নিশাদ ফোন কেঁটে কানে হাত চেঁপে শুয়ে থাকলো।কেন যেন কানে ছেলে গুলোর কথা ভেসে আসছিলো।সেরাত ঘুমাতে পারেনি।সারারাত জানালা ধরে বসেছিলো নিশাদ।তখনই ইদ্রির মেসেজ এলো,

''খেয়েছেন?"

নিশাদ ভ্রু কুঁচকায়।ও মেসেজের উত্তর পাঠায়, 

''হুম।"

আর কোন মেসেজ নেই।হঠাৎ ইদ্রি কল দিলো।নিশাদ কেঁটে দিতেই মেসেজ এলো, 

''কি হলো?ধরার পড়ার ভয়ে কল ধরছেননা?"

নিশাদ মেসেজের উত্তর পাঠালো,

''কিসের ধরা পড়ার?আমার ভালো লাগছেনা।"
''তাহলে আমার সাথে কথা বলতে পারেন।হয়ত ভালো লাগবে।"

নিশাদ এবার নিজেই কল দিলো।অপরপাশ থেকে ইদ্রি বলল,

''ঘুমাননি কেন?"
''আসছেনা।"

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশাদ।ইদ্রি অবাক হয়ে, 

''লম্বা নিশ্বাস ফেললেন।কিছু তো হয়েছে।বলেন না কি হয়েছে?"
''ইদ্রি তুমি কল কেন দিলে?সব ঠিক আছে।"
''সত্যি বলবো কেন কল দিলাম?"
''কেন?"
''আমার কথা বলতে মন চাইছিলো।আপনার সাথে তাও।"

নিশাদ চুপ হয়ে গেলো।মাঝে মাঝে মেয়েটার কিছু কথার উত্তর দিতে পারেনা ও।কেমন যেন চিন্তায় পড়ে যায় ও।যেমন চিন্তা আগে কখনো আসেনি।
এদিকে সেদিন রাতে বেলা আর বিভান খেয়ে রুমে চলে আসে।সকালে বের হতে হবে ওদের জুলির সাথে।বিভান আর বেলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।সামনে ছোট সুইমিংপুলের মতো একটি জায়গা।তবে পানি গুলো থেকে ধোয়া বেরুচ্ছে।বিভান বলল,

''চলো একটু গা ভিজাই।"
''না না কি বলেন?এতো রাতে গরম পানিতে গা ভিজিয়ে গোসল করতে হবে আবার।"

বলেই সরে যেতে চাইলো বেলা।বিভান ওর কবজি ধরে বলল,

''গোসল এখন এমনিতে ও করতে হবে।তাহলে এখানে নামতে কোন সমস্যা নেই।"
''মানে?"

বেলা নিজের হাত ছাড়াতে চাইলো।বিভান ওকে নিয়ে জোর করে পানিতে নেমে গেলো।কুসুন গরম পানি সহ্য করার মতো।হালকা গোলাপের ঘ্রান আসছে।বেলার শাড়ী চিপচিপে ভিজে গেছে।বিভান হাসছে।বেলা উঠে যেতে চাইলে ওকে জড়িয়ে ধরে বিভান।বেলা কিছু বলতে গেলে বিভান ওর ঠোঁটজোড়ায় ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।
কিছুক্ষন পর সরে আসে বিভান।বেলা বলল,

''পাগল হয়ে গেলেন?কি করছেন?উঠে রুমে আসুন।"

বিভান বলল,

''উঠে আসলে একটা সুবিধা আছে।"

বিভান জাকুজি থেকে বেরিয়ে বেলাকে উঠাতে বলল।বেলা জিজ্ঞেস করে, 

''কি সুবিধা?"
''আলোয় তোমাকে দেখতে পাবো ভেজা শাড়ীতে কতো সুন্দর লাগছে।

!!!!

কুঞ্জনের কলেজের প্রিন্সিপালের সামনে বসে আছে নিশাদ। ওর চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে।কিছুসময় আগে ও কুঞ্জনের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো ওর যা মুহূর্তে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে।প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন,

''দেখুন মিঃ নিশাদ কুঞ্জন যাই করেছে বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে।ও খুব ভালো ছেলে ভালো ছাত্র।ওকে বুঝান ভালোমতো। ঠিক বুঝে যাবে ও।এখন উঠতি বয়স এটা আমরা ও পার করেছি মাত্র আঠারো বছর বয়সের বাচ্চা ছেলে বুঝ ও হয়নি এখনো।"

নিশাদ উঠে দাঁড়ায় শক্ত গলায় বলল,

''আমাকে যেতে হবে এখন।ধন্যবাদ ম্যাম।"

বলেই বেরিয়ে আসে নিশাদ।শার্টের কোনায় দুচোখ মুছে রিক্সায় উঠে বসে।পুরো পৃথিবীটা যেন মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়েছে।ছোট ভাইয়ের নামে এমন টা শুনবে কল্পনাও করেনি নিশাদ।গুঁমড়ে কেঁদে উঠে ও চুপ হয়ে যায়।কতোটা খারাপ লাগছে বুঝাতে পারবেনা।দুহাত দিয়ে মুখ চেঁপে বড় নিশ্বাস নেয়।কিন্তু শ্বাস নিতে পারছেনা।দমটা ও আজ ওর সাথে নেই।ছোট ভাইবোনদের পড়াশুনা করাতে গিয়ে কতো খাটতে হচ্ছে সেটায় কোন কষ্ট নেই কোন ক্লান্তি নেই। কিন্তু দিন শেষে এমন কিছু শুনলে ইচ্ছে করে নিজেকে শেষ করে দিতে।নিশাদের হঠাৎ বেজে উঠে।ফোন রিসিভ করে দেখলো বেলা কল করছে।নিশাদ নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করে।অপরপাশ থেকে বেলা বলল,

''কি খবর?"
''ভালো না আপা।"

বেলার বুক কেমন করে উঠে।নিশাদের কম্পিত কন্ঠে আৎকে উঠে ও।কি হলো ভাইটার?কাঁদছে কেন?বেলা জিজ্ঞেস করলো,

''নিশাদ কি হইছে তোর?"
''জানিস তোর ছোট ভাই কি করছে?"
''কে কুঞ্জন?"
''হুম।"
''কি করলো?"

বেলার বুক কাঁপছে।কিন্তু নিশাদ যা বলল এর পর যেন সব থমকে গেলো।নিশাদ বলল,

''কাল ওর দুটো ক্লাশমেটের সাথে দেখা হয়েছিলো।দুটোকে দেখলাম সিগারেট খাচ্ছে।আমি গিয়ে ওূের না করতেই বলল নিজের ভাইকে সামলান।ওরা বলছিলো কুঞ্জন ও ওদের সাথে সিগারেট খায়।একদম বিশ্বাস হয়নি আপা।আজকে যখন প্রিন্সিপাল ম্যামকে কল দিলাম ওনি বলল দেখা করতে।আর যখন গেলাম ওনি বলল কুঞ্জন ও খেয়েছে।ওর প্রথম ছিলো তাই টিসি দেয়নি।ঐ ছেলে গুলোকে টিসি  দিয়ে বের করে দিয়েছে।"

কথা গুলো বলে নিশাদের ভীষন রাগ হতে থাকে।বেলা নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছেনস কিন্তু নিশাদ যা বলল তা মিথ্যে নয়।বেলা বলল,

''নিশাদ যা করছে ও ভুল করছে।রাগারাগী করিসনা।বুঝায় দিস।"
''আপা তোর কেমনে মনে হলো রাগবো না আমি?আমি এতো কষ্ট করি এগুলার কি ওর কাছে মূল্য নাই?ও কি দিন দুনিয়া দেখেনা?সমাজ দেখেনা?আদনান কতো পড়াশুনা করছে কিন্তু এখনো জব হয়না।কতোবার মানা করছিলাম এগুলার সাথে না মিশতে।ও কানেই দেয়নি।"

বেলার ভয় লাগছে।নিশাদ কে বুঝাতে হবে নাহলে ও কুঞ্জনের সাথে কি করবে সেটা বেলা ভালো করেই জানে।তাই ও বলতে লাগলো,

''নিশাদ ও ছোট মানুষ।তুই বুঝা ঠান্ডা মাথায়।রাগারাগী করলে আল্লাহ না করুক কি করে ফেলে।প্লিজ ভাই!!"

কথা শেষ করতে পারেনা বেলা ফোন কেঁটে যায়।বেলা দেখলো ফোনে টাকা নেই।এদিকে বিভান ও ওয়াশরুমে গেছে।বেলার মাথা কাজ করছেনা।ওরা একটা জায়গায় এসেছে জুলির প্রোজেক্টের কাজে।এখানে শুধু গাছপালা আশেপাশে কোন দোকান ও নেই টাকা ভরার।এদিকে নিশাদ ঘরে পৌছে যায়।ঢুকেই কুঞ্জনের রুমে চলে আসে।কুঞ্জন অংক করছিলো।নিশাদ দরজা আটকে স্টিলের স্কেল হাতে নিয়ে চিৎকার করপ বলল,

''কিরে খুব বড় গেছোস না?বিয়া দিতে হবে?"

কুঞ্জন ভাইয়ের এ রুপ আরো অনেক দেখেছিলো কিন্তু আজ ওর সামনে। কুঞ্জন কম্পিত কন্ঠে বলল, 

''ভাই কি বলছিস এগুলা?"
''ভাই বলবি না।আমার ওপর গজব পড়ছিলো আমি কথা বলতেছি তোর সাথে।"

কথা গুলো বলেই কুঞ্জনের পিঠে হাতে মুখে স্কেল চালাতে লাগলো নিশাদ।কুঞ্জনের চিৎকারে জুলেখা বানু ইকরাম রাহমান, হুমায়রা লাবনী দৌড়ে এলো রুমের সামনে।সাঁঝ পড়াতে গেছে।শুক্রবার বলে সকালেই গিয়েছিলো।ভিতর থেকে কুঞ্জনের চিৎকার ভেসে আসছে।নিশাদ জোরে জোরে মারছে ওকে।জুলেখা বানু কাঁদতে কাঁদতে দরজায় ধাক্কা মারতে লাগেন।নিশাদ দরজা খুলছেনা।ওর অকথ্য ভাষার গালাগালি গুলা শুনে সবাই ভয় পেয়ে গেলো।ইকরাম রাহমান রেগে বেরিয়ে গেলেন।অনেকটা সময় পর নিশাদ বেরিয়ে আসে।ওর স্কেলে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত লেগে আছে।জুলেখা বানু ছেলেকে দেখে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন।কুঞ্জন বিছানায় পড়ে আছে নিথর দেহে।জুলেখা বানু দৌড়ে এসে ছেলের পিঠে হাত বুলাতে গিয়ে ভয় পেয়ে যান।শার্ট ভিজে গেছে।ঠোঁট,ভ্রুয়ের কোনা,গাল কেঁটে আছে।রক্ত গড়াচ্ছে সেখান থেকে।লাবনী ভাইকে দেখে কাঁদতে শুরু করে।ফোন লাগায় সাঁঝকে এরই মাঝে বিভানের কল আসে হুমায়রার নম্বরে। বেলার কল কেঁটে সাঁঝকে কল দেয় লাবনী।
বিভান বলল,

''ফোন ধরছেনা বেলা।হুমায়রা ও ধরছেনা আর না ধরছেনা নিশাদ।"
''সাঁঝকে দিন প্লিজ।"

বিভান সাঁঝের নম্বর ডায়াল করে।কিন্তু ফোন ওয়েটিং দেখাচ্ছে।বিভান ফোন সরিয়ে বলল,

''ওয়েটিং আসছে বেলা।টেনশন করোনা কিছু হবেনা।আল্লাহ ভরসা।"
বেলার ভীষন ভয় লাগছে।নিশাদের রাগ সম্পর্কে ওর ভালো ধারনা আছে।সাঁঝ আজকে সাইমন কে দেখে ও না দেখার ভান করে রিক্সায় উঠে যায়।সাইমন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো কিন্তু সাঁঝ এলো না।সাঁঝ জলদিই বেরিয়ে পড়েছে।কুঞ্জনের অবস্থা নাকি খুব খারাপ।ভাই খুব মেরেছে।সাঁঝের কান্না পাচ্ছে।তখনই বিভানের কল আসে।সাঁঝ ফোন রিসিভ করতেই বিভান বলল,

''নিশাদ কই?"
''বাসায়।কেন?"
''নিশাদ কে বল কুঞ্জনকে যোন বুঝায় না মারে।তোমার আপা ভয় পাচ্ছে।"
''ভাই আপনি আপার সামনে থাকলে সরে আসেন। "
''আচ্ছা।"

ফোন কান থেকে সরায় বিভান।বেলাকে বলল,

''কথা কেঁটে কেঁটে আসছে।আমি এখনি আসছি তুমি বসো।"
''কেন কি হলো?কুঞ্জন ঠিক আছে।নিশাদ বকা দিয়েছে।বসো তুমি।"

বিভান একটু দূরে সরে আসে।তারপর বলল,

''সব ঠিক আছে?"
''না ভাইয়া।বড় ভাইয়া খুব মারছে স্টেলের স্কেল দিয়ে।ব্লিডিং হচ্ছে কুঞ্জনের শরীর থেকে।ডাক্তার নিয়ে যেতে বলল।"
''নিশাদের এতোটা রাগ দেখানো ঠিক হয়নি।ও ছোট মানুষ ভুল হয়ে গেছে।যাই হোক জলদি যাও।কি হয় জানিও।"
''জি ভইয়া।"

বিভান কল কেঁটে দেয়। সাঁঝ পরিচিত একজন ডাক্তার নিয়ে ঘরে চলে আসে।কুঞ্জনের শার্ট খুলে দেয়া হয়েছে হুমায়রা ওর পিঠ ভেজা নরম কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছে।মা অথির হয়ে পড়ে আছে।সা্ঝ অজান্তে কেঁদে দেয়।কুঞ্জনের কোন খবর নেই।লাবনী কান্না করছে পাশে দাঁড়িয়ে।সাঁঝ হুমায়রা কে বলল,

''হয়নি তোর?"
''রক্ত অনেক।প্রায় শেষ।"
''ডাক্তার আসছে।তোর হলে বেরিয়ে আয়।"

লাবনী আর হুমায়রা বেরিয়ে এলো।ডাক্তার ঢুকে কুঞ্জনের রুমে।ঢুকেই বলল,

''এভাবে কেউ কাউকে মারে?কি অবস্থা করলো ছেলেটার।"

সাঁঝ বাবাকে কল দেয়।ওনি কল ধরতেই সাঁঝ রেগে বলল,

''আব্বা কই আপনি?"
''কেন?কেন জানতে চাস?নাটক করোস সব গুলা।তোর ভাই ঘরে এসে এক নাটক জুড়ায় দিলো এখন তোরা কি নাটক কইরতে বসে আছোস?"
"আব্বা এটা কেমন কথা?ভাই ওকে মারতেছিলো আপনি বাহির হয়ে গেলেন।থামাইলেননা কেন?কি অবস্থা জানার চেষ্টাও করেননাই।ঘরে আসেন।"

ইকরাম রাহমান আসতেছি বলে কল কেঁটে দেয়।হুমায়রা কে জিজ্ঞেস করলো, 

''মারলো কেন ভাইয়া?"
''জানিনা আপু।ঘরে ঢুকেই মারতে লাগলো দরজা আটকায়।আম্মা কতোবার দরজা নক করলো খুললোই না।"

হঠাৎ পাশ থেকে লাবনী বলল,

''আপু ভাইয়া জেনে গেছে মনে হয়।"
''কি?"

জিজ্ঞেস করে সাঁঝ।হুমায়রা ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাকায়।লাবনী বলল,

''কুঞ্জন ভাইয়া স্কুলে তিনটা ছেলের সাথে সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা খাইছিলো।প্রিন্সিপাল ম্যাম ওকে মাফ করে দিয়েছিলো।"

সাঁঝ কিছু বললনা।ভ্রু কু্ঁচকে চেয়ে রইলো।হঠাৎ ওর মনে হলো নিশাদ কি করছে।ও হেঁটে নিশাদের রুমে এসে দেখলো উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে নিশাদ।সাঁঝ বলল,

''মেরে ফেলতি ওকে।মারোস নাই কেন?ছোট মানুষ ভুল করছে মেরে ফেলতি।তোরা বড় হইছোস তাই যা মন চায় করবি।"

কিন্তু নিশাদের কোন খবর নেই।পাশে রক্তাক্ত স্কেল টা পড়ে আছে।সাঁঝ স্কেল টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়।ডাক্তার ঔষধ লিখে দিয়ে চলে যায়।কুঁঞ্জন চোখ খুলছে ও না।পুরা পিঠে ব্যান্ডেজ।হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ মুখে আর পায়ে ও জায়গায় ব্যান্ডেজ।ইকরাম রাহমান আর জুলেখা বানু ছেলের পাশে বসে আছে।জুলেখা বানু কাঁদছেন।ইকরাম রাহমান অশ্রু সজল চোখে ছেলের পিঠে হাত বুলান।এদিকে লাবনী এসে বলল,

''আব্বা ভাইয়া কথা বলেনা।অনেক ডাকলাম উঠে ওনা।শরীর পুরো ঠান্ডা হয়ে গেছে।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন