জীবন অফিসে চলে গেলে স্পৃহা এতক্ষণ রুমেই বসে ছিল। সারাটা দিন কি সে এই রুমেই বসে থাকবে? কি করবে সে? কীভাবে সময় কাটাবে। বড় আম্মুকে ছাড়া তো কারো সাথে কথাও হয়নি তার। স্পৃহা নিচে যাবার জন্য রুম থেকে বের হলো। পেছন থেকে তাকে কেউ একজন ডাকলো।
'এই মেয়ে এদিকে এসো।'
স্পৃহা বুঝতে পারছে না। একটা মেয়ে তাকে ডাকছে। কে এই মেয়ে? সম্পর্কে জীবনের কি হয়? স্পৃহা তাকে কি বলে ডাকবে?
আরশি বলল,
'হ্যা তোমাকেই ডাকছি। এদিকে এসো।'
স্পৃহা এগিয়ে গেলে আরশি ভালো করে স্পৃহার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,
'কে তুমি?'
স্পৃহা বুঝতে পারছে না সে কি বলে নিজের পরিচয় দিবে। আস্তে করে স্পৃহা বলল,
'আমার নাম স্পৃহা।'
'ওহ্। এবাড়িতে নতুন এসেছ?'
'হুম। '
'দেখেই বুঝতে পেরেছি তুমি নতুন কাজের লোক। তা তুমি উপরে কি করছো হ্যা? তুমি জানো না আমাদের বাড়ির কাজের লোকেরা দোতলায় আসে না। এখন যাও আমার ব্রেকফাস্ট আমার রুমে নিয়ে আসো।'
সকালে খাবার টেবিলে আরশি ছিল না। তাই সে স্পৃহাকেও চিনতে পারেনি। সে ভেবেছে স্পৃহা হয়তো নতুন কাজের লোক। আরশির মুখে কাজের লোক কথাটা শুনে স্পৃহার চোখ ছলছল করছে। আরশি আবার বলল,
'কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? কি বলেছি শুনতে পাও নি। আমার খাবার রুমে দিয়ে যাও।'
'স্পৃহা এই বাড়ির কাজের লোক না আরশি। তুই অন্য কাউকে তোর খাবার আনতে বল।'
জীবন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কথাটা বলল। আরশি আর স্পৃহা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। জীবন ভেতরে এসে আরশির সব কথাই শুনেছে।
আরশি কপাল কুঁচকে বলল,
'ও কাজের লোক না?'
জীবন স্পৃহার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
'না। স্পৃহা এবাড়ির বৌ। আমার স্ত্রী। আর তোর ভাবী।'
জীবনের কথা শুনে আরশি হতভম্ব হয়ে রইলো। চোখ কপালে তুলে প্রায় চেঁচিয়ে বলল,
'এই মেয়েটা তোমার ওয়াইফ?'
'হ্যা।'
'তুমি ওকে বিয়ে করতে পারো না।'
জীবন মুখ বাকিয়ে হেসে বলল,
'কেন পারি না?'
'কারণ তুমি নূপুরকে ভালোবাসো।'
'ওটা এক সময় বাসতাম। কিন্তু এখন বাসি না।'
'আমি তোমার এই বিয়ে মানি না।'
জীবন এবার শব্দ করে হেসে ফেলে বলল,
'আমার বিয়ে তুই না মানার কে? স্পৃহাকে আমি বিয়ে করেছি। ও আমার বৌ। এটা তুই না মানলেও আমার কিছু যায় আসে না। বা তোর মানা আর না মানাতে এই সত্য পরিবর্তনও হবে না।'
আরশি জীবনের শার্টের কলার ধরে বলল,
'তুমি এটা করতে পারো না। তুমি জানো আমি তোমাকে,,,, '
জীবন এক ঝটকায় আরশিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
'একটা থাপ্পড় দিয়ে তোর সব কটা দাঁত ফেলে দিব অসভ্য মেয়ে। আমি তোর বড় ভাই। তোর সাহস কি করে হয় আমার শার্টের কলার ধরার? নেক্সট টাইম থেকে এমন কিছু করার সাহস করিস না।যদি করিস তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। তুই আমার বিয়ে না মানার কে? আমি তোর থেকে অনুমতি নিয়ে বিয়ে করবো? স্পৃহা আমার স্ত্রী। ওকে সম্মান করতে না পারলে অসম্মানও করতে পারবি না। মনে রাখিস কথাগুলো।'
আরশি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন স্পৃহার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আরশির সামনে থেকে চলে গেল। রুমে এসে পকেট থেকে ফোন আর ওয়ালেট বের করে বেডে ছুড়ে রাখলো। স্পৃহা আরশি আর জীবনের কথা কিছুই বুঝতে পারে নি। ভাই বোনের সম্পর্ক এমন হয় নাকি? জয় আর স্পৃহা তো এমন না। জীবন রাগে ফুসছে।
'ওর সাহস কি করে হয় এভাবে কথা বলার? কিছু না বলতে বলতে দিনদিন ওর সাহস বেড়ে গেছে।'
স্পৃহা জীবনের রাগের কারণ ধরতে পারছে না। আরশি তাকে কাজের লোক বলেছে এজন্য জীবন রাগ করেছে? নাকি জীবনের সাথে ওভাবে কথা বলেছে বলে রাগ করেছে?
দাঁতে দাঁত চেপে জীবন আবার বলল,
'তখন সাথে সাথে এক চড় বসিয়ে দিলে এমন করার সাহস পেত না।'
স্পৃহা ভয়ে ভয়ে জীবনের কাছে গিয়ে আস্তে করে বলল,
'আপনি রাগ করবেন না প্লিজ।'
জীবন স্পৃহার দিকে তাকানো মাত্রই যেন তার রাগ কমে গেল। শান্ত গলায় বলল,
'তুমি রুম থেকে বের হয়েছিলে কেন? '
'সারাদিন কি আমি রুমে বসে থাকবো?'
স্পৃহা এই প্রথম জীবনের কথার পিঠে কথা বলেছে। কাল ওদের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে এটাই জীবনের সাথে স্পৃহার প্রথম কথা। জীবন উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
'রুমে বসে থাকবে না। কিন্তু আরশির সাথেও কথা বলবে না। বড় আম্মুর কাছে থাকবে সব সময়। আর কিছু লাগলে খালাকে বলবে।'
জীবন শার্ট খুলে বেডের উপর রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। স্পৃহা শার্ট হাতে নিলো গুছিয়ে রাখার জন্য। জীবন বের হয়ে এলে স্পৃহা বলল,
'আপনি তো অফিসে গিয়েছিলেন। এতো তাড়াতাড়ি ফিরে,,, '
প্রশ্ন শেষ করার আগেই জীবন উত্তর দিয়ে দিলো।
'জয় আসবে। আমাদের সাথে লাঞ্চ করবে। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছি।'
'ভাইয়া আসবে? '
'হুম। ফোন করে তো আসতে বলেছি।'
জয় এসেছে। জীবন স্পৃহা জয় এক সাথে বসে খাচ্ছে। ফরিদা রুমে চলে গেছেন। আজ উনার শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না। জয় খেতে খেতে স্পৃহাকে জিজ্ঞেস করলো,
'ভেবলি এখানে তোর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?'
স্পৃহা মাথা নাড়িয়ে না করলো,
'উঁহু।'
'জীবন তোর ঠিকঠাক খেয়াল রাখছে? নাকি আমার বোনটার অযত্ন হচ্ছে?'
জীবন পাতে তরকারি নিতে নিতে বলল,
'স্পৃহা বলে দাও তো, জয়দের বাসায় থাকতে তোমার যতটা যত্ন হয়েছে এখানে আসার পর তার থেকে বেশি হচ্ছে।'
'হুম এটাই ভালো। আমার বোন কষ্ট পেলে কিন্তু তোর খবর আছে।'
'ওরে শালা। আমার বাড়িতে বসে আমাকেই ধমকি দেয়া হচ্ছে।'
'এই শালা বলবি...'
জয় থেমে গেল। জীবন হেসে বলল,
'বল কি বলছিলি? শালা বলবি না এটাই বলছিলি তো?'
জীবন হাসছে। আগে জীবন জয়কে শালা বললে জয় তাকে বারণ করতো। কিন্তু এখন তো বারণ করতে পারবে না।
'তোর বড় আব্বু, বড় আম্মু বিয়েটা কীভাবে নিয়েছে? '
'সবাই খুশি হয়েই মেনে নিয়েছে। বড় আব্বু তো বলছিল বিয়ে উপলক্ষে পার্টি রাখবে। হঠাৎ করে বিয়েটা হওয়ায় কাউকেই জানানো হয়নি।'
'হুম ভালো।'
আরশি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে টেবিলের উপর বাবার সামনে ব্যাগটা শব্দ করে রাখলো। রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
'এটা কি হলো ড্যাড?'
'কি হয়েছে? '
'তুমি জানো না কি হয়েছে? সকালে তুমি বাসা থেকে আসো নি? জীবন বিয়ে করেছে। ওর বৌকে তুমি দেখো নি?'
আনোয়ার হোসেন শান্ত থেকেই বললেন,
'জানি। আর দেখেছিও।'
'তুমি সব জেনেও কীভাবে শান্ত আছো? কিছু করছো না কেন তুমি? তুমি তো বলেছিলে জীবনের সাথে আমার বিয়ে হবে। যেভাবেই হোক তুমি সেটা সম্ভব করবে। তাহলে এখন জীবন ঐ মেয়েটাকে কীভাবে বিয়ে করতে পারলো? কীভাবে ড্যাড?'
'জীবন বিয়ে করবে এই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। হয়তো জীবন আমাদের প্ল্যান নষ্ট করার জন্য এমন কিছু করেছে।'
'আমি কিছু জানি না ড্যাড। তুমি ঐ মেয়েটাকে জীবনের লাইফ থেকে দূর করো। যেভাবেই হোক তুমি ওদের ডিভোর্স করিয়ে দাও।'
'রিলাক্স আরশি। মাথা গরম করে সব সময় সব কাজ করা যায় না। কিছু কাজের জন্য ধৈর্য ধরতে হয়। কিছু পাওয়ার জন্যও অপেক্ষা করতে হয়।'
'কীভাবে রিলাক্স থাকবো ড্যাড? তুমিই বলো,ঐ মেয়েটা আমার চোখের সামনে দিয়ে ঘুরবে আর আমি ওকে দেখে রিলাক্স থাকবো? খুশি খুশি ওদের বিয়ে মেনে নিব? নো ড্যাড। তুমি কিছু না করলেও আমি তো কিছু একটা অবশ্যই করবো। ঐ মেয়েটাকে এতো সহজে আমি ছেড়ে দিব না। ও আমার জায়গা নিতে চাচ্ছে আমি ওর লাইফ হেল করে দিব। তুমি দেখে নিও।'
আরশি ব্যাগ নিয়ে বাবার অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। আনোয়ার হোসেন আরশির পাগলামি দেখে বিরক্ত হচ্ছেন। তিনি দু'হাত টেবিলের উপর রেখে বললেন,
'এই মেয়েটা একটুতেই এতো অধৈর্য হয়ে পড়ে কেন? কেন বুঝতে চায় না সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। শুধু শুধু মাথা গরম করে আমার বানানো সব প্ল্যান নষ্ট করে দেয়।'
আনোয়ার হোসেন জানালেন দু'দিন পর তিনি বাড়িতে পার্টি রেখেছেন। সব আয়োজন তিনিই করবেন। পরিচিত সবাইকে ইনভাইট করেছেন। জীবনকে বলেছে তার চেনা জানা সবাইকে ইনভাইট করতে। আরশি বাবার উপর খেপে আছে। কোথায় বাবা ঐ মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করবে। তা না করে পার্টি এ্যারেঞ্জ করছে। কোনো মানে হয় এসবের! পার্টির দিন জীবন সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পার্টি রাতে হবে। তবে সকাল থেকেই আয়োজন চলছে। এবাড়িতে স্পৃহার কোনো কাজ নেই। বড় আম্মু রান্নাঘরে যেতেই দিচ্ছে না। জীবন তাকে রুম থেকেই বের হতে দেয় না। সকালে নিজের সাথে বসে খাওয়ায়। দুপুরে খালাকে বলে যায় স্পৃহার খাবার রুমে দিয়ে আসতে। রাতে জীবন অফিস থেকে আগে আগে ফিরে আসে। জীবন আরশিকে স্পৃহার ধারের কাছেও ঘেঁষতে দেয় না। বেরিয়ে যাবার আগে জীবন স্পৃহাকে ডাকলো,
'স্পৃহা! স্পৃহা!'
স্পৃহা রুমে এসে বলল,
'ডেকেছেন? '
'হুম। কোথায় ছিলে এতক্ষণ? '
'জেঠি মা'র কাছে। আপনি কি কোথাও বের হচ্ছেন? '
'হুম। দুপুরের আগে ফিরে আসবো। আর আসতে দেরি হলে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিও। কিছু লাগলে খালাকে ডাকবে। আর আরশির সাথে একদম কোনো কথা বলবে না।'
জীবন বেরিয়ে যাবার সময় স্পৃহা জিজ্ঞেস করলো,
'কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'
কথাটা স্পৃহা নিচের দিকে তাকিয়ে বলেছে। জীবন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে স্পৃহার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
'সেটা আমি ফিরলেই দেখতে পারবে। এখন আসি।'
জীবন চলে যাবার পর স্পৃহা রুমেই বসে রইলো। নিচে পার্টির আয়োজন চলছে। বিকেলেই মানুষ আসতে শুরু করবে। স্পৃহা আগে কখনো পার্টিতে যায় নি। ওদের বাসায়ও কোনোদিন পার্টি হয়নি। বড়লোকদের এসব পার্টির অভ্যাস থাকে তাদের নেই। তারা মধ্যবিত্ত। খুব সাধারন ভাবেই তারা বড় হয়েছে। তাদের জীবনযাপনে বিলাসিতা নেই।
দুপুরে জীবন স্পৃহার বাবা মা আর তোহাকে নিয়ে ফিরে এসেছে। স্পৃহা বাবা মা'কে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। মা'কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। তানিয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
'কাঁদছিস কেন পাগলী মেয়ে? আমরা তো তোকে দেখতেই এসেছি। কেমন আছিস তুই?'
'আমি ভালো আছি মা। তোমরা কেমন আছো?'
স্পৃহা মা'কে ছেড়ে বাবার কাছে গেল। বাবার বুকে মাথা রেখে বলল,
'বাবা তুমি এতো রোগা হয়ে গেছো কেন? ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো না, তাই না?'
'তুই নেই আমার খাওয়া দাওয়ার খেয়াল কে রাখবে বল তো মা?'
তোহা স্পৃহার কাছে এসে বলল,
'আপু তুমি আমাকে দেখছো না নাকি? আমিও এসেছি। আমাকেও একটু আদর করো।'
স্পৃহা কান্নার মাঝেই হেসে দিয়ে বলল,
'আমার বোনটা! কেমন আছিস তুই? আমাকে মিস করেছিস?'
তোহা ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
'অনেক মিস করেছি আপু। আমি আগে জানতামই না আমি যে তোমাকে এতটা ভালোবাসি। তুমি চলে আসার পর বুঝতে পারলাম। আমরা সবাই তোমাকে অনেক মিস করি।'
স্পৃহা তোহাকে ছেড়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,
'তোমরা একাই এসেছো? খালামণি জয় ভাইয়া ওরা কোথায়? ওরা আসবে না?'
তানিয়া বললেন,
'আমাদের তো জীবন গিয়ে নিয়ে আসলো। তোর খালামণিরা পরের দিনই চলে এসেছিল। ওরা এখান থেকেই আসবে।'
জীবন ওদের গিয়ে নিয়ে এসেছে শুনে স্পৃহা জীবনের দিকে তাকালো। জীবন পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ চুপ করে ওদের কান্নাকাটি,ভালোবাসার মুহূর্ত উপভোগ করছিল। স্পৃহা বাবা মা'কে দেখে কতটা খুশি হয়েছে। এখান আসার পর থেকে স্পৃহার কোনোকিছুতে মন লাগছিল না। এটা জীবন ভালোই বুঝতে পারছিল। তার বাবা মা নেই। হঠাৎ করে বাবা মা'কে ছেড়ে থাকতে একটা কষ্ট হয় তা জীবন জানে। আপনজনদের থেকে দূরে থাকা সহজ কাজ নয়। জীবন খালাকে ডেকে বলল,
'খালা আপনাকে সকালে যে রুমটা গুছিয়ে রাখতে বলেছিলাম, আপনি বাবা মা'কে ঐ রুমে নিয়ে যান। উনারা ফ্রেশ হয়ে সারলে কিছু খেতে দিবেন। অনেকটা পথ এসেছে। আর বড় আম্মুকে বলবেন উনারা চলে এসেছেন।'
খালাকে কথাগুলো বলে জীবন পলাশ আর তানিয়াকে উদেশ্য করে বলল,
'মা বাবা আপনারা রুমে যান। রেস্ট নিন। আমি একটু পরে আপনাদের কাছে আসছি। বড় আম্মু, বড় আব্বুর সাথে নাহয় রাতে আলাপ করিয়ে দিব। এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হোন।'
জীবন নিজের রুমে চলে গেল। স্পৃহা বাবা মা তোহাকে রুমে দিয়ে চলে এসেছে। সে রুমে এসে জীবনকে খুঁজতে লাগলো।
'কোথায় গেলেন উনি? রুমের দিকেই তো আসছিলেন।'
জীবন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
'কিছু খুঁজছো? '
স্পৃহা জীবনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
'আপনি বাবা মা'কে আনতে গিয়েছিলেন?'
জীবন ওয়ারড্রব থেকে টিশার্ট বের করে গায়ে পরতে পরতে বলল,
'হুম গিয়েছিলাম। বাবা মা আগে কখনো আমার বাসায় আসেন নি। এই প্রথম আসছেন। বাসা চিনতে যদি অসুবিধা হয়,তাই আমি নিজে গিয়েই নিয়ে আসলাম।'
জীবন যে শুধু স্পৃহার খেয়াল রাখে তা না। জীবন স্পৃহার পরিবারেরও খেয়াল রাখে। সত্যিই স্পৃহা ভাগ্য করে এই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে। জীবন স্পৃহার সামনে এসে বলল,
'আমি বাবা মায়ের কাছ দেখে ঘুরে আসি। দেখি উনাদের কিছু লাগবে কিনা।'
জীবন বেরিয়ে গেল। স্পৃহার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে কি খুশিতে কাঁদছে?
ফরিদা স্পৃহার বাবা মা'র সাথে আলাপ করেছেন। জীবন গিয়ে উনাদের নিয়ে এসেছেন শুনে খুশি হয়েছেন। নিচে যাবার সময় ফরিদা স্পৃহাকে সাথে নিয়ে গেলেন।
'দেখলে তো মা আমার জীবন কেমন ছেলে? আমি জানি না তুমি ওকে কতটা জানো। পরেও আমি বলছি, জীবনের মত ছেলে হয় না। জীবন তার বাবা মা'কে হারিয়েছে। আমার আধপাগল ছেলেটা জানে বাবা মা'র ভালোবাসা কি জিনিস। সে তো ছোট থেকেই বাবা মা'কে অনেক ভালোবাসতো। তবুও আল্লাহ ওর থেকে ওর বাবা মা'কে দূর করে দিলেন। এই জীবনে পাগলটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন তুমি ওর বৌ হয়ে ওর জীবনে এসেছ। তুমি ওকে কষ্ট পেতে দিও না। ওর জীবন থেকে সব কষ্ট দূর করে সুখ দিয়ে ওর জীবনটা ভরিয়ে দিও।'
'জেঠিমা উনার বাবা মা কীভাবে মারা গেছেন? '
'কার অ্যাক্সিডেন্টে। আমার বোন তার একমাত্র ছেলেকে একা রেখে না ফেরার দেশে চলে গেলে।'
'উনার মা আপনার বোন? '
'হুম। আপন বোন।'
স্পৃহা আগে জানতো না জেঠিমা জীবনের খালাও হন। তাইতো জীবন অন্য সবার সাথে একরকম আচরণ করে আর জেঠি মা'র সাথে অন্যরকম আচরণ করে। জেঠি মা'ও এইজন্যই জীবনকে এতো ভালোবাসে।
'জীবন সবার থেকে আলাদা। নিজের কষ্ট ও কারো সাথে শেয়ার করে না। ওর বাবা মা মারা যাবার পর থেকে আমি ওকে কখনো কাঁদতে দেখি নি। ছেলেটা কখনো কাঁদে না। কষ্ট গুলোকে নিজের মনের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। তুমি ওর খেয়াল রেখো মা। আমার ছেলেটাকে নতুন করে আর কোনো কষ্ট পেতে দিও না।'
পুল সাইডে দাঁড়িয়ে জীবন ফোনে কথা বলছে।
'ভাইয়া তুমি আসবে না?'
'নারে। তোর কথা রাখতে পারলাম না। ক্ষমা করে দিস।'
'এটা কেমন কথা ভাইয়া? তোমার বাসায় তুমি আসবে না কেন? আমি বিয়ে করেছি। তুমি আমার বৌকে দেখতেও আসবে না? '
'আসবো না কেন? অবশ্যই আসবো। কিন্তু তোর বাসায়। তুমি ওখানে গেলে জানাস।'
'ধ্যাত। তুমি কেন এমন করো বুঝি না। আমিও তো থাকছি এ বাসায়। তুমি কেন থাকতে পারবে না।'
'আমি ঐ লোকটার সামনে পরতে চাই না। ওকে দেখলেই রাগে আমার শরীর জ্বলে। এই লোকটাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না মানুষ যে এতটা সেলফিশ হয়। ও কাউকে নিয়ে ভাবে না। কারো সুখ ওর কাছে ম্যাটার করে না। ও শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবে।'
'ভাইয়া বাদ দাও তো ওসব কথা। ভাবী কেমন আছে?'
'ওর শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। এই সময় বেবিটা নেয়া সত্যিই ভুল হয়েছে। ও খুব দুর্বল হয়ে গেছে।'
'ভাবীকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাও। সবথেকে ভালো হবে তুমি ভাবীকে নিয়ে বাসায় চলে এসো। এখানে সবার সাথে থাকবে। বড় আম্মু ভাবীর খেয়াল রাখবে।'
'না। আমি আর কখনোই ওই বাসায় যাব না।'
'আচ্ছা। তোমার ইচ্ছে নেই তাহলে আর রিকোয়েস্ট করবো না। রাখছি এখন। সময় করে একদিন তোমাদের কাছে যাব।'
'আসিস। তোরা এলে ও খুব খুশি হবে। আর নূপুরকে আমার হয়ে কনগ্রেস জানাস।'
'হুম। '
কল কেটে জীবন ফোন পেকেটে নিয়ে পুলের পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। নূপুরকে সে বিয়ে করেনি। সে বিয়ে করেছে স্পৃহাকে। নূপুর তাকে ধোঁকা দিয়েছে। এই কথা সে রামিম ভাইয়াকে বলতে পারলো না। অনেকক্ষণ হয়েছে জীবন নিচে আছে। স্পৃহাকেও দেখছে না। কোথায় আছে এই মেয়ে? জীবন স্পৃহার খুঁজে রুমের দিকে যাচ্ছে। তোহা স্পৃহার কাপড় একটা একটা করে ব্যাগ থেকে বের করে বিছানায় ছুড়ে রাখছে।
'কি আপু তোমার তো একটাও ভালো ড্রেস নেই। এগুলো পড়ে তুমি পার্টিতে যাবে নাকি? ওসব ড্রেস তো মানুষ বাসায়ও পড়ে না।'
যেই কাপড় গুলো নিচে পরছে স্পৃহা তা তুলে রাখতে রাখতে বলল,
'এই সবগুলোই ভালো ড্রেস। কিন্তু তোর চোখে তো কিছুই ভালো লাগে না। তাই এগুলোও ভালো লাগছে না।'
'আপু তুমি ক্ষেত মার্কা কথা বলো না তো। এগুলো পার্টিতে পড়ে যাবার মত ড্রেস? এসব পড়ে রাতে পার্টিতে গেলে লোকে তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। সবার সামনে তুমি জীবন ভাইয়ার বদনাম করতে চাও?'
স্পৃহা মুখ কালো করে বলল,
'তাহলে কি করবো আমি? আমার কাছে তো এগুলোই আছে। আসার সময় তুই-ই তো ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছিস।'
'হুম। কিন্তু আমি তো তখন জানতাম না। তোমার বর বাসায় এসেই পার্টি রাখবে।'
জীবন রুমে ঢুকছিল। তোহার কথা শুনে সে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে গেল। ভেতরে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়েই দু'বোনের কথা শুনতে লাগলো। জীবন আর ভেতরে গেল না। পকেট থেকে ফোন বের করে জয়কে কল করলো,
'কোথায় তুই?'
'এইতো তোর বাসায়ই আসছি।'
'তোর আসতে হবে না। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুই আন্টি আঙ্কেল মারিয়া আপুকে পাঠিয়ে দে।'
'আমি আসবো না? আমাকে আসতে না করছিস?'
'আরে গাধা আগে ফুল কথা শোন তারপর রিঅ্যাক্ট কর। হাফ কথা শুনে আগেই লাফিয়ে উঠিস না।'
'তুই-ই তো বললি আমাকে আসতে হবে না।'
'তুই আমার সাথে এখন একটু শপিংমলে যাবি। তাই তোকে এখন আসতে না করছি। শপিং শেষ করে দু'জন একসাথে ফিরবো।'
'স্পৃহার জন্য কিছু নিবি তাই তো? '
'না তোর জন্য নিব। এবার চলে আয় তো।'
'জিজাজি সোজা কথা সোজা ভাবে বলে দিলেই তো পারো। তুমি আমার বোনের জন্য শপিং করতে যাচ্ছ।'
'হ্যা ভালো হয়েছে। আমি আমার বৌয়ের জন্য শপিং করবো। তুই এতো কথা বলছিস কেন?'
'ঐদিন খুব তো বলছিলে বিয়ে করলেও ভালোবাসতে পারবে না। এখন তো দেখছি ভালোবাসায় হাবুডুবু খাচ্ছ।'
'ধুর তোর সাথে কথা বলাই বেকার। ফাও পেচাল পারিস তুই।'
খালামণি মারিয়া এসেছে দেখে স্পৃহা অনেক খুশি হয়েছে। কিন্তু জয় ওদের সাথে আসেনি দেখে স্পৃহা মন খারাপ করে বলল,
'ভাইয়া কোথায় খালামণি?'
'আরে আর বলিস না। বের হওয়ার সময় কার যেন ফোন এলো। আর সে ছুটে চলে গেল। বলেছে বিকালে চলে আসবে।'
মারিয়া স্পৃহাকে নিয়ে ওর ঘরে চলে গেল। তোহাকে স্পৃহার রুম থেকে বের করে দিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল,
'ঘরটা তো সুন্দরই। বেশ ফাঁকা ফোকা। অনেক জায়গা আছে। কি হলো তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস আমার পাশে।'
স্পৃহা বসে বলল,
'সোম ভাইয়া আসবে না?'
'রাতে আসবে। এখন অফিসে আছে। এই স্পৃহা জীবন তোর খেয়াল রাখে তো?'
'হুম।'
'এখানে আসার পর কেউ তোকে কিছু বলেছে?'
'না।'
মারিয়া আমতা আমতা করে বলেই ফেললো,
'স্পৃহা তোদের বাসর হয়েছে? '
মারিয়ার কথা শুনে লজ্জায় স্পৃহার নাক মুখ লাল হয়ে গেল। স্পৃহা উঠে দাঁড়িয়ে গেলে মারিয়া তাকে টেনে বসিয়ে বলল,
'কোথায় যাচ্ছিস। বোস চুপ করে। আর যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।'
'আপু এসব কেমন কথা!'
'কেমন কথা মানে? ওভাবে তাড়াহুড়ো করে এক দিনে তোদের বিয়েটা হলো। আমরা কেউ এখানে আসিনি। তোদের বাসরঘর সাজানো হয়েছে কিনা তাও জানি না। যেভাবেই হোক বিয়েটা যেহেতু হয়েছে। তাই তোদের বাসরও হওয়ার কথা।'
স্পৃহা আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
'আপু,,,
মারিয়াও উঠে দাঁড়িয়ে গেল। বলল,
'কিসের আপু? আমি তোর বোন না। আমার কাছে কিসের লজ্জা। তোদের বাসর হয়েছে কিনা তা জানতে চাওয়া পাপ নাকি? শুধু তো বিয়ে করলেই হবে না। সংসারও তো করতে হবে। ফ্যামিলিতে বাচ্চা কাচ্চা না আসলে কীভাবে হবে? দেখবি একটা বেবি নিলেই তোদের মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে।'
'আপু কিসব বলছো তুমি! '
স্পৃহা মারিয়ার থেকে একপ্রকার পালিয়ে গেল।
বিকেলে জীবন জয়কে নিয়ে ফিরে এসেছে। রুমে এসে স্পৃহাকে না পেয়ে ব্যাগটা আলমারিতে রেখে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। পার্টির সব আয়োজন শেষ। একটু পর থেকেই লোকজন আসতে শুরু করবে। আনোয়ার হোসেন বেশ ভালো ভাবেই স্পৃহার বাবা মা খালা খালুর সাথে কথা বলেছেন। জীবন বিকাল থেকে সবার মাঝে একজনকেই খুঁজছে। কিন্তু সে মানুষটাকে কোথাও দেখতে পারছে না।
'কোথায় গিয়ে বসে আছে স্পৃহা? এই মেয়েটা কি আমাকে ভয় পায়? নাকি আমার সামনে আসতে ওর লজ্জা লাগে? যতক্ষণ বাসায় থাকি সারাক্ষণ সে আড়ালে আড়ালে থাকে। ডাকলে কাছে আসে। আর নয়তো ভুলেও সামনে পরবে না। আজব মেয়ে একটা।'
রাতে মারিয়া স্পৃহাকে শাড়ি পরিয়ে রেডি করে দিয়েছে। জীবন রুমে ছিল না। হঠাৎ রুমে এসে স্পৃহার উপর তার চোখ আটকে গেল। স্পৃহা লাল রঙের শাড়ি পরেছে। জীবনের সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিনও স্পৃহা লাল শাড়িই পড়ে ছিল। মারিয়া জীবনকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
'আরে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমারই রুম তুমি নক না করেও আসতে পারো।'
জীবন ভেতরে এসে দাঁড়াল। তবে তার চোখের এখনো স্পৃহাতেই আটকে আছে। মারিয়া তা লক্ষ করে মুচকি হেসে বলল,
'এই নাও তোমার বৌকে রেডি করিয়ে দিয়েছি। ভালো করে দেখে বলো তো কোনোকিছুর কমতি আছে কিনা? আমি কিন্তু ভাই প্রফেশনাল না। এই একটু আধটু সাজাতে পারি আর কি।'
'কোনোকিছুর কমতি নেই। সবকিছুই একদম পারফেক্ট আছে।'
মুখ ফসকে জীবন কথাটা বলে ফেলেছে। এখন নিজের কাছেই কেমন বোকা বোকা লাগছে। মারিয়া আপুর সামনে আরো বোকা হওয়ার আগে জীবন নিজেকে সামলে নিলো। মারিয়া বলল,
'আবার তাহলে নিচে চলো।'
জীবন বলল,
'আপু আপনি যান। আমরা দুমিনিটে আসছি। '
'আচ্ছা আসো। তবে বেশি সময় নিও না কিন্তু। পার্টিটা তোমাদের জন্যই দেয়া হচ্ছে।'
মারিয়া চলে গেলে জীবন স্পৃহার সামনে এসে দাঁড়াল। পা থেকে মা পর্যন্ত ভালো করে একবার স্পৃহাকে দেখে নিলো। আলমারি থেকে ব্যাগটা বের করে এনে স্পৃহার হাতে দিল। স্পৃহা জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল,
'এটা কি?'
'তোমার জন্য। এতে একটা ড্রেস আছে। এটা পরেই তুমি আজ পার্টিতে যাবে।'
'কিন্তু আমি তো রেডি হয়ে গেছি।'
জীবন স্পৃহার পেটের দিকে তাকিয়ে বলল,
'দেখতেই তো পারছি কেমন রেডি হয়েছো। ঐ দিনের মত আজও পেট দেখা যাচ্ছে। ওসব শাড়ি পড়া তোমার কাজ না স্পৃহা। তুমি শাড়ি চেঞ্জ করে এটা পড়ে এসো।'
জীবনের কথা শুনে স্পৃহার লজ্জার শেষ রইলো না। মুহুর্তেই নাম মুখ লাল হয়ে গেল। জীবন ব্যাপারটা ধরতে পেরে মুচকি মুচকি হাসছে। এই মেয়েটা কাঁদলে, লজ্জা পেলে একে দেখতে আরো সুন্দর লাগে। নাকের ডগার লালচে ভাবটা জীবনকে স্পৃহার দিকে টানে।
'কি হলো যাও। চেঞ্জ করে এসো।'
স্পৃহা ব্যাগ হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। জীবন বেডে বসে শব্দ করে হাসলো। ইচ্ছে করেই একটু আগে সে স্পৃহাকে লজ্জায় ফেলেছে। এই মেয়েকে লজ্জা পেতে দেখতে জীবনের মজাই লাগে। জীবন ভাবছে,
'সামান্য কথাতেই এই মেয়ে এতো লজ্জা পায় কেন?'
স্পৃহা বেরিয়ে এলে জীবন হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। স্পৃহার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না সে।