আলিয়া চোখ বুজে ফেলছে। সে যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছে শ্রাবণ থেকে দূরে সরার কিন্তু পারছেনা। শ্রাবণ প্রচন্ড জোড়ে তার গলা চেপে ধরে আছে।
হুট করে বাইরে থেকে আওয়াজ শোনা গেল। ছয়-সাত জন ছেলে মানুষ এসে শ্রাবণ কে আলিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিল। আলিয়া যেন প্রান ফিরে পায়। সে চোখ বন্ধ রেখেই বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে।
এদিকে ছয়-সাত জন মিলেও শ্রাবণ কে আটকাতে পারছে না। শ্রাবণ হাত-পা ছোটাছুটি করছে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করছে৷
এক লোক এসে শ্রাবণের হাত বেধে দিল মোটা রশি দিয়ে। তারপর শ্রাবণ কে চেয়ারের সাথে বাধানোর চেষ্টা করতে লাগলো সবাই মিলে৷ কিন্তু শ্রাবণ কিছুতেই রাজী না৷সে সুযোগ বুঝে যাকে পাচ্ছে তাকে মারছে।
আলিয়া অসহায় চোখে শ্রাবণ কে দেখতে লাগলো। তার কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে৷ খুব!
রুমানা এসে আলিয়াকে বাসার বাইরে আনল।
আলিয়া রুমানাকে জিজ্ঞেস করে, ওর এই অবস্থা হলো কিভাবে?
রুমানা দুঃখী গলায় বলে, দাদিজান মারা যাওয়ার পর থেকে এই ভাইয়ের মাথা আউলাইছে। শোক কাটায় উঠতে পারেনি৷
সোনা দাদি আর বেচে নেই কথাটা শুনে আলিয়া খুব আহত হলো। এই কয়েকদিনে বুড়ি মহিলাটার জন্য একটা আলাদা অনুভূতি, মায়া সৃষ্টি হয়েছিল আলিয়ার। এই মূহুর্তে আলিয়ার মনটা আরো বিষিয়ে গেল!
রুমানা বলল, আপা আমার বাসায় আসেন। এক কাপ চা খেয়ে যান৷
আলিয়া হতাশ গলায় শ্রাবণের বাসার দিকে তাকিয়ে বলে, উহু। অন্য একদিন আসব। আজকে যাই তাহলে।
আলিয়া একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রাবণ কে দেখে নেয়। রক্ত জমাট বাধা জায়গাটা ভীষণ ফুলে আছে। চোখে কালি পড়ে গেছে। আগের চেয়ে স্বাস্থ্য শুকিয়ে গেছে। উদ্ভ্রান্ত লাগছে শ্রাবণ কে। আলিয়ার চোখে দলা পাকিয়ে কান্না চলে আসে। সে রুমানার সামনে কাদতে চায় না তাই ততড়িঘড়ি করে কুঞ্জি ভিলা প্রস্থান করে।
বাসায় গিয়ে বাবার বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়৷ আলিয়া শ্রাবণের ব্যাপার টা খুব চালাকির সাথে এড়িয়ে যায়। সেদিন রাতে আলিয়ার খুব জ্বর আসে। থার্মোমিটারের লাল দাগ ১০২° এর চেয়ে একটু বেশি। গা কাপিয়ে জ্বর যাকে বলে। সেই সাথে বমি। চোখ-মুখ মূহুর্তের মধ্যে শুকিয়ে গেল। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা। মনে হচ্ছে ব্যথার ভারে মাথা ছিড়ে পড়ে যাবে৷পরের দিন ই আলিয়াকে হাসপাতালে নিতে হয়। স্যালাইন দেওয়া লাগে।
হাসপাতাল থাকাকালীন জ্বরের ঘোরে আলিয়া স্বপ্ন দেখত। আবছা অনেক কিছু দেখতে পায়।
একবার দেখল শ্রাবণের সাথে সেন্টমার্টিন যাচ্ছে। সে আর শ্রাবণ মিলে গাঙচিল গুলোকে রুটি খাওয়াচ্ছে। রুটি ছুড়ে মারার সঙ্গে সঙ্গে গাঙচিলের দল একসাথে উড়ে আসছে। আলিয়া খুশিতে হাত তালি দিচ্ছে৷ আবার একবার দেখল, নীল সাগরের পাড়ে বিশাল নারকেল গাছের নিচে সে আর শ্রাবণ হাত ধরাধরি করে হাটছে৷ আলিয়ার পড়নে স্কাই ব্লু রঙের জর্জেটের শাড়ি।
আবার আরেকবার স্বপ্নে দেখল, তার মা এসেছে। আলিয়া যেই হাসপাতালে আছে সেখানে এসেছে তার মা। আলিয়াকে দেখেই বলছে, তোর চুলের একি দুর্দশা রে আলিয়া? চুলে সাবান-শ্যাম্পু দিস না? তারপর চুলে হাত দিয়ে বলে, ইশ! কি সুন্দর ছিল আমার মেয়েটার চুল গুলো,কতো ঘন ছিল। এখন এমন পাটের দড়ির মতো কেন হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই তেল দিস না? শোন মা,প্রতি শুক্রবার তেল দিবি। লেবু তেল। দুই টুকরো লেবু রস করে নিয়ে হালকা গরম তেল মিক্স করে চুলে দিয়ে এক ঘন্টা রাখবি।
আলিয়া স্মিত হেসে বলে, আচ্ছা।কিন্তু সময় হয় না।
--সময় বের করবি। চুলের যত্ন নিতে হয়। চুল আর ভালোবাসা এই দুইটার যত্ম না নিলে, সময় না দিলে গোড়া থেকে নষ্ট হওয়া শুরু করে। এক ঘন্টা চুলে তেল দিয়ে বসে থেকে শ্যাম্পু করবি। তোরা তো তেল মাথায় দিয়ে বাইরে বের হস না। আগে আমরা চুলে তেল দিয়ে ঘুরতে যেতাম।
এরপর আর মাকে দেখতে পেল না আলিয়া।
লেবুর কথা শুনেই শ্রাবণ কে ঘোড়ের মধ্যে দেখতে পেল। শ্রাবণ লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷
শ্রাবণ আলিয়ার দিকে শরবত দিতে দিতে বলে, হুট করে অসুখ বাধালে কেন? নাও শরবত খাও। মিস্টি কিন্তু কড়া করে দেওয়া। জানো, শরবতে মিস্টি বেশি দিতে হয় আর কফিতে কম। বল তো এর থেকে কি বোঝা যায়?
আলিয়া শরবত খেতে খেতে বলে, জানি না কি বুঝায়।
--মাঝে মাঝে আমাদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিতে হয়৷
--বুঝলাম না!
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে, জ্বরের ঘোরে এসব বুঝবাও না। নাও শরবত খাও।
--খাব না। আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব।
--আচ্ছা। একটা ঘুম দাও। ঠিক হয়ে যাবে জ্বর। শরবত টা সাইড টেবিলে রেখে যাচ্ছি।ঘুম থেকে উঠে খেয়ে নিও।
আলিয়া ঘুমে তলিয়ে গেল। শ্রাবণ আরো কিছু বলছিল যা আলিয়া শুনেনি।
মাথার ভেতর থেকে কেউ বলে উঠছে, ঘুমাও, ঘুমাও, ঘুমাও। পাস ইনটু স্লিপ!!!!
আলিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে।
এভাবেই সাতটা দিন কেটে যায়। সাত দিন পর আলিয়াকে রিলিজ দেওয়া হয়। আলিয়ার জন্ডিস হয়েছিল। সাতদিনে অসুখের ধাক্কায় আলিয়া প্রচন্ড দুর্বল হয়ে যায়। বাসায় যাওয়ার পর ও ঠিকঠাক ভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে পারেনি সে। জাউ ভাত, স্যুপ, জুস, নুডুলস এসব খেয়েই তিন-চার দিন পার করে।
জন্ডিস ধরা পড়ার দশম দিনের মাথায় সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু চিনচিনে মাথা ব্যথাটা এখনো করে। সবসময় না মাঝে মাঝে। আর আজেবাজে স্বপ্ন দেখার ব্যাধিটা এখনো রয়ে গেছে আলিয়ার।
এগারোতম দিনে আয়ান তাকে দেখতে আসে।
বর্তমানে আলিয়া ছাদে বসে আছে।আলিয়াদের ছাদে দোলনা আছে। ছাদের দেয়াল ঘেঁষে পাতাবাহারের সাড়ি। তিন-চার ধরনের পাতাবাহার। একটা ক্যাকটাস ও আছে।
আয়ান তার সাথে কথা বলার জন্য ছাদে আসল। আয়ানকে দেখেই আলিয়ার মেজাজ খারাপ হলো। আলিয়া বুঝল না হুট করে আয়ানকে দেখে তার মেজাজ কেন চটে যাচ্ছে।
আয়ান আলিয়ার পাশে দোলনায় বসতে চাইলে আলিয়া সরে আসে এবং ছাদের রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়ায়৷
আয়ান আলিয়ার পেছনে তাকিয়ে মৃদ্যু গলায় বলে, তুমি কি কোন কারনে আমার উপর রেগে আছো?
--নাহ। যার-তার উপর রাগা আমার স্বভাব না।
আয়ান আলিয়ার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বলে,তোমাকে দেখতে হসপিটালে যাই নি জন্য রেগে আছো কি?
--না তো!
--তাহলে কথা বলছো না কেন?
--এম্নি। ভালো লাগছে না আমার।
--আপসেট কোন কারনে?
আলিয়া আয়ানের দিকে ঘুরে তাকালো। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাহলো আয়ানকে একটা ভয়ংকর সত্য কথা বলবে৷
আলিয়া চেহারায় গুরুগম্ভীর ভাব এনে বলে, আমি একজন কে খুব করে ভালোবাসি।
আয়ান একথা শোনামাত্র ভড়কে গেল। আলিয়ার মুখ থেকে এমন কিছু শুনতে হবে তা মোটেও আশা করেনি আয়ান।
আলিয়া আয়ানের দিকে কঠিন ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, এনজেগমেন্টের দিন যেই ছেলেটা এসে ঝামেলা বাধিয়েছিল তাকে আমি ভালোবাসি।
--হুয়াট!
--হুম। আয়ান আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। সর্যি!
--আলিয়া,,,,,,
--আমি দুঃখিত। তুমি বিদেশে যাচ্ছো। আই এম হ্যাপি ফর ইউ।
আয়ান মাথা নিচু করে বলে, ছেলেটা কি তোমাকে ভালোবাসে?
আলিয়া নির্লিপ্ত গলায় বলে, হ্যা। অনেক।
--নাম কি ওর?
--শ্রাবণ। বাংলা বছরের চর্তুথ মাস। বর্ষাকালের শেষ মাস।
--ওহ।
এইটুকু বলে আয়ান চলে গেল ছাদ থেকে। এরপর আরো ঘন্টাখানেক আলিয়া ছাদে থাকল। তার ভাবখানা এমন যে কিছু ই হয় নি।
মাগরিবের পর নিচে নামে আলিয়া৷ বাসার পরিবেশ থমথমে। সম্ভবত আয়ান কিছু বলেছে। জসীম সাহেব চেয়ারর হেলান দিয়ে বসে আছে। আলিয়া বাবাকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। তারপর ওযু করে নামাজে দাড়ায়।
নামাজ শেষ করে রুমেই থাকে। বাবা বা ভাই এখনো কিছু বলতে আসেনি। সেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না।
রাতে খাওয়ার সময় জসীম সাহেব বলল, আয়ান তোমাকে বিয়ে করতে পারবে না।
আলিয়া অবাক হলো। আয়ান কি পুরাপুরি সত্যটা বাবাকে বলে নি? সে কোন প্রশ্ন না করে বলে, ভালো হয়েছে।
জসীম সাহেব মেয়ের দিকে অবাক নয়নে তাকায়। আলিয়া মাথা নিচু করে খেয়ে রুমে চলে আসে।
রুমে এসে শ্রাবণের দেওয়া শাড়িটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। তারপর ঘুমাতে যায়।
★★★
--আপা আপনি! কেমন আছেন?
কুঞ্জি ভিলার সামনে আসতেই রুমানা ছুটে এসে আলিয়াকে প্রশ্ন করল। আলিয়া সকাল-সকালই শ্রাবণ কে দেখতে এসেছে৷ সেদিন শ্রাবণের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আজকে ও কেমন আছে?
আলিয়া রুমানার দিকে তাকালো এবং বলল, একটু অসুস্থ ছিলাম। তুমি আর বাবু কেমন আছো?
-- আলহামদুলিল্লাহ।
--আচ্ছা। আমি ভেতরে ঢুকে কথা বলছি তোমার সাথে৷
আলিয়া সামনে পা বাড়াতে গেলে রুমানা বলে ভাইয়া তো নাই৷ চলে গেছে।
আলিয়া রুমানার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলে, কোন ভাইয়ার কথা বলছো?
-- শ্রাবণ ভাইয়ার কথা বলছি৷
আলিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে এমন অবস্থা। শ্রাবণ তো অসুস্থ!
আলিয়া বলল, ও বাসায় নেই?
--নাহ৷ আপনি যাওয়ার তিনদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিল উনি। কিচ্ছু খাইত না। ভাংচুর করত। নিজের হাত নিজেই কেটে কেটে রক্ত বের করত। তিন দিন পর নিজে নিজেই শান্ত হয়ে গেল। তারপর যখন সুস্থ, স্বাভাবিক হলো তখন ঘরে বসে কাদত। বিড়বিড় করে আপনার নাম জাবর কাটত। ইশ কি যে মায়া লাগত আমার৷তারপর,,,
--তারপর কি?
-- সাত দিন আগে ভোররাতে সে কোথায় যেন চলে গেল। আশেপাশের এলাকায় খুজা হয়েছে কিন্তু ওনাকে পাওয়া যায় নি৷
আলিয়া সব শুনে নির্বাক। সে হেটে হেটে শ্রাবণের বাসার সামনে গেল। গেট লাগানো ছিল। রুমানা এসে খুলে দিল দরজা। আলিয়ার ভেতরে ঢুকতেই বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো।
বাসাটা পড়ে আছে কিন্তু শ্রাবণ নেই। চারিপাশে জিনিস-পত্র ছড়াছড়ি। আলিয়া চোখ বুলিয়ে পুরা রুমটা দেখে নিয়ে শ্রাবণের রুমে প্রবেশ করে৷
শ্রাবণের রুমটাও এলোমেলো। ছোট ছোট চিরকুট কাগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মেঝেতে৷
আলিয়া মেঝেতে ঝুঁকে কাগজ গুলো হাতে নিল। সব কাগজে আলিয়া লেখা৷
আলিয়া গা বেয়ে এল অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল।
তখনি তার চোখ খাটের নিচে যায়। দুইটা কাগজের টুকরো পড়ে আছে৷ সে নিচু হয়ে সেগুলো উঠালো৷
একটা কাগজ হলো প্রেমবিলাসের চিত্র। মাঝ খান দিয়ে ছেড়া তবুও জুড়ে দেওয়া হয়েছে স্কচটেপ দিয়ে৷ আলিয়া মৃদ্যু হাসল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো মাঝখান দিয়ে জোড়া লাগানোর ফলে স্কেচটা আরো অপূর্ব লাগছে। মনে হচ্ছে এটাই একটা আর্ট! মাঝখান দিয়ে ফাটল না থাকলে এতো অপূর্ব লাগত না!
আলিয়া দ্বিতীয় কাগজটা হাতে ধরল। এখানে কিছু লেখা আছে। আলিয়া পড়া শুরু করল।
"আমি জানি আমি কোন দিন সুস্থ হব না। ডাক্তার ভুল বলেছিল। সিংগাপুরের ডাক্তার বলেছি আমার অসুখ সেড়ে গেছে। সিজোফ্রেনিয়া সারিয়ে উঠতে পেরেছি আমি। এই সুখবর পেয়ে আমি এক মূহুর্তে অপেক্ষা না করে তোমার কাছে ছুটে আসি।
সেদিন তোমার এনজেগমেন্ট ছিল। লাল রঙের একটা শাড়ি পড়েছিলে তুমি, গলায় একটা সোনার মোটা চেইন।খোপা করা চুলে বেলি ফুলের গাজরা।
তুমি কি জানো আলিয়া? সেদিন তোমায় দেখার পর পাক্কা দশ মিনিট আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল? আমি স্তব্ধ হয়ে তোমার দিকে অপলক নয়নে চেয়ে ছিলাম৷
আমি যদি জানতাম আমি আবারো অসুস্থ হব তবে কোন দিন তোমার সামনে আসতাম না। তোমার ক্ষতি হোক এটা আমি কল্পনা তেও চাই না! সেই আমি অসুস্থ হয়ে তোমার গলা চেপে ধরেছিলাম। তোমার গালে কিভাবে আমি থাপ্পড় মারতে পারলাম? এজন্য এখন নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি। যেই হাত দিয়ে তোমাকে মেরেছি সেই হাত চাকু দিয়ে কেটে দিয়েছি। ভালো করেছি না? আই ডিজার্ভ পানিশমেন্ট৷
এতোক্ষন যা বলেছি সেগুলো খুব সাধারণ কথা-বার্তা ছিল৷ এখন একটা ভয়ংকর কথা বলব, তার আগে বলে নিই। আমি খুব ছন্নছাড়া। গুছিয়ে লিখতে পারছি না। হাত কাপছে লেখার সময়। যাইহোক মেইন টপিকে আসি। আমার এই রোগ জন্ম থেকে না। আমি আগে তোমার মতোই সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলাম। হুট করে অসুস্থ হয়ে যাই। আসলে প্রকৃতি তে হুট করে কিছুই হয় না৷ সবকিছুই প্রসেস অনুযায়ী হয়। সিজোফ্রেনিয়া তে আক্রান্তের হওয়ার পেছনে আমার ভয়ংকর অতীত দায়ী।
আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার বাবাকে নবাব বলে ডাকা হত। ওনার এতো টাকা-পয়সা যে গোনার জন্য তিন-চার জন লোক রাখা লাগত। বাপ-দাদার টাকার অভাব ছিল না। তেমনি শক্রুরলও অভাব ছিল না। বাবা একরোখা টাইপের লোক ছিল। কারো না কারো সাথে ঝামেলা বাজাতই উনি। যাইহোক আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার তিন মাস আগে বাবা আমাকে ধরে বেধে গ্রামে নিয়ে যান৷ বাবা সোজাসাপটা জানিয়ে দিল, এই তিন মাস আমি গ্রামের পিউর এয়ারের মাঝে লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিব। ঢাকার পরিবেশ দূষিত। দূষিত বাতাসের মাঝে লেখাপড়া করলে রেজাল্ট ভালো হবেনা।
পরীক্ষার এক মাস বাকি। ধুমসে লেখাপড়া চলছে আমার৷ এমন ই এক রাতে আমাদের বাসায় বাবার পালিত শক্র আক্রমণ করে।
গনহারে কাজের লোক, ড্রাইভার, দারোয়ান, আমার এক দূরসম্পর্কের মামা এবং আমার মা-বাবাকে মেরে ফেলে। সবটা আমার চোখের সামনে ঘটে। জানো শক্রুটা কে? আমার আপন চাচা৷
উনি আমাকে মারতে পারেন নি। কেন পারেন নি জানি না! হয়তো আমাকে খুব স্নেহ করত জন্য! আমাকে মারার জন্য রামদা পর্যন্ত বের করেছিল কিন্তু শেষ অবদি মারে নি আমাকে।
চোখের সামনে আমার বাবাকে গরুর মতো কোরবানি করা হয়। মায়ের পেটে বিশাল রামদা দিয়ে কোপ মারা হয়। আমি সহ্য করতে পারিনি। এরপর থেকে আমি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত আমাকে আমার ফুফু নিজের কাছে রেখে দেয়।সিংগাপুর পাঠিয়ে দেয়। আমার বাবার এতো টাকা যে আমি আজীবন বসে খাইলেও শেষ৷ হবে না। চাচার কি হয়েছে আমি জানি না! ওই সময় আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জন্ডিস ধরা পড়ে। মাথা ঠিক ছিল না আমার। মাথায় ভেতর এক মহিলা কথা বলত!
যাইহোক এতোবছর আমি সিংগাপুরে ছিলাম। আমি আমার মায়ের খুব আদুরে ছেলে ছিলাম। বাবা-মায়ের বিয়ের তের বছর পর আমি পৃথিবী তে আসি। তুমি হয়তো ভাবছো আমার বাবা নিশ্চয়ই খুব খারাপ লোক? উহু আমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিল। বাবা যে ভালো মানুষ তার একটা উদাহরণ দিই৷
সোনা দাদিকে তো চিনোই। উনি হলেন আমার প্রাইমারি স্কুলের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রেতা। ঝালমুড়ির সঙ্গে হাওয়াই মিঠাই ও বেচতেন। আমি হাওয়াই মিঠাই খুব পছন্দ করতাম। প্রতিদিন ওনার কাছ থেকে কিনতাম। আমাকে উনি খুব ভালোবাসত৷ কেন বাসত জানি না!
আমার কাছে আমার জীবনের হিসাব-নিকাশের খাতার বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর ই অজানা। বেশির ভাগ অংক ই আনসলভড!
যাইহোক আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন আচমকা উনি লাপাত্তা হয়ে যান। নেই নেই নেই। কোথাও নেই। স্কুলের সামনে আর আসেন না। একদিন দুইদিন এভাবে সাতদিন ধরে ওনার কোন খোজ নেই৷
আমি বাসায় গিয়ে কান্না করতে লাগলাম। ব্যাস আমার বাবা আমাকে কাদতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সোনা দাদিকে খুজতে লোক পাঠালেন। ওনাকে এক ফুটপাত থেকে খুজে আনা হয়। সোনা দাদিকে তার বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয় ভাড়া না দেওয়ার জন্য। এজন্য উনি স্কুলের সামনে ঝালমূড়ি বেচতে আসতে পারেনি৷ বাবা পর দিনই সেই বস্তি কিনে ফেলেন এবং আমার নামে লিখে দেয়। দাদিকে আবার সেখানে রেখে আসা হয়৷
আমি এরপরে স্কুল চেঞ্জ করি। যার জন্য সেই বস্তিতে দাদিকে মাঝেমধ্যে দেখতে যেতাম। ক্লাস টেনে থাকতে ওই বস্তির নাম দিই কুঞ্জি ভিলা ।
যাইহোক আমি জানি আমি খাপছাড়া লিখছি। কখনো কখনো খাপছাড়া, ছন্নছাড়া গোছানোর কিছুর চেয়েও আকর্ষনীয় হয়৷
আলিয়া, আমার মনে হয় আমার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আছে। আধ্যাত্মিক কিছু! এই আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বোধহয় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তের পর পর শুরু হয়েছে৷ আমি নিযে বিজ্ঞানের পূজারি। অন্ধ বিশ্বাসী। তবুও,,,,,,,
আমার মনে হয়, এই রোগের আরো একটা লক্ষন আছে তাহলো ভয়ংকর প্রেমে আক্রান্ত হওয়া। এই আধ্যাত্মিক ক্ষমতা পাওয়ার সাথে সাথে আমি তোমার প্রেমে ভয়ংকর ভাবে পড়েছি। এজন্য এই রোগের নাম আমি আবারো প্রেমবিলাস দিয়েছি।
প্রেমবিলাস হলো একটা রোগ যার কোন এন্টিবায়োটিক নেই এন্টি ভাইরাস নেই। ফলে কেউ আক্রান্ত হলে আর সুস্থ হওয়ার চান্স নেই। সিজোফ্রেনিয়া থেকে সেরে উঠলেও প্রেমবিলাস রোগ থেলে সেরে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি চলে যাচ্ছি আলিয়া। আমি চাই না তুমি এই লিখা গুলো পড়ো। তারপরও আমার মন বলছে আমি আসবে। আমার খোজে একবার হলেও তুমি আসবে। এখন আর আগের মতো মন যা বলে তা হয় না৷ আগে এর প্রকট বেশি ছিল।
এবার একটা প্রশ্ন করি তোমাকে।দেখি পারো কিনা! প্রশ্নটা হলো, বেশির ভাগ মৌলিক সংখ্যা কিন্তু বিজোর যেমন-- এগারো, তের, সতের, ঊনিশ। তাহলে এক কেন মৌলিক সংখ্যা না? দুই থেকে কেন মৌলিক সংখ্যা শুরু? উত্তর টা বাস্তবিক হওয়া চাই।
আর কিছু লেখা নেই চিঠিতে। আলিয়া সবটা পড়ে চুপচাপ উঠে দাড়ালো এবং বাসার দিকে রওনা হলো।
★★★
কোন এক আষাঢ়ের বিকেলে শ্রাবণ হাটতে হাটতে কুঞ্জি ভিলা এসে থামল। পড়নে আলিয়ার দেওয়া শার্ট।। মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা। শ্রাবণ নিজেই ইচ্ছে করে ছোট করে চুল ছেটে দিয়েছে। তার চুলে প্রচন্ড খুশকি আর উকুন। রাতে হলে খালি মাথা চুলকায়।
সে কুঞ্জি ভিলা ঢুকে পড়ল। বিকেলের প্রথম ভাগ। সূর্যের মিস্টি কিরন তার গায়ে এসে লাগছে৷ সে আঠারো নাম্বার বাসায় দিকে অগ্রসর হচ্ছে৷
হুটহাট করে সে হিমুর মতো হারিয়ে গিয়েছিল। এতো দিন ফুফির বাসায় ছিল। ফুফির বাসা খুলনাতে। চাচার কোন খোজ নাই। সে খুজেও নি চাচাকে। পাচ-ছয় মাস পর এসেছে ঢাকায়। শেষ যেবার এসেছিল তখন শীতকাল ছিল এখন বর্ষাকাল।
গেট হালকা করে ভিজানো। শ্রাবণ গেট খুলতেই হতবাক হয়ে যায়৷ একটা মেয়ে চেয়ারে বসে আছে৷
এই বাসায় কি কেউ নতুন উঠেছে? কোন মেয়ে উঠেছে কি?হতে পারে৷
শ্রাবণ ভিতরে ঢুকে না। সে বাইরে চলে আসে।
বাইরের ফাকা জায়গায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। সিগারেটে টান মেরে আকাশের দিকে ধোয়া উড়াচ্ছে। আজ-কাল তার কি যে হয়েছে। আগাম কোন খবর সে পায় না। মানুষ দেখলেও কিছু বলতে পারেনা।
পেছন থেকে কেউ বলে উঠে, সিগারেট টা ফেলে দাও।
শ্রাবণ চমকে উঠে হাত থেকে সিগারেট টা ফেলে দিল।
মেয়ে এসে পা দিয়ে সিগারেটে আগুন মুছে ফেলে। এবারে শ্রাবণ মেয়েটার দিকে তাকালো। এটা তো আলিয়া!
শ্রাবণ অবিশ্বাস্য চোখে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আলিয়ার পরনে তার মায়ের সেই বেগুন শাড়িটা। কানে পার্লের ঝুমকা। চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া। মৃদ্যু হাওয়ায় চুল গুলো উড়ছে আলিয়ার।
শ্রাবণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আলিয়া চুলে হাত খোপা করতে করতে বলে, দেরি হলো কেন আসতে?
আলিয়ার কথা শুনে কিছুটা ভড়কে যায় শ্রাবণ। সে অপ্রস্তুত হয়ে গেল এবং আমতাআমতা করে বলে, রিকশা পাচ্ছিলাম না।
--ও।
তখনি আলিয়ার খোপা করা চুল খুলে গেল৷ আলিয়া আবারো তার চুলে খোপা করতে লাগলো।
শ্রাবণ বলে, তুমি এখানে কি করছো?
--পাশেই এক ক্লিনিকে আমি ইন্টার্ণ করছি। এখানে ব্রেকে এসে রেস্ট নিই। আর তোমার জন্য অপেক্ষা করি।
--আমার জন্য অপেক্ষা করো!
--হুম।
--কিন্তু কেন?
আলিয়া মুচকি হেসে শ্রাবণের কাছে এসে বলে, আমিও তোমার মতো প্রেমবিলাস রোগে আক্রান্ত!
হুট করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামতে আরম্ভ করে। রাস্তার চলাচল করা মানুষ-জন দৌড়াদৌড়ি করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
কিন্তু আলিয়া-শ্রাবনের মাঝে কোন তাড়া নেই। তারা একে অপরকে দেখছে আর বৃষ্টিতে ভিজছে।
বৃষ্টির পানিতে আলিয়ার পড়নের শাড়িটা লেপ্টে গেল। চুল গুলো ভিজে যেতে লাগলো।
শ্রাবণ এক পা দুই পা করে এগিয়ে এসে আলিয়া কে ঝাপ্টে ধরে ফেলে৷
তখনি পাশ দিয়ে এক মহিলা দ্রুত হাটছে। সেটা আলিয়া দেখল। মহিলা তাকে ক্রস করে চলে গেল। ঠিক সেই মূহুর্তে আলিয়ার চোখের সামনে ভাসল, মহিলার স্বামী হাসপাতালে রক্ত বমি করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। ডাক্তার রা কিছু ই বুঝে উঠতে পারছে না৷ মহিলাটা জোড়ে জোড়ে কান্না করছে। তাকে দেখে এভাবে কাদতে দেখে মহিলাটার স্বামী তার হাত চেপে ধরে বলে, তুমি কান্না করো না প্লিজ। তুমি কাদলে আমার খুব কষ্ট হয়৷ এইটুকু বলে এক ধরনের পিনপিনে নিরবতা। তারপর লোকটা হুট করে মারা গেল৷
আলিয়া ভয়ে কেপে উঠে। কি হচ্ছে তার সাথে এসব? কি দেখল সে?
শ্রাবণ তাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে, খুব ভালোবাসি তোমাকে!
--দুই থেকে মৌলিক সংখ্যা শুরু হয় কেন?
--জানি না। একের কোন দাম নাই। তবে দুইটা মন মিলে একটা মৌলিক মন তৈরি হয়। যাকে অন্য কেউ ভাঙ্গতে পারবে না। কেবল সেই মৌলিক মনের অধিকারি কেউ একজন অপরজনকে ভেঙ্গে ফেলতে পারবে৷
আলিয়া শ্রাবণের কথা শুনল না। কারন তার চোখের সামনে এক দুর্দান্ত দৃশ্য ভাসছে। সে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। চিৎকার করছে।
এক দল ডাক্তার এসে তাকে ওটিতে ঢুকালো। ডেলিভারি করল। এক ফুটফুটে বাচ্চা জন্ম নিল।আলিয়া চোখ তুলে ছেলেকে দেখে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলে।বাবুর কান্নার শব্দে হাসপাতালের দেয়াল গুলো আনন্দে আত্মহারা৷ আলিয়া চোখ বন্ধ রেখেই বাবুর কান্নার আওয়াজ শুনছে৷
ছেলে দেখতে কালো হয়েছে। ডান পায়ের হাটুতে একটা জন্ম দাগ ও আছে৷ শ্রাবণ বাবুকে কোলে নিয়ে হাটছে আর এক মিনিট পর পর বাবুর কপালে চুমু দিচ্ছে।
শ্রাবণ আলিয়াকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে। আলিয়া হুহু করে কেদে দেয়। শ্রাবণ তাকে ছেড়ে দেয়। এবং আলিয়ার মুখের দিকে তাকালো আর বিচলিত হয়ে গেল এবং বলল, কান্না থামাও৷
--কেন?
শ্রাবণ আলিয়ার চোখে চোখ রাখে৷ আজকে আলিয়ার চোখে এক ধরনের নেশা দেখতে পাচ্ছে৷ আজকে সে আলিয়ার চোখের ভাষা বুঝতে পারছে না।
শ্রাবণ মৃদ্যু গলায় বলে,
তোমার অশ্রুতে আমি বিষাক্ত!
তোমার অট্টহাসিতে আমি আসক্ত!
.
.
.
সমাপ্ত..............................