রংধনু - পর্ব ১১ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে দুপাশের ল্যাম্পোস্টের আলো পরিবেশটাকে বেশ মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।পাশে গাড়ি চলাচল করছে।আর সেই একই রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছে বিভান বেলা।দুজনের মাঝে সামান্য দুরত্ব।তবে বিভান বেলার কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে।বেলা পাশে তাকিয়ে লোকটাকে দেখে।কিছুদিন আগে লোকটাকে সরিয়ে রাখছিলো।কিন্তু আজ সব ছেড়ে শুধু তার জন্যই চলে এলো।লোকটার ভালবাসার জন্য চলে এলো।লোকটা তার স্বামী।বেলা ভালবাসে তার বিভানকে।বিভান ও ভালবাসে বেলাকে ওর চেয়ে দ্বিগুন বেশি।বেলার চোখের কোনা ভিজে আসে।বিভান হাঁটতে হাঁটতে গান ধরলো,
দিওয়ানে হোকে হাম 
মিলনে লাগে সানাম 
যাবসে জুড়ে হ্যা সিলসিলে
আখো সে রুঠকার 
নিন্দে চালি গায়ি 
না জানে ক্যায়সে গুলখিলে............
গানটা শেষ করতে পারেনা বিভান।বেলা মাঝে দিয়ে বলল,

''খুব ভালো গাইতে পারেন।"
''থ্যাংক ইউ মিসেস বিভান বেলা শেখ।"

বেলা অবাক হয়ে বলল,

''ও মা এতো বড় নাম।তবে আপনি পুরো নামটাই জানেননা।"
''সেকি?"
''তাসনুভা আফসানা রাহমান বেলা।"
''ওহ বাবা বড় নাম। "
''হুম।"
''হুম তো আমার বিল্লুরানী কেমন লাগছে আজকের রাতটা?
''রোমাঞ্চকর।"
''হুম একদম।আর যেখানে আমার মিসেস সাথে আছে সেখানে তো আজকের রাতটা বেস্ট আমার জন্য।"
''আমার ও।পাশে ভেলপুড়ি আছে খাবেন?"
''এগুলো জাংকফুড বেলা।খেওনা।"
''প্লিজ বিভান।খুব মজার।একটু টেস্ট করুন।"
''দেখো ওরা হাত ও ঠিকমতো ধোয় না।"

বেলা মন খারাপ করে বলল,

''তাহলে না করছেন আপনি?"
''দেখো বেলা আমি রান্না শিখে তোমাকে খাওয়াবো কিন্তু বাহিরের গুলো খেওনা।আর বাহিরে খেতে পারিনা আমি।ফুড পয়জন হয়ে যায়।"

বেলা মলিন হাসে।তারপর বলল,

''তাহলে সামনে চলুন।"

বিভান কিছু বলেনা।তবে বুঝতে পারছে বেলার খেতে মন চাইছে।ও খেতে চাইছিলো।বিভানের জন্যই খাবেনা।বিভান পাশে খেয়াল করলো একটা লোক পাশে বসে কিছু বিক্রি করছে।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বুঝতে পারলো ভেলপুড়ি কারন ওদের ইন্ডিয়াতে ও আছে।বিভান বেলার হাত টেনে বলল,

''চলো।"

বেলা অবাক হয়ে বলল,

''কোথায়।"
''ভেলপুড়ি খাবে।চলো।"
''আরে নাহ বিভান।চলুন।"
''বেলা চলো বলছি।আমি খাবোনা তুমি খেও।"

বেলা বারবার না করার পর ও বিভান ওকে টেনে নিয়ে আসে ভেলপুড়ি বিক্রেতার কাছে।বেলার মুখে হাসি ফুঁটে উঠে।বিভান বলল,

''খাও তবে অল্প করে।পেট খারাপ করবে।"
''আরে চিন্তা করবেননা।আমার এসবে কিছু হয়না।"
''ওকে।"

বিভানের দিকে হেসে বেলা অর্ডার করলো এক প্লেটের।অনেক মরিচ আর টক দিতে বলল।বিভান ওর প্লেট দেখে অবাক।বেলা একটা একবারেই খেয়ে ফেলছে।চোখ বেয়ে পানি পড়ছে কিন্তু মুখে প্রশান্তির ছায়া।বিভান অবাক বেলার খাওয়ায়।এতো ঝাল খায়।বিভানের ও কেন যেন ইচ্ছে হলো খেতে।একটা হাতে নিয়ে বেলাকে বলল,

''খাবো?"
''আপনার পেটে প্রবলেম করতে পারে।ঝাল অনেক।"
''খেয়েই দেখি।"
''অবশ্যই।"

বিভান হেসে মুখে দিতেই হা করে থাকলো। ওর গাল চোখ লাল হয়ে গেছে।চোখে পানি এসে গেছে।বেলা জলদি পানি দিলো বিভানের দিকে।বিভান পানি খেয়ে নেয় তবু ও ঝাল যাচ্ছেনা।
বেলা ভয় পেয়ে গেছে।জলদি পাশের দোকান থেকে একটা চকলেট এনে বিভানের মুখে দিয়ে দিলো।এবার যেন একটু শান্ত হলো।তারপর ও বলল,

''কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।"
''না করেছিলাম।"
''কিভাবে খাও বলো তো?"
''অভ্যাস আছে আমার।আপনি আগে কখনো খাননি।তাই ঝাল বেশি লেগেছে।"
''শুধু বেশি আমার মুখ ঠোঁট জ্বলছে।"

বেলা হেসে ফেলে।ভেলপুড়ির টাকা দিয়ে ওর আবার ও হাঁটতে শুরু করে।আজ দুজনে নিজেদের বিয়েটাকে উদযাপন করছে।এদিকে সাঁঝ অনবরত কাঁদছে।আগে কখনো মার খায়নি ও।বাবা মা কখনো মারেনি ওকে।খুব আদর করেছে সবাই।কিন্তু আজ মার খেয়েছে ও।বড় ভাইয়ার হাতে আপাকে সাহায্য করার জন্য।তবে ওর খারাপ লাগছেনা।ভাইয়ার চড় টা একদমই কষ্ট লাগেনি ওর তবে খারাপ লেগেছে আপার ভালোবাসা ওরা বুঝবেনা।বেলার সাথে কথা শেষ করে পিছনে ফিরতেই নিশাদকে দেখতে পায় সাঁঝ।নিশাদ রেগে বলল,

''কার সাথে কথা বলছিলি?"
''ক কেউ না ভাইয়া।"
''সাঁঝ একদম মিথ্যা বলবিনা।একদম সহ্য হয়না আমার। বল কে ছিলো?"

ভয় পেয়ে গেলো সাঁঝ।ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে ওর ধারনা আছে।কি বলবে ও বুঝতে পারছেনা।নিশাদ আবার ও চেঁচিয়ে উঠলো,

''কি হলো কে ছিল?"

সাঁঝ কেঁপে উঠে।চোখে পানি এসে গেছে।কেউ ওকে এভাবে ধমক দেয়নি।আর আপা আর ভাইয়া ওকে খুব ভালবাসে।আর সেই জায়গায় ভাইয়া চিল্লাচ্ছে ওর ওপর।বোনের জবাব না পেয়ে নিশাদ টেনে ফোন নিয়ে নেয় সাঁঝের হাত থেকে।সাঁঝ ফোন নিতে চাইলে নিশাদ চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,

''কাছে আসলে খুন করে ফেলবো।"

এরই মাঝে মা বাবা আর সবাই এসে যায়।সবাই ওদের দেখছে।নিশাদ কল লগে ঢুকে দেখে বেলার নম্বর।নিশাদ চেঁচিয়ে বলল,

''কি কথা বলছিলি আপার সাথে?"
''ভাইয়া কথা শুনো আমার।"

ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল সাঁঝ।নিশাদ চেঁচিয়ে বলল,

''কি শুনবো আমি? বল আপা কই আছে?এক্ষুনি নিয়ে আসবো আমি।"
''জানি না কই আছে।"
''মিথ্যা বলোস কেন?বল কই আছে?নাহলে আজ মরে যাবি।"
''জানি না আমি।কই আছে জানিনা।"

নিশাদ সরে এসে বলল,

''বলবিনা সমস্যা নাই খুঁজে দেখি আমি। "
________________________________________
সাঁঝ প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়।কি করবে ও?নিশাদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলে আটকানো যাবেনা।তাই সাঁঝ বলল,

''ওরা বিয়ে করে নিয়েছে।"

নিশাদ চোখ বড় করে তাকায় বোনের দিকে।মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়।দৌড়ে এসে সাঁঝের গালে প্রচন্ড জোরে চড় বসায়।সাঁঝ একদম নিচে পড়ে যায়।জুলেখা বানু কেঁদে বলেন, 

''নিশাদ কি করলি এডা?মারিস না মাইয়াডারে।"

নিশাদ চিৎকার করে বলল,

''আম্মা একদম চুপ থাকো।ওর সাহস হয় কেমনে আপারে সাহায্য করার।ওদের বিয়ে হয়ে গেছে ও জানে তারমানে ও সাহায্য করছে।আব্বারে দুনিয়ার অপমান করলো ঐ লোক তোদের কারনে।তোর সাহস হয় কি করে আপারে পাঠানোর?"

সাঁঝ গাল ধরে কাঁদছে।ইকরাম রাহমান বললেন,

''জীবনে কোন পাপ করছিলাম এই মাইয়া দুইডা আমার ঘরে অইছে।জন্মের লগে লবন খাওয়ায় মাইরা ফালাইতাম।"

জুলেখা বানু কেঁদে কেঁদে স্বামীকে বলেন,

''কি কও এডি?কইওনা এমন।আমার মইরা যাইতে মন চাইতেছে।"

নিশাদ আবার ও মারতে গেলে আদনান বলল,

''ভাই প্লিজ।এমন করিস না। এভাবে ওর গায়ে হাত তুলিসনা চলে আয়।"
''ওরে আজকে মাইরাই ফালামু।আদর কইরা মাথায় তুলছে।এখন এই ফলাফল দেখায়।"

সাঁঝ কাঁদছে নীরবে।আদনান ভাইকে নিয়ে গেলো।সবাই চলে গেলো।সাঁঝ কাঁদতে থাকলো।হুমায়রা এসে বোনের হাত ধরে টানতে থাকলো

'' আপু উঠ খাটে।"
''যা তুই।"
''আপু উঠনা।"
''একা ছাড়।"
''আপু কান্দিসনা।উপরে আয়।"

বোনকে জোর পূর্বক খাটে বসায় হুমায়রা।তারপর সাঁঝের চোখের পানি মুছে নিতে নিতে বলল,

''আপা কি আসবেনা আর?"
''অবশ্যই আসবে।মন খারাপ করিসনা।"
''আপার কথা মনে পড়ছে।"
''আমার ও খারাপ লাগছে।আপা থাকলে ভাইয়া এমন করতে পারতো না।"
''ভাইয়া ভালো না।"
''কে বলল? ভাইয়া ভালো অনেক।এখন তো রেগে আছে।পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।"

হুমায়রা বোনকে এসে জড়িয়ে ধরে।সাঁঝকে রাতে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছিলো মা তবে ভাইয়া বাবা আর আসেনি রুমে।আদনান ও আসেনি।সাঁঝ জানে ও ভুল করেনি।ভালবাসার দুটো আত্মাকে মিলিয়েছে।এদিকে সারারাত ঘুরে বেলা আর বিভান হোটেলে ফিরে আসে।কিছুক্ষন পরপরই বেলা কেমন চুপ হয়ে যায়।বিভান জানে বেলার খারাপ লাগে।তবে সব ঠিক হয়ে যাবে একসময়ে।ওরা রুমে চলে এলো।বিভানের ফ্লাইট পরশু তবে ভিসার ডেট বাড়াবে ও কারন এখন তো একা নয় বেলাও যাবে।বেলা রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়।বিভান ফোন বের করে দেখলো মায়ের কল এসে আছে।বিভান মেসেজ করে দিলো,সকালে কল দিবো।ঘুমাও মা।"
বেলা বেরিয়ে আসে।বিভান বলল,

''কেমন লাগছে?"
''কি কেমন?"

কিছুটা অবাক হয় বেলা।বিভান হেসে বলল,

''আজ সোহাগ রাত আমাদের হিন্দি ভাষায়।"

বেলা লজ্জা পেয়ে যায়।মুচকি হেসে বলল,

''ফ্রেশ হন গিয়ে।"

বিভান ফ্রেশ হতে চলে যায়।বেলা চুল আঁচড়ে জট ছাড়িয়ে নিয়ে খোঁপা বাঁধে আবারও।কিছুসময় পর বিভান বেরিয়ে এসে দেখে বেলা খাটে বসে আছে।তবে ওর চেহারা ভীষন মলিন।বিভান ওর পাশে এসে বসে।তারপর বেলার কাঁধে আলতো চুমু খেয়ে বলল,

''ঠিক আছো?"
''বাসার জন্য খুব খারাপ লাগছে। "
''বেলা পরশু আমরা যাবো।সব ঠিক হয়ে যাবে।"
''কিছু ঠিক হবেনা।বাবা খুব রেগে আছে।নিশাদ ও রেগে থাকবে।"
''বেলা আল্লাহকে বিশ্বাস করো তো?"
''পুরো বিশ্বাস করি।"

বিভানের দিকে তাকিয়ে বলল বেলা।বিভান বলল,

''তাহলে চিন্তা করোনা।"
''আপনার মা বাবা জানে?"

বিভানকে চিন্তিত লাগে।তবে পরক্ষনে হেসে বলল,

''জানিয়ে দেবো। "
''ওনারা খুব রাগ করবে।"
''মানিয়ে নেবো।ওনারা খুব ভালবাসেন আমাকে।মেনে নেবেন।"
''ওকে।"

বিভান বেলার হাত স্পর্শ করে এক হাতে বেলার খোঁপা খুলে দেয়।সাথে সাথে বেলার চুল গুলো ওর পিঠের ওপর এলিয়ে পড়ে।বেলা চোখ বুঁজে নেয়।বিভান বেলার গালে কপালে চুমু খেয়ে বেলা কে শুইয়ে দেয়।বেলা তাকাতে পারছেনা পুরো শরীর ঘেমে একাকার হচ্ছে।বিভান বেলার চেহারা দেখে হেসে দেয়।তারপর ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে আলতো চুমু খেয়ে বলল,

''ভয় পেও না।আগে আমরা একে অপরকে বুঝবো তারপর ওসব।"

বেলা চোখ খুলে মুচকি হাসে লজ্জিত মুখে।তারপর বলল,

''ধন্যবাদ বিভান।"
''ইউ আর মোস্টওয়েলকাম।"

বেলা হেসে বিভানের গলা জড়িয়ে ধরে।

!!!!

সকালের রৌদ্রের হালকা ভাবে স্পর্শ করলো বেলার শুকনা মুখটাকে।মেয়েটার চোখ ঘুমে ও মলিন লাগছে।বিভান পর্দা সরিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই।বেলা এমন ভাবে ঘুমুচ্ছে যেন অনেকদিনের ঘুম ঘুমুচ্ছে।সোফায় বসে বেলাকে দেখছে বিভান।বেলাকে ডাকতে চাইছেনা বিভান।কিন্তু উঠতে হবে পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে।বিভানের ভিসার ডেট ও বাড়াতে হবে।বেলার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো ভাবতে বেলার কপালে হাত রেখে মুখে আসা চুল গুলো সরিয়ে ডাকতে যাবে তখনই বিভানের ফোন বেজে উঠে।বিভান ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ওর মায়ের কল। বিভান রুম থেকে বারান্দায় চলে এলো।তারপর কল রিসিভ করে।অপরপাশ থেকে বন্দনা বললেন,

''কিরে বাবা তোর কোন খোঁজ খবর নেই যে?"
''মা একটু ব্যাস্ত ছিলাম। বলো ভালো আছো?"
''ভালো থাকা যায়?তোর বাবা আসলো বাসায় তোর ফুপুকে নিয়ে।"

বিভানের মুখ কিছুটা কালো হয়ে আসে।কিছু টা রেগে গেলো বিভান।বিরক্তিকর কন্ঠে  বলল,

''আবার ও?"
''কি বলবো বল?তা কাল তোর ফ্লাইট।"
''জি।কিন্তু কাল আসছিনা মা।"

বন্দনা অবাক হয়ে যান।বলছেন কি এই ছেলে?মেয়ে দেখতে যাবে ওরা।আর এই ছেলে আসবেনা।বন্দনা বিরক্তিকর ভাবে জিজ্ঞেস করেন,

''কাহিনী কি তোর?আর কতো বাংলাদেশ ঘুরে দেখবি?"
''মা অকারনে আটকে থাকিনি।"
''দেখ বাবা যে কারনেই আছিস জলদি চলে আয়।তোর জন্য কামাল মামার মেয়েকে দেখলাম।মেয়েটা বড্ড সুন্দরী।"
''ওরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।কি বলছো এসব?"
''আরে তাতে কি হবে?মেয়ে অনেক ভালো।"

বিভানের রাগ লাগলে ও ব্যাপারটাকে ও ঠান্ডা মাথা ঠিক করতে চাইছে।তাই বলল,

''মা শুনো আমাদের ধর্মে এমন বিয়ে হারাম।আর তাছাড়া আমি কাউকে পেয়ে গেছি।"

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন বন্দনা।চিৎকার করে বলেন,

''কি বললি তুই?কারে পেয়েছিস?ঐ ফকিরনি দেশে কি পেয়েছিস?"
''একটা পার্ফেক্ট লাইফ পার্টনার।"
''বিভান কি বলছিস এসব?কিসের পার্ফেক্ট লাইফ পার্টনার?"
''ও আমার স্ত্রী মা।ওর নাম বেলা।ওকে দেখলে তোমার খুব ভালো লাগবে।"
''কাজটা ভালো করিসনি।পরিনাম ভালো হবেনা এর।"

বিভান কিছু বলতে গেলে কল কেঁটে গেলো।ফোন কান থেকে সরিয়ে রুমে এলো।বেলা বিছানায় বসে হাঁটু ভাজ করে সেখানে মুখ গুঁজে বসে আছে।ওর লম্বা চুল গুলো দুপাশে পড়ে বিছানা স্পর্শ করছে।বিভান কাছে গিয়ে বুঝলো কাঁদছে বেলা।বিভান ভয় পেয়ে যায়।বেলার সামনে বসে ওর হাত স্পর্শ করলো।বেলা কাঁদো স্বরে বলল,

''প্লিজ একা ছেড়ে দিন।"

বিভান অাতংক বোধ করছে।মেয়েটা হঠাৎ এমন করছে কেন?বিভান বলল,

''বেলা কি হয়েছে?খারাপ লাগছে?"
''বিভান দয়া করে কিছুসময় একা ছাড়েন।"
''অবশ্যই।আমি নাশতার অর্ডার করছি।"

বেলা কিছু বলেনি।ওভাবেই বসে কাঁদছিলো।বিভান সরে যায় ওর সামনে থেকে।এদিকে সকাল থেকে সাঁঝের সাথে কেউ কথা বলেনি।নিশাদ ওর দিকে তাকাচ্ছে ও না।সাঁঝের খুব খারাপ লাগছে।কেন হচ্ছে এমনটা?ওরা কেন বুঝতে পারছে না আপার খুশি কোথায়?ওরা এতোদিন কি খেয়াল করেনি আপার হাসিমুখের পিছনের কষ্টটা? দেখেনি রাত জেগে চোখের পানিতে বালিশ ভেজানোর দৃশ্য?সাঁঝ দেখেছিলো।ও বুঝতে পেরেছিলো বেলার কষ্টগুলো।সাঁঝকে ঘরে হাঁটতে দেখে জুলেখা বানু এসে বললেন,

''হাত মুখ ধুইয়া রুমে যায়া বয়।তোর নাশতা লইয়া আইতাছি।"

সাঁঝের চোখ ভিজে আসে।একমাত্র আম্মাই ওর সাথে কথা বলছে।ওর খবর নিচ্ছে।সাঁঝ মাথা ঝাঁকিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুমে গিয়ে বসে পড়ে।কিছুসময় পর জুলেখা বানু রুমে ঢুকেন ভুনা খিচুড়ী আর ডিম ভাজা নিয়ে।সাঁঝ চোখ মুছে বসলো সোজা হয়ে।জুলেখা বানু মেয়ের সামনে প্লেট রাখতেই সাঁঝ বলল,

''আম্মা আমারে খাওয়ায় দাওনা?যেভাবে আপা খাওয়াইতো।"

জুলেখা বানুর কান্না চলে আসে।মেয়ের সামনে বসে খাইয়ে দিতে শুরু করেন।খাওয়ার মাঝে সাঁঝের চোখ ভারি হয়ে আসে।জুলেখা বানু বললেন,

''বেলা কই গেছে আম্মারে কইয়া দে।"
''না বলবোনা।"
''দেখ কাউরে কিছু কমুনা।দুইডা মাইয়ারে আমি চিনি।না বুইজঝা কিছু করবিনা তরা।বেলারে কয়েকদিন দেখছিলাম বিয়া ঠিক হওনের পর থেইক্কা মাইয়াডার ঘুম পুরতোনা।উইঠা আইলে চোউখ ফুলা থাকতো।"

সাঁঝ ধরে আসা গলায় বলল, 

''জানো আম্মা আপা সারারাত কান্না করতো।কাউরে দেখায় নাই।নিজেরে ভালো রাখছে আমাদের সবার লাইগা।ইদরীস ভালো না বিভান ভাইয়ে খোঁজ নিছিলো।"
''এই বিভান কেডা?"

ভ্রু কুঁচকে জুলেখা বানু। সাঁঝ বলল,

''আম্মা আপা ওনিরে খুব ভালবাসে।বিভান ভাই ও ভালবাসে।"
''ওহ হের কাছে গেছে?"
''জি।"
''বেডায় কি করে?"
''থিসিস করতেছে আর এক কোম্পানীর মালিক।"
''কি কোম্পানী? "
''টাইলস কোম্পানী আছে নিজেদের।গার্মেন্টস ও আছে।বাড়ি আছে কয়েকটা।"
''পোলার বাড়ি কই?"
''ইন্ডিয়া আম্মা!!!"

আঁৎকে উঠেন জুলেখা বানু।চিন্তিত গলায় বললেন,

''তোর আব্বা মানবো না জীবনেও।"
''আম্মা ভাইয়া খুব ভালো মানুষ।আপারে ভালো রাখবো।ভাইয়া আর আব্বা তো কথা শুনবারই চায়না।"
''হেগোরে ঠান্ডা মাথায় বুঝাইতে হইবো।তোর ভাইয়ের মাথা গরম কিন্তু মন নরম।"
''হুম।"

জুলেখা বানু মেয়ের হাত চেঁপে ধরে বললেন,

''ভাইয়ের ওপর রাগ করিসনা আম্মা।জানোসই তোগো ভাইয়া কেমুন?"
''জানি আম্ম রাগ না।খালি চাই ভাইয়া আর আব্বু বুঝুক।"
_________________________________________
ওয়েটার নাশতা নিয়ে এলো ট্রলিতে করে।বিভান নাশতা নিয়ে লোকটা কে চলে যেতে বলে।বেলা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে।চুপ করে আছে ও।চোখজোড়া অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে।বিভান টেবিলে নাশতা সাজিয়ে বেলার দিকে তাকিয়ে বলল,

''এসে খেয়ে নাও।পাসপোর্ট করতে হবে।"
''আমার পাসপোর্ট করাই আছে।ভিসার জন্য এপ্লাই করতে হবে।"

কিছুটা মলিন কন্ঠে বলল বেলা। বিভান হেসে বলল, 

''তাহলে ভালোই হলো।ঝামেলা করতে হবেনা।এসো খেতে বসো।"

বেলা কিছুটা সরে বসলো বিভান থেকে।বিভান কিছুনা বলে প্লেটে নাস্তা নিয়ে বেলার সামনে রাখলো।বেলা নাস্তার দিকে তাকালো।ওর চোখে পানি জমে আছে।বেলা কে এমন করতে দেখে বিভানের খেতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।বেলার সামনের থেকে প্লেট নিয়ে ওর দু কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরায় বিভান।তারপর পরোটা বেলার দিকে ধরলো।বেলা কেঁদেই দিলো।বিভান চেয়ে আছে বেলার দিকে।কাঁদতে কাঁদতে বেলা বলল,

''বিভান খুব খারাপ লাগছে আমার।সবাইকে খুব মনে পড়ছে।"

বিভান বেলার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল,

''খারাপ লাগবেই।কয়েকদিন যাক ঠিক হয়ে যাবে।আর ভারতে ফেরার আগে সবার সাথে সময় কাঁটিয়েই যাবো আমরা।"

বেলা কাঁদছে।নিজের বাবাকে চেনে ও।ভারতীয়দের সহ্য করতে পারেননা বাবা।বেলা এগিয়ে এসে বিভানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।বিভান বেলার মাথায় হাত বুলাতে থাকে।কিছুক্ষন পর সরে আসে বেলা। প্লেট হাতে নিয়ে বলল,

''খেয়ে নিন আপনি।"
''তুমি খাচ্ছো না তো?"
''খাচ্ছি। আপনি ও খেয়ে নেন।"

বিভান আর বেলা দুজনেই খেয়ে রেডি হয়ে নেয়।বের হবে ওরা।ভিসার জন্য ইন্ডিয়ান এ্যাম্বাসিতে যেতে হবে।সেখান থেকে কিছু শপিং করবে।তারপরই হোটেলে ফিরবে ওরা।বেলার ভিসা করতে দেয়া হলো বিভানের ভিসার ডেট বাড়ানোর জন্য বলে ওরা শপিং এর উদ্দেশ্যে বের হয়।রাজধানীর নামকরা একটা মার্কেটে চলে আসে।বেলাকে নিয়ে একটা গোল্ডের দোকানে ঢুকে বিভান।বেলাকে কিছু গয়না কিনে দিলো কারন ওদের বিয়েটা এতো ঘঁটা করে হলো কিছুই দিতে পারেনি।বেলা অবশ্য কিনতে চাইছিলো না বিভান জোর করেই কিনে দিলো।বেলাকে কিছু শাড়ী ও কিনে দিলো।তেমন কোন কাপড় আনতে পারেনি বেলা।সন্ধ্যায় ফিরে এলো ওরা বাহিরে খেয়ে।
হোটেলে ফিরে গয়না গুলো বিভানের লাগেজে রাখতে থাকে বেলা।বিভান স্মোক শেষ করে রুমে আসে।বেলার পিঠ ওর দিকে দেয়া।শাড়ীর ফাঁকে বেলার পেট দৃশ্যমান।বিভান হেসে হাতের সিগারেট ফেলে বেলার পিছনে বসে শাড়ীর ভিতর হাত ঢুকিয়ে বেলার পেট পেট স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠে বেলা।বিভান বেলাকে টেনে কাছে নিয়ে আসে।বেলা কিছু বলতে পারছেনা।ওর পিঠ বিভানের বুকে ঠেঁকেছে।বিভান বেলার কাঁধ থেকে ব্লাউজের কাপড় একটু সরিয়ে সেখানে চুমু দিতেই বেলা বুকে শাড়ী চেঁপে ধরে।বিভানকে যেন নেশায় পেয়ে বসেছে।বেলার শাড়ীর আঁচল কাঁধে উঠিয়ে বেলার চিবুক ধরে মুখ খানা একটু বাঁকা করে ওর দিকে ফিরায়।বেলা পাশে তার স্বামী নামের পুরুষটাকে দেখছে।বেলা কাঁপন ধরা কন্ঠে বলল,

''বিভান কখনো ছেড়ে যাবেননা তো?"
''কখনো না।"

বলেই বেলার ওষ্ঠকে নিয়ে দুজোড়া ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নেয়।আলতো করে দুতিনবার চুুমু দিয়ে দ্বীর্ঘ চুমুর আবির্ভাব ঘটায়।বেলার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে বিভানের ঠোঁটজোড়ার মাঝে।বেলার শাড়ীর আঁচল আলগা হয়ো আসে তবে দুজনের সেদিকে খেয়াল নেই।বিভান বেলার গলায় মুখ নামিয়ে আনে সেখানে নাক ঘষে এলোপাথাড়ি চুমু দিয়ে বেলার শাড়ীর আঁচল ঠিক করে দেয়।তারপর সরে এলো বিভান।বেলা জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে বলল,

''রাত হয়ে এলো ফ্রেশ হয়ে নিন।"

বেলার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে বিভান উঠে চলে গেলো।বেলা ভাবছে কালকের দিনটা কেমন যাবে?সবাই মেনে নিবে তো?এরই মাঝে বিভান ফিরে আসে।বেলাকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

''কি ভাবছো?"
''বাসার কথা?কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে সবাই?"

বিভান হেসে বেলার পাশে বসলো।ওর হাত কোলে নিয়ে সেটার ওপর অপরহাত টি রেখে বলল,

''বেলা যা করেছো সেটা একটা পরিবারের জন্য মেনে নেয়া খুব কঠিন।তারা ব্যাপারটিকে সহজ ভাবে মেনে নেবেননা।এমন যদি হতো তুমি তাদের বলেছিলে আমাদের সম্পর্কের কথা কিন্তু তারা মেনে নেননি তাহলে কথা ছিলো।কিন্তু বিয়ের দিন বেরিয়ে এলে সেটা তোমার পরিবারের জন্য খুব অপমানজনক ছিলো।"

বেলা মন খারাপ করে বলল, 

''তাহলে আপনি কিছু করতেননা?নিয়ে আসতেন না আপনার কাছে?"
''বেলা অবশ্যই যেতাম।আর তোমার বিয়েটাও খুব জলদি হচ্ছিলো। বুঝতেই পারিনি।সাঁঝ প্রত্যেকদিনের খবর আমাকে দিতো।ভাবছিলাম কিভাবে তোমার কাছে যাওয়া যায়।"
''বিভান আমি কি করেছি জানিনা।নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি খুব কিন্তু উত্তর পাইনি। সেদিন আপনার সাথে শেষবারের মতো দেখা হওয়ার পর সাঁঝ খুব বুঝায আমাকে।মনে হতে থাকে আপনাকে হারিয়ে ফেললে আমি থাকতে পারবোনা।সেদিন ইদরীস এসেছিলো।সে আমাদের দেখে ফেলেছিলো এবং আমাকে বাজে ভাবে কথা বলে।ঘরবন্দী করে রাখতে চেয়েছিলো।আমি থাকতে পারতামনা এমন পরিবারে।আমি বেঁচে ও লাশ হয়ে থাকতাম।"

বেলা কে থামিয়ে দেয় বিভান।তারপর বলল,

''আল্লাহ তা'লা যা করেছেন ভালোর জন্যই।তবে পরিবারের জন্য আমাদের ব্যাপারটা মেনে নেয়া সহজ নয়।তবে চেষ্টা করতে হবে আমাদের।সবাইকে মানিয়ে নিতে হবে তাইনা?"
''হুম।"

বিভান হেসে বেলার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন