রংধনু - পর্ব ৩৮ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


নিশাদের ফোন বাজছে।তবে সামনে ফারুজ সাহেবের অনবরত বসে থাকার কারনে নিশাদ ফোন রিসিভ করতে পারছেনা।লোকটা উঠছে ও না।শুধু পানি চিবোচ্ছে।কম্পিউটারের কোনা দিয়ে নিশাদ ফারুজ সাহেবকে একবার দেখে নেয়।তার ঠোঁট প্রচন্ড রকমের লাল হয়ে আছে।চিবুকে পানের পিকের একটু ছিটে পড়েছে।সাদা শার্ট ও বাকি নেই।নিশাদ অস্ফুটস্বরে বলল,
''উফফ!!"
তৎক্ষনাৎ ফারুজ সাহেব হাসতে হাসতে বলল,
''''কি? কিছু বললেন মিঃ নিশাদ রাহমান?"
নিশাদ ঠোঁট টিপে একটু হাসলো।মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''না স্যার।একচুয়ালি আমি মাইগ্রেনের পেশেন্ট তো।মাথা ব্যাথা যায় আসে।"
ফারুজ সাহেব গা কাঁপিয়ে হেসে বললেন,
''তোমরা আজকালের পোলাপানরা সামান্য একটা ব্যাপারকে এতো বাড়িয়ে দাও বুঝিনা আমি।মাইগ্রেন টাইগ্রেন এসব কিছু মানিনা আমি।তোমার অফিস বাদ পড়লে সব কাজ আমাকে করতে হয়।কেন বাপু তুমি কি আমাকে টাকা দাও মাসে মাসে?"
নিশাদ চোখের কোনা দিয়ে লোকটার দিকে তাকায়।এখন অনেক কিছু বলতে পারতো ও।তবে কিছু বলবেনা ও।কারন চাকরীটা ওর দরকার।ফারুজ সাহেব কখনোই ওর অনুপস্থিতিতে কাজ করেনা বরং ওর জন্য ঝুলিয়ে রাখে।সাথে বোনাস থাকে ওনার নিজের ও কিছু কাজ।মাথার দুপাশে টনটন করছে নিশাদের।এদিকে বারবার ফোন আসছে।ফারুজ সাহেব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,
''ফোন রিসিভ করো জলদি।কে মরে যাচ্ছে দেখো।"
তারপর ফিসফিস করে বলছিলেন,
''একদম কমনসেন্স বলতে কিছু নেই।যত্তসব ফাওলের দল।ঘরে সংসার পেতে বসে আছে।"
নিশাদ ফোন হাতে নিয়ে ওনার দিকে রেগে তাকায়।আজ অফিস না হলে বুঝিয়ে দিতো এই লোককে।পাত্তা না দিয়ে ফোন রিসিভ করে নিশাদ।অপরপাশ থেকে ইমতিয়াজ বলল,
''কই তুই?"
নিশাদ হালকা শ্বাস ছেড়ে বলল,
''অফিস।কেন?"
''শোন এই সপ্তাহে সিরাজগঞ্জ  যাবি।"
নিশাদ অনেকটা অবাক হয়ে ডেস্ক থেকে একটু সরে আসে।তারপর ধীরে বলল,
''সিরাজগঞ্জ কেন?"
''ভুলে গেছিস?ভূবনের বিয়ে পনের তারিখ।"
নিশাদ এবার মনে করতে পারে।হালকা হেসে বলল,
''বুঝিসই তো কাজের চাপ বাসার চিন্তা।"
''বুঝি।শোন তুই যাবি।"
নিশাদ হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।যাওয়ার কথায় ইদ্রিকে মনে পড়ে ওর।সেখানে তো ইদ্রি ও থাকবে কারন ওদের কাজিনের সাথে বিয়ে হচ্ছে যেহেতু।নিশাদকে চুপ দেখে ইমতিয়াজ আবার ও বলল,
''চুপ কেন?"
''আমি যাচ্ছিনা সরি।"
ইমতিয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলল,
''তুই আমাকে মানা করছিস শিওর?তুই মানা করতে পারিসনা।কি হয়েছে?বল।"
নিশাদ কিছুক্ষন চুপ করে বলল,
''দেখ অপিসে অনেক কাজ।তারওপর আমার কয়েকদিন বাদ পড়ে গিয়েছিলো।তাই আমি আসবো না।"
ইমতিয়াজ বলল,
''নিশাদ ছয় সাত দিনে কিছু হয়ে যাবেনা।আর তোকে আসতে হবে।সেলিনা মামী তোর কথা অনেক বলছিলো।তোকে দেখতে চেয়েছেন ওনি।জানিসই তো ছোটবেলা থেকে ওনি তোকে কতো আদর করতো।তুই না করতে পারিসনা।তুই বললে তোর বসকে আমি বুঝাবো বাট প্লিজ আসবি তুই।"
নিশাদ বড্ড অস্থির বোধ করছে।কি করে ও বোঝাবে ইমতিয়াজকে কেন ও না করছে?নিশাদ বলল,
''দোস্ত ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আমি পারবোনা।"
''দেখ তুই যদি এমন জেদ করিস তাহলে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে ভুলে যাস।আর আরেকটা কথা ইদ্রি ভালো নেই।তুই কয়েকদিন পরে আসিস।আর কিছু বলবোনা।বাকি ডিসশান তোর।"
নিশাদ কে আর কিছু বলতে না দিয়ে ইমতিয়াজ কল কেঁটে দেয়।নিশাদের মন খুব খারাপ হয়ে যায় একদিকে বেস্টফ্রেন্ড অপরদিকে ইদ্রি।কি করবে ও?নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।তখনই পিছন থেকে ফারুজ সাহেব চিৎকার করে বললেন,
''পিরিত শেষ হইলে আসতে পারেন।"
নিশাদ রেগে পিছনে তাকায় তবে সেটা ফারুজ সাহেবে দৃষ্টির আড়ালে।
........................অদ্ভুত প্রশান্তির চিহ্ন হুমায়রার সারা মুখ জুড়ে।আজ হৃদয়ের সাথে ওর বেশ ভালো সময় কেঁটেছে।দুজনে বোটানিকাল গার্ডেনে বসে আছে।আজ ওর একে বারেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছেনা।ইচ্ছে হচ্ছে হৃদয়ের সাথে সারাটাজীবন কাঁটিয়ে দিতে।হৃদয় হুমায়রার ফোনে সবার ছবি দেখছিলো।হুমায়রা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো ওকে।হঠাৎ লাবনীর ছবিতে এসে থামে হৃদয়। হেসে বলল,
''ও তোমার বোন?"
''হ্যা কেন?"
''না এমনি।বেশ কিউট।"
''থ্যাংক ইউ।ও সবার ছোট।"
''হুম।"
হৃদয় বারবার ঘুরে লাবনীর ছবিই দেখছিলো।তবে হুমায়রার সেদিকে চিন্তা নেই ওর পুরো মনযোগ হৃদয়ের মাঝে।আজ বেশ সুন্দর লাগছে ওকে।কালো শার্ট আর নীল জিন্স প্যান্ট পরে আছে।প্রত্যেকদিনকার মতো হাতে অনেকগুলো চেইনের ব্রেসলেট।হৃদয় ফোন টা হুমায়রা কে দিয়ে বলল,
''একটা আবদার।"
হুমায়রা ভ্রু কুঁচকে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলো, 
''কি?"
''তুমি খারাপ মনে করোনা বাট তোমার ঠোঁটের নিচের খয়েরী তিলটা আমার বড় ভালো লাগে।যদি কিছু মনে না করো আমি এটাকে আদর করতে চাই।"
হুমায়রা একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
''প্লিজ এসব না।আমার ভালো লাগেনা।বিয়ের পর সব।"
হৃদয় হুমায়রার বাহু ধরে ওকে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে বলল,
''বিয়ের পর তো তুমি পুরোটাই আমার।দুবছর পর তোমার বাসায় সম্বন্ধ পাঠাবো।ততো দিনে তোমাকে স্পর্শ করার আদর করার ইচ্ছাটা পাগলামীতে পরিনত হবে।তখন কি কোন পাগল কে বিয়ে করতে পারবে বলো?তার আগে এই পাগলটাকে একটু ঠান্ডা করে নাও জান।"
হুমায়রা কি বলবে বুঝতে পারছেনা।হৃদয়ের দিকে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে বলল,
''দেখো আমার এসব পছন্দ না।তবে এটা লাস্ট। আর কখনো এমন আবদার করোনা প্লিজ।
হৃদয় মৃদু হেসে হুমায়রাকে কাছে টেনে ওর ঠোঁটের নিচে ঠোঁট চেঁপে ধরে ঠিক খয়েরী তিলটার ওপর।হুমায়রা চোখ বুজে হৃদয়ের শার্ট খামচে ধরে।হৃদয় হুমায়রার চিবুক ছুঁয়ে ওর অধর যুগল শুষে নিতে শুরু করে।নিজের ঠোঁটজোড়ায় এমন অদ্ভুত ছোঁয়া কিছুসময়ের জন্য হুমায়রাকে অস্থির করে তুললে ও বেশি সময় তা স্থায়ী হলোনা।হৃদয়ের ঠোঁটজোড়ার চলন ধীরে ধীরে বাড়ছিলো কিন্তু হুমায়রা ওকে জোর করে সরিয়ে ভয় পেয়ে বলল,
''এসব ঠিক না।আমি বাসায় যাবো।নাহলে দেরি হয়ে যাবে।"
হৃদয় কিছুটা হকচকিয়ে বলল,
''সরি হুমু।আসলে কখন এতোটা হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি।বাট ইউ ট্রাস্ট মি রাইট?"
হুমায়রা মলিন চোখে হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায়।
.............................বেলার এমন অদ্ভুত আচরনে বিস্ময়ের ঘোর কাঁটেনি বিভান।বেলাকে একয়দিন দেখেছিলো বিভানের মনযোগ পাওয়ার লোভে কতো কথা বলছিলো।কিন্তু বিভান!!!ও তো অভিমানের কারনে স্ত্রীকে সময়ই দেইনি।ওর এই আচরন হয়ত বেলাকে এমন করো দিয়েছে।তবে বিভান মানতে পারছেনা।বেলা এভাবে পরিবর্তন হতে পারেনা।পিসির কিবোর্ডে বিভানের চলন্ত আঙ্গুল গুলো থেমে যায় গভীর চিন্তায়।
এদিকে দুপুরে মেয়েকে খাওয়াচ্ছিলো বেলা।পূর্না ভাত মুখে নিয়ে বলল,
''মা গপ্প বলো।"
বেলা হেসে বলল,
''গল্প পারিনারে মা।তুমি খেয়ে নাও।"
''না গপ্প বলো।"
বেলা একটু চিন্তা করে বলল,
''চেষ্টা করছি।এতক্ষনে তুমি গিলে ফেলো।"
পূর্না বড্ড জেদী।গল্প শোনা ছাড়া খাবার গিলবেনা।বেলা গল্প বলতে নিচ্ছিলো তখনই সাঁঝের কল আসে ওর ফোনে।বেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
''আন্টির সাথে কথা বলবে?"
''কোন আত্তি?"
''ঐ যে কাল কথা বললে যে?"
পূর্না মনে করার ভান করে হেসে বলল,
''ও ওই আত্তি গুলা?দাও কতা বলি।"
বেলা কল রিসিভ করে কানে ফোন রাখে।সাঁঝ বলছিলো, 
''ভালো আছিস আপা?"
''এইতো।তোর কি খবর?"
''আলহামদুলিল্লাহ। বাবু আর ভাইয়া কেমন আছে?"
''ভালোই।"
বলে মেয়ের চুলে হাত বুলায় বেলা।তারপর জিজ্ঞেস করলো,
''সবাই কেমন আছে?আব্বা আম্মার কি খবর?"
''ভালোই।"
বেলা আরো কিছু বলতে যাবে তখন পূর্না বলল, 
''তুমি না বলতিলা আন্তিল তাতে কতা বলবো।"
সাঁঝ হেসে বলল,
''আপা ভিডিও কল দেই?ওকে দেখবো।কেমন পাকনা কথা বলছে বুড়ি।"
বেলা হেসে বলল,
''দে কল।"
সাঁঝ কল কেঁটে ভিডিও কল দেয় ম্যাসেঞ্জারে।পূর্না সাঁঝকে দেখে শব্দ করে হেসে বলল,
''বালো আতো?"
''হ্যা মামনি তুমি কেমন আছো?"
''বালো।আত্তি তুমি একানে আতো।"
''আসবো বাবা।আর তোমরাই চলে আসো এখানে।নানু নানা মামা রা আছে।অনেক গুলা খালামনিও আছে।"
''ওহ।আতবো।বাবা আতবে?"
সাঁঝ হেসে বলল,
''তুমি বললে তোমার বাবা অবশ্যই আসবে মা।"
পূর্না কি যেন ভেবে বেলার দিকে তাকিয়ে বলল,
''মা তলো দাই।"
বেলা ম্লান হেসে বলল,
''কই যাবা মা?"
''আত্তিদের কাতে।"
''পরে যেও।আগে খেয়ে নাও।"
খাওয়ার কথায় মুখ ফূলিয়ে নেয় পূর্না।সাঁঝের দিকে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,
''আত্তি তোমাল বোন কে কিতু বলো।"
সাঁঝ আর বেলা দুজনেই অবাক।সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,
''কি বলবো আম্মু?"
''তোমাল বোন তালাদিন কেতে বলে।"
সাঁঝ পূর্নার বিচার শুনে হেসে ফেললো।
রাতে বিভান ফিরে আসে।বেলা চুলোয় তরকারি গরম করছিলো।বিভান ঘরে ঢুকেই দেখলো ফ্লোরে মাদুর পাতা।সেখানে পূর্না খেলছে কিছু হাবিজাবি জানিস দিয়ে।বিভান অনূভব করলো মেয়েটাকে খেলনা কিনে দেয়া উচিৎ।একা থাকে।কিছু দিয়ে খেলতে হবে ওর।বিভান মেয়ের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
''আপনার খেলনা লাগবে আম্মু?"
বাবার কথায় মুখ তুলে বিভানের দিকে হাসে পূর্না।উজ্জ্বল হেসে বলল,
''অনেক গুলো পুতুল লাগবে।"
''আচ্ছা মা কাল বাবা মা আর তুমি পুতুল কিনে আনবো অনেক গুলো।"
ড্রয়িংরুম থেকে বিভানের কথা শুনে পাকঘর থেকে বেরিয়ে আসে বেলা।বিভান আর পূর্না যতোবারই একসাথে দেখে ওর মন টা যেন ভরে উঠে অজানা আনন্দে। 
..........................সেদিন রাতের পর থেকে সাঁঝের জন্য সাইমনের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিলো।পুরো শরীর ভরে গিয়েছিলো অসহ্য যন্ত্রনায়।সেদিন কি করতে ভাইয়ের কথা বলেছিলো ও?সাইমন জানে সাঁঝ ওর ভাই বোনের প্রতি দূর্বল তবে বড় ভাইয়ের প্রতি অনেকটাই।সাঁঝ ওকে বলেছিলো নিশাদ ভাই অনেক খাঁটে।তার কাছে তার পরিবার আগে।সাইমনের ও বেশ ভালো লাগে সাঁঝের মুখে ওর ভাইবোনের কথা শুনেসাঁঝের কথায় বুঝতে দেরি হয়নি ওদের ভাইবোনের দৃঢ় বন্ধনের গভীরতা।কিন্তু সাইমন যে পারছেনা আর।এই তো বড় মামা ওকে কয়েকবার ডেকে গিয়েছিলেন ডিনারের জন্য।কিন্তু ও পাঁচমিনিট বলে বলে পচিশমিনিট কাঁটিয়ে দিয়েছে।সাইমন সাঁঝের নম্বরে ফের কল দিলো।কিন্তু ফোন রিসিভ হয়নি।সাইমন মেসেজ পাঠালো,
''সত্যি খুব খারাপ হবে এবার।"
হঠাৎ মামা এসে রেগে বললেন,
''তুই কি বাসার নিয়ম ভুলে গেছিস?জানিস তো রাত দশটার পর ডিনার নিষিদ্ধ। সেটা যেই হোক না কেন?পুরো পরিবারের জন্য একই নিয়ম।সাইমন জানে মামা খুব রাগী মানুষ।অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড।সময়ের বাহিরে কখনো কোন কাজ করেননা।মেজর জেনারেল বলে কথা।সাইমন মামার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।ওনি রেগে বললেন,
''থাক সারারাত না খেয়ে।দশটা বিশ বেজে গেছে।"
সাইমন কিছু বলতে পারেনা।মামার মুখের ওপর কারোর কিছু বলার সাহস নেই।প্রচন্ড খিদেয় মেজাজ অনেক বিগড়ে গেছে ওর।মনে মনে দোয়া করছিলো আজ রাত অন্তত সাঁঝ যেন কল না দেয়।কারন ও কি বলে ফেলে কে জানে?

!!!!

আজ সকালে কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে এসেছিলো আদনানের।একটু জলদিই এসেছিলো অফিসে যার কারনে সকালের নাস্তাটা হয়নি।কাজ শেষে ক্যান্টিনে চলে আসে লাঞ্চের জন্য।ইদানীং প্রিয়াশা মেয়েটা ওর একটু বেশিই চোখে পড়ছে।আসলেই কি ওর চোখেই পড়ছে নাকি ও নিজেই দেখছে।এইতো সেদিন নীল শাড়ী পরে যখন অফিসে ঢুকছিলো তখনকি সবার প্রথমে ওর চোখে পড়েনি?সেদিন আশেপাশে অনেকেই ছিলো কিন্তু আদনান যেন ওকে দেখেছে।মেয়েটাকে নীল শাড়ীতে কি হিমুর রুপার মতো লাগেনি?হয়ত আরো বেশিই সুন্দর লাগছিলো।নীল কাঁচের চুড়ি,ছোট্ট কালো টিপ কপাল বরাবার আর চোখের নিচে একটু করে কাজল।কতোটাইনা ভালো লাগছিলো।আদনান একটু হাসে।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয় এটা ঠিক নয়।ওর চিন্তা করাটা ভুল।মেয়েটা বিধর্মী।আদনান ওর কথা ভাবতে ও পারেনা।প্রিয়াশা কে মন থেকে ঝেড়ে খেতে থাকে আদনান।কিন্তু প্রিয়াশার সেই হালকা খোঁপা কাজল, কালো চোখ,কপালপর ছোট্ট টিপ আর একহাতের নীল চুড়ি ওকে বারবার সেই দিনটায় ফিরিয়ে নিচ্ছিলো।আদনান তো সেদিন প্রিয়াশা কে দেখে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো।ওর কোকড়ানো চুল গুলোয় করা খোঁপা খুলে যাচ্ছিলো।প্রিয়াশা সেগুলো বাঁধায় ব্যাস্ত ছিলো আর আদনান ছিলো ওকে দেখায় মগ্ন।কথা গুলো ভাতেই আদনান আবার প্রয়াশ চালাচ্ছিলো প্রিয়াশা কে মন থেকে ঝেড়ে ফেলার কিন্তু তখনই ওর ওর প্রিয়াশা লাঞ্চ নিয়ে ওর টেবিলোর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো।আদনানের সাথে চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসে প্রিয়াশা।আদনান সেই হাসিতেই যেন আরেকবার মুগ্ধ হলো।হাত নেড়ে প্রিয়াশাকে বলল,
''আমার এখানের একটা চেয়ার খালি।এসে বসুন।"
প্রিয়াশা হাত নেড়ে জানায় ঠিক আছে।আদনান ও কিছু না বলে খেতে থাকে।কিন্তু পরমুহূর্তে প্রিয়াশা ওর সামনের চেয়ারে বসে বলল, 
'''এখানেই বসতে হলো।ওদিকটায় বড্ড রোদ ছিলো।"
আদনান মৃদু হেসে খাওয়ায় মন দিলো।আজ প্রিয়াশা সাদা সালোয়ার কামিজ আর মেরুন রং এর উড়না পরেছে।আদনানের কাছে রং এর মেলবন্ধন টা বেশ মনে হলো।তারওপর কপালে ছোট্ট কালো টিপ।প্রিয়াশাকে এক ঝলক দেখে মাথা নিচু করে খেতে থাকে আদনান।প্রিয়াশা হাত জোড়া খাড়া করে দুটো কে জোর করে চোখ বুজে কি যেন করছিলো।আদনানের বেশ কৌতুহল হলো।আসলে এ ধর্মের লোকের সাথে ওর হাঁটা চলা হয়নি কখনো।প্রিয়াশা চোখ খুলতেই আদনান বলল,
''একটু আগে কি করছিলেন এভাবে?"
প্রিয়াশা একটু হেসে বলল,
''খাবার আগে আপনারা যেমন দেয়া করেন আমি ও ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম।"
''ওহ।"
আদনান হেসে আবার ও খেতে থাকে।প্রিয়াশাকে দেখে মনে হলো এবার যেন সাহস পেলো।এমনিতেই মেয়েটা ভয়ে থাকে।তবে আদনানের মনে হলো আজ স্বাভাবিক লাগছে।প্রিয়াশা আদনানের উদ্দেশ্যে বলল,
''কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?"
আদনান হাসিমুখে মাথা ঝাঁকালো।প্রিয়াশা বলল, 
''আপনার পরিবারে কে কে আছেন?"
প্লেটে চামচ রেখে ন্যাপকিন  দিয়ে মুখ মুছে আদনান বলল,
''আমার বাবা মা আর আমরা সাত ভাইবোন।"
প্রিয়াশা যেন খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
''সাত!!!"
''জি সাত ভাইবোন আমরা।আমি তিন নম্বর।"
''ওহ।আপনার বড় জন কি করেন?"
''আমার বড় বোন ম্যারিড। ইন্ডিয়া থাকেন।বড় ভাই জব করে তারপর আমি।"
''ওহ।ঐদিনকার মেয়েটা আপনার ছোট বোন তাইনা?"
''হুম ও সবার ছোট।"
''আপনার সাথে চেহারায় মিল আছে।"
আদনান মৃদু হেসে পানি খেয়ে নেয়।প্রিয়াশা খেতে থাকে।আদনান প্রিয়াশার দিকে তাকায়।মেয়েটার চেহারা মায়ায় পরিপূর্ণ। ইচ্ছে হয় দেখলে দেখতে থাকি।হঠাৎ বলল,
''আপনার পরিবার?"
প্রিয়াশা খাওয়ার মাঝেই কাশতে শুরু করে।আদনান পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় ওর দিকে।প্রিয়াশা পানি খেয়ে মাথা নামিয়ে রাখে।আদনান কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
''সব ঠিক আছে?"
প্রিয়াশা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''ঠিক আছে।"
''আপনার পরিবারে কেকে আছেন?"
''চাচা চাচী আর চাচাতো ভাই।"
''ওহ।"
আদনান একটু হেসে উঠে দাঁড়ায়।তারপর ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল,
''চললাম।স্যারকে অবশ্য বলে দিয়েছি।একটু শপিং এ যাবো।"
আদনান চলে যেতে থাকে।হঠাৎ প্রিয়াশা দৌড়ে এসে বলল,
''শুনুন।"
আদনান পিছে ফিরে তাকায়।প্রিয়াশা এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।মেয়েটার গাল দুটো।লাল হয়ে আছে একদম।আদনান একটু ভ্রু কুঁচকে দাঁড়ায়।প্রিয়াশা বলল, 
''স্যার আপনি শপিং এ যাচ্ছেন।আমার ও কিছু কাজ আছে।"
আদনান কিছুক্ষন চিন্তা করে বলল,
''আমার সাথে যেতে চাইছো?"
''জি স্যার।"
''ওকে চলুন।তবে একটা শর্ত।"
প্রিয়াশা কিছুটা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আদনানের দিকে তাকায়।আদনান বলল, 
''বাহিরে গিয়ে স্যার বলবেননা প্লিজ।"
''কেন?"
প্রিয়াশার চেহারায় আবার সেই ভয়ের ছাপ।আদনান শান্তা কন্ঠে বলল, 
''আমার ভাল লাগেনা।"
প্রিয়াশা অবাক।বলে কি এই লোক?স্যার ডাক পছন্দ না!!!!প্রিয়াশা চিন্তায় পড়ে যায়।হাসবেনা কাঁদবে বুঝতে পারছেনা।আদনান ওর ঘোর ভাঙ্গিয়ে বলল,
''চলুন।"
''জি স্যার।"
''হুম।"
..........................দুপুর দুটো বেলা বিভান পাশাপাশি শুয়ে আছে।বেলার পাশে পূর্না শুয়ে।ও আজ জেদ ধরেছে মাঝে ঘুমোবেনা।বেলা অনেকবার মানা করলে ও বিভান বলেছিলো,
''যাও মা তোমার যেদিকে ইচ্ছে ঘুমোও।"
পূর্না খুশি হয়ে বেলার পাশে ঘুমিয়ে যায়।অবশ্য ওদিকে দেয়াল থাকায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।বেলা বিভান দুজনের চোখে ঘুম নেই।পূর্না এমনভাবে শুয়ে আছে যে বেলা ওপাশে যেতে পারছেনা।বিভানের দিকে চেপে শুয়ে থাকতে হচ্ছে।তবে ওর কষ্ট হচ্ছেনা কষ্ট হচ্ছে শুধু এতোটুকু ভেবে যে বিভান ওর দোষ দেখতে গিয়ে ওর কষ্টটাকে দেখতে পারেনি।ও তো মা ছিলো।বাবু মরে যাওয়াতে কি কম কষ্ট ছিলো ওর?সত্যিটা জেনে ও বুকের গভীরে বন্দী রাখা সহজ না।এক মায়ের জন্য তো সেটা অনেক কঠিন।বিভান বুঝতে পারেনি।বেলার চোখের কোনা ভিজে আসতেই মুছে নেয় সেটাকে।তবে বিভানের চোখ আড়াল করতে পারেনি।বিভান বেলার দিকে তাকিয়ে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
''বেলা পূর্নার স্কুলের কথা কিছু ভাবলে?"
''উহুম।ও আসলোই ঐদিন।এখনো ছোট।"
''তারপর ও ভাবতে হবে।"
বেলা কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।বিভান শ্বাস ফেলে  শুয়ে পড়ে।কেমন অস্থির লাগছে ওর।প্রায় একমাস হচ্ছে বেলা কাছে পায়নি ও।তবে নিজের রাগ জেদের কারনে।বেলার দিকে ফিরে বিভান তবে বেলা পূর্নার দিকে ফিরে শুয়ে আছে।
বিভান কিছুক্ষন বেলার দিকে ফিরে থেকে অপরপাশ ফিরে শোয়।বেলার কান্না আসতে চায়।এমন টা করে ওর ভাল লাগছেনা।তবে লোকটার এতো অবহেলা নিতে ও পারছিলনা।ও তো ভালোবাসে তাকে।সন্ধ্যায় বেলা চা বানিয়ে পূর্নার জন্য প্যানকেক বানাতে শুরু করে বেলা।পূর্না বেলার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো।তবে ছোট তাই কি করছিলো তা দেখতে পারছিলোনা।পূর্না লাফিয়ে যাচ্ছিলো দেখার জন্য কিন্তু ব্যার্থ হয়ে বেলাকে বলতে লাগলো, 
''মা কোলে নাও আমি দেকবো।"
''না মা।তুমি বাবার কাছে যাও।এখানে অনেক গরম।কষ্ট হবে তোমার।"
''না আমি দেকবো।কোলে নাও।"
বেলা বাধ্য হয়ে কোলে নিয়ে কেক বানাতে থাকে।বিভান পাকঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পূর্না কে বেলার কোলে দেখে।এতো গরম তারওপর একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কাজ করা সহজ না।তারওপর পূর্না ছোট গরমে ঠান্ডা লাগবে মেয়েটার।বিভান বলল,
''পূর্না বাবার সাথে আসো।কিচেনে গরম।"
''না কিতেনে তাকবো।"
পূর্না জেদ করতে লাগে।বিভান এসে বেলার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
''তোমার মা কাজ করছে।তুমি আমার সাথে আসো।"
বেলা মেয়ের দিকে মমতাময়ী হাসি দিয়ে বলল,
''যাও আম্মু বাবার সাথে যাও।আমার শেষ হয়ে যাবে।"
পূর্না চুপচাপ বিভানের কোলে উঠে বেরিয়ে যায় কিচেন থেকে।বেলা বিভান আর মেয়ের যাওয়ার পানে অনেকটা সময় চেয়ে থেকে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মেয়েকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে আসে বিভান।বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে।বিভান মেয়েকে নিয়ে ব্যালকনিতে রাখা সাদা চেয়ারে বসে।পূর্না বিভানের ঘড়ি নিয়ে খেলছে।মেয়ের খেলা দেখছিল বিভান।পূর্না হঠাৎ বলল,
''দানো বাবা আদকে আন্তিল।তাতে কতা হইছে।"
বিভান একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
''কোন আন্টি আম্মু?"
''ঐদিন অনেকগুলো আন্তি মামাল।তাতে কতা বলেতিলাম না?"
''ওহ বুঝলাম।আন্টি কি বলেছিলো?"
পূর্না মনে করতে থাকে।আসলে সাঁঝের সাথে কি কথা হয়েছিলো ও ভুলেই গেছে।তাই পূর্না চেষ্টা করে ও পারলোনা।তখনই বেলা রুমে এলো প্যানকেকে মধু দিয়ে।বিভান আর পূর্নাকে ব্যালকনিতে দেখে বেলা প্লেট নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বিভানের পাশের চেয়ারে বসে।বেলা দেখে পূর্না হাসে।বেলা প্যানকেক একটু ছিড়ে বলল,
''হা করো আম্মু।"
পূর্না জেদ করে বলল,
''আদে বাবাকে দাও।"
পূর্নার কথায় বেলা বিভান দুজনেই অবাক দৃষ্টে একে অপরকে দেখতে থাকে।
........................এদিকে ইমতিয়াজ ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়।সৈয়দা বেগম সালাম ফিরিয়ে বললেন,
''আসছিস বাবা?"
''হা।ইদ্রির কি খবর?খেয়েছিলো কিছু?"
''অনেক জোর করে খাওয়ালাম।একা আছে সারাদিন কথা ও বলেনি।"
ইমতিয়াজ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে।বুঝতে পারছেনা কি হলো ইদ্রির?হঠাৎ এমন কেন করছে মেয়েটা?ইমতিয়াজ ইদ্রির রুমে দাঁড়িয়ে দেখলো খাটে বসে আছে।চুল গুলো উঁচু করে ঝুঁটিতে বাঁধা।ইমতিয়াজ ইদ্রির পাশে এসে বসতেই ইদ্রি ভাইয়ের দিকে তাকায়।ইমতিয়াজ ইদ্রির গাল স্পর্শ করে বলল,
''কি হলো তোর?"
ইদ্রি মাথা নাড়ে।কথা ও বলতে পারছেনা।গলা খুব ভারি হয়ে আছে।ইমতিয়াজ বলল,
''কথা বল।মাথা নাড়ছিস কেন?"
ইদ্রি ভারি গলায় বলল,
''ভালো লাগছেনা ভাইয়া।"
''কি হইছে খুলে বল।"
''বললাম তো সিনেমা।"
অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথা বলতে হচ্ছে ইদ্রিকে।ইমতিয়াজ এবার রেগে যায়।একটা সিনেমা দেখে কেউ এমন ভেঙ্গে পড়তেই পারেনা।ইমতিয়াজ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
''থাপড় দিয়ে গাল ফাটাবো আরেকবার সিনেমার কথা বললে।কি হইছে সত্যি করে বল।কলেজে ও যাচ্ছিসনা।সামনের বছর ইন্টার পরীক্ষা তোর।"
ইদ্রি কিছুটা কেঁপে উঠে।ইমতিয়াজের ধমকে ওর চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেনি।বলতে লাগলো,
''বান্ধুবীদের সাথে ঝগড়া। ওরা আমাকে বুঝেইনা।শুধু ভুল বুঝে।বুঝাইতে চাইলে ও বুঝেনা।"
ইমতিয়াজ গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
''এজন্য এমন করতে হয়?কাল থেকে নিশাদকে আসতে বলবো?"
ইদ্রি মাথা নেড়ে বলল,
''না ভাইয়া পরে।"
''ওকে।শোন আমরা নানুর বাড়ি যাবো।ইশিতার বিয়েতে।আমার বন্ধুরাও আসবে।"
''না আমি যাবোনা।"
হঠাৎ বলে উঠে ইদ্রি।ইদ্রির না বলায় অনেক অবাক ইমতিয়াজ।ও কেন মানা করছে?ইমতিয়াজ রেগে বলল,
''কেন যাবিনা?"
ইদ্রি নিশ্চুপ হয়ে যায়।কি বলবে ও?কারন কি বলবে?ইদ্রির মৌনতা ইমতিয়াজ কে রাগিয়ে দিচ্ছে।ও ভেবেছিলো বাহিরে গেলে ইদ্রির ভালো লাগবে।ইমতিয়াজ খাট থেকে উঠে বলল,
''কোন তর্ক চাইনা।পরশু মামা আসবে।তুই আর মা চলে যাবি।এটাই ফাইনাল।"
বলেই ইমতিয়াজ দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন