রংধনু - পর্ব ৪০ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


সৈয়দা বেগম মেয়ের লাগেজ গুছাচ্ছেন।ইদ্রি সেই আগের মতো চুপচাপ বসে আছে।চোখের কোনা জ্বলজ্বল করছে ওর।মেয়েকে বসে থাকতে দেখে সৈয়দা বেগম হুংকার দিয়ে উঠেন।বলতে থাকেন,
''এত বুড়া মেয়ের কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছি তুই বসে আছিস কেন?"
ইদ্রি ক্রন্দনরত কন্ঠে জোরে বলল,
''বললাম না যাবোনা।এত বিরক্ত কেন করছো?"
সৈয়দা বেগম মেয়েকে কাঁদতে দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠেন।মেয়ের পাশে এসে খাটে বসে বললেন,
''তোর কি হইছে মারে বল।জানিস কতো টেনশন লাগে আমার?কতো ভয় করে তোকে নিয়ে।"
মায়ের আদরজড়ানো কথায় ইদ্রি নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।কেঁদে কেঁদে।বলছিলো,
''মা আমি খুব খারাপ?খুব বিশ্রী দেখতে?কেউ আমাকে ভালবাসেনা।সবাই চলে যায় আমাকে ছেড়ে। আমি কি এতোই বাজে দেখতে? মা বলো না।কেন এমন হয়?কেন বলো না মা।"
সৈয়দা বেগম মেয়ের মাথা বুলিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন,
''বোকা মেয়ে এভাবে কাঁদেনা।তুই জানিস কতো সুন্দর তুই।আমার রাজকন্যা তুই।এভাবে বলিস না।সবাই তোকে ভালবাসে।তোর বাবা আমি তোর ভাইয়া।"
ইদ্রি আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে।ও যার ভালবাসা চায় সেই তো ভালবাসছেনা।ওকে আঘাত করে চলে গেছে।একটা বার ও ফোন বা মেসেজ দেয়নি।এতো পাশান কেন লোকটা?কেন বুঝেনা ওর ভালোবাসাটাকে?ও তো তাকে চায় শুধু তাকে।সে কি বুঝেনা?কেন বুঝেনা?যাকে ভালবাসে তার চোখ নাকি পড়া যায়।নিশাদ ওকে ভালোইবাসেনা তাই ওর চোখের ভাষা ও বুঝতে পারেনি।
→→→→→→ইমতিয়াজ বন্ধুর সাথে কথা বলে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে।নিশাদ কথাটা কেন বলল?ও হোটেলে থাকবে কিন্তু কেন?কি হয়েছে ওর?ইমতিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনের দিকে চেয়েছিলো।নিশাদকে আজকাল বড় অসহায় লাগে।এতো ম্লান হয়ে গেছে চেহারাটা।ইমতিয়াজের বারবার মনে হতে থাকে নিশাদ কিছু লুকাচ্ছে।কিন্তু কি?নিশাদ ওর বেস্টফ্রেন্ড। কখনো কিছু লুকোয়নি তাহলে এখন?এমন কি হয়েছে যে লুকোচ্ছে?ইমতিয়াজ ফোনটা খাটের ওপর রেখে বোনের রুমের দিকে এগুলো।রুমে গিয়ে দেখলো ইদ্রি বসে আছে খাটের ওপর।ওর প্যাকিং শেষ হয়ে গেছে।ইদ্রির কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলায় ইমতিয়াজ। ভাইয়ের ছোঁয়া পেয়ে ইদ্রি চোখ মুছে নেয়।ইমতিয়াজ একটু হেসে বোনের পাশে বসে বলল,
''সব গুছানো কমপ্লিট তাহলে?"
ইদ্রি খুব ধীর কন্ঠে জবাব দিলো, 
''জি।"
''হুম।শোন ঐখানে গেলে তোর ভালো লাগবে।ফ্রেন্ডদের সাথে ঝগড়া হলে এতো মন খারাপ করতে নেই।কিছুদিন পর দেখবি ওরা তোর কাছে এসে মাফ চাইবে।তোরা আবার ফ্রেন্ড হয়ে যাবি।একবার জানিস আমরা যখন ক্লাশ ফাইভে ছিলাম তখন নিশাদ আমার শার্টে কলমের কালি ভরিয়েছিলো।অবশ্য ওর দোষ ছিলো না বুঝলি?ভূবনের কাজ ছিলো সেটা।এখন যেহেতু কাজটা নিশাদ করেছিলো আমি ওর সাথে ঝগড়া করিনি কিন্তু অনেক দিন কথা বলিনি।যেখানে দুজন একসাথে বসতাম আমাদের বেঞ্চ হয়ে গেলো আলাদা।নিশাদ কথা বলার অনেক চেষ্টা করতো কিন্তু অভিমান করে আমিই বলতাম না।পনের বিশদিন পরে ভূবন আমার কাছে এসে পুরো সত্যিটা বলার পর জানিস কতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম।ভাবছিলাম প্রানের বন্ধুর সাথে কিভাবে এত রাগ করে থাকলাম।সেদিন ওর বাসায় চলে যাই।ও খাচ্ছিলো।আমাকে দেখে জানিস কতো হেসেছিলো।আমি গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, 
''দোস্ত সরি।আমি বুঝিনি।এমনটা আর কখনো হবেনা।নিশাদ তো সে কি কান্না।বলছিলো দেস্ত সরি বলতে হবেনা।ফ্রেন্ডদের মাঝে নো থ্যাংকস নো সরি।"
কথাটা বলেই হাসতে লাগে ইমতিয়াজ। ইদ্রি ভাইয়ের কথা এতক্ষন শুনছিলো। নিশাদের নামটা প্রত্যেকবারই ওর ভেতরে তোলপাড় শুরু করেছিলো।ইমতিয়াজ এর হাসি থামার পর ইদ্রি বলল,
''নিশাদ ভাই তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তাইনা ভাইয়া?"
ইমতিয়াজ যেন গর্ব নিয়ে বলল,
''হ্যা।জানিস ছেলেটা এতো ভাল এতো ভদ্র।খুব স্ট্রাগল করছে।জানিস এই একটা মানুষ যাকে দেখলাম।সব কিছুর উর্ধে ওর পরিবার।ওর বাবা মা ভাইবোন।ওদের বন্ডিংটা এতো সুন্দর।জানিস আমাদের যতো টাকা থাকে আমরা আরো বেশি চাই কিন্তু ওর না সেই লোভ নেই।ওর যা আছে তাতেই অনেক খুশি।ও শুধু চায় ওর ভাইবোন আর মা বাবাকে সুন্দর জীবন দিতে।নিশাদের কথাটা বলে শেষ করা যাবেনা বুঝলি ইদ্রি।সত্যি ও অসাধারন।তাই ওকে খুব ভালবাসি আমি।"
ইদ্রির খুব কষ্ট হতে থাকে।ভাবছিলো আমি তো এই অসাধারন মানুষটাকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম সে এভাবে চলে গেলো কেন।ইমতিয়াজের মুখে কথা গুলো শুনার পর থেকে নিশাদের প্রতি ওর ভালবাসা অনেক গুনে বেড়ে গেছে।যে মানুষটা নিজের পরিবারকে এতোটা ভালবাসে সে তার স্ত্রীকে কতেটা ভালবাসবে তা ভেবে ও শেষ করা যাবে না পরিমাপ করা যাবে।এই মানুষটার বুকে সবার জন্য এতো ভালবাসা ওর জন্য কি একটু ও বাকি নেই?
→→→→→→→সেদিন বিকেলে বেলা ও রেডি হয়ে নেয় বিভান আর পূর্নার সাথে শপিংমলে যাবার জন্য।পূর্না বারবার এসে বেলার শাড়ী ধরে টানছিলো।বেলা বারবার মেয়ের দিকে হেসে বলছিলো,
'" এমন করেনা মা।আমি শাড়ী টা পরে নিই।নাহলে দেরি হয়ে হয়ে যাবে।"
পূর্না তারপর ও থামছিলোনা।বেলা ও কিছু বলেনি।শাড়ী পরা শেষে বেলা চুল আঁচড়ে বেরুতে নিচ্ছিলো।পূর্না তখন মাকে ধরে বলল,
''তাদবে না মা?একতু তাদো দেকি?"
বেলা হেসে মেয়েকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে বলল,
''এই মেয়েটা এতো কিছু কিভাবে জানে?"
''দখন এই বাতায় এতেতিলাম তুমি তাদতিলা।তোমাকে কুব তুন্দল লাগতিলো।"
''তাই মা?এখন সাজবো তাহলে ওকে?"
''ওত্তে।"
লাফিয়ে উঠে পূর্না।বেলা সাজতে শুরু করে হঠাৎ বিভান এসে বলল,
''পূর্না দেখো মা বড় মামা কল করেছে কথা বলো এসে।"
পূর্না দৌড়ে সেদিকে গেলো।নিশাদ ফোনের সামনে বসে ছিলো।ও যেহেতু হিন্দি ভালোই বলতে পারে তাই পূর্নার সাথে কথা বলতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি ওর।বিভান পূর্নাকে নিয়ে আসতেই নিশাদ কে বলল,
''ভাই বলছিলেন বাংলার কথা কি জানি?আপা জানে?"
''উহুম তোমার বোনের জন্য সারপ্রাইজ। সেটা বাংলাদেশ গেলে জানবে।"
বিভান কথাটা বলে মেয়েকে ল্যাপটপের সামনে বসায়।নিশাদ হেসে বলল,
''পূর্ন কেমন আছো তুমি?"
''বালো মামা।তুমি তেমন তাতো?"
''ভাল মা।কই যাও তোমরা?"
''মাক্কেতে।বাবা পুতুল কিনে দিবে।"
''পুতুল ভালো লাগে তোমার?"
''হুম কুব বালো লাগে।"
''তোমরা আসলে মামা কিনে দেবো।তুমি খাইছো মা?"
''দুপুলে কেলাম।তুমি ও কি কোতাও দাবে?"
নিশাদের পিছনের বড় ব্যাগটাকে দেখে বলল পূর্না।নিশাদ মাথা নেড়ে বলল,
''জি মা একটা দাওয়াতে যাবো।"
''দাওয়াত?আমি দাবেনা?"
''তুমি এসো অবশ্যই নিয়ে যাবো।"
কিছুক্ষন বাদে বেলা বেরিয়ে আসে।ভাইয়ের সাথে কথা বলে ওরা বেরিয়ে যায়।দিল্লির বড় একটি শপিংমলে এসেছে ওরা।পূর্না দৌড়া দৌড়ি করে এটা ওটা ধরছে।ওর দুহাত বেলা আর বিভান ধরে রেখেছিলো।বিভান দেখলো একটা দোকানে ছোট্ট চারটা পুতুল একসাথে।হলুদ ভালুকের পুতুল।বিভানের বেশ ভালো লাগলো।পূর্নাকে জিজ্ঞেস করলো, 
''দেখো মা পছন্দ হয় কিনা?"
''কুব তুন্দল।"
''লাগবে তোমার?"
''অ্যা।"
বিভান পূর্না আর বেলাকে নিয়ে পুতুল গুলোর কাছে এগিয়ে গেলো।এরপর আরো অনেক গুলো বড় ছোট পুতুল কেনা হলো।বেলার বেশ ভালো লাগছিলো বিভানকে এভাবে দেখে।পূর্নার বাবা মায়ের হাত ধরতে ভালো লাগছিলো না আর।বিভান পারফিউম কিনছিলো।পূর্না বলল,
''আমি বলো হয়েতি।একা হাতবো।আমার হাত তালো।"
বেলা মাথা নেড়ে বলল,
''কে বলেছে তুমি বড়?তুমি অনেক ছোট হাত ছাড়বোনা।"
''না প্লিদ আমাল বালো লাগতেনা।"
বেলা তারপর ও মানছিলনা।হঠাৎ বিভান বলল,
''বেলা চলো শাড়ী কিনবে।
''আমার লাগবেনা।"
''প্লিজ বেলা আসো।পূর্না মাকে বলো।"
বেলা বিরক্ত হয়ে বিভানকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো।কিন্তু পূর্না বলতে লাগলো চিল্লিয়ে, 
''মা প্লিদ কিনো না।তোমাকে তালীতে কুব মানায়।"
বেলা না করতে পারেনি।ওর শাড়ী এমনিতেই খুব পছন্দ।বিভানের সাথে দাঁড়িয়ে শাড়ী দেখতে থাকে।পূর্না বেলার হাত ধরেছিলো।বেলার মনে হলো একসময় পূর্না ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে।বেলা পিছে তাকিয়ে দেখলো পূর্না দাঁড়িয়ে আছে ওর সাথে ঘেঁষে।বেলা পূর্নাকে বলল,
''কোথা ও যেও না মা।"
পূর্না ফিসফিস করে বলল,
''কুতাও দাবোনা।আমি আতিতো।"
বেলা হেসে আবার ও শাড়ী পছন্দ করতে থাকে।বিভান একটা কফি আর বেগুনী রং এর শাড়ী দেখিয়ে পূর্নাকে বলল,
''দেখো পূর্না মাকে কেমন লাগবে?"
''বিউতি কুইন।"
পূর্নার কথায় বেলা আর বিভানের পাশাপাশি দোকনদাররাও হেসে ফেললো।বিভান বেলার কানে কানে বলল,
''দেখলা মেয়ে বলল সুন্দর লাগবে। এ দুটো নাও।আর লাল টাও নাও।"
বেলা লজ্জাবতী গাছের মতো একেবারে মিইয়ে গেলো।
শাড়ী কেনা শেষে ওরা বেরিয়ে আসে।হঠাৎ বিভান বেলাকে থামিয়ে দিলো।বেলা পিছনে ঘুরতেই বিভান বলল,
''আমাদের পূর্না নেই বেলা।"
→→→→→→আদনান বসে আছে ধানমন্ডির একটা ক্যাফেতে।ওদের একটা মিটিং আছে এখানে।প্রিয়াশা ও আসার কথা কিন্তু দেরি হচ্ছে মেয়েটার।ওদের মিটিংটা হলো ওদের পাকিস্তানী এক ক্লায়েন্টের সাথে।আদনান কফি নিয়ে বসেছিলো।কফির কাপে লাস্ট চুমুক দিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে যায়।মেয়েটা এখনও এলোনা।টাইম টেবিল সম্পর্কে কি কোন জ্ঞান নেই?আরো এক কাপ কফির অর্ডার করে আদনান।ইতোমধ্যে ওরা অনেকবার প্রিয়াশার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো।আদনান বলছিলো প্রিয়াশা আসবে।কফিতে চুমুক দিয়ে দরজার দিকে তাকালো আদনান।হঠাৎ প্রিয়াশাকে দেখতে পায় ও।মেয়েটা কিছুটা খুড়িয়ে আসছে ওর দিকে।আদনান কিছুটা রেগে বলল,
''এতো দেরি হলো কেন?জানতেন বিদেশী ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং আজ?"
প্রিয়াশা খুড়িয়ে খুড়িয়ে আদনানের সামনে এসে বলল,
''সরি স্যার।বাসায় একটু কাজ ছিলো।তাই লেট হয়ে গেলো।"
''আগে করতে পারেননি কাজ।বসুন।ওদের কল দিচ্ছি।"
প্রিয়াশা বসে পড়ে।আদনানের মনে হচ্ছিলো ওর কষ্ট হচ্ছে খুব।প্রিয়াশার কফি ও চলে এলো।ওদের মিটিং শুরু হলো।বেশ ভালো মতো শেষ হলো মিটিং।আদনান ল্যাপটপ অফ করে বলল,
''আপনার কি পায়ে ন্যাথা লেগেছে?"
পায়ের কথা শুনে প্রিয়াশা কে দেখে মনে হলো ও খুব আতঙ্ক বোধ করছে।আদনান আবার জানতে চাইলো, 
''কি হলো বলেন।"
''সামনে দীপাবলি তো। কাজ করতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি।আর কিছুনা।"
''ওহ।"
আদনান একটু হেসে প্রিয়াশার দিকে তাকায়।প্রিয়াশা মৃদু হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।আদনান খেয়াল করলো মেয়েটাকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।ভীষন রকমের সুন্দর যাকে বলে।একেবারে মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।

!!!!

পুরো মার্কেটে কোলাহল লেগে গেছে।বিভানকে অনেকেই চিনে একজন সফল ব্যাবসায়ী হিসেবে তাই ও পূর্নার কথা জানাতেই পুরো মার্কেটের সব গুলো গেট লাগিয়ে দেয়া হলো।বিভান প্রত্যেকটা ফ্লোরে গিয়ে খুঁজছে পূর্নাকে।বিভানের এতোটুকুই।মনে হচ্ছিলো মেয়েটা হয়ত হাঁটতে হাঁটতে এখানে কোথা ও চলে গেছে।কারন স্বভাবতই মেয়েটা খুব চঞ্চল প্রকৃতির।বিভানের সাথে ছিলো মার্কেটের ম্যানেজার।ওনি ও পূর্না কে খুঁজছে।বিভান দৌড়ে দৌড়ে মেয়েকে এদোকান ও দোকানে খুঁজছে।যাকে পাচ্ছে তাকেই পূর্নার ছবি দেখিয়ে বলছে এই বাচ্চাটাকে কোথাও দেখেছে কিনা?কিন্তু কেউ দেখেনি।বিভান প্রচন্ড জোরে হাঁপাচ্ছে।ওর সারামুখ লাল হয়ে গেছে।কিন্তু দাঁড়ানোর সময় নেই ওর।বাচ্চাটা ওর সাথে নেই ভাবতেই কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।মেয়েটাকে কেন দেখে রাখতে পেলো না? কেন এমন দায়িত্বহীন পিতা হলো ও?পরীটাকে দেখে রাখতে পারলো না?দুইঘন্টা যাবৎ মেয়েকে খুঁজে একজায়গায় এসে কেঁদে ফেলে বিভান।ম্যানেজার চক্রবর্তী বিভানকে কাঁদতে দেখে ভীষন কষ্ট পেলো।ছেলে মানুষ এতো সহজে কাঁদেনা।কাঁদে খুব কষ্ট পেলেই।বিভানের পাশে এসে দাঁড়ালো সে।বিভানের কাঁধে হাত রাখতেই বিভান বলল, 
''আমি অপদার্থ পিতা।কেন আমার মেয়েকে দেখে রাখতে পারলাম না?মেয়েটা কই আছে কেমন আছে?কে জানে?বেলা তো ভেঙ্গে পড়বে একদম।"
''মিঃ বিভান আমি পারছি আপনার মনের অবস্থা।এভাবে ভেঙ্গে পড়লে ভাবি কে সামলাবেন কি করে?চেষ্টা করতে থাকুন মেয়েকে পেয়ে যাবেন।হাল ছাড়বেননা মিঃ বিভান।বাবারা কখনো অপদার্থ হয়না।যাই হোক চলুন ভাবির কাছে।"
এদিকে বেলা দৌড়ে দৌড়ে মেয়েকে খুঁজছিলো।পিছনে কয়েকজন ওকে থামানোর চেষ্টা করছে।বেলা সবাইকে ধরে বলছিলো,
''আমার মেয়েটাকে দেখেছেন?ছোট্ট মেয়ে।পাচ্ছিনা ওকে।"
জবাব না পেয়ে বেলা আবার ও চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ডাকছিলো, 
''পূর্না কই তুই?মায়ের কাছে চলে আয়।কই গেছিস মা?আমাকে মাফ করে দিস সোনা।মা তোর খেয়াল রাখতে পারিনি।"
মহিলা গুলো ওকে ধরতে পেয়ে বলতে লাগলো,
''পেয়ে যাবেন মেয়েকে।এভাবে কেঁদে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।মেয়েকে খুঁজতে অনেক শক্তি লাগবে।"
''না কাঁদবো কেমনে বলেন?আমার একটা মাত্র মেয়ে বাচ্চা মেয়ে।কই চলে গেলো ও?আমার কি হবে?আমি ওকে ছাড়া কেমনে থাকব?"
মহিলাগুলো ওকে কিছু বলার ভাষা পেলোনা।আসলে যার সন্তান হারানো গেছে সেই বুঝে।
ইতোমধ্যে বিভানকে আসতে দেখা গেলো ম্যানেজারের সাথে।ওকে অনেক ক্লান্ত আর ব্যাথাতুর মনে হচ্ছে।বেলা বিভানকে দেখে আরো জোরে কাঁদতে থাকে।বিভান এসে বেলার কাছে দাঁড়াতেই বেলা কাঁদো কন্ঠে বলতে লাগলো,
''পূর্না কই?কই ও?বলেননা?আপনার সাথে আসেনি?মায়ের সাথে রাগ করেছে?"
বিভান বেলার গাল ধরে থামিয়ে কথা বলতে চাইলো।কিন্তু থামবার পাত্রী নয় সে?বারবার বলছিলো কই?কই রেখে আসলেন?বিভান বেলাকে বুকে টেনে বলতে লাগলো,
''শুনো মেয়েকে অবশ্যই নিয়ে আসবো।ও এখানে নেই।বেলা কথা দিলাম পূর্নাকে তোমার কোলে অবশ্যই এনে দিবো।দোকান বন্ধ করতে হবে।ওনারা বাসায় যাবে।বারোটা বেজে গেলো।"
বেলা সরে এসে ক্রন্দন মিশ্রীত রাগী কন্ঠে বলল,
''মানে কি ওকে নেয়া ছাড়া কোথাও যাবোনা।জলদি এনে দেন।ও এই তলায় নেই তো।নিচে ও নেই।ওকে এনে দিন।"
বিভান বেলাকে আবার ও বুকে টেনে বলল,
''প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো বেলা।ও এখানে নেই।তবে খুব জলদি নিয়ে আসবো ওকে।প্রমিজ করছি। এবার চলো।ওনারা ঘরে যাবেন তো।"
বেলা কাঁদতে লাগলো।বলছিলো,
''পূর্না কই চলে গেলো আমাদের ছেড়ে।মেয়েটা  কই আছে কেমন আছে কে জানে?এ কেমন,শাস্তি দিচ্ছেন আল্লাহ তা'লা।"
বিভান কোনমতে বেলাকে নিয়ে মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসে।সারাগাড়ীতে চিৎকার করে কাঁদছিলো বেলা।বিভানের চোখজোড়া বারবার ভিজে আসছিলো।মেয়েটা সাথে নেই ভাবতেই যেন প্রান চলে যাচ্ছে।বেলাকে টেনে বিভান বুকে নিয়ে নেয়।নিজের শরীর মন কোনটাই আসলে কাজ করছেনা।মনে হচ্ছে সব অচল হয়ে পড়েছে।বিভানের পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে বেলার চোখের পানিতে।ঘরে ফিরে বেলা দৌড়ে রুমে চলে আসে।রুমে আসতেই খাটে মেয়ের ফ্রক দেখে সেটা হাতে নিয়ে বুকে চেঁপে ধরে।চোখজোড়া এবার পুরো ঝাপসা হয়ে আসে।বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।খাটের পাশে ধুপ করে বসে পড়ে।বিভান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে দেখছে।বেলা আবার ও কাঁদছে।
বিভান বেলার পাশে এসে বসে পড়ে।ওর চুলগুলো খুলে আউলে পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে।বিভান চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
''বেলা এমন করোনা প্লিজ।আমি তাহলে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবোনা।আমি বাবা হবার যোগ্য না বেলা।আমার জন্য তোমার এতো কষ্ট হচ্ছে।বেলা আমাকে মাফ করে দাও।সব কিছুর জন্য মাফ করে দাও।না বুঝে তোমাকে অনেক।কষ্ট দিয়েছি।নিজের কষ্ট কে বড় করে দেখে তোমার কষ্টটা দেখতে পাইনি।আমাকে মাফ করে দাও বেলা।আমি সত্যিই অসহায় এখন।মরে যেতে চেয়ে ও পারছিনা।বাঁচতে ও পারছিনা।কি করবো বলো।"
বেলার হাত ধরে কাঁদতে থাকে বিভান।বেলা বিভানের কথা শুনে কাঁদতে ভুলে যায়।চোখে মুখে অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি।বেলা বিভান কে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয়।কিছু বলতে পারেনি কান্নার বদলে।
 →→→→→→→→ সেদিন প্রিয়াশার সাথে মিটিং শেষ করে ঘরে ফিরে এসেছিলো আদনান।সেই যে খাওয়া ছেড়ে উঠে গিয়েছিলো এরপর তিনকাপ কফি ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি।ঘরে পৌছে দেখলো আম্মা আব্বা আর লাবনী সামনের রুমে বসে টিভি দেখছে।ওদের সিঙ্গার টিভিটা অনেক পুরোনো হয়ে গিয়েছে।এর বয়স পনের বছর।যেদিন এটা বাসায় আব্বা এনেছিলো ওরা সবাই দৌড়ে এসে টিভি দেখতে বসে যায়।আপা সেদিন মুড়ি বানিয়েছিলো।সবাই একসাথে মুড়ি খেতে খেতে বিটিভি দেখছিলো।তখন শুধু বিটিভি আর কার্টুন এর চ্যানেল ছিলো সেটা শুধু লাবনী আর কুঞ্জনের জন্য কারন ওরা কার্টুন না দেখে খেতো না।আদনান মৃদু হাসে।জুলেখা বানু ওর দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে টিভিতে মন দেন।এনিমেল প্ল্যানেট নামক একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো।লাবনী আব্বাকে বলছিলো,
''আব্বা জানো এটা কি?"
জবাবে ইকরাম রাহমানের ত্যাড়া জবাব।
''জানুম না কেন?আমি কি অন্ধ নি?এডা গোখরা সাফ।"
''এটা কিং কোবরা আব্বা।"
''হ হ তোগোর ইংলিশ।"
হঠাৎ ইকরাম রাহমানের নজর আদনানের দিকে পড়তেই ওনি বললেন,
''কিরে নবাবজাদা খাড়ায় রইসোস কেন?এইহানে আয়।"
আদনান যেতে নিবে তখনই ইকরাম রাহমান বলছিলেন, 
''ওহ তুই তো এহন জমিদার হইয়া গেছোস।বড় চাকরী পাইছোস অহন কি ঘরের খাওন ভালো লাগবে নি?"
আদনান বুঝতে পারলো আব্বা এভাবে কেন বলছে।দুপুরের আচরনের জন্যই আব্বা এমন বলছে।আদনান কিছু বলতে গেলে ইকরাম রাহমান বললেন,
''তোরা দুইডা ভাই বড় ফ্ল্যাট লইয়া থাক।এহন যেহেতু টাহা কামাই বাপ মারে সম্মান দিতে ফারোস না তাইলে আর কি করবি এহানে থাইকা?"
তখনই জুলেখা বানু পাশ থেকে বললেন,
''কি কইতাছো।এগুলা?ফোলাডা মাত্র গরে ডুকছে।হেরা না কামাইলে তোমার পোলা পাইন বাকি যেগুলা আছে হেগুলারে ফড়াশুনা করাইবা কেমনে?"
তারপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
''যা তুই রুমে যা।খাইছিলি নি?"
আদনান কিছু না বলে মাথা নেড়ে চলে গেলো।ইকরাম রাহমান রেগে বললেন,
''হুন তোর ফোলাগোরে মাথাত তুলিস না বুঝোসনি?"
জুলেখা বানু রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন পাকঘরে।ছেলেটা এখনো খায়নি ভেবে খারাপ লাগছে ওনার।কলিজা ফেঁটে যাচ্ছে।ভাত প্লেটে নিয়ে তরকারি গরম করতে দিয়ে আদনানের রুমে আসেন।আদনান শার্ট খুলে কালো একটা গেঞ্জী পরে নিয়েছে।মাকে দেখে ভীষন খারাপ লাগতে থাকে ওর।মাকে দেখে হেঁটে ওনার কাছে এসে বলল,
''আম্মা আমারে মাফ করে দিও।আমি সত্যি এমন করুম না আর কখনো।ভাই না খাইয়া উঠি গেছিলো তাই খারাপ লাগছে আমার।"
''বুঝছি আব্বা।আমার পোলাগোরে আমি চিনি।আমার পোলারা এমন না আমি জানি।"
আদনান মাকে জড়িয়ে ধরে।বড্ড শান্তি লাগতে থাকে ওর।
→→→→→→→→এদিকে ঢাকায় ফিরে এসে সাইমন নিজের বাসার গেটে ঢুকতেই দারোয়ান থামিয়ে দেয় ওকে।বলতে লাগলো,
''বড় স্যার নাই।"
''তাহলে আমাকে থামালে কেন?ঘরে যাবো আমি।"
''আপনে জানেননা কিছু?"
সাইমনের এবার রাগ লাগছে। কি জানবে ও?এমনিতেই ক্লান্ত তারওপর দারোয়ান এমন করছে।সাইমন রেগে বলল,
''কি জানবো আমি?মাত্র গ্রাম থেকে আসলাম কি জানবো আমি?"
''আপনের ভাইয়ের বৌ কিছু কয় নাই?"
সাইমনের এবার অনেক রাগ লাগছে।এভাবে প্যাচানোর মানেটা কি?সরাসরি বললেই তো হয়।সাইমন দারোয়ানের কলার চেঁপে বলল,
''যা বলার সরাসরি বলো।"
''কইতাছি কইতাছি।আপনের ভাই বাসা ভাড়া দিয়া বনশ্রী গেছে গা।"
''হোয়াট?"
সাইমনের চোখজোড়া বড় হয়ে যায়।দারোয়ান আবার বললেন,
''ভাড়াটিয়ার জিনিস পত্র ও আসার শুরু করছে।"
সাইমন দারোয়ানের কলার ছেড়ে সরে এলো।মেজাজ খারাপ হচ্ছে ওর।এই বাসা ওদের দুইভাইয়ের নামে লিখা।ভাই ওকে না জানিয়ে এই কাজ কেমনে করলো?নিশ্চয়ই ঐ মহিলার কাজ।সেটা পরে দেখা যাবে।এখন ও কি করবে?কই যাবে কই থাকবে?পরক্ষনে সাইমনের মনে পড়লো দাদীর কথা।
দাদি কে কল করে তৎখনাৎ।ফোন রিসিভ হতেই বয়স্ক কন্ঠ ভেসে আসে সাইমনের কানে।সাইমন বলল,
''দাদি কেমন আছেন?"
''ভালো দাদা ভাই তোর কি খবর?"
''ভালো দাদু।রান্না করা আছে?"
''হ্যা কেন?"
''আমি আসতেছি।"
''তুইনা গ্রামে ছিলি?"
''জি দাদু।আমি এসে নিই।অনেক কথা আছে।"
''আচ্ছা সাবধানে আয়।"
সাইমন বেরিয়ে পড়ে আবারো। গাড়িতে বসেই সাঁখের নম্বরে কল দেয়।কিন্তু রিসিভ হয়নি।আজ অনেক ূদিন হলো যোগাযোগ নেই ওদের।সাইমন আরেকটা ম্যাসেজ লিখে সাঁঝকে পাঠিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করে।
→→→→→→→→ইদ্রি রাতের খাবার সেড়ে সবে মাত্র শুয়েছে।সকালে ওরা বেরুবে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে।শুনেছে সেখানে ভাইয়ার অন্য বন্ধুরা যাবে সাথে নিশাদ ও।ইদ্রি কিভাবে তাকে ফেস করবে?সেই শক্তি কিংবা সাহস ওর কি আদৌ আছে।নিশাদ কে দেখলে ওর তো সেই কথাটাই মনে পড়বে।নিশাদ ও ওদের সাথে থাকবে।প্রত্যেকদিন তাকে চোখের সামনে দেখতে হবে।হাঁটতে দেখা যাবে খেতে দেখা যাবে বসতে দেখা যাবে।নিশাদ ও ইদ্রিকে দেখে কেমন রিয়্যাক্ট করবে ভাবতেই ইদ্রির প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।মনকে বারবার শান্ত করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে ইদ্রি।ফোন হাতে নিয়ে নিশাদের ছবি গুলো দেখতে থাকে।লোকটার চেহারা মারাত্মক রকমের মায়াবী।কেন এই মায়ায় পড়ে গেলো ও?কেন এতো ভালবাসলো?যেখানে ওর ভালবাসার কোন দাম নেই তার কাছে।হঠাঝ দরজার শব্দে কেঁপে উঠে ইদ্রি।ফোন বন্ধকরে পিছে তাকিয়ে দেখলো ইমতিয়াজ ভিতরে প্রবেশ করলো।ভাইকে দেখে উঠে বসে ও।ইমতিয়াজের হাতে একটা শপিং ব্যাগ।ব্যাগটা ইদ্রির সামনে খাটে রেখে বলল,
''দেখ পছন্দ হয় কিনা?"
ইদ্রি ম্লান হেসে প্যাকেটটা থেকে একটা রানী গোলাপী বর্নের লেহেঙ্গা বের করে ভাইয়ের দিকে তাকায় বিস্ময় নিয়ে।ইমতিয়াজ হেসে বলল, 
''ইশিতার বিয়েতে পড়িস।খুব সুন্দর লাগবে।"
ইদ্রি জামাটা বুকে জড়িয়ে বলল,
''থ্যাংক ইউ ভাইয়া।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন