নারায়ন বাবুর প্রশ্নে দেবব্রতের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে যায়। তারপর সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজের বাবার চিন্তা ভাবনা এতোটা নিচ সেটা আজ অনুভব করতে পারছে। ঠোঁটের কোনে মলিন হাসি একে ধীর কন্ঠে বলে,
- বাবা, আপনি ঠিক বলেছেন কৃষ্ণার জন্মপরিচয় বেশ ধোঁয়াশা। সে গ্রামে মানুষ, তার বাবা কোথায় কিংবা কে এই বিষয়টা কৃষ্ণা নিজেও জানে না। ভাট্টাচার্য পরিবারে সে আসলেই বেশ বেমানান। আমি আপনার সাথে একমত।
দেবব্রতের কথাশুনে নারায়ন বাবুর মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠে। ছেলেকে শুধু যে দু তিন বাক্যে এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়ে পারবেন ব্যাপারটা ভেবে বেশ মনে আত্নতৃপ্তি হচ্ছে। কিন্তু সেই আত্নতৃপ্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে নি। পরমূহুর্তেই ছেলের মুখে এমন একটি প্রশ্ন শুনতে পায় যা তার ভেতরের কাপুরুষটাকে আয়না দেখাতে সক্ষম ছিলো। দেবব্রত কোনোদিন বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করে নি। তাই আজও পারলো না। তবে নম্র ভাবে কথাটা না বলেও থাকতে পারলো না সে,
- তবে বাবা, আজ কৃষ্ণার এই পরিস্থিতির জন্য কি আমরা দায়ী নই? আজ কেনো তার বাবা থাকা স্বত্তেও তার বাবা তার কাছে নেই, তিনি কোথায় সে আছে তার কোনো খোঁজ আমাদের কাছে নেই এই সকল কিছুর জন্য কি এই ভট্টাচার্য মঞ্জিল দায়ী নয়! আমি যদি কখনো জানতাম সে আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য সোমনাথ কাকাকে এতো বড় বলিদান দিতে হবে আমি সত্যি ই বাঁচতে চাইতাম না। আপনাকে আমি খুব সম্মান করতাম, ভাবতাম আপনি একজন আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী হবার সাথে সাথে একজন আদর্শ মানুষ। তবে আজ আমার ধারণা পুরোপুরি ভেঙ্গে গিয়েছে। আপনি নিতান্ত স্বার্থপর, কাপুরুষ প্রজাতির মানুষ। আজ আমার জীবন্ত থাকার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। আজ আমার বাবার স্বার্থপরতার জন্য এক নিষ্পাপ ফুল তার পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি হয়তো কৃষ্ণার পরিচয় পেয়ে খানিকটা হলেও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবেন, কিন্তু ব্যাপারটা তেমন ঘটলো না। আমার আর এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। শ্বাসে বিঘ্ন হচ্ছে।
বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে নেয় দেবব্রত। নারায়ন বাবু তখন ও মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন। তার ছেলের মুখে এরুপ আচারণ যেনো তার কখনোই কাম্য ছিলো না। কাঁপা কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলেন,
- তুমি জানো?
তার প্রশ্নে দেবব্রতের পা জোড়া থেমে যায়। নারায়ন বাবুর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
- আমার স্ত্রীর অতীতের বিষয়ে জানাটা স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্য ছিলো। কিন্তু কখনোই আপনাকে সেটা বুঝতে দেয় নি। কারণ আমি চাই নি আপনার মনে কোনো রকম গ্লানি তৈরি হোক। চিন্তা করবেন না কৃষ্ণাও তার অতীত সম্পর্কে জানে না। আমি চাই না, তার সামনে আপনি মাথা নিচু করে বাস করেন। যতই হোক বাবা আপনি আমার। আর একটা কথা, একদিন কৃষ্ণাকে নিয়ে আপনার গর্ব হবে। এই কথাটা আমি দাবি করে বলে গেলাম। তাকে আমি এমনভাবেই গড়বো যাতে কেউ তার অতীত ঘাটবে না। এতে অবশ্য আপনারই লাভ হবে। যদি আমার কোনো কথায় আপনার মনে চোট লাগে তাহলে ক্ষমা করবেন।
বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে দেবব্রত। বাবার আচরণে আজ মনটা বেশ ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়েছে। পা জোড়া চলতে চাইছে না। রুমে যেয়েই দেখে বই খাতা নিয়ে তার কিশোরী বউ খাটের উপর বসে রয়েছে। তাকে দেখতেই তার কাছে এগিয়ে আসে। দেবব্রতের মুখখানা বেশ মলিন ঠেকলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
- আপনার কি খারাপ লাগছে।
- নাহ, একটু টায়ার্ড লাগছে
ম্লান হাসি দিয়ে দেবব্রত কথাটা বলে। দেবব্রতের কথা শুনে কৃষ্ণা কিছু একটা ভাবে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
- তাহলে আমি যাই, আপনি আরাম করুন
বলেই বই খাতা গুছাতে লাগে কৃষ্ণা। কৃষ্ণার হন্তদন্ত হয়ে বই খাতা গুছাতে দেখে দেবব্রত কৌতুহলী কন্ঠে বলে,
- কোথায় যাচ্ছিস?
- রুমে, আসলে ক্যামিস্ট্রি বুঝতে এসেছিলাম। অধ্যায়টা খুব কঠিন। তাই আসা, সমস্যা নেই পরে বুঝে নিবো।
কথাটা বলেই বইখাতা নিয়ে চলে যেতে নেয় কৃষ্ণা। তখনই দেবব্রত নির্বিকারভাবেই বলে উঠে,
- এই রুমে থাকা যায় না?
কথাটা শুনেই পা জোড়া আটকে যায় কৃষ্ণার। এই চারমাসে প্রথম দেবব্রত তাকে এই রুমে থাকতে বলছে। ব্যাপারটা তার কাছে খুব অবাককর। হা করে দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে থাকলে দেবব্রত একটু এগিয়ে তার কাছে আসে। ধীর কন্ঠে বলে,
- আজ থেকে আমার কাছে থেকে যা। এক মূহুর্ত শত বছরের লাগে আমার কাছে।
- হঠাৎ, এমনটা তো কথা ছিলো না।
- জানি কিন্তু একটা বছর যে আমার কাছে অনেক। আজ অপেক্ষার বাধ আমি ভেঙ্গে ফেলতে চাই।
দু হাতে কৃষ্ণার মুখটা আদলে ধরে দেবব্রত। কৃষ্ণার চোখজোড়া ছলছল করছে। অবশেষে স্বামীর ঘরে তার ঠায় হলো। দেবব্রত তার মুখটা টেনে চোখ জোড়ায় উষ্ণ ঠোঁট ছুয়ে দেয়। কৃষ্ণার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
- আমাকে ক্ষমা করে দিস, এতোটা মাস তোকে অপেক্ষা করিয়েছি৷ তোর চলার পথটা কঠিন জেনেও তোর পাশে ছিলাম না। তবে কথা দিচ্ছি, তোর চলার পথে আমাকে চিরকাল পাবি তুই৷ বন্ধু হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, স্বামী হিসেবে
কৃষ্ণা দেবব্রতের হাতটা ধরে তাকে বিছানায় বসায়। দেবব্রত তখন অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কৃষ্ণা তার মুখটা তার কোমল হাতে আলতো করে ধরে। শান্ত কন্ঠে বলে,
- বাবামশাই বুঝি কিছু বলেছে?
- তুই জানলি কিভাবে?
- অর্ধাঙ্গিনী হয়ে এটুকু জানবো না? আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে এ বাড়ির প্রতিটি মানুষের মনোইচ্ছা পূরণ করবো। কথা দিলাম
দেবব্রত কোনো কথা না বলে কৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। কৃষ্ণার বুকে মুখ গুজে ধীর কন্ঠে বললো,
- তোকে একটা কথা জানানোর ছিলো। এমন হতেই পারে কথাটা শোনার পর আমাকে তোর দোষী মনে হবে। আমার পরিবারকে অপরাধী। তবে কথাটা আমার বুকে কাটার মতো বিধে আছে।
- আমাকে কোনো কথা বলতে বুঝি ইতস্তত বোধ হয় আপনার?
দেবব্রত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই দীর্ঘশ্বাসে তার বুকের আক্ষেপের উপস্থিতি স্পষ্ট। কৃষ্ণাকে তার পাসে বসিয়ে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে৷ অতীতের কণ্টককীর্ণ সত্যি গুলো ধীরে ধীরে কৃষ্ণার সামনে তুলে ধরে। যখন দেবব্রতের কথা শেষ হয় তখন কৃষ্ণার দিকে খেয়াল করলে দেখে কৃষ্ণা স্তব্ধ। কৃষ্ণার মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চোখজোড়া ভিজে আছে। অস্পষ্ট স্বরে শুধু একটা কথাই বলে,
- আমার বাবা আমাদের ফেলে যান নি।
দেবব্রত ও চুপ করে বসে থাকে। ঘরে পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভাঙ্গলেই বুঝি আতর্নাদের গুঞ্জন শুনবে দেয়ালগুলো। সেই অপেক্ষায় আছে ঘরের দেয়ালগুলো____________
!!২০!!
কলেজ গেটের বটতলায় বসে রয়েছে অর্জুন। প্রথম সেমিষ্টারের পরীক্ষা সামনে, বহুদিন প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া দেবদাসের মতো বাড়ি পড়েছিলো। কিন্তু আর সেই বাহানা দিলে চলবে না। সামনে সদূর ভবিষ্যত পড়ে রয়েছে তার। সুতরাং এখন কৃষ্ণার বেদনায় রাত্রী যাপন করলে চলবে না। এই বটতলা তার আড্ডার জায়গা। বন্ধু, জুনিয়র এখানেই আড্ডা দেয়। আজ একমাস পর অর্জুন এসেছে কলেজে। তাই তাকে ঘিরেই আড্ডার আসর বসেছে। অর্জুনের ছ্যাকা খাবার কথা সবার অবগত। তাই সেই বিষয় এড়িয়েই সবাই কথা বলছে। হাতে ধোয়া উঠা চা, যদিও ফাগুনের মাস তবুও ঠান্ডার কিছুটা আভা আছেই। অর্জুন বিশেষ চাখোরদের একজন। প্রেমে বিরহের পর তা দ্বিগুন হয়ে গেছে। এই নিতে চার নম্বর কাপ তার। হঠাৎ খেয়াল করলো কলেজ গেট দিয়ে অন্না এবং কৃষ্ণা প্রবেশ করছে। কৃষ্ণাকে দেখে বুকে যেনো রক্তক্ষরণ শুরু হলো অর্জুনের৷ সে জানে আপাতত দেড়টা বছর এই কষ্ট তাকে তাড়া করে বেড়োবে৷ মাস্টার্সটা শেষ হলে হয়তো কখনোই কৃষ্ণার মুখটা দেখতে হবে না। চোখ জোড়া সরিয়ে নিলো সে। তার মনোযোগ এখন চায়ের কাপে। অন্যের বউকে দেখে হৃদয় কাঁদিয়ে কি লাভ!! হঠাৎ পাশে থাকা অর্জুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়ন্ত বলে উঠলো,
- যাই বল তাই বল, আজকাল অন্নাকে আমার আর ছোট টি লাগে না। ফাগুনের দিন কি অপূর্ব না লাগছিলো। মেয়েটিকে
দেখে মনেই হচ্ছিলো সে ওই দুপাশে ঝুটি করা চশমা পড়া বাচ্চা মেয়ে। আমার তো আজকাল অন্নাকে দেখলে প্রেম প্রেম পায়। বয়স তো কম হলো না। এবার নাহয় প্রেম টা করেই ফেলি। কি বল?
- একদম ঠিক দাদা
সব জুনিয়ররা সম্মতি পোষন করলো। অর্জুনের মেজাজটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেলো। কড়া কন্ঠে বলে উঠলো,
- থামবি তোরা? আজাইরা কথা সারাক্ষণ
বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। সবাই তাকে বাধা দিতে চাইলেও কিছুই হলো না। গটগট করে হেটে জায়গাটা প্রস্থান করলো সে। সবাই ভাবলো হয়তো ক্ষত জায়গায় আঘাত লেগেছে। ভাবছে প্রেম নামক শব্দে বিরক্ত লেগে গেছে তার। লাইব্রেরিতে এসেও রাগ কমলো না অর্জুনের। অর্জুন নিজেও জানে না তার কেনো বিরক্ত লাগলো। অন্নাকে নিয়ে জয়ন্তের উক্তি তার পছন্দ হয় নি। যদিও অন্নাকে সেদিন সত্যি অনেক সুন্দর লাগছিলো। মেয়েটাকে নারী নারী লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কোনো উপন্যাসের নারী চরিত্র। কিন্তু তবুও মেয়েটির সাথে জয়ন্তকে তার ভালো লাগছে না। মেজাজটা অন্নার ও খুব খারাপ হচ্ছে অর্জুনের, কি দরকার ছিলো এতো সেজেগুজে কলেজে আসার৷ আজ কি সুন্দর একটা লাল পাঞ্জাবী এবং জিন্স পড়ে এসেছে, চুলগুলো দুপাশে ঝুটি করা৷ কি সুন্দর কিশোরী লাগছে। গালটা টেনে দিলেও খারাপ হতো না। এই বাচ্চা মেয়েটাকে বাচ্চাই বাচ্চাই ভালো লাগে৷ হঠাৎ অর্জুনের ভাবনার ছেদ পড়ে। সে বিগত ঘন্টাখানিক যাবৎ এক নাগারে শুধু অন্নাকে নিয়েই ভেবেছে। যে ভাবনার মাঝে শুধু অন্নাই ছিলো। তার সামনে বই রয়েছে, তবুও তার চিন্তা বই এ নেই। নিজেকে বেশ কড়া করে শাসন করলো অর্জুন। সেদিনের পর থেকে অন্নাকে কেনো যেনো আর আগের মতো লাগছে না অর্জুনের কাছে। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। খুবই বিরক্তিকর। বইটা বন্ধ করে বুকসেল্ফের কাছে গেলো অর্জুন। বিষয় বদলালে হয়তো চিন্তাটা বদলাবে। হঠাৎ......
.
.
.
চলবে................................