নীল চিরকুট
পর্ব ০৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
.
.
.
সকাল সাতটায় লঞ্চ হালুয়াঘাটে এসে পৌঁছাল। কেবিনের বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা নম্রতার ঘুম ভাঙল সবার পর। বন্ধুরা তখন ব্যাগ কাঁধে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নম্রতা ভারী মাথা নিয়ে উঠে বসল। নীরা নিজের আর নম্রতার ব্যাগটা পাশে রেখে নম্রতার কপালে হাত রাখল। কপাল কুঁচকে বিজ্ঞদের মতো মুখভঙ্গি করে বলল,
' জ্বর তো কমই মনে হচ্ছে। হাঁটতে পারবি?'
নম্রতা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য! রাতে তার জ্বর এসেছিল? নীরা আবারও একই প্রশ্ন করতেই মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল নম্রতা। মাথাটা ভার ভার লাগছে। চোখে-মুখে পানি ছিঁটাতে পারলে হয়ত কিছুটা শান্তি লাগত। চোখদুটোতেও ব্যথা হচ্ছে খুব। নীরার সহযোগীতায় চোখে-মুখে পানি দিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে কেবিন থেকে বেরুতেই একটা পেটমোটা ডায়েরি ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে। নম্রতা প্রশ্নমাখা চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাতেই নাদিম দাঁত কেলিয়ে বলল,
' এই ডায়েরিতে মোট পয়ত্রিশটা চিঠি আছে দোস্ত। কাল রাত জাইগা এই চিঠিগুলো লিখছি আমরা। যখনই মন খারাপ হবে বসে বসে পড়বি। আমরা কী কম সুন্দর চিঠি লিখি নাকি? তোর পত্রপ্রেমিক থেকে একটু কম ভালো হলেও ভালোই লিখি।'
কথাটা বলে থামল নাদিম। নম্রতার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল,
' শোন, আমার চিঠিগুলাতে দু-একটা বানান ভুল হইতে পারে।'
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাতেই ঠোঁট উল্টে বলল,
' আচ্ছা যা সাত-আটটা ভুল হইতে পারে। ব্যাপারটা ইগনোর করিস। চিঠি লেখাটাই ফ্যাক্ট। কয়টা বানান ভুল হলো সেটা কিন্তু ফ্যাক্ট না।'
নম্রতা ঠোঁট চেপে হাসল। হাতে থাকা রোদ চশমাটা পরে নিয়ে বাঁকা হাসল অন্তুও। কৌতুক করে বলল,
' তোর ফিসফিসানি কথা পুরো লঞ্চের মানুষ শুনছে ভাই। মানসম্মান আর রাখলি না। ঢাবির স্টুডেন্ট হয়ে বাংলা বানান ভুল? আস্তাগফিরুল্লাহ!'
নাদিম গুজগুজ করে বলল,
' ধুর বাল! ইংরেজিতে এসাইনমেন্ট লিখতে লিখতে মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছি। ইউ শ্যুড প্রটেস্ট, বুঝলি? এই স্যারেরা কোনো কাজের না। আকামের ঢেঁকি সব।'
নাদিমের কথায় ঠোঁটে হাসি নিয়ে মাথা নাড়ল সবাই। ব্যাগ কাঁধে লঞ্চ থেকে নামার উদযোগ করল। নাদিম লঞ্চ থেকে নামতে নামতে অন্তুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
' আজ এতো মাঞ্জা মারছ মামা? কাহিনী কিতা? কোন সুন্দ্রীকে গায়েল করতে চায় তোমার মন? হ্যাঁ হ্যাঁ?'
অন্তু চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলল,
' তোর বোনেরে। হেব্বি দেখতে। আমার হাতে তুলে দে। পরের বছরেই মামা ডাকার সু্যোগ-সুবিধা ফ্রী।'
নাদিম অন্তুকে লাথি দিয়ে বলল,
' তুই আসলেই খারাপ। শালা হারামখোর।'
অন্তু হু হা করে হেসে উঠে বলল,
' শালা ডাকছ কেন শালা? দুলাভাই ডাক। শালা তো ডাকুম আমি। শালা, ও শালা। শালা মশাই।'
অন্তুর কথায় অন্তুকে ধাওয়া করল নাদিম। ভীরে মাঝে ছুটতে ছুটতে বলল,
' তোরে তো আজ খাইছি।'
অন্তু-নাদিমের কথায় হেসে উঠলো বাকিরা। ভীরের মাঝে উচ্ছল হাসি নিয়ে ছুটতে থাকা দু'জন তরুনের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল অনেকেই। ছোঁয়া-নীরা কিছুটা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে নম্রতার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল রঞ্জন। নম্রতার হাত থেকে লাগেজটা নিজের হাতে নিয়ে অন্যহাতে সানগ্লাস পরল। নম্রতার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকাল,
' কী রে? খুদা টুদা পেয়েছে তোর?'
নম্রতা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। নাদিমের দেওয়া ডায়েরিটির দিকে দৃষ্টি রেখে বুক ভরে শ্বাস নিল। ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে বলল,
' আমি ঠিক আছি দোস্ত। চিন্তা করিস না।'
রঞ্জন প্রথমেই কিছু বলল না। সামনের ভীরটা অতিক্রম করার পর মুখ খুলল,
' ভাগ্যে বিশ্বাস করিস নমু?'
' হু, করি।'
' তাহলে সবটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দে। সবকিছুর পেছনেই তো কোনো না কোনো কারণ থাকে। তোর কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেমিক হারিয়ে যাওয়া। স্মৃতিময় ডায়েরিটা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া সবকিছুর পেছনেও নিশ্চয় কারণ আছে। সৃষ্টিকর্তা হয়ত এমন কিছুই চাইছেন। লাইফে মুভ অন কর। অতীত খামঁচে ধরে পড়ে থাকলে তো চলে না। অন্য কাউকে সুযোগ দে। সুযোগ না দিলে বুঝবি কী করে? মানিয়ে নিতে পারবি নাকী পারবি না?'
নম্রতার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। রঞ্জনের চোখের দিকে তাকাতেই জমে থাকা জলটুকু মুক্ত হলো। সূর্যের আলোয় ফর্সা গালে জলের রেখাগুলো চিকচিক করে উঠল। রঞ্জনের পুরুষ মন ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
' যে প্রেমিকের তরে এই রমণীর চোখ ভাসে। সেই নিঃস্ব প্রেমিকের কী কখনও মন হাসে?'
দূর থেকে নাদিমের দৃষ্টি আকর্ষণময় ডাকে ভাবনা কাটল রঞ্জনের। তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা রেস্তোঁরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাদিমরা। রঞ্জন তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তেই দৃঢ় কন্ঠে বলল নম্রতা,
' জীবনের সব পরিস্থিতিতে যুক্তি খাটে না দোস্ত। অনুভূতির মামলায় যুক্তি বেচারা বড্ড অসহায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আমি পারছি না সরে আসতে। আর না পারতে চাইছি। আর না এই বিষয়ে কোনরূপ ডিসকাশন শুনতে চাইছি। চারটা বছর ধরে এইসব কথায় শুনে আসছি আমি। আর কত?'
এক দমে কথাগুলো বলে নিয়েই দ্রুত পা চালালো নম্রতা। রঞ্জন দৌঁড়ে গিয়ে ওর সঙ্গ নিল। বলল,
' আচ্ছা বেশ। আলোচনা-সমালোচনার দরকার নেই। তুই যেমন আছিস থাক শুধু হ্যাপি থাক। মন খারাপ করে থাকিস না। আচ্ছা, গান শুনবি?'
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। সুদর্শন রঞ্জন মন ভুলানো হাসি দিয়ে গলা ছেড়ে সুর টানলো,
' আমার কাছে তুমি মানে সাত রাজার ধন
আমার কাছে তুমি মানে অন্যরকম।
আমার কাছে তুমি মানে আমার পোষা পাখি,
দিনে রাইতে চোখ বুজিয়া তোমায় আমি দেখি।
তোমার কাছে হয়তো বন্ধু আমি কিছু না,
তাইতো তোমার স্বপ্নে বন্ধু আমি আসি না।
আমি মানে তুমি আর তুমি মানে আমি,
আমার কাছে আমার চেয়ে বন্ধু তুমি দামী।'
রঞ্জনের গান শুনে সেখান থেকেই গিটারে সুর তুলল নাদিম। উটপটাং লাফাতে লাফাতে চেঁচাতে লাগল,
' আহা! আহা!'
অন্তু মসৃণ ছিটি বাজিয়ে সুন্দর হাসল। নম্রতা হেসে ফেলে রঞ্জনের ধুমধাম কিল বসাল। হাসি ফুটল নীরা আর ছোঁয়ার ঠোঁটেও। রঞ্জনের গান থামল না। রেস্তোরাঁয় কোণার একটা টেবিল ঘিরে বসে একের পর এক গান চলতে লাগল আড্ডায়। নাদিম গিটার আর অন্তু টেবিল বাজিয়েই আড্ডা জমিয়ে তুলল। রঞ্জনের অদ্ভূত গানে কখনও বা সুর মেলাতে লাগল, কখনও-বা হেসে কুটি কুটি হতে লাগল নীরা-নম্রতা-ছোঁয়া। রেস্তোঁরায় থাকা অধিকাংশ খদ্দের মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সোনালি সকালে ফুটে উঠা একদল উচ্ছল তরুণ-তরুণীদের। সকালের নাস্তা এলো ডিম,পরোটা আর দই। ধীরে সুস্থে নাস্তা শেষ করে চারপাশটা ঘুরে ফিরে দেখল ওরা। কিছুক্ষণ পা ছড়িয়ে ঘাটে বসে রইল। সমস্বরে গান গাইল। সারাটাক্ষন ফূর্তিতে মেতে রইল প্রতিটি প্রাণ। দশটায় লঞ্চ আসতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে গেল তাতে। উদ্দেশ্য কুতুবদিয়া। লঞ্চ ছাড়ার পর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। ঠিক তখনই মন খারাপের মেঘ এসে জমা হলো নম্রতার আকাশে। সেই সাথে এলো কান্না। এতোক্ষণ চেপে রাখা আক্রোশগুলো চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইল।চিঠির ওপাশের মানুষটির কলার চেপে বলতে ইচ্ছে করল, ' কেন করলে তুমি এমন? সত্যিই হারালে? নাকি ধোঁকা দিলে? আমাকে মরণ যন্ত্রণায় ফেলে এভাবে পিছুতে পারলে তুমি? একটুও কষ্ট হলো না?' এই উত্তরগুলোর জন্য হলেও নম্রতা তাকে খুঁজতে চায়। অপেক্ষা করতে চায়। এই উত্তরগুলো না পেলে যে তার ভালো থাকা হচ্ছে না। কিছুতেই না। তাছাড়া, ওই বেয়াদব লোকটিকেও ছাড়বে না নম্রতা। আবার দেখা হলে, শক্ত কয়েকটা চড় লাগাবে। ধাক্কা দিয়ে ডায়েরি ফেলে দিয়ে আবার আবেগ নিয়ে ছেরখানি! এতো বড় সাহস!
কুতুবদিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হলো। এখানকার স্থানীয় একটা হোটেলে উঠেছে তারা। আজকের রাতটা কাটিয়ে সকালের লঞ্চে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পৌঁছাবে। অন্ধকার আকাশে মেঘ করেছে। ঝড় হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। চারপাশে উলোট পালোট হাওয়া। সেই হাওয়ায় উড়ে চলেছে নীরার অস্থির চুল, ওড়না। বারান্দার থামে ঠেস দিয়ে ফোনালাপ সারছে সে। চোখে-মুখে চাপা উৎকন্ঠা। হরিণীর মতো টানাটানি চোখে অল্পবিস্তর দ্বিধা। খানিক দূরে বসে থেকে এসবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল অন্তু। আড্ডায় মশগুল রঞ্জন, নাদিম একপর্যায়ে থেমে গেল। অন্তুর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে নীরার দিকে তাকাল। দু'জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অপরের দিকে তাকাল। নাদিম ফট করে বলে ফেলল,
' এইবার ঢাকায় ফিইরা তোগো দুইডারে কাজি অফিসে ঢুকাইয়া তালা মাইরা দিমু। খুলতাম না। তোগো এসব পারু-দেবদাসের কাহিনী আর ভাল্লাগতাসে না।'
অন্তু কপাল কুঁচকাল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
' ক্যারা দেবদাস? ওর জন্য দেবদাস হওয়া লাগব? এতো বাজে দিন আসে নাই আমার।'
' হ। ওইডা তো তোর চোখ দেখলেই বুঝা যায়। দোস্তের দিকে এমন কামুক দৃষ্টিতে তাকাইতে তোর বিবেকে বাজে না?'
অন্তু নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল,
' প্রথম যখন তাকাইছিলাম তখন তো আর দোস্ত ছিল না। সাধারণ সুন্দরী মেয়ে ছিল। দেখতেই প্রেমে পড়ে গেলাম। আর সেও আমাকে ফ্রেমেবন্ধী করার পায়তারা করতে লাগল। এই মেয়ের যন্ত্রণাতেই মরে যাব একদিন, দেখিস।'
রঞ্জন ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
' বুঝিয়ে বললেই পারিস।'
' আর কত বুঝাব? তিনটা বছর ধরে তো বুঝাচ্ছিই। আমি কী দেখতে খুব খারাপ? আমার মধ্যে পছন্দ করার মতো কিচ্ছু নাই? একটা গুণও না?'
কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল অন্তুর। চোখদুটো হয়ত একটু টলমলও করে উঠল। রঞ্জন অন্তুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
' কি বলিস এগুলো? তুই আর খারাপ দেখতে? মাইয়ারা তাহলে কী দেইখা পটে যায়, বল তো মামা। ফালতু চিন্তা বাদ দে। নীরা বুঝবে। সময় দে ওরে।'
নাদিম অসহায় চোখে তাকাল। হতাশ কন্ঠে বলল,
' এল্লায় ভাল্লাগে না বাল। নীরুর জায়গায় অন্যকেউ হইলে থাপড়া মাইরা ঠিক কইরা ফেলতাম। কিন্তু নীরুও তো আমাগোই দোস্ত। কারে কী কই বল তো? যন্ত্রণার এক শ্যাষ। শালা তুই প্রেমে পড়ার জন্য আর কোনো মেয়ে পাইলি না?'
অন্তু ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে বলল,
' পাইছিলাম তো। তোর বোনেরে। দিলি না। ছ্যাঁকা!'
নাদিম ওর দিকে তেড়ে এসে বলল,
' তোর লাইগা হুদ্দাই সেমপ্যাথি আসে। তোরে তো মাইরা ফেলানো উচিত।'
' তোর বোনের জন্য জান কুরবান শালা মশাই।'
রঞ্জন এবার হুহা করে হেসে উঠে। নাদিমের মুখ তখন রাগে আগুন।
.
.
.
চলবে..........................