আতিকা বেগম নিজেকে সামলাতে না পেরে ধপাস করে খাটেই বসে পড়লেন। সেলাইয়ের দাগ চকচক করছে।
কোনোমতে নিজেকে শক্ত করে," তোর কী এইখান থেকে যাওয়ার পর কিডনিতে পাথর হয়েছে নাকি? কিন্তু কিডনিতে পাথর হলেও তো কিডনি ফেলে দেয় না। তাহলে কী হয়েছে?"
সম্পূর্ণা অনায়াসে বলল," হিমেল বিক্রি করে দিয়েছে মা।"
কথাটা শুনে আতিকা বেগম আঁতকে উঠে," বিক্রি করেছে মানে? তুই বিক্রি করতে দিয়েছিস?"
-" আমি তো জানতামই না। এইখানে আসার আগে ও আবার আমার দ্বিতীয় কিডনিটা বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিল সেখানেই একজন ডাক্তার আমাকে সব বলে। আর ওই ডাক্তারই আমাকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। না হলে হয়তো তোমরা আমার লাশটাকেও খুঁজে পেতে না। কারণ তোমাদের জেদ তো আর আমাকে খুঁজতে যেত না। তাই না?"
আতিকা বেগমের মাথাটা ঘুরছে। মেয়েকে কী থেকে কী বলবেন বুঝতে পারছে না। এত বড় জানোয়ার মানুষ হয় কী করে? অবশ্য ও তো আগে থেকেই জানোয়ারের মতোই ছিল। শুধু আমার মেয়ের চোখেই ভালো।
সম্পূর্ণা নিজে থেকে আবার বলল," আমরা যখন এইখান থেকে যাই তখন থেকে ওর হাতে কোনো কাজ ছিল না। আমার কাছে তো কিছুই ছিল না তখন। সেখানে গিয়ে কত দিন না খেয়ে ছিলাম। কোনো মতো টুকটাক কাজে একবেলা খেলে দু'বেলা না খেয়ে থাকতে হতো। তবুও যেন ভালো ছিলাম। পরে ও একটা মুদীখানায় কাজ পায়। লোকটা ভালো ছিল। বেতন ছাড়াও মাঝেমধ্যে আমাদের সাহায্য করতো।যেমন চাল,ডাল,সাবান অনেক কিছু এমনিই দিয়ে দিতো হিমেলকে। আমাদের একরুমের একটা ঘরও দিয়েছে থাকতে। মাস শেষে টাকা পেয়ে ঘর ভাড়া আর সংসার ভালোমতো না চললেও কোনো অভিযোগ করিনি মা। কারণ আমি তো নিজের ইচ্ছে গিয়েছি তাই না। তাই কাকে বলবো বলো? আমার তো ওই শহরে আপন কেহ নেই যে নিজের সময় ফেলে আমার কথা শুনবে। দুইমাস যেতেই হিমেল আবার বিভিন্ন রকমের নেশা করতো। কত বুঝিয়েছি আমার কথা শুনতো না। কয়েকমাসের মাথায় আমাকে বলল হসপিটাল যেতে। বললাম কেন? সে বলল, অনেকদিন খেয়ে না খেয়ে আছি আমার কোনো সমস্যা হয়নি তো? তাই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে আমাকে অপারেশন করানো হবে। কিন্তু কিসের আমি জানি না। শুধু অনেকগুলো রিপোর্ট দেখিয়ে আমায় বলল আমাকে নাকি অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন করা হবে। কিন্তু আমার তো সেই ধরনের কোনো লক্ষণই নেই। ওকে যখন বললাম," হিমেল আমার তো পেটে ব্যথা কিংবা অন্য কোনো সমস্যা নেই।"
সে আমায় বলল," তুমি কী আমার থেকে বেশি বোঝ? ডাক্তার ওরা না-কি তুমি? ডাক্তার বলেছে এখন কম সমস্যা আছে যদি বেড়ে যায় তখন তোমাকে বাঁচাতে প্রবলেম হয়ে যাবে।"
তার কথায় সেদিন বিশ্বাস করেছিলাম মা। আর কোনো প্রশ্ন করেনি। কারণ আমি তো ভাবতাম পৃথিবীতে ওই আমার একমাত্র আপন লোক। যার কাছে নিজের সব কষ্ট বলা যায়। যে আমার ভালো চায়। হয়তো ওই টাকায় সে নেশা করেছে।বাজার করেছে।আমাকে দুটো সুতির শাড়ি দিয়েছে। আবার আমার সেলাইয়ের জায়গার ব্যথা কমানোর ঔষধ এনেছে। তারপরও তো আমার স্বামী ছিল। ভালোবাসতো। তারপর তো দুইদিন আগের কাহিনি। যেটা আর আমাকে আটকাতে পারিনি। ছুটে আসতে হয়েছে তোমাদের কাছে।"
কথাগুলো বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদছে সম্পূর্ণা।
আতিকা বেগম নিস্তব্ধ, নির্বিকার, স্থির হয়ে বসে আছেন। চোখ দিয়ে অনবরত পানিগুলো ঝরে পড়ছে।
যদি একটাবার মেয়েটার খবর নিতো তাহলে হয়তো এইদিন দেখতে হতো না। কেন যে এত পাথর হলাম কে জানে।
আতিকা বেগমের পায়ের কাছে বসে সম্পূর্ণা বলল," আমায় মাপ করে দাও। তোমাদের মুখে চুনকালি মেখে আমিও শান্তি পাইনি মা। ও মা মাপ করে দাও না আমায়। তোমরা মাপ না করলে এই পৃথিবীতে বাঁচার ইচ্ছে আমার নেই। মা গো মাপ করে দাও না।"
আতিকা বেগম সম্পূর্ণাকে উঠিয়ে নিজের কাছে বসিয়ে," মা কখনো সন্তানকে খারাপ বোধদোয়া করেন না। সবসময় আল্লাহর কাছে বলেন," সন্তান যাই করুক না কেন ভালো থাকুক।"
সারারাত মা মেয়ে একসাথে কাটিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণা মা'কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। কতদিন এমন ঘুম ঘুমালো জানে না সে। আজ সে ছোট্ট সম্পূর্ণাকে যেন ফিরে পেয়েছেন আতিকা বেগম।
পরের দিন সকালে সাইফুল ইসলাম আতিকা বেগমকে বারবার জিজ্ঞেস করলেন। সম্পূর্ণার সাথে কথা হয়েছে কি-না হিমেলের ব্যাপারে। আতিকা বেগম ভাবলেন সম্পূর্ণার একটা কিডনি নেই এইটা বললে সাইফুল ইসলাম কষ্ট পাবেন।হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবেন না। আর পুলিশের কাছে বললেও ঘটনা ঘাটাঘাটি হবে। মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়েটা আর দেওয়া যাবে না। মানুষে জেনেশুনে এমন মেয়ে বিয়ে করবে? করবে না। তাই তিনি দুঃখ কষ্টের কথা বললেন,নেশা করে সেটাও বললেন। এবং নেশার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সম্পূর্ণা চলে এসেছে। রাতবিরেত মারধর করে তাই।"
সাইফুল ইসলাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিল ছেড়ে উঠার আগেই থানা থেকে ফোন এসেছে।
ওসি সাহেব সালাম দিয়ে বললেন," সাইফুল সাহেব, আপনি গ্রামের সম্মানিত একজন ব্যক্তি। আমরা থানা থেকে গিয়ে আপনাদের অপদস্ত করতে চাইনি। কারণ গ্রামের মানুষেরা থানা থেকে পুলিশ গেলেই বিরাট কিছু ভেবে নেয়। তাই আমি আপনাকেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই। ব্যাপারটা আসোলে কী? শুনলাম আপনার মেয়ে ফিরে এসেছে?"
সাইফুল ইসলাম শান্ত আর অসহায় গলায় বললেন," জি।"
-" এখন তো আপনাদের বাড়ির ওই মহিলা,মানে আপনার মেয়ের শ্বাশুড়ি মামলা করতে আসছে। কোনো রকম বুঝিয়ে কাগজ কলমে লেখে বলেছি মামলাটা নিয়েছি। এখন আপনি যদি সত্যটা কী বলতেন তাহলে ভালো হতো। আমরাও সামনে এগুতে পারতাম। আসোলে আমরা যতটুকু জানি আপনার ফ্যামিলি এবং আপনি অনেক ভালো মানুষ । যদি উনার ছেলেকে খুন করেই আসতো তাহলে চট্টগ্রাম থেকে নিশ্চয়ই ফোন আসতো। ফোন যখন আমাদের থানায় আসেনি তাহলে ব্যাপারটা অন্যকিছু। "
-" আপনি ঠিক ধরেছেন। ওই মহিলা আমাদের বাড়িতে এসে অনেক গালাগালি করে। যখন তখন এসে আজেবাজে হুমকি দেয়। তারপর আতিকা বেগমের বলা কথাগুলো বলতেই ওসি সাহেব বললেন," আপনাদের থানায় আগেই জানানো উচিত ছিল। এবং আপনাদেরই উচিত ছিল নারী নির্যাতনের মামলা করা। যখন করেন নাই ব্যাপারটা আমরা দেখতেছি।"
ওসি সাহেব সালাম দিয়ে রেখে দিলেন।
কয়েকদিন কেটে যেতেই সম্পূর্ণা আগের থেকে এখন ভালো আছে। বড় ভাবির সাথে টুকিটাকি কাজে সাহায্যও করে। পুলিশ হিমেলের মাকে হুমকি দিয়েছে যদি আবার ওদের বাড়ি গিয়ে কোনো রকম ঝামেলা করে তাহলে হিমেলের মা'কেই জেলে ভরে রেখে দিবে। এবং হিমেল যদি নোয়াখালী আসে তাহলে তাকে যেখাই পাক ধরে নিয়ে যাবে।হিমেলের মা সারা গ্রাম করেছে সাইফুল ইসলাম টাকা খাইয়ে পুলিশদের কিনে নিয়েছে। বাজারে গেলে অনেকে অনেক কথা বললেও সাইফুল ইসলাম কানে তুলে নেন না। আমজাদের সাথে বাজারে দেখা হতেই একদিন দুজনে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতে দিতে সম্পূর্ণার কথা তুললো। এবং সাইফুল ইসলামও সব খুলে বললেন। আমজাদ শুনে বলল," তোর মেয়েকে একটা বিয়ে দিয়ে দে। ভালো ছেলে দেখেই দে। তোর তো টাকা পয়সার কম নেই। মেয়েও দেখতে শুনতে ভালো।"
-" এমন ছেলে আমি পাব কই বল? গ্রামের সবাই জানে। সব শুনে ভালো ছেলেরা আসে না। সবাই উল্টো টিপনি কাটে।"
-" ঠিক আছে তাহলে আমি একটা ভালো ছেলে দেখে তোকে জানাবো। অবশ্য আমাদের এলাকায় যত ছেলে আছে সবগুলোই প্রবাসী। তুই আবার প্রবাসীর কাছে দিবি নাকি?"
-" ভালো হলে দিয়ে দিব। ধরে রেখে লাভ কী? মেয়েটার জীবন তো আর নষ্ট হয়ে যেতে দিতে পারি না।"
-" হুম ঠিক বলেছিস।"
সেদিন রাতেই সাইফুল ইসলাম আতিকা বেগমকে বলতেই সম্পূর্ণা সব শুনে নিয়েছে। কিন্তু বাবাকে কি বলবে তার জীবনে কোনো পুরুষ মানুষের স্থান দিতে সে পারবে না। তবে বাবাকে বলে এবার আর কষ্ট বাড়াতে চান না। তাদের যদি মনে হয় তারা বিয়েটা দিলে আমি ভালো থাকবো তারাও শান্তিতে থাকবে তাহলে হাসি মুখে না হয় ওদের জন্য আরেকবার আগুনে পা বাড়ালাম।
এতক্ষণ আফরা সম্পূর্ণার অতীত শুনে গালে হাত দিয়ে টলমল চোখে তাকিয়ে আছে সম্পূর্ণার দিকে। সম্পূর্ণা আফরার দিকে চোখ পড়তেই," আপনি কাঁদছেন নাকি? লেখিকাদের কাঁদতে নেই। তারা শুধু শুনে আর গল্প তৈরি করে। আপনার সাথে আমার দেখা করা স্বাদ ছিল। যখন শুনেছি আপনি আমার সম্পর্কে আত্মীয় হোন তাহলে সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইনি। তাই আজ রাতটা আপনার সাথে থাকার একটা বাহানা ছিল। আপনার লেখা ফেসবুকেই পড়েছিলাম মোটামুটি ভালো লেখেন। তবে আমার খুব ইচ্ছে ছিল কাউকে দিয়ে গল্পটা লেখাবো নিজের জীবনের। বড় বড় মাপের লেখকরা তো আমাকে সময় দিবেন না। আর তাদের সাথে যোগাযোগ করারও সামর্থ্য আমার নেই। তবে আপনিও অনেক ভালো লেখেন।তাই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি।
আফরা গাল থেকে হাত নামিয়ে," মুচকি হেসে, চা খাবেন আপনি?"
সম্পূর্ণা অবাক হয়ে," এতরাতে চা বানাবেন?"
-" ওটা আমার অভ্যাস রাত একটা দুইটায় চা বানানো। আপনি বসুন আমি এখুনি আসছি।"
চায়ের ফাঁকে শুরু হলো আফরার কৌতূহল। প্রশ্ন ছুড়ে মারলো সম্পূর্ণার দিকে," আচ্ছা আপনি হিমেলের বিষয়টা আমাকে একটু ক্লিয়ার করেন। হিমেলের সাথে প্রেমটা কীভাবে? এবং হিমেল কী আগে থেকেই খারাপ ছিল? বা আপনি পড়াশোনা কতটুকু করেছেন। আমি আমার বড় আপার কাছ থেকে শুনেছি আপনি এইসএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। এক্সামটা দিয়েছেন?"
-" না। হিমেলকে তো আমি ছোট বেলায় থেকে দেখতাম। কারণ আগেই বলেছি হিমেল আমাদের পাশেরই। ওর নজরে আমি এসেছিলাম ক্লাস নাইনে।
হিমেলের মা আর হিমেল ওই ছোট ঘরটাতে থাকতো। আমি মাঝেমধ্যে বাড়ির কয়েকটা মেয়ের সাথে ওদের ঘরে যেতাম। হিমেল তখন শুয়ে থাকতো নয়তো আমাদের দেখলে চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকতো। তাদের ঘরে অনেক বেলা করে রান্না হতো। তার মা পাশের বাড়ির খালিদ কাকুদের বাসায় বুয়ার কাজ করতো। ওইখান থেকে এসেই রান্না করতো। তারপর খেতো। হিমেল যে দেখতে অনেক স্মার্ট বা সুন্দর ছিল তাও না। তবে শান্ত ছিল আমার কাছে তখন এটাই মনে হয়েছিল। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে আসার পথে হিমেল আমায় রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে বলল," সম্পূর্ণা, কাল সকালে একটু তাড়াতাড়ি আসিস তো। তোর সাথে কথা আছে আমার।"
আমিও আচ্ছা বলে বাড়ি গেলাম।
পরের দিন সকালে,,,,
.
.
.
চলবে...................................