কৃষ্ণাবতী - পর্ব ৩৩ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


এবার অবন্তীকা দেবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো দেবব্রতের উপর। তারপর হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
- শোনো দেবব্রত, কখনো কিছু বলি নি মানে এটা নয় কিছু কখনোই বলবো না। আমার বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে, আমি চাই না তুমি কোনো ঝামেলা করো। এমতেই আমার বউমার শরীরটা ভালো নেই।
- হিপোক্রেসির একটা লিমিট থাকে মা, আজ কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট বলে তুমি তাকে মাথায় তুলে রেখেছো। এটা তোমার জানারও প্রয়োজনীয়তা নেই কৃষ্ণার এতে কোনো ক্ষতি হবে কি না! বাহ! এতোদিন তুমি কৃষ্ণার সাথে কথাও বলতে চাও নি, কিন্তু যেই দেখলে কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট অমনি তুমি বদলে গেলে। কেনো মা?

দেবব্রতের কথায় যেনো মুখে তালা লেগে গেলো অবন্তীকা দেবীর। নিজের মাকে দুয়েক বাক্যে চুপ করিয়ে দিতে পারবে এটা যেনো বিষ্ময়কর আবিষ্কার। দেবব্রতের কথাটা যে ভুল নয় এই কথাটা খুব ভালো করেই জানেন অবন্তীকা দেবী। ছেলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কথাটা বুঝিয়ে দেওয়াতে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন অবন্তীকা দেবী। দেবব্রত এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
- কৃষ্ণার ক্ষতি আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না, তার জন্য যদি আমাকে সন্তানহীন জীবন কাঁটাতে হয় তাতেও আমি রাজী। 
- কৃষ্ণার ক্ষতি মানে?
- মানে টা হলো, কৃষ্ণার প্রেগ্ন্যাসিতে ডিফিকাল্টিস আছে। বাচ্চাটা ক্যারি করাটা ওর জন্য রিস্কি হবে। 
- এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। বাচ্চা নেবার জন্য সবারই একটু আকটু সমস্যা থাকেই। 
- মা তুমি কি সত্যি ই বুঝতে পারছো না?
- আমি দুনিয়াতে তোমার পরে আসি নি! তুমি হবার সময় ও আমার অনেক ধকল গেছে, এখন এটাকে যদি তুমি ধরে বসে থাকো তবে কেউ ই মা হতে পারবে না।
- মানুষের কথা আমি জানতে চাই না মা। আমার কৃষ্ণার কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না। তোমার জিদের কারণে তোমার চাপের কারণে আজ কৃষ্ণা নিজের ক্যারিয়ার বলি দিচ্ছে। নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে দিয়ে সে এই বাচ্চাটা রাখতে চাচ্ছে। এই বাচ্চাটার কারণে যদি ওর কোনো ক্ষতি হয় তাহলে কি তুমি সেই দায় নিবে!

এবার যেনো নিজেকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না দেবব্রত। যেই ছেলে কখনো মায়ের সাথে উঁচুগলায় কথা বলে নি সেই ছেলেটা আজ রীতিমতো চিৎকার করছে। মা ছেলের মাঝে এই বিবাদ যেনো একেবারেই মেনে নিতে পারছে না কৃষ্ণা। রীতিমতো কথার কুরক্ষেত্র লেগেছে তাদের মাঝে। তখন কৃষ্ণা ধীর গলায় বলে উঠলো,
- আমি কারোর চাপে সিদ্ধান্ত নেই নি, আমি নিজে মা হতে চাই। আমি বাচ্চাটা রাখতে চাই। 

কৃষ্ণার কথায় দেবব্রত চুপ হয়ে যায়। চোখজোড়া সরু করে এক দৃষ্টিতে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রইলো। অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে কৃষ্ণা তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কৃষ্ণার কথায় খানিকটা জোর পেলো অবন্তীকা দেবী। গর্বের স্বরে বললেন,
- শুনে নিয়েছো? এবার যেনো এবোর্শনের উচ্চারণ তোমার মুখে না শুনি। 

বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন অবন্তীকা দেবী। দেবব্রত তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। খুব কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো কৃষ্ণা। ধীর পায়ে হেটে দেবব্রতের সামনে দাঁড়ালো সে৷ অসহায়ের মতো বললো,
- মাষ্টারমশাই, আমরা কি পারি না একটা স্বাভাবিক দম্পতির মতো সংসার করতে! স্বাভাবিকভাবে আমাদের আগত শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে! 
- স্বাভাবিক দম্পতির কোনো সিদ্ধান্ত যেকোনো একজন নেয় না কৃষ্ণা। সব সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েই নিয়েছিস তাহলে আমাকে জানানোর কি প্রয়োজন, তোর যেটা ভালো মনে হয় তুই কর। আমাকে কিছু বলতেও আসিস না আবার আমাকে কিছুতে জড়াস ও না। 

কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় কৃষ্ণা। চোখ জোড়া আপনা আপনি ছলছল করে উঠে। জীবনের সুখময় অনুভূতিটা যেনো বিষাক্ত কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। দেবব্রত সটান রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। কৃষ্ণা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। হাতটা আপনা আপনি পেটের কাছে চলে যায়। দু হাতে পেট আকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে কৃষ্ণা। কেউ তার অনুভূতিগুলো কেনো বুঝে না, সবাই শুধু নিজেদেরকেই সঠিক প্রমাণে লেগে রয়েছে। 

!!২৭!!

সন্ধ্যা ৭টা,
স্থানঃ- গুলশান
বন্ধুদের সাথে বসে রয়েছে দেবব্রত। আজ বহু বছর পর বন্ধুরা একত্রিত হয়েছে। উপলক্ষ্য সৌদামিনী। এই বন্ধুদের সাথে একটা সময় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো, আড্ডা দিতো। আজ যেনো পুরোনো স্মৃতি গুলো তাজা হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণাকেও নিয়ে এসেছে সে। কৃষ্ণা এক কোনায় চুপ করে বসে রয়েছে। সৌদামিনীর সাথে এখনো কথা হয় নি দেবব্রতের। অনেক বদলে গেছে সৌদামিনী। শ্যামলা বাঙ্গালী মুখটা এখন আর বাঙ্গালী নেই। লম্বা কেশটুকু ও কেটে ফেলেছে সে। এখন আর চোখে কাজল দেয় না সৌদামিনী। মুখের মায়াবী ভাবটাও রুক্ষতায় পরিণত হয়েছে। অনেকটাই পালটে গেছে দামিনী। আড্ডার মাঝেই সৌদামিনী এসে বসলো রবিনের পাশে। 
- তোদের কিছু লাগবে? 
- নারে, আয় না বস একটু

জোর করে কথাটা বলে রবিন। রবিনের কথা শুনে ঠোঁটের কোনায় হাসি টেনে রবিনের পাশে বসে সৌদামিনী। দেবব্রতের বেশ অন্যরকম লাগছে, খানিকটা অস্বস্তি ও বোধ হচ্ছে তার। কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। তখন রবিন বলে উঠলো,
- আমাদের টিমে সবাই এক থেকে দুই, কেউ কেউ তিন হচ্ছে বা হবে। তোর কথাটা এবার বল দামিনী!

রবিনের কথায় ঠোটের কোনায় একটা ম্লান হাসি দিয়ে দামিনী বললো.......
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন