ঝরা ফুলের কান্না - পর্ব ০৫ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


রাত এগারোটায় তাবিয়া খাবার টেবিলে খাবার দিয়ে আদীলকে ডাকতে গেল।সাইফুল ইসলাম এসে বসে," আদীলের মা আমার লক্ষ্মী খাবে না?" 
-" আজ স্কুল থেকে আসার পর থেকে দেখছি চুপচাপ। 
স্কুলে কিছু হয়েছে কি-না কে জানে?"
-" জিজ্ঞেস করনি?"
-" কী জিজ্ঞেস করবো? "
কথাটা বলেই, " সম্পূর্ণা, খেতে আয় মা।"
সম্পূর্ণা এসে চেয়ার টেনে বসে," আদীলের মা আমার মেয়েটা খুব ভালো। তুমি শুধু শুধু ওর ওপর রাগ দেখাও। কথাটা বলে সম্পূর্ণার প্লেট টেনে নিয়ে মাছ বেছে ভাতের লোকমা তুলে খাওয়াতে খাওয়াতে," সামনে তো পরীক্ষা। ভালো করে মন দিয়ে পড়। টিচার একটার জায়গায় দুইটা হোক।তবুও রেজাল্ট ভালো চাই মা। তুই রেজাল্ট ভালো না করলে মানুষে বলবে সম্পূর্ণা কিচ্ছু পারে না। পঁচা একটা মেয়ে।"
-" বাবা আমি এখন বড় হয়েছি।"
কথাটা শুনেই সাইফুল ইসলাম হা হা হা করে এসে," হ্যাঁ জানি তো আমার মায়ের ষাট বছর হয়ে গেছে। আদীলের মা আমার মা যা বলবে তাই শুনে চলবে। ঠিক আছে?"
আতিকা বেগম কিছু বললেন না। আদীল আর তাবিয়া এসে খেতে বসেছে। আদীল সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে," দাদী, দাদা জান কবরে কী আপনাকে এখনো লাভ লেটার দেয় না-কি? "
সম্পূর্ণা ন্যাকা স্বরে বলল, " আমি কিন্তু এইবার খাবই না।"
সাইফুল ইসলাম ধমকের স্বরে বললেন," আদীল, তোমার খাওয়া তুমি খাও। আমার মেয়েকে ক্ষেপাবে না।"
কথাটা বলেই ছেলের দিকে ইশারা করলেন চুপ করতে।"

কয়েকদিন কেটে গেল। হিমেল সময় মতো রাস্তায় দাঁড়ালেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আদীল মোটরবাইকে করে সম্পূর্ণাকে দিয়ে আসে আবার নিয়ে আসে। 
আদীল লন্ডনে যাওয়ার পরেরদিনই সম্পূর্ণাকে একা পেয়ে হিমেল যেন পাগলের মতো টেনে রাস্তের পাশে নিয়ে দাঁড় করিয়ে," কী ভেবেছিস তুই? একটাবার আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলি না?"
-" ভাইয়া ছিল তো।"
-" ঠিক আছে এখন আমার আনসার দে। তুই আমাকে ভালোবাসিস কি বাসিস না?"
সম্পূর্ণা নিচের দিকে তাকিয়ে, " বাসি।"
হিমেলের যেন প্রান ফিরে এলো। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলল," এই কথাটা বলতে তোর এতদিন লেগে গেল? আচ্ছা ঠিক আছে রোজ আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো। তুই একবার হলেও দেখা করিস।"
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।  

সম্পূর্ণার পরীক্ষা ঘনিয়ে আসতেই সাইফুল ইসলাম এবার নিজেই সম্পূর্ণাকে দিয়ে আসবেন ভেবে সম্পূর্ণা চলের যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বেরুলেন। একটুখানি গিয়ে দেখেন সম্পূর্ণা হিমেলের সাথে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে কিছু একটা নিয়ে। সাইফুল ইসলাম কাছে যেতেই দু'জনে থমকে গেল। সম্পূর্ণা ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে, " বাবা আমি স্কুলেই যাচ্ছি,,,,।"
সাইফুল ইসলাম মেয়েকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে," চল আমি তোকে দিয়ে আসি।"
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে সামনে পা বাড়ালো। সাইফুল ইসলাম হিমেলকে কিছু না বলে সম্পূর্ণাকে নিয়ে চলে গেলেন।
বিকেলে সম্পূর্ণা স্কুল থেকে আসার পর সাইফুল ইসলাম মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। তাবিয়া এসে বলতেই সম্পূর্ণা ফ্রেশ হয়ে সাইফুল ইসলামের ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। 
-" বস।"
সম্পূর্ণা বসতেই তিনি বললেন," বাবা এমন একজন মানুষ পৃথিবীর সবাই খারাপ হলেও মেয়েদের জন্য বাবা কখনো খারাপ হয় না। তেমনি আমিও তোর বাবা। জানি না হিমেলের সাথে কী নিয়ে হাসাহাসি করছিলি তবে মারে হিমেলের সাথে হাসাহাসি,কথা বলার দরকার নেই। ছেলেটা ভালো না।শুনেছি গাজা টাজা খায়। নেশা করে মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আমি চাই না আমার মেয়ে এমন কারো সাথে কথা বলুক। সামনে পরীক্ষা কে ডেকেছে না ডেকেছে এইগুলো চিন্তা না করে পড়ায় মন দে। আর যদি অন্যও কিছুও হয়ে থাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেল। তুই এখনো ছোট। অস্বাভাবিক কিছু ভাবনার সময় তোর নয়। আমি কী বলেছি শুনতে পেয়েছিস? হিমেলের সাথে আর কথা বলার দরকার নেই। পরে গ্রামের মানুষ কী থেকে কী বলবে মানসম্মান সব যাবে।"
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। পরেরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় হিমেল দাঁড়াতে বললেও সম্পূর্ণা দাঁড়াচ্ছে না দেখে হিমেল হাত ধরে ফেলে," আমার কথা শুনতে পাও না?"
-" আপনি নেশা করেন? গাজা খান? এইগুলো করেন আবার আমার সাথে আসছেন প্রেম করতে। আপনার লজ্জা করে না?"
হিমেল করুন গলায় বলল," আমি জানি তো এইগুলো তোমার বাবা তোমাকে বলছে। আমাকে দেখে এমন মনে হয়? আমরা গরীব বলে তোমার বাবা আমার নামে যা ইচ্ছে বলছে আমাকে ছোট করার জন্য। এই সহজ হিসেব তুমি বুঝলে না? "
-" কিন্তু আমার বাবা মিথ্যা বলে না।"
-" হ্যাঁ তোমার কাছে তোমার বাবা তো পীর হবেই। আমরা তো রাস্তার ছেলে। আমার মা অন্যের বাসায় কাজ করে বলে তোমরা আমাদের মানুষ মনে কর না। আমাদের কী মন নেই? ঠিক আছে তুমি তোমার বাবার কথা শুনেই চলো। আমি আর কী? এই জীবন রেখে কী হবে? যারে এত ভালোবাসছি সে আমাকে ভুল বুঝে। যাও তুমি যাও।"
-" ঠিক আছে,আপনি এইগুলো বলতে হবে না। নেশা করলেও ছেড়ে দিন। আর আমার সাথে এইভাবে দেখা করার দরকার নেই। কয়েকদিন পর পর দেখা করেন।"
সম্পূর্ণা চলে গেল। হিমেল তাকিয়ে আছে। এই সম্পূর্ণাকে তার বেশ ভালোই লাগে। অনেক ভালোবাসে তাকে। যেভাবেই হোক সম্পূর্ণাকে ভুল বুঝতে দিলে হবে না। সম্পূর্ণার পরীক্ষা শেষ হলেই মা'কে তাদের ঘরে পাঠাবো। বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো।

সম্পূর্ণার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তাবিয়ার সাথে তাবিয়াদের বাড়িতে বেড়াতে আসছে সে। সেদিন রাতেই হিমেলও দাউদের কাছ থেকে শুনে এসেছে এই বাড়িতে। তাবিয়া সহ অনেক গল্পসল্প হলো। অনেক রাত করে হিমেল বাড়ি গেল। পরের দিন হিমেল আবার আসতেই তাবিয়ার চোখে লাগলো। নিজের মায়ের কাছে গিয়ে বলল," মা, হিমেল কী প্রতিদিন আসে না-কি আমাদের বাড়ি? "
-" কই না। এখন কেন আসে কে জানে?"
তাবিয়া আজ হিমেল আর সম্পূর্ণার দিকে খেয়াল রাখছে। তাদের চোখে চোখ কথা বলার ধরন যেন অন্যরকম। সম্পূর্ণা যেন হিমেলকে ছেড়ে ভিতরের ঘরে আসতেই চাইছে না। হিমেল যাওয়ার পর দাউদের ঘরে গিয়ে তাবিয়া বলল," দাউদ, হিমেল এইখানে আসে কেন?"
-" আমার বন্ধু, আসবে না?"
-" আমার কাছে অন্যকিছু মনে হচ্ছে।"
-" তুই কাউকে বলবি না তো?"
-" না বলবো না বল?"
দাউদ হেসে বলল," হিমেল তোর ননদের জন্যই আসে। দেখিস না তোর ননদ হিমেলকে দেখলে পরিবর্তন হয়ে যায়? ওরা দু'জন দু'জনকে ভালোবাসে।"
তাবিয়া অবাক হয়ে, " কী বলিস? এই ছেলেটার সাথে?"
-" হ্যাঁ!"
-" দাউদ তুই এইগুলো আমাকে আগে কেন বলিসনি?"
-" আরে আমিও জানতাম না। তুই এইখানে আসার পর হিমেল আমায় সব বলেছে।"
তাবিয়া শুনে বিশ্বাস করতে পারছে না। এইখানে সে আরও কয়েকটা দিন থাকলে যদি কোনো অঘটন ঘটায়? আর সম্পূর্ণাকেও তো একা যেতে দিলে বাবা মা কী ভাববেন? তাই সে নিজেই পরের দিন বিকেলে চলে গেল শ্বশুর বাড়ি। তাবিয়াকে দেখে আতিকা বেগম অবাক হলেন। মুখে কিছু না বললেও ব্যাপারটা তিনি সহজভাবে মানতে পারেননি। কিন্তু রাতে তাবিয়া সাইফুল ইসলাম আর আতিকা বেগমের কাছে সব খুলে বলতেই সাইফুল ইসলাম বললেন," আমার সন্দেহ ঠিক।"
আতিকা বেগম চমকে উঠে, " তুমি কী আগে থেকে কিছু জানতে?"
-" জানা বলতে আমি কয়েক মাস আগে দুজনকে এক সাথেই দেখেছি। সেদিন সম্পূর্ণাকে বুঝিয়েছি। কিন্তু এরপরেও যে ও এইভাবে অবাধ্য হবে সেটা কী আমি জানতাম?"
আতিকা বেগম ধমক দিয়ে বললেন," তাহলে আমাকে কেন সেদিন বললে না? আরে আমাকে বললে তো মেরে ওর পীঠের ছাল উঠাতাম।"
সাইফুল ইসলাম শান্ত গলায় বললেন, " ছাল ছাড়লেই কী তোমার মেয়ে ঠিক হয়ে যেতো? "
-" এই আমার মেয়ে বলবা না। এতদিন তো নিজের লক্ষ্মী মেয়ে বলে সবার মাথায় খেয়েছ। তোমার কারণে মেয়ের আজ এই অবস্থা। "
তাবিয়া বলল," মা আপনারা থামুন। ঝগড়া করলে সব ঠিক হয়ে যাবে? ওর যে বয়স ওটা খুব খারাপ। এই বয়সটা পার করতে পারলেই ও নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখবে। আর আপনারা ওকে এখন মারধর করে কোনো লাভ হবে না। বরং বুঝিয়ে বলুন। আর না হলে ছেলের মাকে গিয়ে বলুন ছেলেকে সাবধান করতে।"
সাইফুল ইসলাম বললেন," বড় বউ ঠিক বলেছে। কাল থেকে ওকে বাড়ি বাইরে আপাতত বের হতে দিবে না। আমি দেখি কী করা যায়।"
আতিকা বেগম পরেরদিন মেয়েকে বুঝালেন। কিন্তু মনে হচ্ছে সম্পূর্ণা এককান দিয়ে কথাগুলো ঢুকায় আরেক কান দিয়ে বের করে। 
সাইফুল ইসলাম হিমেলকে বাজারে দেখে একা দেখা করতে বললেন। হিমেল বিকেলে বাড়ি আসতেই সাইফুল ইসলাম ঠান্ডা মাথায় বললেন," সম্পূর্ণা এখনো ছোট। ওকে তিনি অনেক দূর পড়াতে চান। আর বাড়ির ভেতরেও মেয়ে বিয়ে দিতে চান না। হিমেল যেন এইসব ভুলে সম্পূর্ণার সাথে যোগাযোগ না করে।"
হিমেল বলল," আপনি সোজাসজি বললেই তো হয়, আপনি আমার কাছেই আপনার মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। এত তাল বাহানা করেন কেন?"
সাইফুল ইসলাম ভদ্রভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলেও হিমেল যেন আরও গরম হয়ে যায়। সাইফুল ইসলামকে বলে," আপনার মেয়েকে কীভাবে নিয়ে যাই আপনি শুধু দেখেন। কতদিন আটকিয়ে রাখবেন? আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে এমন কাজ করবো বাজারেও মুখ দেখাতে পারবেন না। আমারে রাগায়েন না। আমি রাগলে ক্ষতিটা আপনারই হবে। পরে মেয়ে ঘরে রাখাটাই কষ্ট হবে।"
.
.
.
চলবে................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন