দেবব্রত শুধু অবাক নয়নে তার কিশোরী বউকে দেখে যাচ্ছে। কি অপরুপ না লাগছে, একেবারে গিন্নি গিন্নি। এই রুপে দেবব্রত হাজারোবার মরতে রাজী। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে দেবব্রতের, ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই চোখজোড়া অবাক হয়ে যায়। স্ক্রিনের নাম্বারটি যে তার পরিচিত, ফোনটা রিসিভ করতেই চিরচেনা কন্ঠটি কানে এলো,
- কেমন আছিস দেব?
দেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, পাঁচটা বছর পর তার কান্র এই কন্ঠটি এলো। হ্যা, সৌদামিনী ফোন করেছে। সৌদামিনী বিদেশ যাবার পর থেকে এক বারো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি দেবব্রতের সাথে। আজ এতোদিন পর, আর ফোনটি এসেছে সৌদামিনীর বাংলাদেশের নাম্বার থেকে। তাহলে দামিনী কি দেশে? চোখ বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো দেবব্রত। শান্ত গলায় বললো,
- মা দূর্গার কৃপায় ভালো আছি, কতোদিন পর তোর সাথে কথা বলছি। তোর খবর বল?
- ভালোই আছি, কেমন চলে দিনকাল?
- এইতো চলছে, আজ অন্নার আশীর্বাদ। তুই ভালো দিনে ফোন দিয়েছিস। তা দেশে কবে ফিরলি?
- ফিরেছি সপ্তাহ হয়েছে। আমার দেশে আসা উপলক্ষে আগামী শুক্রবার সারা, রবিনদের নিয়ে একটা হ্যাংআউট করতে চাচ্ছিলাম। সময় হবে?
- আমার তো হবে, তা আমার বউ কি এল্যাউড?
- হুম সবাই তাদের পার্টনারের সাথেই আসবে। তুই ও ব্যাতিক্রম নস৷ শুক্রবার দেখা হচ্ছে তাহলে৷ রাখছি
বলেই ফোনটা খট করে কেটেদিলো দামিনী। দেবব্রত ফোনের স্ক্রিনের দিকে নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। পাঁচ বছরে অনেক বদলে গিয়েছে হয়তো দামিনী। তাই তো এতো দূরত্ব রেখে কথা বললো। বন্ধুত্বের বাঁধনটা এখন শুধু একটা তীক্ষ্ণ সুতোয় ঝুলছে। সুতোটা এতোটা সরু যে, দেবব্রত চাইলেই এই বাঁধনটা আগের ন্যায় পুরু করতে পারবে না। মেয়েটার জীবনের গতি তার জন্য ঘুরে গেছে। দোষটা তার ছিলো। খুব জানতে ইচ্ছে করছে দামিনীর জীবনে কি কেউ এসেছে কি না! জানতে পারলে মন্দ হবে না।
- কি ভাবছো?
কৃষ্ণার ডাকে ভাবনার অথৈ জগৎ থেকে বের হয় দেবব্রত৷ মাঝায় আঁচলটা গুজে রয়েছে, বা হাত দিয়ে খোপা থেকে খোলা চুলগুলো কানের পাশে সরিয়ে দিতে দিতে কথাটা বললো কৃষ্ণা। কাজ করতে করতে বেশ ঘেমে গেছে। জুলাই এর ভ্যাবসা গরমে তার চুল থেকে ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। কোনো সাজ নেই মুখে শুধু ঠোটে হালকা লিপস্টিক তবুও কি অপরুপ লাগছে। মুচকি হাসি দিয়ে কৃষ্ণার মাজা চেপে ধরলো দেবব্রত। লজ্জায় রাঙ্গা কৃষ্ণার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। আশে পাশে দেখে মৃদু স্বরে বললো,
- ছাড়ো, মানুষ দেখলে বেহায়া বলবে
- মানুষের বউকে তো জড়িয়ে ধরি নি, আমার বউকে ধরেছি।
বলেই কৃষ্ণার কপালের চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলো। কৃষ্ণা চোখ জোড়া বুঝে মাথা নিচু করে বললো,
- মা ডাকছেন, চলো
- ছেড়ে দিবো তাহলে?
কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো কৃষ্ণা। লোকটার আশেপাশে আসলেই কেমন মাতাল মাতাল হয়ে যায় কৃষ্ণা। কথাগুলো সব গবলেট হয়ে যায়। যতদিন যাচ্ছে তত যেনো আর বেশি ভালোবেসে ফেলছে সে দেবব্রতকে। দেবব্রত ধীর কন্ঠে বললো,
- শুক্রবার কিন্তু একটু বের হবো
- কোথায় যাবো?
- দামিনী এসেছে
কথাটা শুনতেই বুকে কামড় পরে কৃষ্ণার। কেনো যেনো পাঁচ বছর পুরোনো ভয়গুলো বুকের মাঝে জড়ো হয়। তখন বয়সটা খুব ছোট ছিলো তাই এই আবেগগুলো তার কাছে অজানা ছিলো, কিন্তু এখন বয়সটা আগের মতো নয়। সম্পর্কগুলোর অন্তর্গত অর্থ সে আজ বুঝতে পেরেছে৷ দেবব্রতের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ না হলেও একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়েই গেছে। যে দেয়ালটা সে ভেদ করতে অপারগ। এর মাঝে দামিনীর আগমণ কোনো অশুভ বার্তা বয়ে আনবে নাতো তাদের মাঝে! কৃষ্ণার কপালে চিন্তার ছাপটা বুঝতে বাকি রইলো দেবব্রতের। মলিন হাসি হেসে বললো,
- ভালোবাসি
ছোট একটা কথা, খুব ছোট। তবুও কথাটা মনের মাঝে একটা শান্তির বন্যা বয়ে দিলো কৃষ্ণার। অবাক চোখে দেবব্রতের দিকে তাকালো সে। দুজন নির্বাক, চোখের চাহনী একে অপরের চোখে স্থির। একটা শব্দ উচ্চারণ না করেও নিজেদের মাঝে নীরব কথোপকথন হলো তাদের_______
!!২৪!!
আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে, পূর্ণিমা বলে কথা। শীতল ঠান্ডা বাতাস বইছে, কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ এখন ফকফকা, তাই চাঁদের আলোটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে অন্না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। কানে মুঠোফোন, অপরপাশে অর্জুন। কিছুদিন পর বিয়ের তারিখ পড়েছে। অগ্রহায়ণ মাসের চৌদ্দ তারিখ তাদের বিয়ে। ব্যাপারটা ভাবতেই অবাক লাগছে অন্নার। অন্না তার ভাবনায় ব্যাস্ত বিধায় অর্জুন অপরপাশ থেকে বলে,
- কি হলো চুপ করে আছো যে?
- ভাবছি
- কি ভাবছো?
- এই যে, ভগবান সত্যি সত্যি তোমাকে আমার ভাগ্যে রেখেছে।
- এখনো অবিশ্বাস লাগছে?
- লাগবে না বলো? কখনো ভেবেছিলাম এই উদাসীন লোকটা আমাতে মত্ত হবে
- কিন্তু হয়েছি তো, শুধু মত্ত নই। একেবারে ডুবেছি। ওই যে একটা গাণ আছে না,
" তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না"
"তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না"।
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাবো না
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আর পাবো না না না না, আর পাবো না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না"
অর্জুনের গানটা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে অন্না। অন্নার হাসিটা যেনো অর্জুনের বুকের মাঝে তীরের মতো লাগছে। হাসি থামিয়ে অন্না বলে,
- চাঁদ দেখছো?
- হু, তুমি?
- আমিও। আজ চাঁদটা যেনো আরো বেশি সুন্দর লাগছে।
- আমার চাঁদের কাছে ওই চাঁদ কোনো পাত্তাই পাবে না!
- তাই বুঝি, তো তোমার চাঁদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিবে?
- দিবো, অগ্রহায়ণ মাসের ১৪তারিখ তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিবো।
- অর্জুন?
এই প্রথম অন্না অর্জুন এর নাম ধরে ডাকলো। ডাকটা শুনে কিছু মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো অর্জুন। শান্ত গলায় বললো,
- বলো?
- কিছু না, ডাকতে ইচ্ছে হলো। আর কিছুদিন পর এই নামটা আর ডাকতে পারবো না।
- কেনো?
- ওমা জানো না, স্বামীর নাম মেয়েদের মুখে নিতে হয় না।
- এসব আদিম থিওরি ওফ রিলেটিভিটি আমার সাথে চলবে না কিন্তু। তোমার মুখে নিজের নামটা আমার কাছে অমৃতের মতো। মনের মাঝে শীতল ঢেউ খেলে যায়। কতোটা ব্যাকুল ছিলাম আমি জানো, কবে অর্জুনদায়ের বদলে অর্জুন বলে ডাকবে আমায়। এখন এসব বললে হবে না। আচ্ছা শোনো
- বলো
- আজ তোমায় একেবারে বউ বউ লাগছিলো। পারলে আজ ই সাত পাক ঘুরে নিতাম। কিন্তু ওই পন্ডিত কোনো লগ্ন পেলোই না। কি রাগ হচ্ছিলো আমার জানো, শুধু পিছাচ্ছিলো, আর পিছাচ্ছিলো। আমার বাড়ি হলে
- কি করতে?
- মেরে দিতাম, দক্ষিণাও দিতুম না।
- ইশশশ
- সত্যি, রাত বারোটায় লগ্ন কেউ ফেলে
- আমাদের পঞ্জিকা না মিললে তার কি দোষ
- সব ওই ব্যাটার ই দোষ। আমার জন্য তুমি একেবারে পরোটার উপরের মাখন। বললেই হলো পঞ্জিকা মিলবে না।
অর্জুনের কথায় অন্না আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলো। তখন অর্জুন বুকে হাত রেখে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
- উফফফফ, এই হাসি, এই হাসি পাগল করে ছাড়বে।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লে অন্না বলে,
- হয়েছে হয়েছে। এই শুনো, এখন রাখছি। মা এসেছে বোধ হয়।
- আচ্ছা, গুড নাইট।
অর্জুনের ফোনটা রেখে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে কৃষ্ণা ভেতরে ঢুকে। কৃষ্ণার মুখে একপ্রকার ভয়৷ অন্না কিছু জিজ্ঞেস করতেই, একটা প্রেগ্ন্যাসি কিট এগিয়ে দেয় সে। কিটের দিকে নজর দিতেই..…....
.
.
.
চলবে.............................