ঝরা ফুলের কান্না - পর্ব ০১ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


হসপিটালে এসেছি কিছুক্ষণ হয়েছে। এরইমধ্যে জানতে পারলাম আমার স্বামী হিমেল আমার একটা কিডনি বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা কী জানেন? আমার এই একটাই কিডনি আছে। দু'টোর মধ্যে একটা একবছর আগে বিক্রি করেছে এখন দ্বিতীয়টা। কথাটা শুনে আমি হতভম্ব। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি ডাক্তার নাহিদের কথা শুনে। টলমল লাল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি অদ্ভুত ভাবে বললেন," দেখুন মিসেস মানুষের অভার হতে পারে,স্বামীর প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকতেই পারে। তাই বলে আপনি কিডনি বিক্রি করে দিবেন?"
সম্পূর্ণা টলমল চোখে হেঁচকে উঠতেই নাহিদ নার্সকে বলে এক গ্লাস পানি দিলো। সম্পূর্ণা ঢকঢক করে একটানে সব পানি খেয়ে গ্লাসটা নাহিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে," আমি জানতাম না আমার আগের একটা কিডনি নেই। আর আজও জানি না আমি এইখানে এসেছি কিডনি বিক্রি করার জন্য। কিন্তু স্যার আমার জীবনে যাকে বিশ্বাস করে যার হাত ধরে সব প্রাচুর্য ছেড়ে চলে এলাম সে এমনটা কীভাবে করতে পারে?"
নাহিদ বলল," আপনার হাতে বেশি সময় নেই। যে কোনো সময় আপনার স্বামী চলে আসতে পারে। আপনি যদি চান আমি তাহলে এইখান থেকে আপনাকে পালাতে সাহায্য করতে পারি। 
সম্পূর্ণা নাহিদের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে, " আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই। আর যাবই বা কী করে? ভাড়াটাও আমার কাছে নেই।"
ডাক্তার নাহিদের মনে হয়তো সে সময় দয়া হয়েছিল একটা অসহায় মেয়ের জীবন বাঁচাতে। পকেট থেকে একহাজার টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে যান এইখান থেকে। আশা করছি আপনার ভাড়াটা মিটে যাবে। 
সম্পূর্ণা হাত দুটো জোড় করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে হাটতে লাগলো। কোথায় যাবে সে? মা বাবার কাছে? যাদের সমাজের চোখে চুনকালি লেপ্টে এসেছিল। তারা কী তাকে এত সহজে মেনে নিবে? তবুও হাঁটছে সে। চট্টগ্রামের কদমতলী বাস স্টেশনে এসে দুইশো টাকার একটা টিকেট কেটে নোয়াখালী আসার জন্য একটা বাসে উঠে পড়লো। দেড় বছর আগেই ঠিক এইভাবে পালিয়ে এসেছিল এই শহরের বুকে। তবে এই শহর খারাপ নয়। খারাপ নিজের কাছের মানুষটাই। তাই একবুক কষ্ট, ভয় আর ভালোবাসার প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যে। 

হিমেল এসে পুরো হসপিটাল তন্নতন্ন করে খুঁজে না পেয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। সম্পুর্ণা এই শহরটা চেনে না বললেই চলে। তাই হিমেল বেশিদূর পর্যন্ত খুঁজতে পারছে না। হঠাৎ মাথায় এলো কদমতলী বাস স্টেশনে যায়নি তো? ভাবতেই যেন মনটা আছাড় খেল। বন্ধুর একটা মোটরবাইক নিয়ে কদমতলী গিয়ে পৌঁছালো। সেখানে গিয়ে জানতে পারলো নোয়াখালীর বাস বিশ মিনিট আগেই ছাড়া হয়ে গেছে।
হিমেল সম্পূর্ণার খোঁজ আর নিলো না। নিজের একরুমের বাসায় এসে মেজেতে বসে পড়লো। ভাবতেই লাগলো ঘন্টা কয়েক আগের কথা। সম্পূর্নাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেই সকালে বের হয়েছিল। সুন্দর করে সেজেছিল সে। একটা সুতি শাড়ি গোল্ডপ্লেটের একজোড়া চুড়ি।কান-গলা খালি তবে একটা খোপা করেছিল সে। চোখে কাজল পুরো যেন বাঙালি বউ। বেশ লাগছিল তাকে। হিমেল ভাবতে ভাবতেই যেন রাত পুরিয়ে যাচ্ছে। শুধু অপেক্ষা সম্পূর্ণা তার কাছেই ফিরে আসবে। ভালোবাসার টানে ফিরে আসবে। কারণ ও ছাড়া সম্পূর্ণার এই শহরে যাওয়ার জায়গা নেই।তবে অনুশোচনার নেই চোখেমুখে বিন্দুমাত্রও।

ভোরে এসে নোয়াখালী চৌমুহনীতে বাস থেমেছে। সবাই একে একে নামলেও সম্পূর্ণা থমথমে হয়ে বসে আছে নিচের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ একটা ছেলে এসে, " আপা আপনে নামবেন না? নোয়াখালী এসে গেছে কিন্তু।"
সম্পূর্ণা কথাটা শুনে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তেআস্তে বাস থেকে নামলো। দেড় বছর পর নিজের মাতৃভূমিতে পা রাখেছে। যাবার সময় ভাবেইনি এভাবে তাকে আবার ফিরে আসতে হবে। 
বাস থেকে নেমে সিএনজি স্টেশনে এসে একটা সিএনজি ভাড়া করলো নিজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। একটা বার গিয়ে দেখাই যাক না। মা হয়তো ফেলে দিবেন না। দরকার হলে মা'য়ের পায়ের উপর পড়ে থাকবো। আমাকে যে ক্ষমা নিতেই হবে মা'য়ের কাছ থেকে। 

ফজরের নামাজের আজান দিচ্ছে চারদিকে। আতিকা বেগম সদর দরজা খুলতেই কানে ভেসে আসছে মসজিদের মুয়াজ্জিন বলছে, " আস সালাতু খাইরুম মিনান্নাওম। 
আস সালাতু খাইরুম মিনান্নাওম।(ঘুম হতে নামাজ উত্তম)
তিনি হাই তোলতেই সামনের উঠানের দিকে তাকিয়ে দেখেন নিজের মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরে বিদ্যুৎ এর লাল বাতির আলোতে মেয়েকে লালবতি লাগছে।
আতিকা বেগম হতভম্ব হয়ে পা বাড়িয়ে এক পা এক পা করে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসলেন। সম্পূর্ণা নিজেকে সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মা'কে জড়িয়ে ধরেছে।আতিকা বেগম মুক্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন বিস্ময় নিয়ে। কোথায় থেকে এসেছে মেয়েটা? এতদিন খুঁজেও যাকে পায়নি আজ সে নিজে এসেছে! মেয়েটাকে দেখে মনেই হয়নি মেয়েটা সুখে আছে। অনেক কষ্টনিয়েই কী এসেছে আমার মেয়েটা? ভাবতে ভাবতেই একটা হাতে নিজেও জড়িয়ে ধরলেন। সম্পূর্ণার এমন হাউমাউ কান্না শোনে বাড়ির আশেপাশের ঘরগুলো থেকেও লোক বেরিয়ে এসেছে।

আতিকা বেগম মেয়েকে ঘরে তুললেন। সামনের ঘরটায় বসিয়ে," সবাই কই গো তোমরা দেখে যাও কে এসেছে। আমার লক্ষ্মী আমার ঘরে আবার আসছে। সম্পূর্নার ভাইয়ের বউ আর বাবা উঠে এসেছে। বাবা মেয়েকে দেখে অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। তিন ছেলের পরে মেয়েটা দুনিয়াতে এসেছিল। কত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বলছি, নফল রোজা রাখার নিয়ত করছি, এতিমখানায় একটা গরু দিয়েছি। তারপর আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন। ছেলেদের দশ বছর পর মেয়েটা আসছে। যেদিন ওর জন্ম হয়েছিল সেদিন পুরো ঘরটা যেন আলোতে ঝলমল করছে। ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম সম্পূর্ণা। ও আসার আগে আমার ঘর অসম্পূর্ণ ছিল। তাই নামটা রাখাতে ওর দাদীও অমত করলো না। তবে মা আবার আলাদা করে নাম রেখেছে হাসিবা জান্নাত সম্পূর্ণা।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সাইফুল ইসলাম মেয়ের পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সম্পূর্ণা ঝাপটে ধরে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। 
আস্তেআস্তে বাহিরে লোকজন ভিড় জমাতে শুরু করেছে। লোকের নানান কথায় কান না দিয়ে আতিকা বেগম লন্ডনে ফোন দিয়েছেন ছেলেদের কাছে। সম্পূর্ণার বড় দুই ভাই লন্ডনে থাকে আর ছোট ভাই দুবাইতে থাকে। বড় ভাই বিয়ে করেছে চার বছর। তার ঘরে একটা মেয়ে আছে। 
সম্পূর্ণা ফিরে এসেছে শোনে ভাইয়েরা খুশি হলেও মনের কষ্টে বেশি কিছু বলতে পারলেন না। হাসি মুখে ফোনটা রেখে দিলো তারা।

সকাল নয়টা। হিমেলের মায়ের কানে পৌঁছে গেল সম্পূর্ণা এসেছে। নিজের ছেলেকে দেখার আশায় পুকুর পাড়ের ছোট্র দোচালা ঘর থেকে দৌড়ে সম্পূর্ণার বাড়িতে এলেন। সদর দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে, " আদীলের বউ ও আদীলের বউ। আমার কথাটা একটু শুনে যাও মা।"
তাবিয়া রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে," আপনি কেন এসেছেন চাচী। বাবা এসে দেখলে বকাঝকা করবেন। আপনি এইখান থেকে চলে যান।"
-" বকব মানে? ভালো কথার ভাত নাই? কত সুন্দর করে তোমারে ডাকলাম আর তুমি আইসা আমারে জ্ঞান দাও। এখন এইটা বলো আমার ছেলে কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রাখছ তারে?"
তাবিয়া নরম গলায় বলল," আপনার ছেলে তো আসেনি চাচী। ভোর বেলায় শুধু সম্পূর্ণা একাই এসেছিল।"
-" আমার ছেলেকে খুন করে আসছে না-কি? চু*মা**নি যে আমার পোলা নিয়া গেছে এখন আইসা কই লুকাইছে। বাহির কর। এহনি তারে রানের উপর পা দিয়া টাইনা ছেরবো। বাহির কর তোর মা* ননদরে।"
-" চাচী আপনে এইখান থেকে যান। আপনাকে বলছি না আমাদের সাথে এইভাবে কথা বলবেন না?"
আতিকা বেগম চিল্লাপাল্লা শুনে বেরিয়ে এসে, " তরো এইখানে কে আসতে বলছে? আর এসে এইভাবে মুখ খারাপ করছিস কেন?"
-" মুখ খারাপের কী দেখছোস। তোর মাইয়া বাহির করে নিয়ে আয়। তারপর দেখ আমি কী করি।"
-" তুই কী করবি না করবি সেটা পরে দেখা যাবে। আমার মেয়েটা এখন ঘুমাচ্ছে। জানি না তোর ছেলে আমার মেয়েটার সাথে কী করছে যার কারনে এক কাপড়ে আমার মেয়ে চট্টগ্রাম থেকে এইখানে আসে রাতে আঁধারে। সম্পূর্ণা ঘুম থেকে উঠলেই সব শুনে তারপর ব্যবস্থা নিব।"
-" কী ব্যবস্থা নিবি তুই? তোর মাইয়া রাতের আঁধারেই তো আসবে। বেশ্যার শান্তি আছে? বেশ্যাগিরি করেই তো আমার পোলারে আমার কাছ থেকে ভাগাই নিছে। "
আতিকা বেগম তাবিয়াকে ভিতরে যেতে বলে," আমার মেয়ে বেশ্যা না তুই বেশ্যা সেটা পরেই টের পাবি।" কথাটা বলে তিনিও ঘরের ভিতর গিয়ে দরজাটা আটকিয়ে দিলেন। হিমেলের মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাড়ির আশেপাশের লোকজন আবার বেরিয়ে এসে তামশা দেখছে। 
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন