জল ফড়িঙের খোঁজে - পর্ব ১৬ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


সৌহার্দ্যর কথা শুনে উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। কেউ ভাবতেও পারেনি সৌহার্দ্য এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে এরকম একটা কথা বলে ফেলবে। সৌহার্দ্যর কথা শুনে নুসরাত অবাক হয়ে গেল। অবাক কন্ঠে বলল,

" তুই এসব কী বলছিস ভাই?"

" ঠিকই বলছি। আর আমি জানি বিহান এমন কিছুই করবে না।"

বলে ওপরে যেতে নিলেই শফিক রায়হান বলে উঠলেন,

" দাঁড়াও! কথা আছে তোমার সাথে।"

সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে গেল। তারপর সোফায় গিয়ে বসল। কারণ ও ওর বাবাকে যথেষ্ট সম্মান করে। বিহানের ব্যপারটা সাইডে রাখলে শফিক রায়হানের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক সৌহার্দ্যর। সৌহার্দ্য বসতেই শফিক রায়হান বললেন,

" তোমাকে আগেও বলেছিলাম আমার অফিসে বসতে কিন্তু তুমি বসোনি। কী কর সেটাও জানিনা। আপাতত কী খুব ব্যস্ত?"

সৌহার্দ্য ব্যপারটা বুঝতে না পেরে বলল,

" নাহ তেমন না। কেন?"

" আমাকে কয়েক মাসের জন্যে ব্যাংকক যেতে হবে। কদিন পর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কালকেই যেতে হচ্ছে। তাই তোমাকে ততদিন অফিসটা সামলাতে হবে। পারবেতো?"

সৌহার্দ্য চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। বাবা যদি চেয়ারে না বসে তাহলেতো ওকেই বসতে হবে কিছু করার নেই। ইচ্ছে না থাকলেও মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,

" হুম পারব। তুমি নিশ্চিন্তে যেতে পারো।"

শফিক রায়হান বললে,

" ভালো করে ভেবে বল। সবটা সামলাতে পারবে তো?"

" চিন্তা করোনা আমি সবটা সামলে নেব। তুমি শুধু রাতে আমাকে একবার সবটা বুঝিয়ে দিও তাহলেই হবে।"

" সন্ধ্যায় রুমে চলে এসো।"

বলে শফিক রায়হান রুমে চলে গেলেন। নিজের বাবার যাওয়ার দিকে কিছুদিন তাকিয়ে থেকে নুসরাত সৌহার্দ্যকে বলল,

" একটা কথা কিন্তু বাবা ঠিকই বলেছে ভাই। তুই অফিসে কেন বসিস না? বাবার কাছে টাকাও চাস না। তাহলে টাকাগুলো কোথায় পাস?"

মিসেস নাহারও চিন্তিত কন্ঠে বলল,

" সত্যিই তো, করিস টা কী তুই?"

সৌহার্দ্য কিছু না বলে হাসল। নুসরাত বা মিসেস নাহারও কিছুই বুঝলনা। এমন কী বলল সৌহার্দ্য যার কারণে ওরা হাসল? কিন্তু সৌহার্দ্যর কাছে কিছু জানতেও চাইল না কারণ ওনারা জানেন সৌহার্দ্য কিছু বলবে না। তাই আপাতত আর কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা।

_____________

রাতে ডিনার করতে রিখিয়া কিছু একটা ভেবে চলেছে। তুর্বী প্রথমে খেয়াল না করলেও এখান খেয়াল করছে। তাই খাবার চিবুতে চিবুতে বলল,

" কীরে? কী ভাবছিস?''

রিখিয়া আনমনেই খেতে খেতে বলল,

" বিহানের কথা।"

তুর্বী পুরো বিষম খেয়ে গেল। কোনরকমে কাশি থামিয়ে বলল,

" বাপড়ে! খেতে বসেও ওর কথাই ভাবছিস? কেস এতদূর এগিয়ে গেছে?"

রিখিয়া ভ্রু কুচকে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

" সবসময় উল্টোপাল্টা কথা। আসলে কফি খেতে যাব কী-না ভাবছিলাম।"

" চলে যা না। কফিই তো খাবি সমস্যা কোথায়?"

রিখিয়া বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,

" বলছ?"

তুর্বী মুখে খাবার পুরতে পুরতে বলল,

" হ্যাঁ বলছিতো চলে যা।"

তুর্বীর কথায় রিখিয়াও এবার একটু ভরসা পেল। ঠিক করল যে খেয়েই বিহানকে একটা ফোন করবে। তুর্বী বিরক্তি নিয়ে খাচ্ছে, সেটা দেখে রিখিয়া বলল,

" তুমি আবার কী নিয়ে বিরক্ত?"

তুর্বী বিরক্তি নিয়ে বলল,

" আর বলিস না। কদিন পর থেকে অফিসে বসের ছেলে বসবে। এমনিতেই এত প্যারায় আছি। এখন আবার এই নতুন বস কেমন হবে কে জানে?"

" এত চিন্তা করোনা তো। এমনও তো হতে পারে ওনার ছেলে খুব ফ্রেন্ডলি হল। আর তোমারও কাজে সুবিধা হল।"

তুর্বী হতাশার একটা শ্বাস ফেলে বলল,

" আমার কপাল কোনদিন এত ভালো হয় না রে।"

রিখিয়া হেসে দিয়ে বলল,

" তোমার ভাগ্য কী তুমি দেখে বসে আছ?"

" আরে বুঝি, বুঝি।"

" কচু বোঝ।"

_____________

বিহান ব্যালকনির ফ্লোরে বসে বিয়ারের বোতলে চুমুক দিচ্ছে আর খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য থাকলে ভালোই হত। কিন্তু ওর মামু পছন্দ করে না তাই ও কখনও সৌহার্দ্যকে নিজে থেকে ডাকেনা ওর কাছে, সৌহার্দ্য নিজে থেকেই আসে। কিন্তু এই সময়গুলো বিহানের একা লাগে, খুব বেশি একা লাগে। বারবার নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে ওর সাথেই কেন হল এরকম? ওরও তো একটা সুন্দর পরিবার আছে, সেই পরিবারে সবার সাথে হেসেখেলে কত সুখী ছিল ও, কত আনন্দের ছিল দিনগুলো। কিন্তু এখন ও নিঃস্ব, একেবারেই নিঃস্ব। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবারও বিয়ারের বোতলে লম্বা করে একটা চুমুক দিল। এরমধ্যেই বিহানের ফোন বেজে উঠল। ফোনের আওয়াজে চমকে উঠল বিহান। এইসময়ে কে ওকে ফোন করবে? সৌহার্দ্য? ও স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল আননোন নম্বর। ও নম্বরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিসিভ করে বলল,

" কে?"

" আমি রিখিয়া।"

রিখিয়া নামটা শুনে অবাক হল বিহান। এরপরেই মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। ও মুখে হাসি রেখেই বলল,

" যাক, অবশেষে ফোন এল তাহলে? কেমন আছো?"

রিখিয়ার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

" জি আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি ভালো আছেন?"

" এতক্ষণ ছিলাম না। এখন আছি। তো কী ভাবলে? আসবে?"

রিখিয়া নিজের সব সংকোচ কাটিয়ে উঠে বলল,

" হ্যাঁ আসব। কবে আর কোথায় আসতে হবে?"

বিহান নিঃশব্দে হাসল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

" কালকেই করছি। আমি এড্রেস তোমাকে পাঠিয়ে টেক্সট করে দেব? নাকি ফ্লাটের সামনে থেকে পিক করব?-

রিখিয়া দ্রুত বলল,

" ন্ না। আমায় এড্রেস দিয়ে দিলেঈ আমি পৌছে যেতে পারব সমস্যা নেই।"

বিহান ভ্রু কুচকে বলল,

" আর ইউ শিউর?"

" ইয়া।"

" আচ্ছা রাখছি তাহলে?"

" হুম বাই।"

ফোনটা রেখে বিহান রিখিয়ার ফোনে এড্রেস পাঠিয়ে দিয়ে আবারও বাঁকা হাসি দিল। ও জানতো রিখিয়া ফোন করবেই। আর হলোও সেটাই। দেয়ালে হেলান দিয়ে বোতলে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল।

এদিকে রিখিয়ার ফোনটা রেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। এর আগে কোন ছেলের সাথে এভাবে একা দেখা করতে বা সময় কাটাতে যায় নি। কিন্তু কাল যাবে ভাবলেই কেমন যেন লাগছে ওর। আচ্ছা এমন কেন লাগছে? শুধু তো কফি খেতেই যাবে এত টেনশন আর উত্তেজনার কী আছে? এটা কেমন অস্বস্তি?

হঠাৎ করেই তুর্বীর চিৎকারে চমকে উঠল রিখিয়া। বুকে থু থু দিয়ে হাফানো কন্ঠে বলল,

" তুর! এভাবে চেঁচায় কেউ?"

তুর্বী খুশিতে রিখিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

" রিখু! আ'ম সো হ্যাপি।"

রিখিয়া তুর্বীকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

" কী হয়েছে সেটা বলবে?"

তুর্বী উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

" আমি আমার টোটাল ডিজাইন প্লান বলে বসকে একটা মেইল পাঠিয়েছিলাম মনে আছে?"

" হ্যাঁ তারপর?"

" সেটা এপ্রুভ হয়েছে এন্ড কাল আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন উনি।"

রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,

" কিন্তু তুমিতো বলেছিলে তোমার বস তোমাকে আরও একটু সময় নিয়ে আরও অভিজ্ঞ হতে বলেছে?"

" হ্যাঁ কিন্তু হয়তো ওনার এই মেইলটা পরে ভালো লেখেছে?"

" হুম। যাক, যাওয়ার আগে একটা ভালো কাজ করে দিয়ে যাবে তাহলে।"

তুর্বী খুশিতে ছটফট করে যাচ্ছে। রিখিয়া গালে হাত দিয়ে বলল,

" শান্ত হও। আর নিজের প্লানটা রি-চেক করে নাও। ভালো হবে।"

তুর্বী একটু জোরে চেঁচিয়ে বলল,

" কারেক্ট আছে!" 

বলে দৌড়ে গিয়ে ল্যাপটপ আনতে গেল। রিখিয়া তুর্বীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।

_____________

তুর্বী আর রিখিয়া দুজনেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। তুর্বী তো অফিস যাচ্ছে তাই সাজবেনা। ও নিজে রেডি হয়ে রিখিয়াকে রেডি হতে হেল্প করল। রিখিয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,

" আরে এত সাজানোর কী ছিল?"

" চুপ কর তো। নে চল! লেট হয়ে যাবে।"

বলে তুর্বী রিখিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। রিখিয়া ওর গন্তব্যে পৌছে গেল। তুর্বী নিজের অফিসে ঢুকে একপ্রকার দৌড়ে যাচ্ছে বসে কেবিনে প্রচন্ড এক্সাইটেড ও। যেতে যেতে অনেকের সাথে ধাক্কাও লাগে। বসের কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে বলে,

" মে আই কাম ইন স্যার?"

" কাম ইন।"

ভেতরে থেকে আওয়াজ আসতেই তুর্বী দ্রুতপদে ভেতরে ঢুকে এগুতে গিয়ে কার্পেটে আটকে পরে গেল। ব্যাথা পেয়ে চোখ মুখ খিচে বসে আছে ও। নিজেই নিজেকে মনে মনে বকাও দিল। হঠাৎ কেউ ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। লোকটার দিকে তাকিয়ে তুর্বী অবাক হয়ে গেল।
.
.
.
চলবে........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন