কৃষ্ণাবতী - পর্ব ৩২ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


দেবব্রত খানিকটা চিৎকার করে উঠে। তার রাগ হচ্ছে কৃষ্ণার প্রতি। এতোবছরে ইচ্ছে আজ পূরণ হচ্ছে তার মনটা এতোক্ষণ খুশিতে আটখানা ছিলো। কিন্তু কৃষ্ণা আবারো জিদ করছে। দেবব্রতের ধমকে কেঁপে উঠে কৃষ্ণা। চোখগুলো আপনাআপনি ভিজে যায়। কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখে বলে,
- আমি যাব না মাষ্টারমশাই, আসলে আমি যেতে পারবো না।
- কেনো?
- কারণ আমি প্রেগন্যান্ট। 

কথাটা শোনা মাত্র দেবব্রত যেনো আকাশ থেকে পড়ে। নিমিষেই চোখজোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করলো। মাথার ডানপাশের শিরাটা দপদপ করে লাফাচ্ছে। রাগটা মাথা জেকে বলেছে। রাগটা কার উপরে হচ্ছে এবং কেনোই বা হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না। সে শুধু এটুকু জানে তার রাগ হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
- আমার এখন ফাজলামো করার মতো মন মানসিকতা নেই কৃষ্ণা। এই মজাটা অন্য সময় করলেও আমি মেনে নিতাম।
-............. 
- কি হলো চুপ করে আছিস কেনো? প্রেগন্যান্ট মানে টা কি? 

দেবব্রতের রাগ সম্পর্কে কৃষ্ণার ধারণা তো ছিলো কিন্তু কখনো সেটার মুখোমুখি হবার মতো পরিস্থিতি হয় নি। কৃষ্ণার হাত অজান্তেই তার পেটে চলে গেলো। তার শরীর কাঁপছে। গলার কাছে মনে হয় কেউ পাথর রেখে দিয়েছে। ঠিকমতো মনের ভাবগুলো প্রকাশ করে উঠতে পারছে না। মানুষের যতগুলো অনুভূতি রয়েছে সব যেন একসাথে ঘেটে ঘ হয়ে আছে কৃষ্ণার ভেতরে৷ চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত বইছে। দেবব্রতের অগ্নিদৃষ্টি তাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলছে। মাথায় তীব্রভাবে ব্যাথা শুরু হলো, অস্পষ্ট স্বরে বললো,
- আ...আমি মজা করছি না। আমার মাঝে একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। আমার ভালোবাসা যার উৎস। 

এবার যেনো নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না দেবব্রত। তেড়ে এসে কৃষ্ণার বাহুজোড়া শক্ত করে ধরলো সে। কৃষ্ণার হাড় যেনো ভেঙ্গে যাবে, এতোটা জোড়ে সে তার বাহু ধরেছে। বজ্র কন্ঠে বললো,
- এতো জেদ তোর? এতো জেদ? শুধু আমার কথা না শোনার জন্য এতো বড় স্টেপ নিয়ে নিলি? বারবার মানা করেছি। আমাদের অজস্র সময় রয়েছে। তবুও তুই এই কাজটা করলি? আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই তোর কাছে। আমি বারবার বলেছি আমি বাচ্চা চাই না, চাই না বাচ্চা। তবুও তোর সেই জেদ। আজ যখন তোর জীবনে এতো বড় অপরচুনিটি আসছে জাস্ট এই বাচ্চাটার জন্য সব নষ্ট করার ফন্দি করেছিস। আমার এতো কষ্টের কোনো দাম নেই তোর কাছে?
- ক্যারিয়ারটা দুবছর পরেও আমি গড়তে পারবো মাষ্টারমশাই। ক্যারিয়ার গড়ার লোভে আমাদের সংসারটা 
- গো টু হেল উইথ ইউর সংসার। তুই তাও এমন চিন্তাধারার মহিলা ছিলি না, যাদের জীবন শুধু বিয়ে, স্বামী সংসারে চলে যাবে। আমি ভেবেছিলাম তোর এম্বিশনগুলো আকাশচুম্বী। আমি সত্যি তোকে চিনতে পারছি না, তুই কি সেই মেয়েটা যাকে আমি ভালোবাসি?

কৃষ্ণা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বুকের মাঝে ভোতা ছুরি দিয়ে কেউ যেনো ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে। দেবব্রত এবার কৃষ্ণা বাহু ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রাগ কমাতে লাগতো। তারপর বরফ ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
- এবোর্শন করতে হবে। 
- কিহ?? মাথা ঠিক আছে তোমার। 
- আমার মাথা ঠিক ই আছে। এখন বাচ্চা নেওয়া মানে তোর ক্যারিয়ারটাকে গলা টিপে মারা।
- এর চেয়ে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলো তুমি?

কথাটা শুনতেই দেবব্রত থমকে গেলো। অবাক চোখে কৃষ্ণার দিকে তাকালে অনুনয়ের স্বরে বলে সে,
- আমি তৃতীয়বার আমার বাচ্চাকে হারাতে পারবো না। আমি সত্যি মরে যাবো মাষ্টারমশাই। আমি মরে যাবো। এর চেয়ে তুমি আমায় মেরে ফেলো। 
- যে বাচ্চা এখনো ধরাতেই আসে নি, তার জন্য এতোবড় কথাটা বলতেও তোর মুখে বাধলো না। এতোটা পাষন্ড ভাবিস আমাকে? এতো? তোর কি মনে গত দুবার শুধু তুই ই কষ্ট পেয়েছিস? আমি ও এই বাচ্চাটার বাবা, আমার ও তোর মতোই কষ্ট হয় কৃষ্ণা। কিন্তু আমি নিজের কষ্টগুলো আমার মাঝে পাথর চাঁপা দিয়ে রেখেছি যাতে তোর জীবনটা সুন্দর হয়। আফসোস তুই আমাকে কখনোই বুঝবি না
- তুমি কি একটাবার আমাকে বুঝার চেষ্টা করেছো মাষ্টারমশাই? 

নির্বিকারভাবেই কথাটা বলে উঠে কৃষ্ণা। কৃষ্ণার কথাটা যেনো দেবব্রতের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। চোখের কোনে চিকচিক করছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
- আমরা কাল যাচ্ছি হাসপাতালে 

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দেবব্রত। কৃষ্ণা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে, মাথাটা ঘুরোচ্ছে, শরীর কাঁপছে। নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে পায়ের মাটিটা সরে যাচ্ছে, সে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে______

!!২৬!!

থমথমে পরিবেশ ভট্টাচার্য মঞ্জিলে, দেবব্রত বাসায় নেই। কৃষ্ণার জ্ঞান নেই, মুখটা শুকিয়ে গেছে। আর একটুর জন্য বাচ্চাটা বেঁচে গেছে। একটু আগেই ডাক্তারের মুখে সুখবরের আশ্বাস পেয়ে গদগদ হয়ে উঠেছিলেন অবন্তীকা দেবী এবং রীতা দেবী। কিন্তু যেই ডাক্তার অনিন্দ্য বলল,
- বৌদি, বউ মার অবস্থা ভালো না। প্রচুর মানসিক চাপে রয়েছে। এই রকম চলতে থাকলে বাচ্চাটি টিকবে না। আর বউমার শরীরের অবস্থাটাও খুব ভালো না। এই নয়মাস সে কিভাবে পার করবে এটা নিয়েও আমার প্রশ্ন জন্মাচ্ছে 
- কেনো অনিন্দ্য দা?
- বৌমা অনেক দূর্বল। অনেক যত্নের প্রয়োজন। একে ফিনফিনে শরীর। উপরে মানসিক চাপ। কিছু পরীক্ষা করতে হবে, তারপর আমি শিওর হয়ে বলতে পারব।

ডা. অনিন্দ্য নারায়ন বাবুর পুরোনো বন্ধু। একরকম পারিবারিক ডাক্তার ই বলা যায়। তার কথাটা শুনে অবন্তীকা দেবীর মনটা বসে গেলো। ঠাম্মা হবার আনন্দটা একেবারেই ফিকে হয়ে গেলো কৃষ্ণার অবস্থা দেখে। কৃষ্ণার মুখ একেবারেই শুকিয়ে গেছে। চোখের পানিগুলো শুকিয়ে রেখা হয়ে গেছে। বয়সের অভিজ্ঞতাই হোক বা নিজের ছেলের নাড়ী সম্পর্কে অবগত হবার কারণে আন্দাজ করতে পারলেন তাদের মাঝে কোনো সমস্যা উৎপন্ন হয়েছে। মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তিনি। মুখোমুখি হতেই হবে দেবব্রতের। এবার একটা শেষ দেখেই ক্ষান্ত হবেন তিনি। 

রাত ৯টা,
ক্লান্ত শরীরটা চলতে চাচ্ছে না দেবব্রতের। ওভার ব্রীজের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সে। কৃষ্ণার শেষ কথাটা মাথায় ঘুরছে। কৃষ্ণা রীতিমতো তাকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে কি সত্যি দোষী! চোখ বুঝতেই পুরোনো স্মৃতিগুলো ক্যামেলার রিলের মতো তার সামনে ভাসছে। দেড় বছর পূর্বে যখন কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট হয়েছিলো, তখন ডা. নিশাত তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলো,
- কথাগুলো বলার হয়তো এখন সঠিক সময় নয়। কিন্তু আমি মিথ্যে আশা দিতে চাই না। কৃষ্ণা মা হতে পারবে না এটা ঠিক সঠিক নয়, তবে বাচ্চা নেওয়ার ক্যাপাসিটি ওর বডিতে নেই। সি ইজ নট দ্যাট মাচ ক্যাপাবল অফ বিঙ্গ প্রেগন্যান্ট। নেক্সট টাইম মেক শিওর, যে খুব তাড়াহুড়ো যেনো না হয়৷ 

কথাটা এখনো দেবব্রতের মাথায় খোদাই হয়ে আছে। একারণেই সে এবোর্শন করাতে চেয়েছিলো। ভগবান সেটার সুযোগ দেন নি। বরং কৃষ্ণার মিসক্যারেজ হয়েগিয়েছিলো। দেবব্রত কৃষ্ণাকে হারাতে চায় না। সেকারণেই সে এই পড়ালেখার জেদ দেখায়। অন্তত পক্ষে কৃষ্ণা যদি তার জীবনে ব্যস্ত হয়ে উঠে তাহলে এই বাচ্চা নেবার জিদ করবে না। দেবব্রত বিশ্বাস করে সবকিছুরই একটা সঠিক সময় আছে, অনুরুপ বাচ্চার ও একটা সঠিক সময় আছে। কিন্তু কৃষ্ণাকে এটা বুঝাতে অপারগ সে। আজ না চাইতেও এতো খারাপ ব্যাবহার করলো কৃষ্ণার সাথে। বাচ্চা মেয়েটা কেনো বুঝে না দেবব্রতের জীবনে তার অস্তিত্ব সব কিছু থেকে অধিক। মেয়েটা তার রক্তে মিশে আছে। এই বাচ্চা নেবার জিদে যদি কৃষ্ণার কিছু হয়ে যায়! কিভাবে থাকবে সে! না কৃষ্ণা যদি তাকে ভুল ও বুঝে তবুও দেবব্রতকে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতেই হবে। থাকতেই হবে______

অর্জুনের সাথে ক্যাফেতে বসে রয়েছে অন্না। তার মনটা ভালো নেই। কফিটা চামচ দিয়ে নাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্নাকে অমনোযোগী দেখে অর্জুন ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
- মনটা কোথায় ফেলে এসেছো, আমার কিন্তু এখন ঈর্ষা হবে। আফটার অল এতো হ্যান্ডসাম একটা মানুষ তোমার সামনে বসা।
- আচ্ছা বাচ্চা হারানোর কষ্ট কি শুধু মেয়েদের হয়? কোনো ছেলের কেনো সেই কষ্টটা হয় না

অন্নার কথা শুনে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় অর্জুন। অন্নার এই কথাটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। প্রশ্নটা সত্যি তার ভেতরটাকে ভাবিয়ে তুললো। সে কখনো বাচ্চা হারানোর কষ্ট অনুভব করে নি, তাই বলতে পারছে না। কিন্তু সত্যি কি ছেলেদের কোনো কষ্ট হয় না!!!

রুমে প্রবেশ করতেই দেবব্রতের চোখ যেনো ছানাবড়া হয়ে গেলো। অবন্তীকা দেবী বেশ স্নেহ করে কৃষ্ণাকে খাওয়িয়ে দিচ্ছেন। আর কৃষ্ণা বাধ্য বাচ্চার মতো শ্বাশুড়ি মায়ের হাতে খেয়ে যাচ্ছে। নিজের মাকে এই রুপে দেখে যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না দেবব্রত। রীতা দেবী সব কাজের মানুষকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। আরোও মিষ্টি অর্ডার করছেন। একটু মাথায় জোর দিতেই দুই আর দুই চার মিলালো দেবব্রত। নতুন সদস্য আসার খুশি পালন করছে তারা। অবন্তীকা দেবী দেবব্রতকে রুমে ঢুকতে দেখেও কিছুই বললেন না। তার মনোযোগ সম্পূর্ণ কৃষ্ণার উপর। হিনহিনে গলায় তখন দেবব্রত বললো,
- এসব আদিক্ষেতা কিসের চলছে?
-......... 
- কিছু জিজ্ঞেস করছি 
- তোমার কথার উত্তর দেওয়া আমি প্রয়োজন বোধ করছি না
- তোমার প্রয়োজন বোধ না করলেও আমার জানার অধিকার আছে, আর যে আসবেই না তার জন্য এতো আনন্দ করার কোনো মানেই হয় না। 
- দেবব্রত
- আমি যখন বলেছি এবোর্শন হবে তাহলে হবে

এবার অবন্তীকা দেবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো দেবব্রতের উপর। তারপর হিনহিনে কন্ঠে বললেন….... 
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন