রংধনু - অন্তিম পর্ব ৭৫ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


আরেকটাদিন পেরিয়ে যায়।কাল বিয়ে নিশাদ ইদ্রির।দুজনে সারারাত কথা বলে শুভরাত্রি জানিয়ে শুয়ে পড়ে।হঠাৎ মাঝরাতে নিশাদ দেখছিলো ইদ্রি আর ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।ইদ্রি বিয়ের সাজে সজ্জিত আর নিশাদ ওর শেরওয়ানি পরে।ইদ্রিকে ভীষন সুন্দর লাগছে।দুজনে এক অপরকে দেখে হাসছে।একটু আধটু কথা বলছে।ওদের হাতজোড়া একেঅপরের বাঁধনে বাঁধা।হঠাৎ পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে ইদ্রির ওপর দিয়ে চলে যায়।নিশাদের মুখে সারা গায়ে রক্ত ছিটিয়ে পড়ে। চিৎকার করে উঠে সজোরে।রাস্তায় বসে ইদ্রির রক্তাক্ত শরীরটা ধরে কাঁদতে শুরু করে শব্দ করে।হঠাৎ ঘুম থেকে ধপ করে উঠে বসে নিশাদ।খেয়াল করে পুরো শরীর ঘেমে গেছে।পাশ থেকে বিভানের ঘুম ভেঙ্গে যায়।নিশাদকে উঠে বসতে দেখে বিভান উঠে বসে।লাইট জ্বালিয়ে বিভান খাটে এসে বসে।তারপর বলল,
''নিশাদ ঠিক আছো?"
নিশাদ যেন চমকে উঠার মতো পাশ ফিরে তাকায়।বিভান ওর দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।নিশাদ ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
''তেমন কিছুনা।একটা ভয়নাক স্বপ্ন ছিলো।"
নিশাদের কাঁধে হাত রাখে বিভান।তারপর বলল,
''নতুন জীবনে পা রাখতে যাচ্ছো।একটু আধটু এমন হবেই চিন্তা করোনা।দাঁড়াও আসছি......"
বলে খাট থেকে নেমে যায় বিভান।রুম থেকে বেরিয়ে যায়।নিশাদ ভাবতে থাকে পুরো স্বপ্নটাকে।কি দেখছিলো ও?ইদ্রি ঠিক আছে তো?সব ঠিক ভাবে হবে তো?ভাবতেই নিশ্বাস আটকে আসে নিশাদের।এরইমাঝে বিভান একগ্লাস পানি নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।নিশাদের হাতে পানি দিয়ে বলল,
''খেয়ে নাও।"
নিশাদ পানিটা খেয়ে নেয়।বিভান বলল,
''জানি না কি দেখেছো।তবে কাল তোমার বিয়ে তো তোমার সাথে একটা মেমরি শেয়ার করি।জানোই তো আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম।তোমার বোনকে বিয়ে করার আগের দিন রাত একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। এমন স্বপ্ন ছিলো যেন ওকে হয়ত হারিয়ে ফেলবো।ও হয়ত আমার জীবন থেকে দূরে সরে যাবে।কিন্তু ঠিক পরদিন সকাল....."
মৃদু হাসে বিভান।বলতে লাগলো,
''তারপর তো জানোই।"
নিশাদ বলল,
''আন্টি আপনার বিয়ের কথায় খুব রেগেছিলো তাইনা?"
বিভান নিশাদের দিকে তাকায়।তারপর বলল,
''এখন ওসব ছাড়ো।তোমার জীবন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।অনেক দায়িত্ব আসবে।অনেক কিছু করতে হবে।আমি আর তোমার আপা জানি তুমি পারবে।তুমি ভীষন দায়িত্ববান একটা ছেলে।পুরো পরিবারের খেয়াল রেখেছো খুব যত্ন করে।আগামীতে ও পারবে ইনশাআল্লাহ।ইদ্রি মেয়েটাও ভীষন লক্ষী।বড় বৌ হয়ে আসবে।হয়ত মনের অনেক কথাই শেয়ার করতে চাইবেনা তবে হাত গুঁটিয়ে বসে থেকোনা। জানতে চাইবে না বললে বের করে নিবে।এই সংসারে আসতেছে তোমাকে ভালবেসে।বাবা নেই ওর।প্রত্যেকটা মেয়ে চায় তার হাসবেন্ড বাবার মতো ওর খেয়াল রাখুক যত্ন করুক।ইদ্রি তো ছোট।ওকে কখনো ওর পরিবারের অনুপস্থিতি বুঝতে দিওনা।অনুভব করাবে তুমি ওকে ভালবাসো,ও তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।বুঝলে?"
নিশাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বিভানকে জড়িয়ে বলতে লাগলো,
''ভাই আপনি খুব ভালো।একদম বড় ভাই আমাদের।প্লিজ যাবেননা।"
বিভান নিশাদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
''আসবো শীঘ্রই।শুনো নিশাদ।"
নিশাদ সামনে এসে বলল, 
''জি ভাই!!!"
''এতকিছুর ভিতরে ভুলে যেওনা মেয়েটা পড়াশুনা করছে।"
নিশাদ মৃদু হেসে বলল,
''কখনোনা ভাই।"
.....................এদিকে সেদিন হলুদের পরপরই সৈয়দা বানু মেয়ের সামনে এসে বসেন।ইদ্রি হলুদ লেহেঙ্গা পরে বসে আছে।কাঁচা ফুল ওর সৌন্দর্য কে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।একটুপরই রাঙ্গানো হবে ওর হাত মেহেদীর আলতো ছোঁয়ায়।সৈয়দা বানু এসে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
''একটা কাজ একেবারেই ভুলে গেছিলাম।"
ইদ্রি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মাকে দেখলো।বলল,
''কি মা?"
সৈয়দা বানু বললেন,
''নাক ফোড়ানো হয়নি তোর।আজ ফুড়িয়ে দেবো।"
ইদ্রি চোখ বড় করে তাকায়।তখনই তমা একটা মেয়েকে নিয়ে প্রবেশ করে রুমে।সৈয়দা বানু সরে বসেন।মেয়েটা এসে ইদ্রির সামনে বসে আর তমা পাশে বসলো।ইদ্রির নাকে মেয়েটা কি যেন লাগালো তুলা দিয়ে। মনে হলো নাকটা অবশ লাগছে।তমা কানে কানে বলল,
''ভয় পেওনা।নিশাদকে ভাবো কষ্ট হবেনা।"
ইদ্রি চোখজোড়া বুজে নেয়।নিশাদকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে।নিশাদ আর ও একটা বেড রুমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।নিশাদ ওর সাদাপাথরের নাক ফুলটার ওপর তাকিয়ে বলল,
''মায়াবতী লাগছে।"
মৃদু হাসে ইদ্রি।নিশাদ ওর দিকে এগিয়ে এসে নাকফুলটার ওপর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই ইদ্রি চিৎকার করে উঠে।অনুভব করলো নাকে ওর বিয়ের নাকফুল পরানো।চারপাশটা লাল হয়ে আছে।একটু ব্যাথা পেয়েছিলো তবে সেটা ভীষন আনন্দের।ইদ্রির চোখজোড়া ভরে আসে।তমা বলল,
''কেমন লাগছে?"
ইদ্রি ধীর কন্ঠে বলে,
''খুব ভালো।"
পরদিন সকাল হতেই শুরু হয়ে গেলো দৌড়াদৌড়ি। ইমতিয়াজ সকাল থেকেই ভীষন ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে।বাসা আর বাহিরে যাচ্ছে বারবার। ভূবন কাব্য ও চলে এসেছে সাথে তমাও।বাসায় ভীষন কাজ।ঘর দুদিনে কিছুটা সাজিয়ে নিয়েছে ওরা।ছোট মেয়েটার বিয়ে বলে কথা।নিচে বাবুর্চিরা রাঁধছে।পুরো বাড়ি ক্ষুধাবর্ধিত ঘ্রানে মৌমৌ করছে।ইদ্রিকে এক সুযোগে পার্লারে নিয়ে যায় তমা।বৌ সাজাতে হবে ওকে।ঘরের কাজ মোটামুটি হয়ে এসেছে তাই তেমন চিন্তা নেই।
..................এদিকে হৈ-হুল্লোড় নিশাদদের বাসায়।বোনেরা কোমড় বেঁধে কাজে লেগেছে।ঘর গুছানো রান্না বান্না।বিয়েটা অবশ্যই ইমতিয়াজদের বাসায় হবে তবুও বৌ আসবে সব গুছিয়ে ফিটফাট রাখতে হবে।পূর্না সকাল থেকে চিৎকার করছে।এত হৈ-হুল্লোড় দেখে ভয় পেয়ে গেলো বাচ্চাটা।বারবার গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরছে আবার কখনো আদনানের কোলে গিয়ে লুকাচ্ছে।বিয়েটা হবে দুপুরে।ঘর গুছানোর কাজ শেষ হতেই বেলা সাঁঝ লাবনী হুমায়রা প্রিয়াশা সাজতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো।রাত দুটো পর্যন্ত বেলা ওদের মেহেদী লাগিয়েছে।সেগুলোর রং ও খুব গাঢ় হয়ে ছড়িয়েছে।পূর্না সবাইকে রেডি হতে দেখে কাঁদতে শুরু করে ফ্লোরে বসে পা ছিটিয়ে।কাঁদার কারন জানতে চাইলে ও জানায় ও সাজতে চায়।সাঁঝ ভাগনীকে আদর করে কান্না থামিয়ে একটু সাজিয়ে দেয়।এদিকে কল্যান তীর্থ আর ফারহান নিশাদের কাছে এসেছে।ওরা ওকে রেডি করিয়ে দিয়েছে।
দেড়টায় বেরিয়ে আসে ওরা।ইমতিয়াজদের বাসায় যাবে এখন।সেখানে পৌছুতেই ইমতিয়াজ এসে নিশাদকে জড়িয়ে ধরে। ইমতিয়াজ বলছিলো,
''আজ এবাসার একমাত্র জামাই হিসেবে প্রবেশ করছিস। তোর শমন্দি আমি।এখন থেকে সম্মান দিবি।"
নিশাদ ওর পিঠে হাত দিয়ে চাপড়ে বলল,
''হুম দেখা যাবে।"
সৈয়দা বানু জুলেখা বেগম কে জড়িয়ে ধরেন।ইমতিয়াজ সাঁঝ আর সাইমনকে দেখে ও চোখ ফিরিয়ে নেয়।কারন ও চায়না বোনটার বিয়েতে ও সাঁঝের জন্য কষ্ট পাক।চায় বোনটার খুশিতে খুশি থাকতে।আজ অন্তত অশ্রুগুলো জমা হয়ে থাক চোখের কোলে।সবাই ড্রয়িংরুমে এসে বসে।কথা বার্তা হচ্ছে ওদের।ইদ্রি আর তমা এখনো আসেনি।বিভান তিনটা বেজে উনপঞ্চাশ মিনিট।বিভান হঠাৎ বলল,
''ইমতিয়াজ ইদ্রি কখন বেরিয়েছে?"
ইমতিয়াজ জানালো।বারোটায় গেছে ওরা।বিভান বলল,
''তোমার মনে হচ্ছেনা বেশ দেরি হচ্ছে।কাজী অনেকক্ষন যাবৎ অপেক্ষা করছে।"
কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো ইমতিয়াজ।ও বলল,
''আমি ওকে কল দিচ্ছি।"
বলেই উঠে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ।হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠে।রানু খালা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখেন তমা আর ইদ্রি দাঁড়িয়ে।ইদ্রি বৌয়ের সাজে সজ্জিত।ভীষন মায়াবী লাগছে ওকে।লেহেঙ্গাটা বেশ ফুলে আছে।রানু খালা হেসে বললেন,
''ইদ্রি মামুনিরে পুরাই পুতুল লাগতাছে।"
ইদ্রি হেসে ফেলে রানুখালার কথায়।ওকে নিয়ে যাওয়া হয় মায়ের রুমে।কাজী আগে নিশাদের বিয়ে পড়াবে তারপর ওর।এদিকে নিশাদ শুনেছে ইদ্রি এসেগেছে।ওর চোখজোড়া খুঁজে যাচ্ছে ইদ্রিকে।নিশাদের বিয়ে পড়ানো শেষে কাজী গেলো ইদ্রির বিয়ে পড়াতে।নিশাদ বাবা মা কে সালাম দিলো তারপর শাশুড়ীকে।আর ইমতিয়াজ ওকে জড়িয়ে ধরে।নিশাদ বলছিলো,
''একদম চিন্তা করবিনা।এত ভাল রাখবো ভাবতে ও পারবিনা।"
বিয়ে পড়ানো শেষে ইদ্রিকে ড্রয়িংরুমে এনে নিশাদের পাশে বসিয়ে দেয়া হলো।এবার তমাকে ইমতিয়াজ দেখে।ভীষন মায়াবী লাগছে সাদা শাড়ীতে।ইমতিয়াজ চোখ ফেরাতে পারছিলোনা।তমা আড়চোখে ইমতিয়াজের দিকে তাকাতে চোখাচোখি হলো দুজনের।ভীষন লজ্জা পেলো ওরা।মালাবদল হলো আর ছবি তোলাও হয়ে গেলো।ইদ্রি আর নিশাদ উভয়েই সকলের মাঝে বসে লজ্জা পাচ্ছে।ইদ্রি পূর্নাকে টেনে কোলে তুলে নেয়।পূর্না ইদ্রির গালে চুমু দিয়ে বলল,
''তুমি আমাল বলো মামী আমি দানি।"
ইদ্রি হেসে ছোট্ট পূর্নার গালে চুমু দিয়ে বলল,
''হ্যা মানু তোমার বড় মামী আমি।"
পূর্না ইদ্রির গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
খাওয়াদাওয়া শেষে কিছুক্ষন গল্প করার পর বিদায়ের পালা আসে।ইদ্রির চোখজোড়া ভরে আসে।গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে মাকে জড়িয়ে ধরে।ইমতিয়াজ রুমে গিয়ে কাঁদতে থাকে।হঠাৎ কাঁধে কারোর ছোঁয়া পেয়ে পিছনে তাকায়।নিশাদ দাঁড়িয়ে।ইমতিয়াজ বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো,
''বাবা চলে যাওয়ার থেকে ইদ্রি একদম পাগল হয়ে গিয়েছিলো।তারপর তুই ওকে সামলেছিস। এখনতো তুই ওর সব।সামলে নিস বোনটা কে দোস্ত। আর কিছু লাগবেনা আমার।বোনটা খুব ছোটরে।সংসার সম্পর্কে কিছু বুঝেনা।ওকে কখনো কষ্ট দিসনা।জানি দিবিনা।একটা মাত্র বোন আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে রে।"
নিশাদ বলল,
''একদম চিন্তা করবিনা।ওকে কখনো বুঝতে দিবোনা আঙ্কেল নেই।সবসময় ভালো রাখবো।বিশ্বাস করিস তো?"
ইমতিয়াজ সরে এসে বলল,
''অবশ্যই করি।"
নিশাদ বলল,
''তাহলে চল।ইদ্রিকে বিদায় দে।"
ইমতিয়াজ বন্ধুর সাথে চলে আসে নিচে।ইদ্রি কাঁদছে দাঁড়িয়ে।জুলেখা বানু ওকে কি যেন বলছে।ইমতিয়াজ যেতেই বেলা ইদ্রির কাঁধে হাত রেখে বলল,
''ইদ্রি তোমার ভাই।"
ইদ্রি পাশে তাকিয়ে ইমতিয়াজ কে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।ইমতিয়াজ বোনকে ধরে কাঁদতে শুরু করে।ইমতিয়াজ কান্নার মাঝে বলছিলো,
''কাঁদিসনা পাখি। অনেক ভালো থাকবি তুই আমি জানি।নিশাদের কথা শুনিস বোন।এখন ও তোর সব।আর এই বাসাটা তোর।কখনো মনে করিসনা পর হয়ে গেছিস।যখন ইচ্ছা হবে চলে আসবি সোনা।"
ইদ্রি কান্না করছে।নিশাদের হাত ধরে ইমতিয়াজ আবার ও বলল,
''পাখিটার খেয়াল রাখিসরে।মেয়েটা ভীষন ভালো তোকে খুব ভালোবাসে।তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড থেকে ভাই ছিলি বেশি।বোনটাকে যত্নে রাখিস....."
হঠাৎ বিভানের কোলে থাকা পূর্না বলল,
''বাবা মামী কাঁদে কেন কালি?তলে দাত্তে ওনি?"
বিভান মেয়ে কে বলল,
''মামী আমাদের সাথে যাচ্ছে তো তাই কাঁদছে।"
অনেক্ষন যাবৎ কান্নার পর্ব শেষ হওয়ার পর বেলারা ইদ্রিকে নিয়ে চলে যায়।সৈয়দা বানু একদম দূর্বল হয়ে গেছেন।ইমতিয়াজ ওনাকে ঘুম পাড়িয়ে রুমে এসে কাঁদতে থাকে।এদিকে তমা তখনো যায়নি।ইমতিয়াজের পাশে এসে বসে ও।কাঁধে হাত রেখে বলল,
''কাঁদিসনা।দেখবি তোর ভাবনা থেকে সুখে থাকবে ও।"
তমার কথায় ইমতিয়াজ বান্ধুবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।তমার চোখে ও পানি চলে আসে।ইমতিয়াজ বলছিলো,
''মন মানছেনা রে।কি করবো বল?সারাটা বাড়ি মাতিয়ে রাখতো ও।আর পিচ্চিটা চলে গেলো।খুব কষ্ট হচ্ছে আমার তমা।"

!!!!

রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট...
ঘরে নতুন বৌ এসেছে তবে সেটা প্রতিবেশীরাই ভাবছে।আসলে নতুন বৌ রাহমান পরিবারের কাছে নয় এসেছে পরিবারের ছোট্ট মেয়ে।ভীষন আদরের মেয়ে একদম কাছের।যেন বছর বছর যাবৎ পরিবারটাকে চিনে সে।ঘরে এসেই লেহেঙ্গা পাল্টে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইদ্রি।গুঁটি গুটি পায়ে সাঁঝের কাছে এসে দাঁড়ায়ও।সাঁঝ  মিষ্টি রেডি করছে।ইদ্রি কাঁচুমাচু করছিলো।ওকে দেখে সাঁঝ মৃদু হেসে বলল,
''কি হলো ভাবি কিছু বলবে?"
ভাবি ডাকে ইদ্রি লজ্জায় শেষ।লোকটা আসতেই কই যেন চলে গেলো।সাঁঝ ইদ্রিকে লজ্জা পেতে দেখে হেসে ফেললো।বলতে লাগলো,
''লজ্জা পেওনা গো ভাবি।এবার ভাবি ডাক টা সহ্য করে নাও।এই ডাকটাই রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা শুনতে হবে।"
তখনই সাইমন এসে সাঁঝের পিছু দাঁড়ায়।প্লেট থেকে মিষ্টি নিয়ে বলল,
''নিশাদ ভাই ও বুঝি ভাবি ডাকবে সাঁঝ?পাগল হয়ে গেলে বুঝি?রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা সবাই ভাবি ডাকলে নিশাদ ভাইতো বেচারা সুযোগ পাবে ভাবির সাথে দুদন্ড কথা বলতে।কি বলেন ভাবি?"
বলেই ইদ্রিকে একটু মিষ্টি খাওয়ালো সাইমন।ইদ্রি লজ্জা পেয়ে মৃদু হেসে মাথা নিচু করে।সাঁঝ রেগে বলল,
''এসব কি বলো?লজ্জা পাচ্ছে ও।তুমি ও না।"
তারপর ইদ্রির দিকে তাকায় সাঁঝ। ওকে নরমাল করার জন্য বলল,
''ও সাইমন আমার হাসবেন্ড।কিছু মনে করোনা ওর কথায়।মজা করছে......"
ইদ্রি দ্রুত বলে ফেললো,
''না আপু সমস্যা নেই।আমি ঠিক আছি....."
সাঁঝ আবার বলল,
''কিছু বলতে?"
ইদ্রি মাথা নাড়ে।তারপর বলল,
''আপু আমি একটা শাড়ী পরবো।আসলে পারিনা তো পরতে।একটু যদি হেল্প করতেন।"
সাঁঝ কিছুটা চিন্তা করে বলল,
''যাও আমি আসছি।"
ইদ্রি মাথা নেড়ে রুমে চলে গেলো।কিছুক্ষণ পর সাঁঝ গিয়ে ওকে শাড়ী পরিয়ে দিলো শক্ত করে।ইদ্রি সবটা সাজ তুলে মুখে হালকা ক্রিম পাউডার আর কাজল লাগায়।আর ঠোঁটে নেয় হালকা লিপস্টিক।তারপর চলে আসে পাকঘরে।ইদ্রিকে পাকঘরে দেখে বেলা আর জুলেখা বানু অবাক।প্রিয়াশা ও কিছুটা অবাক।বেলা বলল,
''কিছু লাগবে?ক্ষিদে পেয়েছে?"
ইদ্রি মিনমিন করে বলল,
''আসলে.... আপনাদের সাথে একটু হাত লাগাতাম।মানে..... "
বেলা কোমড়ে বাঁধা শাড়ীর আঁচলের এককোনা খুলে বলল,
''আমরা সআবাই আছি করছি। তুমি যাও....সবেই তো এলে।"
ইদ্রি মাথা নেড়ে বলল,
''না আপু কি বলেন?কাল আপনি চলে যাবেন।আমিও কিছু কাজ করবো।"
প্রিয়াশা হেসে বলল,
''না ভাবি তুমি যাও আমরা করছি।"
ইদ্রি কোন উপায় না দেখে বলল,
''মা আপনি পাকঘরে কেন?আমরা দুটো বৌ আছি।প্লিজ আপনি কোন কাজ করবেননা।"
জুলেখা বানু অবাক হলে ও খুশিই হন।কিন্তু ভাবছেন এত বড় ঘরের মেয়ে কি করে পারবে কাজ করতে?জুলেখা বানু বললেন,
''না আম্মা তুমি রেস্ট নাও।নতুন আইছো আগে শিখো কাজ কাম।"
ইদ্রি মৃদু হাসে।তারপর বলল,
''মা আমি বাসায় কাজ করেছি।রান্না ও মোটামুটি পারি।আর করতে করতেই তো শিখবো তাইনা?আর নতুন এসেছি তো কি হয়েছে?আমিও তো বৌ তাইনা?"
বেলা আর জুলেখা বানু হাসছে।বেলা বলল,
''একটা কাজ করবে?"
ইদ্রি মাথা তুলে তাকায়।বেলা বলল,
''তোমার বিভান ভাই, আদনান, সাইমন আর আব্বাকে একটু চা করে দাও।"
''আর আপনারা?"
বেলা মৃদু হেসে বলল,
''নিশাদ আসুক।"
ইদ্রি মিষ্টি হেসে পাকঘরে ঢুকে চা বানাতে শুরু করে।চা বানিয়ে পর্যায় ক্রমে বাবা বিভান সাইমন আর আদনানকে দিলো।ইকরাম রাহমান নাতনীকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন।নতুন বৌ কে চা আনতে দেখে ইকরাম রাহমান বললেন,
''কি গো বৌ।তুমি চা আনছো যে?হেরা কই?"
ইদ্রি বলল,
''বাবা আপা প্রিয়াশা আপু আর মা কাজ করছেন।তাই আমি নিয়ে এলাম।"
ইকরাম রাহমান চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
'''চা তুমি বানাইছো?"
ইদ্রি দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''জি বাবা।"
''খুব স্বাদ হইছে চা।"
তারপর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পাঁচশত টাকার নোট বের করে ইদ্রির হাতে ধরিয়ে বললেন,
''নাও এটা।তোমার উপহার এত মজার চা খাওয়াইছো।"
ইদ্রি টাকা নিয়ে বলল,
''বাবা ওকে আমার কোলে দেন।আপনি চা খেয়ে নিন।"
ইকরাম রাহমান হাসি মুখে নাতনীকে বৌয়ের কোলে দেন।ইদ্রি পূর্নাকে নিয়ে চলে যায়।রাতে ফিরে আসে নিশাদ।হুমায়রার কালপ্রিট দের এ্যারেস্ট করা হয়েছে।ইমতিয়াজ কল করেছিলো তাই সেখানে গিয়েছিলো নিশাদ।জেলে ঢুকে থাপড় মারে তিনজনকে।আরো মারতে যাচ্ছিলো কিন্তু ইমতিয়াজ থামিয়ে দেয় ওকে।নিশাদ ওদের বলল,
''এসব না করে পরিবারের কথা তোমাদের নিজেদের মা বোনদের কথা ভাবো।তাহলে অন্যের বোনের দিকে এতো বাজে নজর দেয়ার আগে হাজার বার চিন্তা করবে।"
বলে বেরিয়ে আসে নিশাদ।ঘরে ফিরে শেরওয়ানী পাল্টে একটা টিশার্ট আর প্যান্ট পরে সোফায় এসে বসে।ভুলেগিয়েছিলো বিয়ে করেছে।হঠাৎ সামনে চায়ের কাপ দেখে মাথা তুলে তাকায় ও।বেলা চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আর পিছে ইদ্রি লুকিয়ে।বেলা হেসে বলল,
''দেখ তোর বৌ বানিয়েছে।খেয়ে জানা কেমন হয়েছে চা?"
ইদ্রির দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দেয় নিশাদ।মুহূর্তে যেন ভেতরটা শান্তিতে ভরে গেলো।সেদিন রাতে সবাই মিলে গল্প করে।সেই তিনজনের কথা জেনে সবাই ভীষন খুশি ছিলো।সবচেয়ে বেশি হুমায়রা।বড় ভাইকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করেও।রাত বাড়ছে নিশাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম হচ্ছে।সকালে উঠতে হবে।আপা কাল চলে যাবে।আজ রাতটা ওদের বাসর মেয়েটা কি ভুলে গেছে।ইদ্রিতো ওকে ভুলেই গেছে।সবার সাথে গল্পে এত টাই মশগুল যে অপেক্ষারত স্বামীর রাগান্বিত চেহারা ওর চোখে পড়ছেনা।নিশাদককে দেখে বিভান স্ত্রীর কানে কি যেন বলে।হঠাৎ বেলা বলল,
''আচ্ছা আমি ঘুমাবো।তোরাও ঘুমিয়ে যা।নিশাদ তুই ও যা।তোর তো ঘুম আসছে।"
নিশাদ খুশি মনে উঠে দাঁড়ায়।ইদ্রি বলল,
''আপু আরেকটু কথা বলি?"
বেলা নাকোচ করে বলল,
''না ঘুম আসছে।কাল সকালে।"
অগত্যা উঠে পড়তে হয় ইদ্রিকে।রুমে আসতেই নিশাদ দরজা লাগিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে বলতে লাগলো,
''আরো কতক্ষন গল্প করতে তাইনা?"
ইদ্রি মাথা ঝাঁকায়।নিশাদ ওর ঘাড়ে মৃদু কামড় দিয়ে বলল,
''বুঝোনি তোমার এই পাগলা স্বামীটা অপেক্ষা করছে।তোমাকে কাছে  পেতে ব্যাকুল হয়ে আছে।"
ইদ্রির নিশ্বাস মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে আসে।নিশাদ সামনে এসে ইদ্রির কপালে ঠোঁট বুলিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়।ইদ্রি অবাক হয়ে বলল,
''কি হলো?কোলে নিলেন যে?"
নিশাদ ইদ্রির কপালের সাথে কপাল লাগিয়ে বলল,
''আজ আমাদের বিয়ের প্রথম রাত।এই রাতটায় তোমাকে পাওয়ার সকল ইচ্ছা মিটাতে চাই।তোমাকে নিজের করতে চাই। দিবেনা?"
ইদ্রি মৃদু হাসে চোখ বুজে।নিশাদ ওকে খাটে শুইয়ে ওর পাশে এসে শোয়।।নিশাদের দিকে ঝুঁকে বলল,
''বৌ।"
ইদ্রি চোখ খুলে তাকায়।ডাকটা এত মধুর কেন?ওর ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো একে বারে।নিশাদ বলল,
''তোমাকে বৌ করে পাওয়া স্বপ্নের মতো ছিলো।আজ পূরন হয়েছে।"
ইদ্রি নিশাদের বুকে মাথা রাখে লজ্জায়।নিশাদ ইদ্রির মুখ উঁচিয়ে ধরে।বলল,
''লজ্জা কোন কাজ করবেনা আজ।আজ তো ভালবাসার সময়।অনেক অনেক ভালবাসা।যেদিন প্রথম তোমায় চুমু দিয়েছিলাম মনে হচ্ছিলো একেবারেই শেষ করে ফেলি।কিন্তু পরক্ষনে মনে হলো আমার কিছু হয়ে গেলে পাগলীটার কি হবে?"
নিশাদের কথায় ইদ্রির চোখের কোনে পানি জমা হয়।কাঁপন ধরা কন্ঠে বলল,
''একদম বাজে বকবেননা।কি হবে আপনার?মৃত্যু এলে আগে যেন আমাকে স্পর্শ করে আমাকে।"
ইদ্রির গালে আলতো করে চড় দেয় নিশাদ।রাগী গলায় বলল,
''বেয়াদব মেয়ে।এমন কথা বলো কেন?"
ইদ্রি অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে হেসে ফেলে।বলল,
''এবার থেকে সারাজীবন মনে হয় চড় খেয়ে কাঁটাতে হবে।"
ইদ্রির কথায় নিশাদের মায়া লাগে।ইদ্রির ঠোঁট গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আর কোন চড় না এবার শুধু ভালবাসার আদান প্রদান হবে।"
ইদ্রি চোখ বন্ধ করে বলল,
''দিন না।না করিনি তো।"
নিশাদ ইদ্রিকে শুইয়ে ওর ওপর শুয়ে পড়ে।ইদ্রির ঠোঁটজোড়ায় ঠোঁট বুলিয়ে নিতে নিতে ওর গলায় অসংখ্য চুমু দিয়ে মাথা তুলে তাকায় নিশাদ।বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ছে ইদ্রি।নিশাদ বলল,
''মে আই?"
''আ'ম অল ইওরস।"
কাপন ধরা কন্ঠে বলল ইদ্রি।নিশাদ মৃদু হেসে ইদ্রিকে নিয়ে ডুবে যায় ভালবাসার অতল সমুদ্রে।আজ দুজন এক হয়ে গেলো পরিপূর্ণ ভাবে।আর কোন দূরত্ব রইলোনা ওদের মাঝে।পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে বেলা বিভান, হুমায়রাআর পূর্না বেরিয়ে যায় বিমানবন্দরের উদ্দেশ্য।আজ ওদের বিদায় দিতে পুরো পরিবার আছে।বেলার চোখের পানি বাঁধা মানছেনা।ওর জীবনের বেস্ট একুশটা দিন কি করে শেষ হয়ে গেলো বুঝতেই পারেনি।আবার ও চলে যেতে হচ্ছে প্রিয় মানুষ আর প্রিয় মুখ গুলোকে ছেড়ে।বাবা মা ভাইবোনকে ধরে কাঁদছে ও।বাকি নেই ভাইয়ের বৌরাও।সবার চোখে পানি।দুই ভাইয়ের বৌ কে বেলা বারবার বলেছিলো মা বাবা আর কুঞ্জন লাবনীর খেয়াল রাখতে।ওরা ও বারবার বেলাকে আশ্বস্ত করেছিলো।পূর্নাকে ধরে কাঁদছে মামা খালা নানু নানু আর মামীরাও।বাচ্চাটা অল্প সময়ে ওদের সবার মন জয় করে নিয়েছে।হুমায়রা ও কাঁদছে ভাইবোনকে ধরে।কেউই হয়ত ভাবেনি ও চলে যাবে ওদের সাথে।নিশাদ বেলা চর হুমায়রাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিভানকে বলল,
''ভাই আমার কলিজার টুকরা দুইটা আপনার হেফাজতে থাকবে।খেয়াল রাখবেন।"
বিভানের চোখে পানি।তা এখন ভারি হয়ে গেলো।বলল,
''নিশাদ ওদের অযত্ন হবেনা নিশ্চিন্ত থাকো।"
ইকরাম রাহমান বড় জামাইকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন,
''বাবা তোমারে অনেক কথা কইছিলাম।আমারে মাফ কইরা দিও।মাইয়া গুলার খেয়াল রাইখো।তুমি আমাগোর লাইগা অনেক কিছু করছো।সেজন্য তোমারে ধন্যবাদ দিয়া ছোট করতে চাইনা।কাল কমু এই বুড়া বাপটার ওপর অভিমান রাইখোনা।"
বিভান শ্বশুর কে স্বান্তনা দিয়ে বেরিয়ে আসে তিনজনকে নিয়ে।সাথে যাবে নিশাদ আদনান।এয়ারপোর্টে গিয়েও বোনদের ধরে খুব কেঁদেছিলো ওরা সেই সাথে ভাগনীকেও।সেদিন ফিরে আসে ওরা নিজের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।পূর্নাকে স্কুলে ভর্তি করার পরিকল্পনা করছিলো বিভান সেই সাথে হুমায়রার জন্য ভালো ভার্সিটি সেই সাথে ক্যারাটি স্কুলে এডমিশন।হুমায়রাও ব্যাস্ত হয়ে যায় পড়াশুনা আর ক্যারাটি শিক্ষা নিয়ে।মাস দুয়েক চলে যায়।পূর্না প্লে তে ভর্তি হয়েছে।সেদিন সকালে ডোর বেল বাজে।হুমায়রা কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো।কলিংবেল শুনে দৌড়ে দরজা খুলে দেখলো বন্দনা আখতার দাঁড়িয়ে।ও চিনতো না বন্দনা আখতারকে।তারওপর বয়স যেন অনেক বেশি হয়ে গেছে।কিছুটা কালো হয়ে গেছেন ওনি।হুমায়রাকে দেখে বললেন,
''আমার ছেলে কই?"
হুমায়রা অবাক হয়ে জানতে চায়,
''আপনার ছেলে?"
বন্দনা আখতার কাঁদো স্বরে বলতে লাগলেন,
''বিভান থাকেনা এখানে?"
হুমায়রা বুঝতে পেরে ওনাকে বসতে বলে বেলার কাছে দৌড়ে এসে বলল,
''আপা তোর শাশুড়ী এসেছে।"
বেলা পূর্নার চুলে ঝুঁটি করছিলো।বন্দনা আখতারের কথায় ওর হাত পা কাঁপতে থাকে।পূর্নাকে নিয়ে রুমে আসতেই বন্দনা আখতার বেলার হাতজোড়া চেঁপে বলল,
''বৌমা আমাকে মাফ করে দাও।আমি খুব ভুল ছিলাম।অনেক গুনাহ করছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও।একা থাকতে পারছিনা আর।তোমরা ছাড়া আমার কেউ নাই।"
বেলার চোখজোড়া গড়িয়ে পানি পড়ছে।ও তো মা তাই হয়ত আরেক মায়ের কষ্ট বুঝতে পারছে।বেলা কিছুটা থমথমে গলায় হুমায়রাকে বলল,
''তুই পূর্নাকে নিয়ে যায়।"
হুমায়রা অবাক হয়ে বলল,
''তুই আসবিনা?"
বেলা বলল,
''না।তোরা চলে যা।"
সেদিন রাতে বিভান এসে মাকে দেখে প্রচুর রেগে রুমে চিৎকার করতে করতে বলল,
''বেলা কই তুমি?"
বাথরুমে কাজ করছিলো বেলা।স্বামীর চিৎকারে বেরিয়ে আসে ও।বিভান চেঁচিয়ে বলল,
''ঐ মহিলা কি করছে এখানে?"
বেলা বলল,
''আস্তে বলুন।"
''কি আস্তে বলবো?সে খুনি আমার সব শেষ করে এখানে কেন এলো?"
বেলা কেঁদে ফেললো। বলতে লাগলো,
''বিভান সবার ভুল হয়।মানুষ ওনিও।সবাইকে সুযোগ দেয়া উচিৎ।ওনি ভুল করে ছিলেন বিভান।তবে এটা সত্যি যে ওনি আপনার মা।আপনাকে খুব ভালবাসেন।হয়ত আমাকে ভালবাসতেননা।তাই এমন করে ছিলেন।বিভান আপনিই তো বলেন অতীত কে ভুলো গিয়ে বর্তমানকে ভাবতে।মা অনেক ভুল করেছিলেন।সেটার প্রায়শ্চিত্ত করেছেন ওনি।ভালো নেই ওনি।খুব কষ্টে আছেন।আপনি ছেলে। প্লিজ ওনাকে মাফ করে দিন।"
বিভান রাজি হয়না।তবে বেলা হাল ছাড়েনি।বিভানের অমতে মাকে ঘরে রাখে।সারাদিন বিভানকে বুঝাতে থাকে।তবে বেশি সময় লাগেনি বিভানের।ও বুঝতে পারে মা অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছেন।নিজের কাজে অনুতপ্ত ওনি।বিভানের মন মানতে চায়না কিন্তু মাকে ও অবহেলা করতে পারছেনা।শেষ রাতে বেলা পূর্নাকে দেখিয়ে বলছিলো,
''ওকে দেখেন।আপনার কষ্ট আমাদের বেবির জন্য।আল্লাহ হয়ত পূর্নার রুপে ওকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।প্লিজ মাকে মাফ করে দিন মাকে।বাবুটার কথা ভুলে যান কারন আমাদের পূর্না আছে মায়ের তো আপনিই ছিলেন।"
বিভান কেঁদে ফেলে।বলতে লাগলো,
''পারছিনা বেলা।ভুলতে পারছিনা তার কাজ গুলোকে।যখন দেখি ওনি পূর্নাকে তোমাকে ভালবাসে আদর করে মুহূর্তের জন্য মনটা নরম হলে ও মুহূর্তেই তার ওসব কাজ গুলো মনে আসে।পারছিনা বেলা আমি জানি ওনি আর আগের মতো নেই।আজ তার দৃষ্টিতে তোমাদের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা দেকি যা আগে কখনো দেখিনি।কিন্তু পারছিনা আমি।"
''সময় দিন নিজেকে বিভান।"
পরদিন সকাল বন্দনা আখতার ছেলের সাথে আবার ও কথা বলার চেষ্টা করেন।গত কয়েকদিন যাবৎ চেষ্টা করে ও ব্যার্থ হয়ে ছিলেন।নিজের কাজে ভীষন ঘেন্না হয় ওনার।কেন মরে গেলেননা ওনি?তাই দেরি না করে বেরিয়ে আসছিলেন তখনই পূর্না দৌড়ে এসে ওনার হাত ধরে বলল,
''দাদু কই যাও তুমি?"
বন্দনা আখতার নাতনীর দিকে তাকিয়ে কেঁদে বলেন,
''যাচ্ছি দাদু মনি।তোমার বাবা মায়ের দিকে খেয়াল রেখো।"
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলল,
''আর তোমার খেয়াল কে রাখবে মা?"
বন্দনা আখতার পিছে তাকিয়ে ছেলেকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।বলতে লাগলেন,
''বাবা মাফ করে দে আমাকে।আমি সত্যিই অনুতপ্ত।"
বিভান এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
''আর না মা।মাফ করে দিয়েছি।এখন থেকে আমরা সবাই একসাথে থাকবো।তুমি আর কোথাও যাবেনা।"
বন্দনা আখতার কাঁদতে থাকেন ছেলেকে ধরে।বেলা হুমায়রা হাসছিলো মা ছেলের মিল দেখে।পূর্না আবার ও বলল, 
''খালামনি সবাই এত কাঁদে কেন?"
বেলা আর হুমায়রা হেসে ফেলে।হুমায়রা বলল,
''তোমার দাদু তোমার বাবা কে পেয়েছে যে। "
দুবছর পর
বাইক থেকে নেমে আসে ইদ্রি।বাইকটা থামলো ঠিক মেডিকেল কলেজটার সামনে।ভারি হয়ে আসা পেটটাকে সামলে নিশাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে ও।নিশাদ হেলমেট খুলে বলল,
''আমি এখানে আছি।তুমি যাও ক্লাশ করো।"
ইদ্রি রেগে বলল,
''মাথা খারাপ।রোদ দেখেছেন?আপনারও অফিস আছে।জলদি চলে যান।আমি ঠিক আছি।"
নিশাদ ইদ্রির কপালে চুমু দিয়ে বলল,
''দেখো কোন সমস্যা হলে কল দিবা।"
ইদ্রি হেসে বলল,
"'ওকে এবার যান।"
নিশাদ বাইক চালিয়ে চলে গেলো।ইদ্রি কলেজ গেইটে ঢুকে গেলো।ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা ও।নিশাদ প্রচন্ড সাপোর্ট দিচ্ছে নিজেকে ভীষন ভাগ্যবতী মনে হয় ওর।ও দেখেছে সাইমন ভাই কিভাবে সাঁঝকে প্রেগ্ন্যাসিতে সাহায্য করেছিলো।সাঁঝের জমজ মেয়ে হয়েছে।সায়নী আর সারনী।দুটোই ইদ্রি বলতেই পাগল।আর আজকাল কুঞ্জন ভার্সিটিতে রকস্টার নামে পরিচিত।প্রেম করেনা সেটা ইদ্রি জানে কারন কুঞ্জন সব কথা ওকেই বলে।প্রিয়াশার ও ছেলে হয়েছে গত মাসে।ওর ভাই ইমতিয়াজ তমাকে বিয়ে করেছে দেড় বছর হয়ে গেছে।ওরা বর্তমানে সুইডেনে স্যাটেলড।সেখানে মাকে নিয়ে গেছে।মায়ের অপারেশন চলছে।
লাবনীদের কলেজে আজ কুঞ্জনদের ফেয়ারওয়েল।আশেপাশে প্রচন্ড শব্দে গান বাজে লাবনীর ওসব একেবারেই ভালো লাগেনা।কানটা ধরে গেছে একেবারে।তবে ওর দৃষ্টি আশেপাশে ঘুরছে।তন্ময় ছেলেটা ওকে খুব বেশি ফলো করে আজকাল। ছেলেটা কুঞ্জন ভাইয়ার বন্ধু।বেশ ভদ্র। কিন্তু এই ছেলেটা লাবনীকে দেখা মাত্রই কেমন যেন হয়ে যায়।আজতো লাবনী শাড়ী পরে এসেছে।একদম টকটকে নীল বর্নের।তন্ময়ের চোখে পড়লে নিশ্চিত সে ঘায়েল হয়ে যাবে।হঠাৎ হল রুমে চলে আসে ও।সামনে নীল পাঞ্জাবীতে তন্ময় দাঁড়িয়ে কুঞ্জনের সাথে গল্পে মশগুল।লাবনীকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসছেও। লাবনী চোখ সরিয়ে নেয় ওর থেকে।হঠাৎ অন্যান্য ছেলেরা গাইতে লাগলো,
''বাস রেহনা তু পাল পাল দিলকে পাস......
জুড়ি রাহে তুঝসে হার এক শ্বাস........... 
ছেলেটা আড়াল করে এসে লাবনীর হাতে একটা কাগজ দিয়ে সামনে চলে যায়।লাবনী সরে এসে সেটা খুলে দেখে একটা কবিতা।সেটা ছিলো,
তুমি বলে ছিলে আসবে
হাজারটা ফোটা সদ্য পদ্য নিয়ে
আমি দুয়ারে দারায়ে
প্রহর গুনছি আজও।
তুমি বলে ছিলে আসবে
এক রাশ ফুটন্ত হাসি নিয়ে
আমি তারার পানে চাহিনী
তোমার হাসির তারা কুড়াবো বলে।
তুমি বলে ছিলে আসবে
সেই নীল শাড়িটি পড়ে
আমি ঘাসের বানানো নূপুর
পড়িয়ে দিবো তোমার পায়ে।
তুমি বলে ছিলে আসবে
আমার ভালোবাসার অন্তজালের টানে
আমি প্রতিক্ষায় ছিলাম
চাহিনী ফিরে অন্য নারীর পানে........
কবিতাটা দেখে ঠোঁট টিপে হাসে লাবনী।তাকায় সামনে হেঁটে যাওয়া তন্ময়ের দিকে।সেমুহূর্তে তন্ময় ও ওর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ নয়নে হাসে সেই সাথে লাবনীও।আজ ওর দুনিয়াটা ও যেন রঙ্গিন করে ভালবাসা নিয়ে এসেছে তন্ময়।
অপরদিকে হুমায়রা আজ স্টেজে এসে দাঁড়ায়।প্রধান অতিথি ওর হাতে একটা গোল্ড মেডেল তুলে দেয়।সেটা দেখে কেঁদে দেয় ও।লোকটা বলল,
''কিছু বলতে চাও?"
হুমায়রা মাইক হাতে নিয়ে বলল,
''আজ আমি যা হয়েছি সব কৃতিত্ব আমার বড় ভাইয়ের।ছোটবেলা থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছিলাম।বড় ভাই আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ খুব পরিশ্রম করে যুগিয়েছিলো।একসময় বড় ভাই কে ভুল বুঝে খুব বড় একটা ক্ষতি করে বসি নিজের।মুহূর্তের জন্য মনে হয় জীবনটা শেষ।কিন্তু আসলে শেষ হয়নি।ফেমিলি সাপোর্ট মেন্টাল স্ট্রেন্থ মানুষকে অনেক দূর নিয়ে আসতে পারে সেটা আজ এখানে এসে বুঝলাম।থ্যাংক ইউ বিভান ভাই থ্যাংক ইউ আপা তোমাদের সাপোর্ট আর ভালবাসার জন্য।তবে আজ আমি একজন গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত ক্যারটি খেলোয়াড় আমার ফেমিলির জন্য।আমার বড় দুলাভাই আমাকে প্রচন্ড মানসিক শক্তি যুগিয়েছিলো নাহলে কখন আমার চলা থেমে যেতো।তাই সবাইকে বলছি কখনো আশাহত হবেননা।জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন এগিয়ে যাবেন।চেষ্টা করলে আপনাকে সফলতার পিছনে দৌড়াতে হবেনা সফলতা আপনাকে ধরার চেষ্টা করবে।আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।"
হুমায়রার কথায় গ্যালারীতে বসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ সেই সাথে বিভান বেলার চোখ ভরে এসেছিলো।ওর জীবনটা ও নিজেই নিজের চেষ্টায় এত দূর নিয়ে এসেছে।জীবনে উন্নতি করতে হলে স্পাউজ কিংবা কোন পুরুষ লাগবে তা না মেয়েরা নিজেরাও জীবনটাকে এগিয়ে নিতে পারে সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে।আর সেটার উদাহরন হুমায়রা।আজ রংধনুর সাতটা রং পরিপূর্ণতা পেয়েছে।কেউবা ভালবাসা দিয়ে আবার কেউ জীবনটা সফলতার পথে এগিয়ে নিয়ে।


                                              —(সমাপ্তি)—

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন