ঝরা ফুলের কান্না - পর্ব ১৭ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


শাদাব শার্ট চেইঞ্জ করে ড্রইংরুমে আসতেই ইয়াসমিন বেগম বললেন," তোর বউ আমাকে জ্ঞান দিয়ে গেল। আমি তোর খারাপ চাই? আমি চাই আমার বংশে একটা নাতি আসুক। কিন্তু না তোর বউ আমাকে নানা বিনা কথা শুনিয়ে গেল। 
শাদাব রাগান্বিত হয়ে বলল," সব কথায় তুমি এত দোষ খুঁজো কোথায় থেকে আমাকে বলবে? মেয়ে হোক ছেলে হোক এইটা তো আর শেষ নয়। যত্তসব!"
কথাটা বলেই শাদাব বেরিয়ে গেল। রাতে যখন ঘরে এলো এসে দেখে সম্পূর্ণা শুয়ে ঘুমাচ্ছে। লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং এ বসে বলল," বড় ভাবি খাওয়ারটা দিয়ে যাও।"
শারমিন এসে খাবার দিয়ে বলল," বউ আসার পর যদি আমাদেরই খাবার দিতে হয় তাহলে বিয়ে করার কী দরকার ছিল?"
-" ওর শরীরটা মনে হয় ভালো নেই।"
-" ভালো থাকবে কী করে সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে?"
কথাটা শুনে শাদাব কয়েক লোকমা খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে গেল। শাদাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সম্পূর্ণা উঠে বসে," তুমি বসো আমি খাবার দিচ্ছি।"
তোমাকে আর খাবার দিতে হবে না। সারাদিন একটু কাজ করলেই তো পারো। আর তুমি মা'য়েরে
 জ্ঞান দেওয়া কোথায় থেকে শিখেছ? আমার মা'কে দেখে তোমার ছোট মনে হয়? "
সম্পূর্ণা চুপ করে রইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল," কাজ তো আমি করি। কিন্তু এই অবস্থা ভারি কাজ পারি না তাই সেগুলো ভাবি করে।" 
-" আর কাজ দেখাতে হবে না আমাকে। আমি বুঝি তুমি কতটা কাজ করো।"
বিড়বিড় করতে করতে শাদাব শুয়ে পড়লো।
সকালে সম্পূর্ণা উঠে গিয়ে দেখে থালাবাসন সব এঁটো হয়ে আছে। ইয়াসমিন বেগম এসে বললেন," মহারানী উঠে এসেছেন। এখন যাও এইগুলো তাড়াতাড়ি ধুয়ে দাও বড় বউকে।"
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে থালাবাসন ধুতে বসে গেল। 
শাদাব ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে রেডি হয়ে কানে ফোন নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
-" তুই কী কোথাও যাচ্ছিস?"ইশরাত কথাটা বলে শাদাবকে আটকালো। ইয়াসমিন বেগম এইদিকে সম্পূর্ণাকে বললেন," মা তাড়াতাড়ি উঠ। তুই পারছিস না আমি বুঝতে পারছি।
সম্পূর্ণা উঠতে চাইনি বলে তিনি জোর করে উঠিয়ে নিজে বসে পড়লেন। শাদাব যাওয়ার সময় দেখে ইয়াসমিন বেগম বসে থালাবাসন মাজছে আর সম্পূর্ণা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শাদাব কিছু না বলে বাহিরে চলে গেল। শাদাব যেতেই ইয়াসমিন বেগম বললেন," সম্পূর্ণা, ভেবেছিলাম এইগুলো ধুয়ে দিব। কিন্তু কোমর ব্যথার জন্য পারছি না। ধর তুই কষ্ট করে ধুয়ে দে।"
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে আবার বসলো। 
কিছুক্ষণ যেতেই ইয়াসমিন বেগম দৌড়ে এসে তুই একটু রুমে গিয়ে দেখ তোকে কে ফোন দিয়েছে।"
-" এইগুলো শেষ করে যাই।"
-" আমার ছেলেও তো ফোন দিতে পারে। ও হলে তো তোর উপর রাগ দেখাবে৷ যা উঠে যা।"
সম্পূর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে কেউ ফোন দেয়নি। শাদাবই রুমে ঢুকে দেখে সম্পূর্ণা ফোন হাতে বসে আছে। শাদাবের মেজাজটা বিগড়ে গিয়ে সম্পূর্ণার হাতের ফোনটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেলে," এই ফোন নিয়ে যেহেতু এত জ্বালা ফোনই চালানোর দরকার নাই। আমার মা কোমর ব্যথা নিয়ে থালাবাসন মাজছে আর তুমি বসে বসে ফোন টিপতেছ? যাওয়ার সময় দেখে গেলাম দাঁড়িয়ে আছ? তোমার আক্কেল বলতে কিছু নাই? বাবা মা কী কিছুই শিক্ষা দিতে পারে নাই? বাড়ির বউ তুমি। তুমি যদি সবার দেখাশোনা না কর তাহলে আরেকবাড়ির লোক এসে করবে?" ভাগ্যিস আমি ভুলে মানিব্যাগ রেখে গেলাম। না হলে তো এসে দেখতেই পারতাম না তোমার অবস্থা।"
শাদাব মানিব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। সম্পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে নিজের ফোনটা কোনোমতে ঠিক করে তাবিয়াকে ফোন দিলো। সব বলতেই তাবিয়া বলল," তুই আসোলেই বোকা সম্পূর্ণা। তোর মাথায় এটা এলো না? যে উনি কেন বারবার আমাকে উঠিয়ে দিচ্ছে। যখন দেখছিস প্রথমবার এমন করে উঠিয়ে দিচ্ছে পরেরবার তো জোর করে বসে থাকতি। বলতি না আমিই কাজ সেরে নিব।"
সম্পূর্ণা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল," না উঠলে তো আমাকে জোর করে হাত টেনে উঠায়। এইটা দেখলেও তো আমাকে শাদাব বকবে। আমি কী করব?"
-" তোর জামাইটা কী কিছুই বুঝা যায় না। যা শুনলাম তাতে বুঝলাম তার মাও তোকে কিছু বলতে পারবে না। আবার তুইও তাদের মনে কষ্ট দিতে পারবি না। শুন আমার মনে হয় এরা শাদাবের কাছে তোকে খারাপ বানাতে চাইছে। শাদাব যখন আসবে আজ থেকে তুইও দেখিয়ে দেখিয়ে কাজ করবি। শাদাব ডাকলেও যাবি না।"
-" কী বলছ? এইভাবে থাকা যায়?"
-" যে যেমন তার সাথে এমনই করবি। একটু চালাক হ সম্পূর্ণা।"
সম্পূর্ণা আর কথা বাড়ালো না। রেখে দিলো ফোনটা। বিকেলে আসার সময় শাদাব একটা ফোন কিনে এনেছে। সম্পূর্ণাকে কয়েকবার ডাকতেই দেখে সে রুমে এলো না। শাদাব গিয়ে দেখে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। 
শাদাব বলল,"ঝাড়ু রেখে রুমে এসো কথা আছে।" 
-" কাজটা শেষ করেই আসছি।"
ইয়াসমিন বেগম এসে বললেন," সারাদিন তো বসেই ছিলি। এখন আমার ছেলে আসাতে তোর ঘর ঝাড়ু দেওয়ার দরকার হয়ে পড়েছে? ইশরাত ঝাড়ু দিয়ে দিবে। আমার ছেলের কী লাগে গিয়ে দেখ।"
সম্পূর্ণা ঝাড়ু রেখে শাদাবের পিছন পিছন আসতেই শাদাব দরজা আটকিয়ে খাটের কিনারায় বসিয়ে," ফোনের বক্সটা হাতে দিয়ে," পছন্দ হয়েছে?"
সম্পূর্ণা গম্ভীর কণ্ঠে বলল," আমার ফোন লাগবে না। এইটা তুমি ফেরত দিয়ে দাও। সকালে যেটা ভেঙে গেছ আমি কোনো রকম চালু করতে পেরেছি। ওইটা দিয়ে চলে যাবে।" 
শাদাব একগাল হেসে, " এত রাগ কেন তোমার? এই পাগলী রাগ করলে তোমাকে মোটেও ভালো দেখায় না। আর আমার মেয়েটা যদি জানতে পারে তার মা তার বাবার উপর রাগ করেছে তাহলে আমার আস্ত থাকবে?"
কথাটা বলতেই সম্পূর্ণা ম্লান হেসে বলল," আচ্ছা তুমি শুধু তোমার চোখের সামনে যা ঘটে তা নিয়ে কেন পড়ে থাকো। ভিতরে কী হয় তাও তো খতিয়ে দেখতে পারো।"
-" এইসব মেয়েলি অভ্যাস আমার নেই। বাদ দেও এইসব। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। তুমি বসো। আর হ্যাঁ পরশু আমি চলে যাচ্ছি।"
সম্পূর্ণা আর কিছু বলল না। 
শাদাব যাওয়ার আগে মা'কে বুঝিয়ে গেল সাথে সম্পূর্ণাকেও।
শাদাব যাওয়ার দুইমাস পরেই সম্পূর্ণার মেয়ে হলো। সবাই খুশি হলেও ইয়াসমিন বেগম খুশি হতে পারলেন না। সাইফুল ইসলাম মেয়েকে দেখতে আসার সময় এক মণ মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। 
মেয়ে হওয়ার একবছর পার হতেই শাদাব আবার বাড়ি এলো। মেয়েকে কাছে পেয়ে শাদাব খুব খুশি। ইয়াসমিন বেগম বললেন," মেয়ে হয়েছে দেখে এমন করছিস ছেলে হলে কী করতি তুই?"
শাদাব হাসি মুখে বলল," মা ছেলেমেয়ে সবই আল্লাহর দান। সময় তো কোথাও চলে যাচ্ছে না তাই না?"
শাদাব আসার কয়েকদিন পরেই মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেল সম্পুর্ণা। গাড়ি থেকে নেমে শাদাব মেয়ে শৈলীকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো। আদীল বাড়ি এসেছে দুইদিন আগে। তাই সম্পূর্ণারও মেয়েকে নিয়ে আসা। আদীল এসে শাদাবের কোল থেকে শৈলীকে নিয়ে কুশল বিনিময় করলো। আদীল আগে আগে হাটছে। সম্পূর্ণা শাদাব কথা বলতে বলতে দেখে হিমেল সামনে এসে দাঁড়িয়ে শাদাবের সাথে হ্যান্ডশেক করলো। সম্পূর্ণা ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে শাদাবের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে," চলো ভাইয়া চলে যাচ্ছে তো।"
শাদাব বলল," আপনাকে তো চিনলাম না।"
হিমেল হেসে," আমি এইবাড়ির। বাড়িতে থাকি না। কালই আসছি।"
-"ওহ্, আচ্ছা পরে কথা হবে। সম্পূর্ণা চলো।"
সম্পূর্ণা ঘরে এসে তাবিয়াকে বলল," ভাবি হিমেল বাড়িতে?"
-"হ্যাঁ তোর সাথে দেখা হয়েছে নাকি?"
-" হ্যাঁ শাদাবের সাথে কথা বলল।"
-" চিন্তা নেই। বাড়িতে আসার পর পুলিশের কাছ থেকে লিখত দিয়েছে ও আর তোকে কখনো ডিস্টার্ব করবে না। তুই আসার পর ও আরেকটা বিয়েও করেছে। গার্মেন্টসে চাকরি করে মেয়েটা। এখন বউয়ের রোজগার খাচ্ছে।"
সম্পূর্ণা তবুও স্থির হতে পারলো না। হিমেলের প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। কিন্তু শাদাবের কাছে উল্টোপাল্টা বললে তো শাদাব আমাকে আস্তো রাখবে না। আতিকা বেগম এসেও বুঝালেন। দুইদিন থেকেই সম্পূর্ণা ওই বাড়ি থেকে চলে এলো শাদাবকে নিয়ে। সত্যিই হিমেল এই দুইদিন কিছু করেনি। আতিকা বেগম মেয়েকে বুঝালেন,হিমেলের উপর বেশি খবরদারি করতে গেলে হেতে বিপরীত হবে। আমরা আমাদের মতো থাকি।এমনতো না ওকে কিছু করলে তোর অতীত সবাই ভুলে যাবে!
সম্পূর্ণা তাই আর কথা বাড়ালো না।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন