তুর্বী চলে যাওয়ার পর সৌহার্দ্য নিচের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। এরপর চারদিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। সৌহার্দ্য বুঝতে পারছে যে একটুবেশিই রুড হয়ে গেছে ও মেয়েটার সাথে। কিন্তু এখনতো আফসোস করে লাভ নেই। যা করার তা তো করেই ফেলেছে। মেয়েটা একটু দুষ্টুমি করে ঠিক আছে তাই বলে এভাবে সবার সামনে ইনসাল্ট করাটা ঠিক হয়নি। ওর সাথে কথা বলতে হবে। সৌহার্দ্য সবার দিকে তাকিয়ে একটা গম্ভীর স্বরে বলল,
" স্টপ লাফিং।"
সবাই সাথেসাথেই চুপ করে গেল। সৌহার্দ্য পুনরায় একই স্বরে বলল,
" মিটিং আজকের মত ক্যান্সেল।"
এটুকু বলে সৌহার্দ্য উঠে বেড়িয়ে গেল কনফারেন্স রুম থেকে। বেড়িয়ে প্রথমে নিজের কেবিনে গিয়ে ল্যাপটপ রেখে এরপর সোজা স্টাফ রুমে চলে গেল তুর্বীর সাথে কথা বলতে। কিন্তু তুর্বীর ডেস্কে গিয়ে দেখে তুর্বী নেই। তুর্বীকে দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হল সৌহার্দ্য। তাহলে কী অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে নাকি মেয়েটা। সৌহার্দ্য দ্রুত নিজের ফোন বেড় করে তুর্বীর নম্বরে ডায়াল করল। কিন্তু তুর্বীর ফোন রিসিভ করছে না। বারবার ডায়াল করার পরেও কোন লাভ হলোনা। ফোন বাজছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। সৌহার্দ্য নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল। মিস ভয়ংকরী ভীষণ ক্ষেপেছে। রাগ ভাঙনো এবার মুশকিল হবে। কী কী করতে হবে কে জানে? ' অল দা বেস্ট সৌহার্দ্য বেটা' নিজেই নিজেকে এই কথাটা বলে সান্ত্বনা দিল সৌহার্দ্য।
তুর্বী সিএনজির পেছনে বসে বসে একটু পরপর নাক টানছে। ওর নাক লাল হয়ে আছে। কিন্তু ওর চোখে জল নেই। তুর্বী যখন কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে তখন ওর চোখ আর নাক এমন লাল হয়ে যায়। ফোন বেজে চলেছে অনেক্ষণ যাবত কিন্তু তুর্বী ধরছে না দেখছেও না কে ফোন করেছে। প্রচন্ড রেগে আছে ও। ও এমনিতে কেমন ও জানেনা। কিন্তু নিজের কাজ নিয়ে ও যথেষ্ট সিরিয়াস। ও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। আর তাছাড়াও এটা ওর স্বপ্ন। আর ওর স্বপ্নটা যে ওর কাছে কী সেটা একমাত্র ওই জানে। সেখানে ঐ লোকটা ওকে সবার সামনে এভাবে কীকরে বলল? এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে ওর কোন যোগ্যতাই নেই। আচ্ছা? সত্যিই কী সব ভুলভাল বকছিল? ওর কোন যোগ্যতাই নেই? সিএনজির ড্রাইভার বলল,
" ম্যাম স্টানে চলে এসছি এবার কোনদিকে যাবো?"
তুর্বী রেগে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
" জাহান্নামে চলুন।"
" অ্যা?"
" হ্যাঁ। জাহান্নামের রাস্তা চেনেন? চিনলে সেদিকেই চলুন।"
সিএনজি ড্রাইভার বোকার মত তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। কিছুক্ষণ পরও যখন সিএনজি চলছেনা তখন তুর্বী প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলল,
" এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে চলুন? হা করে দেখছে।"
ড্রাইভারও এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
" কোনদিকে যাবো?"
তুর্বী আগের চেয়ে দ্বিগুন রেগে বলল,
" ডানে চলুন না ভাই।''
ড্রাইভার চোখ ঝাপটে একটা লম্বামত শ্বাস ফেলল। তারপর ডানে টার্ন করল। কিন্তু মনে মনে ভাবছে যে কোন পাগলকে এনে গাড়িতে তুলেছে ওপরওয়ালা জানেন। তুর্বীর সেদিকে কোন পাত্তা নেই ও ওর মত বসে রাগে ফুসছে আর কান্না আটকে রাখার জন্যে জোরে জোরে নাক টানছে।
______________
রিখিয়া আর বিহান একটা পার্কে পাশাপাশি বসে বসে বাদাম খেতে খেতে মাঝেমাঝে হালকাপাতলা গল্প করছে। বিহান নিজেই বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে রিখিয়াকে। রিখিয়া বিকেলবেলা অফিস থেকে বেড়োনোর পরই দেখেছে বিহান দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। এটা এখন মাঝেমাঝেই হয়। ওরা মাঝমাঝেই একেওপরের সাথে ঘোরে, দেখা করে, সময় কাটায়। আজও এখানে এসছে সময় কাটাতে। কিছুক্ষণের নিরবতার পর বিহান বলল,
" আচ্ছা তোমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই আপাতত?"
রিখিয়া একটু অবাক হয়ে বলল,
" বিয়ে?"
" হ্যাঁ বিয়ে। এখনতো তুমি জব করছো। মোটামুটি সেটেল হয়ে গেছ লাইফে। এবার একটা পার্টনার খুঁজে নিতে হবে তাইনা?"
রিখিয়া মুচকি একটুখানি হেসে বলল,
" সবসময় চাইলেই কী বিয়ে করে ফেলা যায়?"
" কেন যাবেনা কেন?"
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
" আমারটা ছাড়ুন। আপনিও তো এখনও বিয়ে করেন নি। আপনিও তো করতে পারেন।"
" কালসাপ ঘরে তুলতে বলছ?"
রিখিয়া চমকে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
" কীহ?"
বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা একটু হেসে বলল,
" হুম, আর তাদের সেই বিষ কালসাপের বিষের চেয়েও ভয়ংকর। এতটাই ভয়ংকর যে না মেরেও সারাজীবনের মত মেরে দেয়। শ্বাস তো চলে কিন্তু দেহে প্রাণ থাকে না।"
রিখিয়া ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। কী বলতে চাইছে? কালসাপ কাদের বলছে? মেয়েদের? রিখিয়ার মুখ দেখে সাথেসাথেই শব্দ করে হেসে দিল বিহান। কোনমতে নিজের হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল,
" আরে ইয়ার আই ওয়ার জাস্ট কিডিং। আমার কথা এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন?"
রিখিয়া লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বিহানের কাধে একটা চাপড় মেরে বলল,
" এরকম করে কেউ? কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম।"
বিহান এখনও হাসছে। বিহানের হাসি দেখে রিখিয়াও হেসে দিল। হাসার সময় কত সুন্দর লাগে ছেলেটাকে তাকিয়েই থাকতে মনে চায়। কিছুক্ষণ হাসার পর হাসি থামিয়ে বিহান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
" চল ওঠো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ফিরবে না?"
রিখিয়াও হ্যাঁ বলে উঠে দাঁড়াল। দুজনে কিছুক্ষণ হাটার পর হঠাৎ করেই একটা মেয়ে এপ্রকার দৌড়ে এল বিহানের কাছে। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
" বিহান! এখানে কী করছ তুমি? তুমি সেই বলেছিলে ফোন করবে কিন্তু এখনও করনি।"
রিখিয়া চোখ ছোট ছোট করে দেখছে দুজনকে। বিহান মেকি হেসে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে রিখিয়ার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে বলল,
" না আসলে ইদানিং একটু বেশিই ব্যস্ত থাকি তো তাই। সরি হ্যাঁ?"
" আরে ছাড়োতো। আজ ফ্রি আছোতো? আসব তোমার ফ্লাটে?"
বিহান কী বলবে বুঝতে পারছেনা বারবার শুধু রিখিয়াকে দেখছে। রিখিয়ার এবার প্রচন্ড পরিমাণ রাগ হচ্ছে। কিন্তু কেন রাগ হচ্ছে সেটা জানেনা তবে মেয়েটার বারবার বিহানের গায়ে পরতে দেখে মাথা গরম হয়ে উঠছে ওর। ও তো ভেবেছিল বিহান বদলে গেছে। কিন্তু এখনও কী এরকমই আছে। মেয়েটা রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
" আর ও কে? তোমার সাথে এখানে কী করছে?"
রিখিয়া দাঁত করমর করে বিহানের দিকে একটু তাকিয়ে কোন কথা না বলে লম্বা লম্বা পা ওখান থেকে চলে গেল। বিহান ঐ মেয়েটাকে বলল,
" আমি আসছি। বাই।"
মেয়েটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিখিয়ার পেছনে ছুটলো। বিহান পেছন থেকে রিখিয়াকে ডেকে যাচ্ছে কিন্তু রিখিয়া শুনছে না নিজের মত করে হেটে যাচ্ছে। বিহান দৌড়ে দৌড়ে রিখিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাফানো কন্ঠে বলল,
" আরে দাঁড়াও। এত জোরে হাটো কীকরে? আ'ম টায়ার্ড।"
রিখিয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,
" পথ ছাড়ুন।"
বলে যেতে নিলেই বিহান আবার পথ আটকে বলল,
" আরে আমার কথাটাতো শুনবে ইয়ার!"
" কী শুনবো হ্যাঁ? আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনি এখন এসব আর করেন না। কিন্তু আপনিতো একটুও বদলান নি। একচুয়ালি আপনার মত ছেলেরা বদলায়ও না। ভুলটা আমার ছিল যে আমি ভেবেছিলাম আপনি সুধরে গেছেন।"
বলে রিখিয়া যেতে নিলেই বিহান ওর হাত চেপে ধরে কাছে এনে বলল,
" কী ভাব নিজেকে? একাই দেখবে? একাই শুনবে? একাই বুঝবে? একাই বলবে? আরে আমাকেও তো এক্সপ্লেইন করতে দেবে? মেয়েটা কী বলেছে কানে শোননি? অনেকদিন হল যোগাযোগ করিনা ওর সাথে। মানেটা বুঝতে পারছ না? এগুলো সব পাস্ট। আরে আমার তো ওর নামটাও মনে নেই ইয়ার।"
রিখিয়ার এবার হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা যদি শোনে বিহানের ওর নামটাও মনে নেই নিশ্চয়ই হার্ট এটাক করবে। বিহান বলল,
" কী হল এখন দাঁড়িয়ে আছ কেন যাও?"
রিখিয়া খানিকটা ইতস্তত করে বলল,
" আসলে.."
" কোন আসলে নকলে নয়। এক মিনিট।"
বলে রাস্তা থেকে একটা সিএনজি থামিয়ে একপ্রকার জোর করেই রিখিয়াকে তুলে দিল। রিখিয়া এত করে কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু বিহান শুনলোই না। বরং ড্রাইভারকে বলে সিএনজি চালাতে বলে দিল। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়েও দিলেন। রিখিয়া মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আসলেই ও একটা গাধা। কিছু না বুঝে শুনেই রিঅ্যাক্ট করে ফেলে। বিহান তো রেগে গেছে এখন রাগ কী করে ভাঙাবে কে জানে?
.
.
.
চলবে..........................................