রংধনু - পর্ব ৬৯ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


নিশাদের সমস্ত কথা শুনার পর কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ইমতিয়াজ। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ও।কি করবে বন্ধুর এ বিপদ ঠেঁকাতে?পাশেই নিশাদ বসে গুঁমড়ে কাঁদছে আর ইমতিয়াজ ওকে দেখছে।ইমতিয়াজের চোখজোড়াও ভরে এসেছে।বন্ধু এত বড় বিপদে ছিলো আর ইমতিয়াজ সেটার আঁচ ও পেলোনা?কেমন বন্ধু হলো সে?ভাবতেই নিজের প্রতি রাগ লাগলো ইমতিয়াজের।নিশাদের হাত ছুঁয়ে বলল,
''এখন কেমন আছে হুমায়রা?"
নিশাদ চোখ মুছে নেয় তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নেয় দুচোখে হাত চেঁপে তারপর বলল,
''বড় দুলাভাই সামলে নিচ্ছে তবে বুঝিস তো এতসহজে ভুলা যায়না ওসব।রাতে ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ কেঁদে উঠে,খুবই চুপচাপ হয়ে গেছে আমার হুমায়রা।ও কিভাবে স্বাভাবিক হবে কবে ঠিক হবে বল?"
ইমতিয়াজ বলল,
''শোন তোরা সবাই ভাইবোন আঙ্কেল আন্টি ওকে সময় দে হাসা বেড়াতে নিয়ে যা।সময় বেশি লাগবেনা তখন ওর ঠিক হতে আর তাছাড়া বিভান ভাই ওকে ওনার সাথে নিয়ে যাবে।ওর জীবন পরিবর্তন হয়ে যাবে বুঝতে পারছিস নিশাদ?হুমায়রার তখন জীবনে চলতে কোন পুরুষ লাগবেনা।ও একাই থাকতে পারবে।"
নিশাদ মৃদু হেসে বলল,
''বিভান ভাই আসলেই অনেক বড় চিন্তা মুক্ত করল জানিস।"
ইমতিয়াজ মাথা ঝাঁকালো।তারপর কি যেন ভেবে বলল,
''আচ্ছা হুমায়রার সাথে যে এমন করেছে তাকে খুঁজার চেষ্টা করছিস না তোরা?"
নিশাদ বলল,
''দেখ এখন হুমায়রা তেমন স্বাভাবিক হয়নি।ওকে ওসব জিজ্ঞেস করাও ঠিক হবেনা।ও ঠিক হয়ে নেক তারপর না হয় জানতে চাইবো ও দেখেছিলো কিনা।"
''সেটা ঠিক তবে তোদের উচিৎ এখন থেকে খোঁজ খবর নেয়া।ওদের শাস্তি হওয়া উচিৎ নিশাদ।যেটা হুমায়রার সাথে হয়েছে সেটা আরো অনেক বোন মায়ের সাথে হতে পারে।"
নিশাদ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
''ঠিক বলেছিস।এখন?"
''চিন্তা করিসনা তুই ওকে সময় দে।আমার এক বড় ভাই কে দিয়ে খোঁজ নেয়াচ্ছি।তুই ভাবিস না আমি তোকে জানাবো খোঁজ পেলে।"
নিশাদের চোখজোড়া ছলছল করে উঠে।ইমতিয়াজের হাত ধরে বলল,
''বড় চিন্তা মুক্ত করলি ইমতিয়াজ।তোর জন্য কি করবো বল?কিছুই করতে পারিনি তোর জন্য।তুই সব করলি আমার জন্য।"
নিশাদের পিঠে চাঁপড়ে ইমতিয়াজ বলল,
''কি করিসনি বল?সব করেছিস।আমার জীবনে আছিস তুই।আমার বোনকে কতো ভালবাসিস।বাবা মারা যাওয়ার পর ইদ্রিকে সময় দিয়ে কতোটা হেল্প করেছিস ভাবতে ও পারবিনা।"
নিশাদ এগিয়ে এসে ইমতিয়াজ কে জড়িয়ে ধরে।দুবন্ধুর চোখজোড়া ভরে আসে সুখের অশ্রুতে।কিছুসময় পর সরে আসে ইমতিয়াজ।চোখ মুছে বলল,
''তোকে না জানিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি।"
নিশাদ চোখমুছে মৃদু হেসে বলল,
''কি করেছিস এমন?"
ইমতিয়াজ চুপ করে।ওর কেমন যেন বোধ হচ্ছে তমার কথা বলতে।তবে বন্ধুকে না বলে থাকতে ও পারবেনা।তাই বলল,
''ব্যাপারটা হলো তমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''মানে?"
''হুম।ও আমাকে ইন্টার থেকে ভালবাসে।সেটা আমার অজান্তে।যেদিন সাঁঝের বিয়ো হলো সেদিন ওর বাসায় গিয়ে ওর একটা ডায়েরী পেলাম। সেখান থেকে জানতে পারলাম এসব।আর তাছাড়া তমা আমাকে মানসিক ভাবে অনেক সাপোর্ট করেছে।এটা সত্যি সাঁঝকে ছেড়ে আর কাউকে সেভাবে ভালবাসতে পারবোনা।কিন্তু দেখ তমা জীবনে সব হারিয়েছে।কাছে পেয়ে ও আমাকে কখনো জানতে দেয়নি ও আমাকে ভালবাসে।আর আমি ও বুঝতে পারলাম তমাকে আমার প্রয়োজন।ওর ভালবাসা আমার প্রয়োজন।আমাকে ও তমার প্রয়োজন তাই মনে হলো দুজনে যদি এক হয়ে যাই তাহলে হয়ত খারাপ হবেনা।"
কথা গুলো বলার মুহূর্তে ইমতিয়াজের গলা কাঁপছিলো।নিশাদ হেসে বলল,
''খুব ভালো ডিসিশান।তবে তমাকে জানিয়েছিস?"
ইমতিয়াজ ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল,
''বলেছিলাম।জানিস অনেক খুশি হয়েছে ও।আমি জানি ওকে কখনো ভালবাসতে পারবোনা তবে চেষ্টা করে যাবো ওকে পরিপূর্ণ সম্মান দেয়ার। "
নিশাদ হেসে বলল,
''খুব ভালো লাগছে শুনে।তমা মেয়েটা খুব ভালো। দুজনেই ভাল থাকবি।"
''হুম।আর তুই একবার বাসায় আসিস।আমি ইদ্রিকে বুঝিয়ে বলবো। "
নিশাদ উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় মুহূর্তে ইমতিয়াজকে আরো একবার জড়িয়ে ধরে।ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেলে নিশাদ কাজে মন দেয়।সেদিন নিশাদের অফিস থেকে বেরিয়ে ইমতিয়াজ ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।ঘরে পৌছে সেই পরিচিত বড় ভাইকে কল দিয়ে হুমায়রার ব্যাপারটা পুরো জানিয়ে দেয়।সেই বড় ভাই পেশায় পুলিশের একজন ইনভেস্টিগেটর। সে জানালো তারা কার্যক্রম শুরু করবে তবে হুমায়রার সাহায্য দরকার হবে তাদের।তবে হুমায়রার ঠিক হওয়া পর্যন্ত ওরা নিজেরা কোন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবে।ইমতিয়াজ কল কেঁটে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার বাহিরে তাকায়।
......................এদিকে সেদিন অফিসে পৌছে প্রিয়াশা আর আদনান যে যার কেবিনে প্রবেশ করে।যাবার মুহূর্তে প্রিয়াশাকে বেশ উত্তোজিত দেখাচ্ছিলো।আদনান নিজের কেবিনে এসে কাজ করতে থাকে।লাঞ্চ টাইমে আদনান প্রিয়াশাকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় চলে আসে।প্রিয়াশার খাওয়ার মুহূর্তে আদনান দেখলো ওর হাত কাঁপছে।আদনান ওর হাত ছুঁয়ে বলল,
''তোমার কি হলো?"
''আসার আগে স্যার জড়িয়ে ধরেছিলো।আমার খুব ঘেন্না লাগে জানেন।খুব খারাপ লাগে আমি পারছিনা আদনান।"
আদনান প্রিয়াশার হাত ধরে বলল,
''দেখ চিন্তা করোনা।আজকের পর থেকে কিছু করতে পারবেনা ওনি।"
বলেই আদনান প্রিয়াশার হাতে ছোট্ট স্পীকার ধরিয়ে বলল,
''এখন তুমি রুমে গিয়ে এটা ওনার কাপড়ে লাগিয়ে দেবে।এর ওনি যাই তোমাকে বলবে সেটা সবাই শুনতে পারবে।তখন সবাই জানতে পারবে ওনি কতোটা চরিত্রহীন।তোমার কাজ শুধু এতোটুকুই এরপর যা করার আমিই করবো।"
প্রিয়াশা স্পীকার টা হাতে নিয়ে বলল,
''আমি পারবো আদনান?"
আদনান ওর দুবাহু চেঁপে ধরে বলল,
''কেন পারবেনা? অবশ্যই পারবে পারতেই হবে।"
''হুম।"
লাঞ্চ সেড়ে রুমে চলে আসে প্রিয়াশা।তখনই স্যার রুমে আসেনি।প্রিয়াশা স্পীকারটা হাতের মুঠে রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
ভয় আর উত্তেজনায় ওর শরীর কাঁপছে।হঠাৎ ডোর খুলে বস এসে বললেন,
''ওহ ডার্লিং তুমি এসে গেছো?"
প্রিয়াশা রেগে বলল,
''স্যার এসব বলবেননা।আমার হাসবেন্ড আছে।"
''আরে বেবি হাসবেন্ড তো ঘরে আর বাহিরে ও তো ইন্জয় করতে হবে তাইনা বলো?"
বস এসে প্রিয়াশার গালে চুমু দিতে চেষ্টা করেন।প্রিয়াশা সুযোগ বুঝে কোটের কলারের নিচে স্পীকার ঢুকিয়ে দেয়।বস বলল,
''জানু আসো বেবি একটা কিস দাও।আদনাকে তো ঠিকই কিস করতে দাও।আর আমি চাইলে দোষ?প্লিজ প্রিয়াশা।"
প্রিয়াশা জোরে বলল,
''স্যার প্লিজ।এমন করবেননা।খুব খারাপ হবে।"
''প্রিয়াশা কাল আমার সাথে যখন যাবে তখন তো তোমাকে চেঁটে পুটে খাবো।তখন তো আর কেউ থাকবেনা তোমাকে রক্ষা করার মতো।তোমার স্বামীওনা।প্রিয়াশা ওনাকে ছাড়িয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।বস ও বেরিয়ে এলো প্রিয়াশার পিছুপিছু।দেখলেন সবাই দাঁড়িয়ে আছে।সেই সাথে আদনান ও।সবার মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন আর আদনানের চেহারায় রাগ।আর ওর পিছে প্রিয়াশা দাঁড়িয়ে কাঁদছে।ওনি বললেন,
''কি হলো কাজ বাদ এখানে কেন আপনারা?আদনান আপনি ও কাজে যান।প্রিয়াশা আপনি আসুন।"
আদনান এবার মুখ খুলল।শক্ত মুখে বলতে লাগলো,
''স্যার কি মনে করেছেন আমাদের চোখ কে ফাঁকি দিয়ে আপনি এসব নোংরামী করবেন আর আমরা কিছুই বুঝবোনা?এমন কিছুইনা স্যার।আমরা সব জেনে গেছি।আপনি নিজের ঘরে স্ত্রী রেখে অফিসের মহিলা এমপ্লয়িদের সাথে বেয়াদবি করেন।আর এখন আমার স্ত্রীকে ও ছাড়েননি।"
বস রেগে বলল,
''এসব কি আজেবাজে বকছেন আদনান।যা ভাবছেন এমন কিছুইনা।আপনার স্ত্রী নিজের ইচ্ছায় আমার কাছে এসেছে।সো আমাকে না বলে আপনার স্ত্রীকে বলুন।"
আদনান বলল,
''স্যার দোষ টা কার সেটা আমি জানি কারন শুধু আমার স্ত্রী প্রিয়াশাই নয় আয়া থেকে শুরু করে বাবুর্চি খালাকে ও ছাড়েননি আপনি।এমন কি এখানকার সব মেয়েদের গায়ে হাত দেন আপনি।কেউই এতদিন বলতে পারেনি কারন চাকরী হারানোর ভয়ে।তবে আজ আমরা চুপ থাকবোনা।"
''শুনেন মিঃআদনান মেয়েরা ভোগের জন্যই।আমি সবাইকেই আমার বিছানায় নিবো।পারলে আপনার মা বোনকে ও।কি করবেন আপনি?"
এবার আদনান রেগে গিয়ে স্যারকে চড় থাপড় ঘুষি মারতে থাকে।তারপর কিছুসময়ের জন্য থেমে প্রিয়াশাকে বলল,
''তুমি কিছু করবেনা?"
প্রিয়াশার চোখে পানি।দৌড়ে এসে লাথি ঘুষি মেরে দেয় অনেক গুলো।তারপর পিছনে ফিরে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
''আপনারা কিভাবে চুপ আছেন?কিছু বলছেননা কেন?এটাই কি আমাদের সমাজ?অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারছেননা?আজ এখানে আমি ছিলাম কাল অন্য কেউ থাকবে।সেখানে আপনার স্ত্রী বোন ও থাকবে।তখন ও কি আপনারা চুপ থাকবেন?"
হঠাৎ আয়া আর বাবুর্চি খালা এসে বললেন,
''না আইজ এরে মাইরাই ফালামু।"
বলে ওনারা এসে মারতে লাগলেন খুন্তি আর ঝাড়ু দিয়ে।সাথে সাথে সবাই মারতে লাগলো। প্রিয়াশার চোখে পানি চলে এসেছে।ওর খুব ভাল লাগছে।এতদিন পর এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হতে দেখে।কিছুক্ষন পর সবাই ধীরে ধীরে সরে আসতে থাকে।স্যার মাটিতে গড়াচ্ছে।আয়া খালা আরো লাথি মারছিলেন।।আদনান বলল,
''খালা হয়েছে।এবার পুলিশ আসবে একটু পর।ওনাকে নিয়ে যাবে।"
সবাই ক্ষান্ত হলো।তারপর কিছুসময় পর পুলিশ এসে বসকে ধরে নিয়ে যায়।বস যাবার সময় বলছিলেন,
''তোকে দেখে ছাড়বো।"
পুলিশ বলল,
''এমন মার মারবো সব ঝাঁঝ চলে যাবে।আর হয়া সবাই বেরিয়ে আসুন।অফিস বন্ধ করে দিবো।"
বলে উঠে পুলিশ কর্মকর্তা।সবাই বেরিয়ে এলো।পুলিশের একজন সদস্য অফিসে সিলগালা লাগিয়ে দিলো।
পুলিশ যেতেই সবাই বলতে লাগলো খুব ভাল হয়েছে।তবে সবার একটাই চিন্তা এখন কি করবে?কারন অনেক ঝামেলা করেই যাও একটা চাকরী পেয়েছিলো।এমন বদমাশ বসের কারনে সেটাও গেলো।সেই সাথে আদনান ও কিছুটা চিন্তায় পড়লো তবে প্রিয়াশাকে বুঝতে দেয়নি।

!!!!

সেদিন ঘরে ফিরে আদনান প্রিয়াশা কিছুই বলেনি কাউকে।কি বলবে ওরা?কিভাবে বলবে ওদের অফিস বন্ধ হয়ে যাবার কথা?প্রিয়াশা ঘরে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে পাকঘরে চলে আসে রান্না দেখতে।বেলা রান্না করছে আর হুমায়রা পাশে দাঁড়িয়ে আছে বেলার।প্রিয়াশাকে দেখে বেলা হেসে বলল,
''চলে এসেছো?খাবে কিছু?"
প্রিয়াশা ম্লান দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।চোখের কোনে অশ্রু জমে।মানুষ গুলো জানবে ওদের চাকরী নেই কতো কষ্ট পাবে।ভাবতেই বুক ফেঁটে যাচ্ছে প্রিয়াশার।প্রিয়াশাকে চুপ দেখে বেলা বলল,
''কথা বলছো না যে?কিছু হয়েছে?"
বেলার কথায় নড়ে উঠে প্রিয়াশা।চোখ মুছে নেয় চটজলদি।তারপর বলল,
''না আপু কিছু না।কি রান্না হচ্ছে?"
বলেই এগিয়ে আসে প্রিয়াশা রান্না দেখার জন্য।বেলা মৃদু হেসে বলল, 
''মাংস রান্না হচ্ছে।সাঁঝ সাইমন আর ওর ননদ টা আসবে।পোলাউ হয়ে গেছে সবজি ও রান্না শেষ।"
প্রিয়াশা বলল,
''তাহলে আমি সালাদ কেঁটে দিচ্ছি।"
বেলা হেসে জানায় ঠিক আছে তবে বেশি করে কেঁটো।তোমার দুলাভাই খুব পছন্দ করে সালাদ।পাশ থেকে প্রিয়াশা মৃদু স্বরে বলল,
''হুম ভাইয়া ভাত একদম অল্প খায়।সালাদ টা মনে হয় বেশ পছন্দ ওনার।"
বেলা হেসে বলল,
''ওনি এমনই আগের থেকে।খাওয়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন।"
প্রিয়াশা হেসে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলল,
''সেজন্যই বলি ভাই এখনো এতো হ্যান্ডসাম কিভাবে?"
বেলা কন্ঠ চিনতে পেরে পিছনে তাকিয়ে দেখলো সাঁঝ হাসছে।বেলা বের হবার আগেই সাঁঝ এসে জড়িয়ে ধরে বোনকে।বেলা ঠিক মতো জড়িয়ে নিতে পারেনি বোনকে।বলছিলো, 
''কেমন আছিস?"
''ভালো আপা..... তোর কি খবর?"
''ভালো।আচ্ছা আমি হাত ধুয়ে কথা বলছি।"
সাঁঝ সরে এসে প্রিয়াশাকে বলল,
''ভাবি কেমন আছো?"
''ভালো।তুমি কেমন আছো আপু?"
''ভালো ভাবি।"
প্রিয়াশা হেসে মাংস নাড়তে থাকে আর সাঁঝ হুমায়রাকে নিয়ে চলে যায়।ঘরটা আবার ও পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।বেলা পাকঘরে এসে বলল,
''প্রিয়াশা আঁচটা কমিয়ে ঢাকনা দিয়ে চলে এসো।"
''জি আপু।"
প্রিয়াশা নাড়া বন্ধ করে চুলার আঁচ কমিয়ে পাতিলে ঢাকনা দিয়ে বেরিয়ে আসে।আদনান,বিভান সাঁঝ,সাইমন,হুমায়রা লাবনী গল্প করছে।কুঞ্জন বাহিরে গেলো কোক স্প্রাইট আনতে।নিশাদ এখনো আসেনি ঘরে।
সবাই খেয়াল করলো আদনান প্রিয়াশা তেমন কথা বলছেনা কেমন চুপচাপ হয়ে আছে।সাঁঝ বলল,
''ভাই তোর আর ভাবির কি হয়েছে?"
আদনান হাসার চেষ্টা করে বলল,
''আরে কই?ঠিক আছি।"
বেলা বলল,
''অফিসে কি তোদের অনেক চাঁপ?"
আদনান মাথা ঝাঁকায়।এমন মুহূর্ত আজ সত্য কথাটা বলে নষ্ট করতে চাইছেনা।কিছুদিন কাঁটিয়ে দেবে ওরা এভাবে।তারপর নাহয় সুযোগ পেয়ে বলে দেবে।ভেবেই আদনান বলল,
''মিষ্টি নিয়ে আসি আমি।তোরা থাক।"
বেলা হেসে বলল,
''আচ্ছা যা।"
হঠাৎ পাশের বিভান বলল,
''চলো আমি ও যাই।"
আদনান বলল,
''না ভাই আপনি থাকেন।আমি আসতেছি কিছুক্ষনের মাঝে।"
বিভান বারবার যেতে চাওয়া সত্ত্বে ও আদনান একাই চলে যায়।ও একটু থাকতে চাইছে এ মুহূর্তে। ভীষন কষ্ট হচ্ছে আজ।যে দেশের সামাজিক, নৈতিক অবস্থা এমন সেখানে চাকরী টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে।চোখের কোনা গড়িয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ে দুফোঁটা।রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় লেগে পড়ে আদনান।এদিকে কিছু ঘন্টার মাঝেই নিশাদ চলে আসে ঘরে।ছোট বোনকে দেখে মন টা বেশ ভালো হয়ে যায় ওর।জুলেখা বানুকে বেশ খুশি দেখা যাচ্ছে মেয়ের আগমনে।নিশাদ আসতেই বললেন,
''আব্বা যা গোসল কইরা আয়।সাঁঝেরা আইছে।"
নিশাদ হেসে বলল,
''আচ্ছা।"
তারপর সাইমনের দিকেমুখ ঘুরিয়ে বলল,
''কেমন আছো সাইমন?"
''এই তো ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?"
''আছি ভাই আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।কথা বলবো।"
নিশাদ মৃদু হেসে বলল,
''আচ্ছা বসো।"
নিশাদ রুমের পথে পা বাড়ায়।প্রিয়াশা সবার জন্য চা বানাচ্ছে।পূর্না ঘুম থেকে উঠে সাঁঝকে দেখে ওর খুশির সীমানা নেই।দৌড়ে এসে খালার কোলে উঠে বসে।তারপর অসংখ্য চুমু দিয়ে ভরে দিতে দিতে বলল,
''কেমন আতো কালামনি?"
সাঁঝ ভাগনীকে চুমু দিয়ে বলল,
''ভালো আম্মু।তোমার কি খবর সোনা?"
''বালো।তোমাকে দেকে বালো লাগতে।"
সাঁঝ ভাগনীকে কোলে নিয়ে বসে ভাই বোন আর দুলাভাইয়ের সাথে গল্পে মন দিলো।মিষ্টি কিনে ফিরে আসে আদনান।মিষ্টির প্যাকেট গুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে প্রিয়াশাকে দেখলো ফল কাঁটছে।স্বামীকে দেখে প্রিয়াশার বুকটার ভেতর কেমন করে উঠে।চোখ গুলো কেমন হয়ে আছে তার।কিছুটা ফুলে আছে।নিশ্শচই কেঁদেছে সে।প্রিয়াশা কিছু বলতে গিয়ে ও পারলোনা।আদনান হঠাৎ ক্ষীনস্বরে বলল,
''কাউকে বলোনা এখন.......মুখে ও এনোনা।আমি সুযোগসমেত বলবো।"
প্রিয়াশা মন খারাপ করে বলল, 
''আমাকে পাগল মনে হয়?কেন বলবো বলুন?সবার কতো কষ্ট হবে শুনলে।আর এখন মেজ আপু এসেছে।কেন বলবো ওসব?"
আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
''এখানে দুই কেজি মিষ্টি।সবাইকে দিয়ে ফ্রিজে রেখে দাও। "
''জি আচ্ছা।"
সেখান থেকে সরে এসে বাথরুমে চলে যায় আদনান অন্তত এমন অবস্থায় কারোর সামনে যেতে পারবেনা ও। প্রিয়াশা ফল আর মিষ্টি নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসে।এখানে সবাই বসে আছে।
..............................সেদিন সন্ধ্যার চা শেষ করে মায়ের দিকে তাকায় ইমতিয়াজ।মাকে খুব অসুস্থ দেখায় আজকাল।তেমন খাওয়া দাওয়া ও করেনা।শুধু কান্না করে জায়নামাজে বসে।সেদিন খালা বলছিলেন মা নাকি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো ওনি এসে সামলেছেন মাকে।ইমতিয়াজ ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল,
''আম্মা তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।কি অবস্থা করে রেখেছো নিজের দেখলে?"
সৈয়দা বেগম চোখজোড়া মুছে বললেন,
''বাবা আমার কথা না ভেবে মেয়েটার দিকে তাকা।আমার আর ভালো লাগেনা ওর এই মলিন দৃষ্টি আর কষ্ট।নিশাদ আসেনা কেন আর?মেয়েটার কতো কষ্ট হচ্ছে সেটা দেখতে পারি আমি।আমার মেয়েটা কেমন হয়ে গেলো এটা কি তোর বন্ধু দেখেনা?"
ইমতিয়াজ বলল,
''মা ওর বাসায় একটা প্রবলেম হয়েছে।যার কারনো বাসার সবাই একটু ভেঙ্গে পড়েছে।আর তুমি জানোই নিশাদ ওর পরিবারের প্রতি কতোটা দায়িত্ববান। তাই ও চাইছে পুরো পরিবারটাকে সামলে তারপর আসতে।"
সৈয়দা বেগম কেঁদে উঠেন নিঃশব্দে।বলতে লাগলেন,
''আমি তো বুঝি বাবা ও বড় ছেলে পুরো পরিবার সামলায়......... কিন্তু আমি তো মা আমার চিন্তা হয় মেয়েটাকে নিয়ে। কতো কষ্ট পাইতেছে।কি করবো বল?মায়ের মন তো.........."
ইমতিয়াজের ভীষন খারাপ হয়ে যায় মন।কিছু না বলে উঠে আসে মায়ের সামনে থেকে।কি যেন ভেবে হাঁটতে শুরু করে ইদ্রির রুমের দিকে।দরজাটা হালকা চাঁপানো।ভেতর থেকে কোন শব্দ আসছেনা।আগে যেমন রুমের আসলে গানের শব্দ পেত হালকা পায়ে নাচের শব্দ আসতো।এখন তা আর আসেনা।এখন মনে হয় রুমটা খালি পড়ে আছে।ভেবেই বুকের গভীরে কেমন যেন করে উঠে ইমতিয়াজের।দরজায় নক করতেই ভিতর থেকে ইদ্রির রুমের আলো জ্বলে উঠে।বলল,
''আসো।"
ইমতিয়াজ দরজা খুলে ভিতরে আসে।ইদ্রি খাটে বসে আছে।খোলা চুল গড়িয়ে পানি পড়ছে।ইৃতিয়াজ ওর পাশে বসে বলল,
''কি করছিলি?"
ইদ্রি মৃদু হেসে বলল,
''কিছুনা ভাইয়া।বল....."
''নিশাদের সাথে দেখা করলাম আজ।"
ইদ্রি চোখ তুলে তাকায় ভাইয়ের দিকে।কাঁপানো কন্ঠে বলল,
''কি বলল ওনি?কেন আসেনা?"
ইমতিয়াজ ছোট বোনের দুটো হাত হাতে নিয়ে বলল,
''খুব বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে ওদের জীবনে।
ওর ছোট বোন হুমায়রাকে চিনিস?"
''জি।কি হয়েছে আপুর?"
ইদ্রির কন্ঠে আতঙ্কের সুর।ইমতিয়াজ বলল, 
''কিছু ছেলে ওকে রেপ করার চেষ্টা করে।তখন ওদের বড় দুলাভাই না গেলে আরো বড় দূর্ঘটনা হতে পারতো।তাই নিশাদ ভেঙ্গে পড়েছে।সবার খুব মন খারাপ।বুঝতেছিস তো এমন একটা ঘটনায় পরিবারের ওপর কি যায় তখন?"
ইদ্রির চোখে পানি চলে আসে।বলতে লাগলো,
''তাহলে হুমায়রা আপু ও ভালো নেই।"
''এটা স্বাভাবিক ইদ্রি।তাই নিশাদ আসছেনা।তারপর ও তুই ওকে কল দিস।কথা বলিস ওর সাথে।ওর ভালো লাগবে।"
ইদ্রি মাথা ঝাঁকিয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো।ইমতিয়াজ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যায়।সেদিন রাতে ডিনারের পর ইদ্রি ফোন হাতে নেয়।রাত বারোটা বাজে।এতক্ষনে হয়ত শুয়ে পড়েছেন ওনি।কিন্তু ইদ্রি কথা বলবে।কতোদিন লোকটার কথা শোনা হয়না ওর।ভীষন মনে পড়ে তার কন্ঠস্বর তার আদুরে কথা গুলো।ইদ্রি কল দেয় নিশাদের নম্বরে।কয়েকটা রিং হওয়ার পর কল কেঁটে পরক্ষনেই ফোন বেজে উঠে ইদ্রির।
দেরি না করে কল রিসিভ করে কানে রাখে ও।অপরপাশ থেকে নিশাদ বলল,
''ইদ্রি!!"
''আমার সাথে একটু দেখা করবেন প্লিজ।"
অপরপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই।কিছুক্ষন পর নিশাদ বলল,
''কোথায় যাবে?"
''যেখানে নিয়ে যাবেন।"
''আচ্ছা কাল দুপুরে রেডি থেকো।আমি আসবো।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন