বিয়ের একমাস কেটে গেল। শাদাব বাড়ি থেকে চলে যাবে। আরও কয়েকটা দিন ছুটি ছিল। কিন্তু তার বন্ধু নকিব জরুরী ভাবে যেতে বলেছে। শাদাব, নকিব,আর তোসার তিনজনেই শেয়ারের ব্যবসা করে ফ্রান্সে। শাদাব চলে যাচ্ছে শুনে সম্পূর্ণার কোনো অনুভূতি নেই। এই অনুভূতিহীন মানুষটার অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা কখনো করেনি শাদাব। শাড়ি আর গহনা পরে থাকলে অনুভূতি সৃষ্টি হয় না। জোর করে ভালোবাসায় অনুভূতি হয় না।এইতো কয়টা দিন আগের কথা। শাদাব টিয়া রঙের একটা শাড়ি এনেছিল। রংটার কথা ভাবলেই সম্পূর্ণার গা গুলিয়ে আসে। আর সেই রঙটাই শাদাব তার জন্য এনেছে।
সম্পূর্ণা শাড়িটা দেখে চুপ। মেয়েটার এমন পিনপতন নীরবতা দেখে শাদাব বলল," পছন্দ হয়নি?"
সম্পূর্ণা এবার সহজ হলো। আস্তে করে বলল," কালারটা যদি অন্য..."
মুখের কথা যেন মুখেই রয়ে গেল। তার আগেই শাদাব বলল," শাড়িটা একদিন পরে ঘর মুছবে। আর এটাই আমার অর্ডার!"
সম্পূর্ণা অবাক হয়ে," শাড়ি একদিন পরে ঘর মুছবো? এরচেয়ে বরং দোকানে দিয়ে কালারটা পরিবর্তন করা যায় না? শুধু শুধু টাকাটা অপচয়...!
-" তুমি আবার কথা বলছ? চুপচাপ শাড়িটা এখন পরবে। আর পরে আমার সামনে আসো।যাও!"
-" এখন?"
-" হ্যাঁ এখন।"
-" আম্মা বলেছেন উনাকে পানি গরম করে দিতে। বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। ছ্যাক দিবে মনে হয়।"
-" পানি একঘন্টা পরে হলে কিচ্ছু হবে না। ওকে তুমি শাড়িটা পরো আমি বড় ভাবিকে বলে আসছি।"
-" ভাবি! ছি ছি ভাবি ভাববেন আমি তোমাকে পাঠিয়েছি নিজে পারবো না বলে।"
-" ভাবুক তাতে আমার কী?"কথাটা বলে শাদাব বাহিরে চলে গেল।
ভাবনাটা শেষ হতেই দীর্ঘশ্বাস তার। শাদাব এসে," গোছানো শেষ? একটু পর আমাকে বের হতে হবে। যাওয়ার সময় কী আর বলব তোমায়! ফোন দিয়ে যাচ্ছি যদি শুনেছি আমি নেই বলে শরীরের জ্বালা মিটানোর জন্য ফোনে অন্য ছেলের সাথে কথা বলছ তাহলে পরেরদিন আমি বাড়িতে। আর আসলে কী অবস্থা হবে এটা তুমি খুব ভালোই জানো।"
সম্পূর্ণা স্থির হয়ে বসে রইল। কথাগুলো তার গায়ে লাগছে না। নির্বিঘ্নে তাকিয়ে আছে শাদাবের দিকে। সাদা শার্ট আর কালো কোটে তাকে বেশ লাগছে। ছেলেটা সুন্দর, খুব সুন্দর। ফর্সা, গালে খোচাখোচা দাড়ি চোখগুলো মেয়েদের মতো টানা, চুলগুলো সিল্কের মতো তবে সবগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণা ছোট বেলা শুনতো যার চুল নাকি খাড়াখাড়া সে নাকি খুব রাগী হয়। সম্পূর্ণা এই কথা বৃত্তিহীন ছাড়া কিছু ভাবে না। তবে আজ মনে কেন কথাটা নাড়া দিলো। হয়তো শাদাবকে দেখেই।
শাদাব রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে," তোমাকে কী এখনো বলেকয়ে সব করাতে হবে?"
কথাটা শুনেই সম্পূর্ণা ধীরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। সে অনুধাবন করলো তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। এইটা কী সিন্দুতে পরিনত হবে? আচ্ছা শাদাব এখন কী করবে? যাওয়ার সময়ও কী বলবে সম্পূর্ণা চলো না আর মাত্র একবার! কিন্তু মানুষটা জন্য মায়া হচ্ছে। এতক্ষণ তো হয়নি। এখন হচ্ছে কেন? ভাবতে ভাবতেই শাদাবের স্পর্শ পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। শাদাব তাকে জড়িয়ে ধরে মাথার উপরে থুতনিটা রেখে," স্যরি। এতদিন আমার জন্য এতকিছু সহ্য করার জন্য। আমি চেয়েছি তুমি শুধু আমার কথা ভাবো। বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে তুমি শুধু আমাকে নিয়ে থাকবে। তোমার চোখে, মনে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গে শুধু আমার ছোঁয়া থাকবে। আমি চাই না আমার ঘরে থেকে তুমি অন্য পুরুষের স্পর্শ অনুভব কর। আমি চেয়েছি শুধু যেভাবে হোক তোমার মনে দাগ লাগাতে। আমি জানি আমি বেশি করে ফেলেছি। সত্যিই স্যরি।"
সম্পূর্ণা হাউমাউ করে কেঁদে শাদাবের শার্ট খামচে ধরে যেন বুকের ভেতর মিশে যেতে চাইছে। এইভাবে যদি বিয়ের পর একবার বলতো তাহলে নিজেকে নিজে ঘৃণা করে ওর কাছে যেতে হতো না। একমুঠো ভালোবাসা হলেও নিয়ে দাঁড়াতাম ওর দরজায়। সম্পূর্ণার এমন কান্না দেখে শাদাব ভেবেছে সম্পূর্ণা হয়তো তার জন্যই কাঁদছে। সে ভেবেই কথা দিলো দুইমাস পর সে আবার আসবে। কথাটা শুনে সম্পূর্ণা অবাক হলো।এখনো গেলই না কিন্তু চলে আসার নাম নিচ্ছে। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে চোখমুখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। শাদাব সম্পূর্ণার কপালে এক টুকরো ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
কেটে গেল কয়েকটা দিন।
পিরিয়ড হচ্ছে না দেখে সম্পূর্ণা ভাবলো এমনিই হয়তো হচ্ছে না। এইদিকে মেজ ভাবি চলে যাবে লন্ডন। তাই সাইফুল ইসলাম সম্পূর্ণাকে নিয়ে গেলেন। শাদাবের মা হাসি মুখে সম্পূর্ণাকে বিদায় দিলেও ঘরে এসে বড় মেয়েকে বললেন," শাদাবের কল আসলে ফোনটা আমার কাছে একটু দিস।"
বড় বোন ইশরাত বলল," কেন মা?"
-" সম্পূর্ণা বাড়ি থাকলে সব কথা বলা যায়?তুই কতকাল এইবাড়িতে থাকবি? একটা ঘর দরজার তো ব্যবস্থা করতে হবে। শাদাব ফোন দিলে বলব আমি অসুস্থ টাকা দেওয়ার জন্য। সম্পূর্ণার সামনে বললে তো ও শাদাবের কাছে বলে দিবে।বুঝিস না?"
-" হ্যাঁ তা ঠিক বলেছ। ঠিক আছে ভাইয়া আগে কল দিক ।"
সম্পূর্ণা ওই বাড়িতে যাওয়ার যেন আনন্দে মুখরিত। সবাই আড্ডা হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেই দিন যাচ্ছে। তাবিয়া সম্পূর্ণার ঘরে আসছে ছাদে যাবে কি-না!সেই ফাঁকে কথা বলতে বলতে সম্পূর্ণা জানালো শাদাব যাওয়ার পর থেকেই তার পিরিয়ড হচ্ছে না।" তাবিয়া কথাটা শুনে বলল," কী বলিস? কনসিভ করিসনি তো আবার?"
সম্পূর্ণা সুরু চোখে তাকিয়ে, " কী বলছ?"
তাবিহা মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে," খুশির খবর মনে হচ্ছে। এককাজ করি তোর ইউরিন টেস্ট করলেই বুঝা যাবে। "
সম্পূর্ণা ভয়াতুর হয়ে তাকিয়ে আছে। তাবিয়া আবার বলল," তোর কী ইচ্ছে নেই?"
-" না মানে.."
-" বাবা মা শুনলে অনেক খুশি হবেন। আমি এখন কাউকে বলব না। সকালেই টেস্ট করিয়ে তারপর।"
পরেরদিন সকালেই তাবিয়া আর সম্পূর্ণা ক্লিয়ার হলো সম্পূর্ণা কনসিভ করেছে। তাবিয়া সম্পূর্ণাকে জড়িয়ে বলল,"শাদাবকে আগে খবরটা দে! আমি বাবা মা কে বলে আসছি।"
কথাটা বলে তাবিয়া দৌড়ে গেল। সম্পূর্ণা স্তব্ধ স্থির হয়ে আছে।খাটের কিনারায় বসে শাদাবকে ফোন দিলো।
শাদাব রিসিভ করে বলল," কী অবস্থা? বাপের বাড়ি এসে দেখছি আমার খবর নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছ?"
-" ভালো। একটা কথা ছিল।"
-" হ্যাঁ বলো।"
-" তুমি ফ্রি?"
-" মোটামুটি, বলো? তোমার কী কিছু হয়েছে? টাকা লাগবে?"
-" ধ্যাৎ তুমি টাকা ছাড়া কিছু বুঝ না?"
-" বউদের টাকা দিলে মাথা ঠান্ডা থাকে তাই বললাম। ঠিক আছে কী বলবে বলো?"
-" আমি কনসিভ করেছি!"
কথাটা শুনে শাদাবের শরীরে শীতল বাতাস যেন প্রবাহিত হয়ে গেল। সম্পূর্ণা কথাটা বলার সময় কোনো বনিতা করে নাই। মেয়েরা নাকি মা হলে লজ্জা পায়। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে।কিন্তু সম্পূর্ণা আলাদা সে জানে।তাই বলে এই ব্যাপারেও। শাদাব আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল," মাকে বলেছ?"
-" তোমাকেই প্রথম জানালাম।"
-" ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি।"
তারপর দুজনে কথা বলতে লাগলো। শাদাব আজ খুশি। বাবা হচ্ছে সে। সে ভাবেনি এত সকাল এমন একটা খবর শুনবে৷ তবে ভালো লাগছে তার।
সন্ধ্যায় যখন মা'য়ের কাছে ফোন দিলো মা খুশির খবর শুনার আগেই সম্পূর্ণার নামে নালিশ করতে লাগলো।
-" আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল, তুই যখন ছিলি তখন কী আমরা তোর বউকে দিয়ে কাজ করিয়েছি? সারাদিনই তো দুজনে রুমে পড়ে থাকতি। এখন তো তুই নেই।তাহলে রুমে সারাদিন কী করে? বউ মানুষ বাড়িতে কত লোকজন আসে। তাদের সাথে কথা বলবে আড্ডা দিবে তা-না সারাদিন সে রুমেই শুয়ে বসে কাটায়।"
শাদাব চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, " মা একটু সময় দেওয়া উচিত ওকে। আর বড় ভাবি বড় আপু তো আছে তারা কাজ করলেই তো হয়৷"
-" তোরা সবাই তো আমার মেয়েটাকেই দেখিস চোখে। একদিন তো চলে যাবে তখন আর তোদের জ্বালাতে আসবে না।"
শাদাব কথার প্রসঙ্গ পালটে বলল," মা সম্পূর্ণা কনসিভ করেছে। কথাটা বলার জন্যই ফোন দিয়েছিলাম।"
কথাটা শুনে ইয়াসমিন বেগম বললেন, "কী বলিস? কই সম্পূর্ণা তো আমাদের কিছু বলেনি!"
-" মা সেটা আজ সকালেই কনফার্ম হয়েছে। আর আমি বলেছি তোমাদের জানিয়ে দিব।"
-" ঠিক আছে আলহামদুলিল্লাহ। আমি ফোন দিয়ে খবর নিবো।এখন শুন আমি তো অসুস্থ কয়েকদিন থেকে। কিছু টাকা পাঠাতে পারবি?"
-" ঠিক আছে। কত টাকা লাগবে?"
-" ঢাকা গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করাবো। কোমরের খুব সমস্যা দেখাচ্ছে। লাখ দুয়েক হলেই হবে।"
-" ঠিক আছে পরশু টাকা পাবে। আমি রাখছি মা। আব্বাকে বলিও সম্পূর্ণাকে একবার দেখে আসার জন্য।"
ইয়াসমিন বেগম আর কিছু বললেন না। শাদাব ফোন রেখে দিলো।
সাইফুল ইসলাম খবরটা শোনার পর থেকে কতক্ষণ পর পর লুকিয়ে লুকিয়ে সম্পূর্ণাকে দেখছে। সেই ছোট্র সম্পূর্ণা। যখন প্রথম একটা দুটো করে শব্দ বলতো তখনই সে বা..বা বলতে শিখেছে। সাইফুল ইসলাম যত কাজেই থাকুন না কেন তাকে একবার কোলে নিতেই হতো। সাত মাস থেকেই বাবার সাথে তার অভিমান হতো। বাবা কাছে এলে যতক্ষণ না কোলে নিবে সম্পূর্ণা রাগ করে থাকতো। তাকাতো না তার বাবার দিকে। আর আজ সেই সম্পূর্ণা নিজে মা হচ্ছে। আল্লাহ" আপনি আমার মেয়েটাকে দেখে রাইখেন। অনেক কষ্ট করছে আমার মেয়েটা। আল্লাহ" শাদাবকে দিয়ে সব ভুলিয়ে দিও।
.
.
.
চলবে...............................