সন্ধ্যা সাতটা।ইতোমধ্যে ঘরটা একদম জমজমাট হয়ে গেছে। কিছুক্ষন আগে সাইমন সাঁঝ ও এসেছে।সাইমন আসতে চাইছিলোনা কারন দাদী আর মিতুল একা বাসায় তারওপর ওর নিজের ও অফিস আছে পর দিন।কিন্তু বিভানের কল আসে ওর কাছে যখন ও আর সাঁঝ ঘুরে বেড়াচ্ছিলো আর গল্পে মশগুল ছিলো।সাইমনের ভাষ্যমতে বিভান বলছিলো ওদের দ্রুত ঘরে ফিরতে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে সাইমনের সাথে।তাই আর না করতে পারেনা ও।চলে আসে স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে।কিন্তু এসে দেখলো বার্বিকিউ এর আয়োজন চলছে।কুঞ্জন মশলা পাতি বার্বিকউ স্টোভ নিয়ে হুড়োহুড়ি করছে।হুমায়রা পরোটা সেঁকছে।আর ইকরাম রাহমান মুরগী কেমন সাইজ হবে সেটা দেখাচ্ছে।আর লাবনী উনাকে বুঝাচ্ছে বার্বিকিউ এর জন্য মুরগীর কেমন সাইজ হয়।আর বেলা বিভানকে কোথাও দেখতে পেলোনা।সাইমন চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাঁঝকে বলল,
''বাসায় তো মনে হয় কোন আয়োজন চলছে।ভাই তো এমন কিছুই বলেননি।"
সাঁঝ ব্যাগ হাত থেকে রাখতে রাখতে বলল,
''সম্ভবত।ভিতরে গিয়ে দেখতে হবে।"
সাইমন সাঁঝের সাথে ভিতরে প্রবেশ করলো।ডাইনিং টেবিলে আদনান বসে ফোনে কথা বলছে আর প্রিয়াশা নাস্তা বানাচ্ছে।সাইমন কে দেখে কান থেকে ফোন সরালো আদনান। বলল,
''কেমন আছো সাইমন?"
''আলহামদুলিল্লাহ ভাই আপনি?"
''আলহামদুলিল্লাহ। বসো তুমি।"
সাইমন বলল,
''বড় দুলাভাই কই?"
আদনান ওকে টেনে বসিয়ে বলল,
''বড় ভাই তো একটু ব্যাস্ত।কেন?"
''আরে নাহ ওনি ডাকলো কি কাজে যেন।"
আদনান কি যেন ভাবলো।তারপর বলল,
''বাসায় আজ বার্বিকিউ হবে।তাই বোধহয় ডেকেছো আর ভাইয়ের ও হয়ত কাজ আছে।আসছো ভালো হয়েছে।সবাই মিলে মজা হবে।"
হঠাৎ জুলেখা বানু আসতেই সাইমন সালাম দেয় শাশুড়ীকে।জুলেখা বানু খুব খুশি হয়ে বললেন,
''সাইমন আব্বা ভালো আছোনি?তোমার দাদি কেমন আছে?"
''আলহামদুলিল্লাহ মা।আপনার কি খবর?"
''ভালো আব্বা।আদনান বৌ কই রে?"
আদনান একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
'''আম্মা ও পাকঘরে।"
জুলেখা বানু প্রিয়াশাকে ডাকতে ডাকতে পাকঘরে যাবার জন্য উদ্যত হলেন।সাইমন আদনানের সাথে কথা বলছিলো।এরই মাঝে বিভান বেরিয়ে আসে রুম থেকে।সাইমনকে দেখে বলল,
''চলে আসছো?কেমন আছো সাইমন?"
''আলহামদুলিল্লাহ ভাই। আপনার কি খবর?"
''ভালো।"
বিভান ওদের সাথে এসে বসে।সাইমন জিজ্ঞেস করলো,
''ভাই কিছু কাজ ছিলো আপনার।"
বিভান হাসতে লাগলো।তারপর বলল,
''আসলে কাজ তেমন কিছুনা।বাসায় ছোট্ট একটা বার্বিকিউ পার্টি।তুমি ছাড়া তো সম্পূর্ন হবেনা। তাই বললাম।"
সাইমন মৃদু হাসলো।এরই মাঝে ইকরাম রাহমান এসে সাইমন বিভান আর আদনানের হাতে তিনটা গোলাপ দিয়ে বললেন,
''তোমাদের জন্য আনলাম।"
সাইমন হেসে বলল,
''বাবা ভালোবাসা দিবসের গিফট?"
''না বাবা কোন কারন নাই এমনি। ওসব দিবস টিবস বুঝিনা।"
ইকরাম রাহমান ও ছেলে আর জামাইদের সাথে জয়োন হলেন।বেলা আর সাঁঝ গল্প করছে নিজেদের মাঝে।একটু পর হুমায়রাও এসে যোগ দিলো।আজ কাল নরমাল লাগছে বেশ ওকে।কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।ব্যাপার গুলো বাসার সবার খুব ভালো লাগছে।পূর্না ঘুমে মগ্ন।সারাদিন ঘুমোতে থাকে কিন্তু রাত হলে আজকাল ঘুমোতে চায়না।এরইমাঝে নিশাদ ঘরে প্রবেশ করে।ওকে কল দিয়ে বলা হয়েছিলো বার্বিকিউ পার্টি।তাই সাথে করে কোক স্প্রাইট নিয়ে এলো।ঘরে ঢুকে সাইমন আর বাকিদের সাথে কথা বলে বোনদের রুমে এলো।তারপর বেলাকে আলাদা ঘরে নিয়ে আসে।কারন হুমায়রা সাঁঝ ওরা কেউ ইদ্রি আর ওর সম্পর্কের ব্যাপারে জানেনা।তাই বেলাকে বলল,
'আপা ক্লিপ গুলো ইদ্রি পূর্নাকে দিয়েছে।আর এই চকলেট বক্স ওর জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু ও বলল ও পেয়েছে তাই তোদের জন্য পাঠিয়ে দিলো।তাই এগুলোর সাথে আরো কিছু চকলেট আনলাম সবার জন্য।"
ভাইয়ের কথায় কি বলবে বুঝতে পারছেনা বেলা।শুধু বলল,
''তুই নিয়ে ও এসেছিস?কেন?"
"আপা ও বলল তাই। "
বেলা বলল,
''ওর জন্য নিয়েছিলি ও নিলো না তাই নিয়ে আসলি?ওতো বলবেই এগুলো নিবেনা।তাই বলে নিয়ে আসবি।ও তো ছোট রে।তুই তো বড় কিভাবে নিয়ে এলি?"
নিশাদ মুখ শুকনো করে বলল,
''ফুল চুড়ি দিয়েছি। "
''তারপর ও চকলেট কার না পছন্দ।একটা কাজ কর।"
বলে উঠে বেলা।নিশাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
''কি আপা?"
''ওকে আর ইমতিয়াজ কে বাসায় ডাক।পারলে তোর সব বন্ধুদের। ইদ্রি আসলে ওর ভালো লাগবে।"
নিশাদ লজ্জা পেয়ে বলল,
''আপা ইদ্রি এসে কি করবে?ইমতিয়াজকে বলি।"
বেলা চড় উঠিয়ে বলল,
''চড় দেবো।ইমতিয়াজ কে কল দিয়ে বল ইদ্রিকে নিয়ে আসতে।"
নিশাদ স্মীত হেসে বলল,
''ওকে দিচ্ছি কল।"
বেলা হেসে বেরিয়ে এলো।জুলেখা বানু কে মেয়েরা জোর করে লাল শাড়ী পরিয়েছে।ওনি লজ্জায় শেষ।তার ভাষ্যমতে ঘরে বৌ আর জামাইরা আছে।তারা কি ভাববে।কিন্তু ওনার মেয়েরা কোন কথা শুনলোনা।মাকে জোর করে শাড়ী পরিয়ে চুলে খোপা বেঁধে দিলো তারপর ফুল লাগিয়ে দিলো খোপায়।এদিকে ইমতিয়াজ কে আসতে বলে রুম থেকে বের হয় নিশাদ।ইমতিয়াজ আসতল চাইছিলোনা কিন্তু বেলার চাঁপের কথায় রাজি হয়েছে।বলেছে বেশিক্ষন থাকবেনা সৈয়দা বেগম একটু অসুস্থ।এরই মাঝে প্রিয়াশা ঘর্মাক্ত শাড়ী বদলাতে রুমে ঢুকতেই আদনান ওর কোমড় জাপটে ধরে।আকস্মিকতায় কেঁপে উঠে প্রিয়াশা।একহাতে নিজের বুক অপরহাতে আদনানের শার্ট চেঁপে ধরে চিৎকার করতে যাবে তখনই আদনান ওর মুখ চেঁপে ধরে বলল,
''প্রিয়াশা আমি আদনান।"
চুপ হয়ে গেলো প্রিয়াশা।আদনান বলল,
''ঘাবড়ে গেলে?"
পাশে হাত বাড়িয়ে রুমের আলো জ্বালিয়ে প্রিয়াশা বলল,
''ঘাবড়াবোনা আবার?এভাবে কেউ ধরে?"
আদনান হেসে স্ত্রীর ওষ্ঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
''আজ প্রথম ভালবাসা দিবস বিয়ের পর।তাই ভাবছি কিছু না দিবো কি করে বৌকে?তাই এটা নিয়ে এলাম।"
বলে গাজরা ফুলের মালা তুলে ধরে প্রিয়াশার সামনে।খুশিতে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে প্রিয়াশার।মালা গুলো ছুঁয়ে বলল,
''এগুলো আমার?"
আদনান মাথা নেড়ে বলল,
''জি ম্যাম।"
প্রিয়াশা বলল,
''আগে পরিয়ে দিন খোঁপায়।এরপর শাড়ি পাল্টে নিবো।"
হেসে ফেললো আদনান।এরপর বলল,
''ঠিক আছে আসো।"
প্রিয়াশার খোঁপায় জড়িয়ে দিলো ফুলগুলো।এরপর প্রিয়াশা কাপড় পাল্টে নেয়।এদিকে লাবনীকে সাইমন আর বিভান দুজনে ছয়টা গোলাপ দিয়ে বলল,
''ছোট্ট শালীকে বুঝি কিছু দিবোনা?এটা কি হয়?"
লাবনী খুশি হলো আবার লজ্জা পেয়ে বলল,
''থ্যাংকস ভাইয়ারা।"
হুমায়রার ক্ষেত্রে ও ব্যাতীক্রম হয়নি।কিছুক্ষন পরই ওরা ছাদে উঠে যায় চুলা আর যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে।ইকরাম রাহমান স্ত্রীর গায়ে লাল শাড়ী দেখে খুব খুশি হয়েছেন।ছাদে এসেই নিশাদ চুলায় আগুন ধরাতে লেগে যায়।অন্যদিকে বেলা মাংস গুলো আবার ও মাখাতে থাকে।আগেই মাখানো ছিলো।এখন একটু নেড়ে দিচ্ছে।এরই মাঝে ইমতিয়াজ আর প্রিয়াশাকে দেখা গেলো।মাংস ও বসানো হয়ছে চুলায়।ইদ্রি এসে বেলাকে জড়িয়ে বলল,
''আপু কেমন আছেন?"
বেলা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
''ভালো। তোমার কি খবর?"
ইদ্রি সরে এসে বলল,
''ভালো আপু।বাবু কই?"
বেলা বলল,
"এখানেই আছে।সম্ভবত নিশাদের কাছে।দাঁড়াও দেখছি।"
ইদ্রি ওকে থামিয়ে বলল,
''আপু আমিই খুঁজে নিচ্ছি।এই সুযোগে সবার সাথে দেখা হবে।"
বেলা হেসে বলল,
''খুব মিষ্টি মেয়ে তুমি ইদ্রি।যাও দেখা করো।"
ইমতিয়াজ বেলা বিভানের সাথে গল্প করছিলো আর ইদ্রি নিশাদ আর পূর্নাকে খুঁজতে থাকে।
নিশাদ আর পূর্নাকে কে খুঁজতে গিয়ে প্রায় সবার সাথে দেখা হলো।ইদ্রি ভাবছে ওনি কই গেলো।হঠাৎ চোখ পড়লো ছাদের কোনায়।পূর্নার সাথে দুষ্টুমি করছে নিশাদ।পূর্না কি যেন বলছে ওর ভাষায় নিশাদ ওকে কিছু একটা বলছে পূর্না হাসছে সাথে নিশাদ ও।ইদ্রি ফোন বের করে নিশাদের নম্বরে কল লাগায়।এদিকে বিভান বেলাকে একা পেয়ে এক কোনায় এনে ওর হাতে দুটো চুড়ি দিয়ে বলল,
''কখনো কিছু দেয়নি বেলা।আর এখানে এসে তেমন আলাদাও পাইনি।তাই এই দুটো চুড়ি তোমার জন্য। দেখো ভালো লাগে কিনা?"
বেলার চোখজোড়া ভরে আসে।বলল,
''কি বলছেন?সব দিয়েছেন।আপনি আমার জীবনে আছেন।আমার আর কিছু চাইনা।"
বেলা এবার চুড়ি গুলো আলোয় এনে বলল,
''অসাধারন হয়েছে বিভান।থ্যাংক ইউ।"
বিভান একটু হেসে বলল,
''ধন্যবাদ দিওনা।শুধু এভাবে পাশে থেকো সারাজীবন।"
বেলা মাথা নেড়ে জড়িয়ে ধরে বিভানকে।বিভান বেলার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে।এদিকে ইমতিয়াজকে দেখে সাইমন আর সাঁঝ এগিয়ে আসে।ইমতিয়াজ খেয়াল করলো। সাঁঝ আগের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গেছে।ওর গায়ে হলুদ জামা।পাশে ওর হাসবেন্ড।সাঁঝকে দেখে অজান্তেই চোখ ভরে এলো সাইমনের।সাঁঝ এসে বলল,
''ভালো আছেন ভাইয়া?"
চোখ মুছে নেয় ইমতিয়াজ।হেসে বলল,
''আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?"
''ভালো।আন্টি কেমন আছেন?"
''একটু অসুস্থ মা।সাইমন কেমন আছো?"
সাইমন বলল,
''এইতো ভাইয়া।আপনি?"
''ভালো।"
সাঁঝ সাইমন কে বলল,
ওনি বড় ভাইয়ার বেস্টফ্রেন্ড ইমতিয়াজ ভাইয়া।"
সাইমন হেসে বলল,
''চিনেছি।"
ভাগনীকে আদর করার মাঝে ফোন আসে নিশাদের।ফোন বের করে দেখলো ইদ্রির কল।নিশাদ ফোন রিসিভ করো কানে দিতেই অপরপাশ থেকে ইদ্রি বলল,
''আপনার বৌ আপনাকে আর ছোট্ট মা টাকে খুঁজছে।একটু ডানদিকে ঘুরে তাকান।"
নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''মানে?"
''আরে তাকান তো।তাহলে বুঝবেন।"
নিশাদ পিছনে তাকিয়ে দেখলো সেই শাড়ীতেই আচ্ছাদিত ইদ্রি।তবে চুলের কোনায় গুঁজে রাখা গোলাপ আর হাত ভর্তি চুড়ি।পূর্না ইদ্রিকে দেখে খুশিতে হেসে উঠে।বলতে লাগলো,
''বলো মা এতেতে।মামা নামাও মামীল কোলে দাবো।"
ইদ্রি এসে ভাগনীকে কোলে নিয়ে চুমু দিলো।পূর্না নিজের চুলে লাগানো ক্লিপ দেখিয়ে বলল,
''এদুলো তুমি দিয়েতো?"
ইদ্রি আদুরে কন্ঠে বলল,
''হ্যা মা।তোমার ভালো লাগেনি?"
''কুব তুন্দল।ত্যাংক ইউ মামী।"
ইদ্রি ওকে আদর করতে থাকে।নিশাদ ওদের দেখছে।ওর ভীষন ভালো লাগছে।নিশাদ হঠাৎ বলল,
''পূর্নার জায়গায় আমি হলে খারাপ হতোনা।"
ইদ্রি অবাক চোখে নিশাদের দিকে তাকায়।হঠাৎ অজানা লজ্জা ঘিরে ধরে ওকে।ইদ্রি নিজেকে সামলে বলল,
''মানে বুঝলামনা।"
নিশাদ ইদ্রির চুলে হাত পেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
''ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে বিয়ে করে খুব আদর করি তোমাকে।"
ইদ্রি ধীর কন্ঠে বলল,
''না করেছে কে?আমি তো রাজি।করে নিন না।এই কাপড়েই আপনার বৌ হয়ে যাই।"
ইদ্রির কথায় হেসে ফেলে নিশাদ।বলল,
''শুনো ওর সামনে থেকোনা বেশি।ও মামী মামী করে ডাকলে সাঁঝদের সন্দেহ হতে পারে।"
ইদ্রি বলল,
''একদিন না একদিন তো ওনারা জানবেই।"
নিশাদ বলল,
''আমি চাইনা এভাবে জানুক।সবাইকে নিজেই বলতে চাই।কারন তোমার আমার সম্পর্কটা না নরমাল না।কারন বয়সের পার্থক্যটা।ব্যাপারটা সবার কাছে অন্যরকম লাগবে।"
ইদ্রি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রাজি হলো।তারপর ও পূর্নাকে নিশাদ বলেছিলো ইদ্রিকে দেখলে আন্টি বলে ডাকতে।পূর্না ও কি বুঝে মাথা ঝাঁকায়।তবে নিশাদের একটাই ভয় ছিলো না জানি পূর্না ইদ্রিকে মামী ডাকতে থাকে।তবে তেমন কিছুই হয়নি।বাবু হয়ত মামার সমস্যা বুঝেছিলো তাই দু একবার যাও দেখেছিলো ইদ্রিকে আন্টিই ডেকেছিলো।প্রায় দশটা পর্যন্ত পার্টি চলে সেদিন।খাবার শেষে সবাই নিচে নেমে আসে।ইমতিয়াজ ও ইদ্রিকে নিয়ে বেরিয়ে আসে।
!!!!
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় নিশাদ। বিছানার পাশটায় চোখ পড়ে ওর। এখানে একদিন ওর ইদ্রি থাকবে।ওকে জড়িয়ে ঘুমোবে।ওর দিকে মিষ্টি হেসে তাকাবে।আর নিশাদ ওকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে ছোট্ট চুমু দিয়ে বলবে ভালবাসি আমার ইদ্রি।মৃদু হাসে নিশাদ। তারপর পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আধঘন্টা আগে এসে থাকা একটি বার্তা।নিশাদ বার্তাটি বের করে দেখলো ইদ্রি পাঠিয়েছে।সেখানে ছিলো,
''আজ পয়তাল্লিশটা মিনিট আমার জীবনের বেস্ট সময় ছিলো। মূহুর্তের জন্য মনে হলো ওখানকার বড় বৌ হয়ে গিয়েছি।আন্টি যেভাবে বুকে টেনে আদর করলো,আঙ্কেল কতো কিউট করে কথা বলল।বিশেষ করে ওনি যখন ডাকলেন মা বলে মনে হচ্ছিলো বাবা কে দেখছি।বিশেষ ভাল লাগার মানুষটি হলো বেলা আপা।খুব আদর করে কথা বলেন।আর পূর্না বাবুতো লাখে এক।খুব শীঘ্রই আসতে চাই।প্লিজ নিয়ে যান আপনার ইদ্রিকে।সারাজীবন আপনাকে পাগল করে ছাড়বো।সারাক্ষন বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখবো।আচ্ছা এক কাপড়ে বৌ হয়ে আসাটা খুব চমৎকার হবে তাইনা?"
বার্তায় চোখ বুলাতে বুলাতে চোখজোড়া ভার হয়ে আসে নিশাদের।চোখের কোনা কেমন ভিজে এসেছে কেন যেন।সবসময় চাকরীর পিছনে দৌড়েছে।জীবনে সবসময় একটা লক্ষ্য ছিলো ভালো চাকরী পেয়ে পরিবারকে ভালো কিছু দেয়ার।তবে এখন মনে হচ্ছে ওর গন্তব্য ইদ্রি।এই মেয়েটাকে ওর চাই।খুব জলদি চাই। ভীষন ভালবাসতে চাই।মৃদু হেসে বার্তার উত্তর লিখতে থাকে নিশাদ,
''ম্যাডাম আপনাকে এক কাপড়ে আসতে হবেনা।আপনার এই অযোগ্য বরটা আপনাকে সুন্দর শাড়ী দিতে পারবে।হয়ত খুব বেশি দামী হবেনা তবে আপনার অযোগ্য ও হবেনা।মন তো চাইছে আপনাকে এখনই বৌ বানিয়ে আনি।অন্তত পাগল হতে ও আপনাকে লাগবে আমার।আমার বাড়ি মাতিয়ে তোলার জন্য লাগবে।আর ছোট্ট একটা ইদ্রির মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য হলে ও চাই আপনাকে।"
বার্তাটি পাঠিয়ে স্মীত হাসে নিশাদ।এদিকে নিশাদের এমন উত্তর ওদিকে লাজরাঙা হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে ইদ্রি।লম্বা চুল গুলো পিঠের ওপর এলিয়ে পড়েছে। বুকটা ভীষন ধকধক করছে।এত কাঁপছে!!!কাকে দেখাবে এই কাঁপুনি?লোকটা যে ভীষন লজ্জায় ফেলে দিলো ওকে।বদমাশ লোক একটা।ইদ্রি ফোনটা রেখে ভাবতে থাকে একদিন ওদের ও একটা ছোট্ট বাবু হবে।ওকে মা বলবে আর ওনাকে বাবা।আর সারাবাড়ি মাতিয়ে তুলবে।ইদ্রি নিজে নিজেই হেসে ফেললো।তারপর উত্তর দিতে বসে গেলো।বিভান রুমে ঢুকতেই নিশাদ ফোন রেখে হাসলো।বিভান অবাক হয়ে বলল,
''কিছু হয়েছে নিশাদ?"
মাথা নাড়ে নিশাদ।বলল,
'"না ভাই।আপনি শুয়ে পড়ুন।আপা কি করে?"
''ওরা ঘুমিয়ে।বড় ধকল গেলো সবার ওপর দিয়ে।"
নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে শোয়।বিভান খাটে বসে বলল,
''তা বিয়ে করছো কবে?বাবা খুব চিন্তা করে।বয়স হচ্ছে তো।"
বিভানের কথায় নিশাদ বলল,
''আব্বা এমন করে।আজ এই মেয়ে কাল ঐ মেয়ে।"
বিভান পিছনে তাকিয়ে একটু হাসলো।বলল,
''ওনি বাবা।চিন্তা করবেনই।তা কি প্রবলেম তোমার?বিবাহভীতি?"
নিশাদ মাথা নেড়ে একটু হেসে বলল,
''এমন কিছুনা।আসলে কুঞ্জন লাবনী ওরা এতো ছোট।"
বিভান শুয়ে বলল,
''তা ওদের বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করছো বুঝি?"
নিশাদ বলল,
''তেমন কিছুনা।আসলে......."
বিভান জোর দিয়ে বলল,
''দেখো আসলে নকলে বুঝিনা।বাবা আজ ও বলেছে আমাকে তোমাকে যেন বিয়ে দিয়েই যাই।আর আছে ছয়দিন।তোমার পছন্দের কেউ আছে?"
নিশাদ একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
''ভাই তেমন কিছুনা।আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত।আমি ও ঘুমোচ্ছি।"
বলেই বিভানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অপরপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে নিশাদ।
এদিকে রাতে আবার ও বার্তা আসে ইদ্রির।ও লিখেছে,
''ছিঃ কি সব বলেন?আমার কেমন যেন লাগে।মায়ের শরীরটা ভালো না।হঠাৎ কেমন যেন দূর্বল হয়ে পড়েছে।খুব ভয় লাগছে।"
বার্তাটা টা দেখে নিশাদের বুক কেমন করে উঠে।দ্রুত লিখে,
''চিন্তা করোনা।আন্টি ভালো হয়ে যাবেন।তুমি ঘুমাও।সকালে কলেজ আছে তো।"
এদিকে বেলার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পূর্না।সাঁঝ শুয়ে শুয়ে ওর গালে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
''আপা একটা কথা।কিভাবে বলি?"
বেলা পাশে তাকিয়ে বলল,
''বল?"
সাঁঝ বলল,
''এবার তোদের যাওয়াটা আটকানো যায়না?"
বেলা দেখলো সাঁঝকে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।মেয়েটা এমন কথা কখনো বলেনা।বেলা বলল,
''কি হয়েছে?"
সাঁঝ বলল,
''কিছুনা।যাসনা আপা খুব খারাপ লাগবে।"
বলতে বলতে সাঁঝের চোখ ভরে আসে।বেলা বলল,
''পাগল হয়ে গেছিস?বাচ্চাদের মতো কথা কেন বলছিস?আর ওখানে ওনার বিজনেস আছে। কথা তো হয়ই।আর ছয়দিন আছে আরো।এই ছয়টা দিন খুব আনন্দ করবো।"
সাঁঝ বলল,
''আপা আবার কবে আসবি?আমি জানি আসাটা অনেক কঠিন।বললেই আসা যায়না।তোকে খুব মিস করি।"
বেলার চোখ ভরে আসে।বোনকে কাছে টেনে নেয়।হঠাৎ অপর দুপাশ থেকে আরো দুটো হাত ওদের জড়িয়ে ধরে।লাবনী আর হুমায়রা ছিল।বেলা অনুভব করলো তিনজনেই কাঁদছে।বেলা নিজে ও কেঁদে ফেলে অজান্তেই।
এদিকে রাত পেরিয়ে সকাল হলো।অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে সবার।নিশাদ আর সাঁঝ রেডি হয়ে ডাইনিংটেবিলে বসলো সবে। রুটি দুবার মুখে নিয়েই বেরিয়ে যায় অফিসে যাবার জন্য।সাথে আছে লাবনী আর কুঞ্জন। আজকাল দুজনেই ওর সাথে চলে যায়।লাবনী আর কুঞ্জন কে নামিয়ে দিতেই নিশাদের ফোনে কল আসে ইমতিয়াজের নম্বর থেকে।নিশাদ ফোন রিসিভ করে জোরে বলল,
''হ্যা বল।আমি গাড়িতে আছি।"
অপরপাশে ইমতিয়াজকাঁদো গলায় বলল,
''আসতে পারবি?"
নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''সব ঠিক আছে?"
ইমতিয়াজ বলল,
''মা খুব অসুস্থ।তোকে ডাকছে প্লিজ বাসায় আয়।পারলে এক্ষুনি আয় নিশাদ।"
নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''আন্টি আমাকে ডাকছে?ওকে আসছি।চিন্তা করিসনা।"
বলেই কল কেঁটে চিন্তায় পড়ে যায় নিশাদ।ভাবতে থাকে আন্টি ওকে কেন ডাকলো হঠাৎ?নিশাদ ড্রাইভার কে গাড়ি ঘোরাতে বলে।
এদিকে অফিসের মাঝেই সাইমনের কল আসে সাঁঝের ফোনে। মিটিং চলাকালীন ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গিয়েছিলো সাঁঝ।ওর ফোন বেজে উঠায় সবাই ওর দিকে অবাক চোখে তাকায়।সাঁঝ মাথা নিচু করে মাফ চাইতে থাকে।মিটিং শেষে সাইমনকে কল লাগায় সাঁঝ।সাইমন বলল,
''কই ছিলা?"
সাঁঝ বলল,
''কিছু দরকার?"
''কেন দরকার ছাড়া বৌকে কল দেয়া যায়না?"
সাঁঝ নিজের রুমে ঢুকে বলল,
''আরে মিটিং চলছিলো।সবার সামনে কল চলে এলো।সাইলেন্ট করতে একে বারেই ভুলে গেছি।"
''ওকে ঠিক আছে।তা আমার কাছে জোস প্ল্যান আছে।"
সাঁঝ অবাক হয়ে বলল,
''কি?"
সাইমন বলল,
''আজ লাঞ্চ করো আমার সাথে। তখন বলবো।"
সাঁঝ একটু হেসে বলল,
''কখন কোথায়?"
সাইমন বলল,
''তোমাকে টেক্সট করছি।দেখে নিও।"
''ওকে।"
কান থেকে সরিয়ে নেয় ফোন তারপর তাকায় মোবাইলের স্ক্রীনে।
দুপুর একটা বাজে।সাঁঝ সাইমনের দেয় ঠিকানায় এসে পৌছোয়।দেখলো সাইমন মাঝের একটা চেয়ারে বসে।সাঁঝ গিয়ে ওর সামনে বসে পড়ে।সাইমন বলল,
''কেমন আছো?"
সাঁঝ হেসে বলল,
''ভালো তুমি?"
''ভালো।কি খাবে?"
সাঁঝ বলল,
''চাইনিজ।"
সাইমন হেসে ওয়েটারকে খাবার আনতে বলে সাঁঝের দিকে তাকায়।সাঁঝ বলল,
''কি বলতে?"
সাইমন সাঁঝের হাত জড়িয়ে বলল,
''অনেকটা দিন তো হলো।চলো না কোথাও যাই।"
সাঁঝ রেগে বলল,
"পাগল?আপারা চলে যাবে।আমি কিভাবে যাবো?"
সাইমন ভুলে যাওয়ার মতো করে বলল,
''ইস ভুলে গেলাম।কবে যাবে?"
''ছয় দিন পর।"
''ওহ আচ্ছা।তাহলে পরেই যাই।"
সাঁঝ হেসে সাইমনের হাত শক্ত করে ধরে।
......................ইদ্রি কলেজে যাবার সময় হঠাৎ সৈয়দা বেগম ঘুরে পড়ে যান।মায়ের চেহারাটা খুব খারাপ দেখায় আজকাল।যেন কথা বলতে ও ভীষন কষ্ট হয়।ইদ্রি দৌড়ে গিয়ে সৈয়দা বেগম কে ধরতেই দেখলো কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে হাত পা।ইদ্রি কেঁদে উঠে। চিৎকার করে ডাকতে থাকে,
''ভাইয়া ভাইয়া দেখ না মা কেমন হয়ে গেছে।"
ইমতিয়াজ নিজেই অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলো। বোনের ডাকে দৌড়ে নেমে আসে।ভীষন চিন্তা হচ্ছিলো ওর।মা এমনিতেই খুব দূর্বল হয়ে গেছে।ডাক্তার বলেছে মায়ের লিভারে সমস্যা।একটা এইটি পারসেন্ট ড্যামেজড আর অপরটা থার্টি পার্সেন্ট।ইমতিয়াজ কোলে করে মাকে রুমে নিয়ে যায়।জ্ঞান ফেরানোর পর মা বলছিলো,
''বাবা একটু নিশাদকে ডাক না।খুব দরকারি কথা আছে ওর সাথে। মায়ের কথায় ইমতিয়াজ আর একটা মুহূর্ত ও অপেক্ষা করেনি নিশাদ কে কল দিয়ে আসতে বলে।ইদ্রি মায়ের মাথার কাছে বসে কাঁদছিলো।বাবাকে হারিয়েছে কিন্তু মাকে হারাতে চায়না।অনেক বছর পর কাছে পেয়েছে মাকে।সবসময় মায়ের কাছেই থাকতে চায়।কিছুক্ষনের মাঝেই নিশাদ চলে আসে।মায়ের রুমে আসতেই ইদ্রি উড়না ঠিক করে।ইদ্রিকে একবার দেখে সৈয়দা বেগমের দিকে তাকায় নিশাদ।ওনাকে সালাম দিয়ে পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে ও।তারপর বলল,
''আন্টি আপনি ডেকেছেন আমাকে।বলেন কি বলবেন?"
খুব কষ্টে মুখ খুলে সৈয়দা বেগম।ক্লান্ত কন্ঠে বলতে লাগলেন,
''বাবা তোমাকে না বুঝে সেদিন অনেক খারাপ কথা বলেছিলাম। ওসব মনে রেখোনা বাবা।মা আমি তাই হয়ত বলে দিয়েছিলাম কারন চিন্তা হয় বাবা।"
ওনার এই কথায় নিশাদ বলল,
''আন্টি যা হবার হয়ে গেছে।আপনারা বড় আমাদের।আপনারা বলবেন নয়ত কে বলবে?"
সৈয়দা বেগম ওর হাত ধরে থামান।তারপর বললেন,
''আর হয়ত বেশিদিন বাঁচবোনা বাবা।তাই একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই বাবা।আমার মেয়েটা অনেক লক্ষী।কতো কমবয়সে ওর আব্বুকে হারালো।একদম পাগল হয়ে গেছিলো।কিন্তু বাবা আমার মেয়েটাকে বাঁচালে তুমি।ওকে স্বাভাবিক করে তুললে।তখন ও বুঝিনি আমি।কিন্তু ইমতিয়াজ যেদিন তোমার আর ইদ্রির সম্পর্কের কথা বলল আমি ভেবে নিয়েছি আমার মেয়েকে আর কেউ ভালো রাখতে পারবেনা তুমি ছাড়া।বাবা আমার কথা রাখো প্লিজ মেয়েটাকে বিয়ে করো।অন্তত মরে যাবার আগে ওর বৌ সাজটা দেখতে চাই।বাবা করবানা বিয়ে?তুমি ওকে তো অনেক ভালবাসো।আমি মা হয়ে বলছি বাবা।আমার মেয়েটাকে বিয়ে করো।"
সৈয়দা বেগমের কথায় চমকে উঠে নিশাদ।অপরদিকে ইদ্রিও অবাক।তবে মায়ের কথায় ভরে উঠেছে ওর দুটো চোখ।নিশাদকে চুপ দেখে সৈয়দা বেগম বললেন,
''বাবা কিছু বলো।এই মায়ের শেষ আবদার রাখবানা?"