ঝরা ফুলের কান্না - পর্ব ০৮ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


আতিকা বেগম মেয়ের এমন দৃশ্য দেখে যেন ভীমড়ি খেলেন। চিৎকার করে বললেন," সম্পূর্ণা! তোর এই দৃশ্য দেখার জন্য বেঁচে আছি আমরা?"
সম্পূর্ণা হিমেলের পা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হিমেলের এক হাত চেপে ধরে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আতিকা বেগম ধমক দিয়ে বললেন, " আয় বাড়ি আয়।"
সম্পূর্ণা বলল," না আমি যাব না। আমি হিমেলের কাছেই থাকবো। বরং তুমিই এইখান থেকে চলে যাও।"
মসজিদ থেকে মানুষ বেরিয়ে এমন কোলাহল দেখে এগিয়ে এসেছে। একেএকে সবাই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে।সাইফুল ইসলাম মেয়ের হাত টেনে আনতে যাবে তখন হিমেল বলল," ওকে নিলেই কী ওর মন থেকে আপনি আমার নাম মুছে দিতে পারবেন? আমি এতক্ষণ চুপ ছিলাম আপনার আসার অপেক্ষায়। একমাস আগে আপনি আমায় গ্রাম ছাড়া করেছিলেন লোক লাগিয়ে। আপনি কী ভেবেছেন লোক লাগিয়ে রাখলে আমি আর গ্রামে আসবো না? আপনার ধারণা ভুল।দেখুন আমি গ্রামে এসেছি কেউ আমার একটা বাল ছিড়তে পারেনি।"
কথাটা বলতেই সাইফুল ইসলাম হিমেলের গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে," আমি যদি চাইতাম না তোদের মা ছেলেকে এইখানেই পুঁতে ফেলতাম।শুধু করুণা করে তোদেরকে থাকতে দিয়েছি এইখানে।আর সেই তুই আজ আমার গলায় ছুরি ধরলি। সম্পূর্ণা চল এইখান থেকে। কত বড় বেয়াদব তুই নিজের চোখে দেখ। এরপরেও তুই ওর সাথে থাকবি?"
-" বাবা হিমেল কোনো অন্যায় করেনি। যা করেছে আমাকে ভালোবেসে করেছে। বরং তুমি অন্যায় করেছ ওদের উপর। তোমরা চলে যাও। আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই না। "
সাইফুল ইসলাম কিছু বলতে যাবে তখন আতিকা বেগম হাত ধরে বললেন," চলো এইখান থেকে। থাকুক ও এইখানে। তবে আজ থেকে এই সবার সামনে বলে রাখলাম তুই আমাদের কাছে মৃত। আমার কোনো মেয়ে নেই।"
সাইফুল ইসলাম টলমল চোখে বলল," আতিকা, তুমি পাগল হয়ে গেছ।মেয়েকে এইখানে রেখে যাবো?"
-" হ্যাঁ যাবো। এই ছাড়া তো উপায় নেই৷ তবে তুই একটা কথা মনে রাখিস, জীবনে যখনই পিছনে ফিরবি তখনই দেখবি তোর মা বাবাই তোর পাশে ছিল।তোর ভালো চায় বলে তোর সব ভুল মাপ করে দিয়ে নতুন করে বাঁচতে দিতে চেয়েছে। যা দুইদিনের ভালোবাসার মানুষ করে না। আর করবেও না। তাহলে কেন তুই আমাদের কষ্ট দিচ্ছিস? আমি জানি না তুই ভালো থাকবি কি-না। তবে আমি তোকে অভিশাপ দিব না। শুধু বলব মা কথাটা উচ্চারণ করিস না। তোর পরিবার তোর পাশে আজ থেকে আর দাঁড়াবে না।" কথাগুলো বলে তিনি সাইফুল ইসলামকে টেনে নিজের ঘরে গেলেন। সাইফুল ইসলাম এসে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। লামিয়ার শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাই এসে বুঝাছে। সাইফুল ইসলাম কোনো কথা বলছেন না। দম মেরে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ির দশ বছরের একটা ছেলে এসে," কাকীমা ও কাকীমা হুজুর আসছে সম্পূর্ণা আপুর বিয়ে পড়াতে। হিমেল ভাইয়ার বন্ধুরাও নাকি আসছে। "
আতিকা বেগম চুপ করে চোখের পানি মুছে নিচ্ছেন। সাইফুল ইসলাম বাহিরের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বলতে, " মা এই পঁচা কাজ করিস না। তুই ভালো মেয়ে হয়ে থাকলে তাহলে বাবা তোকে আরও ভালো খেলনা কিনে দেবো। কিন্তু মেয়েটার তো এখন আর খেলনার বয়স নয়। তাই হয়তো মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফেরাতে পারলাম না।

হুজুর বিয়ে পড়িয়ে গেলেন অনেকক্ষণ হয়ে গেল। সম্পূর্ণা স্থির হয়ে বসে আছে। রাত কিছুটা গভীর হয়ে এলো৷ হিমেলের মা আজ এই ঘরে ঘুমাবেন না।ঘুমাবেনই বা কী করে। একটা মাত্র চৌকি এই ঘরে। আগে মা ছেলে কোনোমতে ঘুমাতো।এখন ছেলের বউ হয়েছে।এইখানে তো আর ঘুমানো যায় না। তাই তিনি পাশের বাড়িতে গিয়ে রাত কাটিয়ে দিবেন ভেবে চলে গেলেন। হিমেল এসে সম্পূর্ণার পাশে বসে হাতটা ধরে আফসুস হচ্ছে?"
সম্পূর্ণা চোখ বড় বড় করে তাকালো তার দিকে। চোখগুলো ভেজা। চোখেমুখে অনুতপ্তের চাপ।
হিমেলের হাতদুটোকে শক্ত করে জড়িয়ে, " হিমেল,আমি ভুল করিনি তো? আমি তো যা করেছি তোমাকে পাবার জন্য করেছি। কিন্তু এখন কেন ইচ্ছে হচ্ছে বাবাকে একটা নজর দেখতে? বাবাকে জড়িয়ে বলতে বাবা আমাকে মাপ করে দাও। হিমেল আমি ভুল করেছি?"
হিমেল মুচকি হেসে সম্পূর্ণাকে নিজের কাছে টেনে বুকের সাথে লাগিয়ে," না তুমি কোনো অন্যায় কিংবা ভুল করোনি। তবে চিন্তা করো না। তোমার পরিবার একদিন ঠিক তোমায় মেনে নেবে।"
সম্পূর্ণা ভেজা গলায় বলল," তোমাকে নেবে না?"
-" তোমাকে নেওয়া মানে তো আমাকে। তাই না?"
সম্পুর্ণা আর কথা বাড়ালো না। আবেগের ভালোবাসা তাকে ঘিরে ফেলেছে।নিজেকে হারাচ্ছে হিমেলের ভালোবাসার কাছে।

রাত দুটো, সাইফুল ইসলাম জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। অঝর নয়নে গাল ভিজে যাচ্ছে। আতিকা বেগমকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছেন তিনি। নানায় বিনায় কান্না করে যাচ্ছিলো। মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসে সে। আমার কথা বাদ দিলাম। আমি পুরুষ মানুষ।মন পাথরে পরিনত করতে পারব কিন্তু আতিকা নিজেকে সামলাতে পারবে তো? আতিকা হয়তো ভুলে গিয়েছে বেশি ভালোবাসার জিনিস বেশি দিন টিকে না। সহজেই হারিয়ে যায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আতিকা বেগম নামাজ পড়লেন। তারপর লামিয়াদের ঘরে গিয়ে বললেন, " লামিয়া হাঁটতে যাবি? চল রাস্তা থেকে হেঁটে আসি।"
লামিয়া ম্লান হেসে দরজা বাহিরে দিয়ে লাগিয়ে, "চলেন চাচী। কিন্তু আপনি তো এত ভোরে হাঁটেন না। আজ সম্পূর্না ওই ঘরে আছে বলেই যাচ্ছেন তাই না?"

আতিকা বেগম হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাথায় এসে বারবার হিমেলদের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। লামিয়া নিজে থেকে বলল," দরজা বন্ধ। বুঝা যাচ্ছে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।"
আতিকা বেগম বললেন," তুই কার কথা বলছিস? কে ঘুম থেকে উঠেনি?"
-" সম্পূর্ণা।"
-" সে আবার কে?"
লামিয়া আর কথা বাড়ালো না। চুপ করে আছে দেখে আতিকা বেগম বললেন," ওই নামের মানুষকে কালই কবর দিয়েছি। তাই নতুন মানুষটা চিনতে পারছি না।"
দুজনেই আবার বাড়ির পথে বা বাড়াতেই সম্পূর্ণা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আতিকা বেগমকে রাস্তায় দেখে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আতিকা বেগম বললেন," লামিয়া এইখান থেকে চল। আমার ঘরে আমার মেয়ে তাবিয়া বসে আছে। এইখানে থাকলে ও চিন্তা করবে।"
কথাটা বলে হনহন করে হেঁটে চলে এলেন। 
সম্পূর্ণা আর কিছু বলল না। লামিয়া সম্পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন," এইটা কী করলি তুই? নিজের হাতেই নিজের জীবনটা শেষ করে দিলি? আমি শুধু এটাই ভাবছি তোকে যেন কালকের দিনটার জন্য আফসোস করতে না হয়।" লামিয়াকে কথা বলতে দেখে হিমেলের মা এসে বলল," সকাল বেলাই শুরু করছ আমার ছেলের বউয়ের কান ভাঙ্গানি? ও এখন আর তোমাগো মেয়ে না। তাই যখন তখন এসে কথা বলবা না। সম্পূর্ণা যা ঘরে যা। কালকে রাতের বাসনকোসনগুলো ধুয়ে নিয়ে আয়। এইখানে আসছোস যখন কাজ করেই খেতে হবে। এমনি এমনি পেটে ভাত যাবে না।" সম্পূর্ণা লামিয়ার কথায় কিছু না বলে ঘরে গেল। এঁটো বাসনগুলো পুকুরে নিয়ে ধুয়ে নিয়ে এসেছে সে। হিমেল আস্তেধীরে ঘুম থেকে উঠে সম্পূর্ণাকে খাটের কিনারায় বসে থাকতে দেখে," কী ব্যাপার, এইভাবে বসে রইলে যে? মা কোথায়?"
-" ফুফু পাশের বাড়ির কাজে গেছে। তুমি উঠে হাতমুখ ধুয়ে আসো।"
-" তুমি কিছু খাইছো?"
-" আমার খিদে পায়নি। ফুফু বলেছে কালকের পান্তা ভাত আছে তুমি আমি যেন খেয়ে নিই। তুমি খাও আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে ফেলি।"
হিমেল বুঝতে পেরেছে সম্পূর্ণা পান্তা ভাত খায় না। সকাল বেলায় ওর এইসব অভ্যাস নেই। সম্পূর্ণার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে," অনেক কষ্ট তোমায় সহ্য করতে হবে সম্পূর্ণা। তুমি কাল এইভাবে আসাটা ঠিক হয়নি।আমার কাজ নেই মা পরের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে যেতো। এখন তুমি এইসবে মানিয়ে নিতে পারবে?"
সম্পূর্ণা শান্ত গলায় বলল, " পারবো। তুমি পারলে আমিও পারবো। এতদিন আমি ছিলাম না তুমি হেলায় দিন পার করেছ। এখন আমি আসছি একটা কিছু করো।" হিমেল আর কথা না বাড়িয়ে কলে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে শার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিশ মিনিট পরে এসে ছোট কাগজের একটা প্যাকেট সম্পূর্ণার হাতে দিয়ে," কই আমাকে ভাত দাও। খেয়ে বের হতে হবে।"
সম্পূর্ণা কাগজের মোড়ানো প্যাকেট খুলে দেখে দুটো সিঙ্গারা আর দুই পিস জিলাপি। গরম গরম সিঙ্গারা দেখে," হিমেল তুমি আমার জন্য এইসব আনতে গেছো?"
হিমেল হাত ধুয়ে নিজেই ভাত নিয়ে," হু,আমি তো জানি আমার ছোট্র বউটা সকালে পান্তা ভাত মোটেও খাবে না।তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।"
হিমেল ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে, " মা'কে কিছু বলো না এই ব্যাপারে। না হলে রাগ করবেন।"
-" ফুফুকে ছাড়াই খাব?"
-" হ্যাঁ খাবে।না হলে তোমার কপালে এটাও জুটবে না।"

বিয়ের কয়েকটি দিন পার হলো। হিমেলের মা কয়েকদিন থেকে সম্পূর্ণার কান গলার দিকে তাকিয়ে বলতো কিছু টাকা হলে ঘরটা ঠিক করতে পারতাম। মানুষের ঘরে কয়দিন ঘুমানো যায়?
হিমেল আজ রেগে বলেই ফেললো," তুমি কথাগুলোকে কেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে না বলে সরাসরি বলতে পারো না? ঘরে আসলেই তুমি এই কথাটা বলো।"
হিমেলের মা বললেন," সম্পূর্ণার কানে এক জোড়া দুল আছে গলায় একটা চেইন। এইগুলো নিশ্চয়ই সোনার হবে তাই না? ওর বাবা মায়ের কী কম আছে না-কি? মায়েকে নকল জিনিস পরানোর মন তাদের নয়। আমি বলি কী ওর এইগুলো বিক্রি করে অন্তত ঘরটা যদি একটু বড় করে আরেকটা চৌকি দেওয়া যেতো তাহলে ভালো হতো।"

হিমেল রাগি গলায় বলল, " মা তুমি পাগল হয়ে গেছ? এইগুলো ওর সাথে থাকলে মনে হবে ওর বাবা মা ওর পাশেই আছে। আমরা তো কিছুই মেয়েটাকে দিতে পারিনি। এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে ও। দুইটা সুতি শাড়ি এনে দিয়েছিলাম ওইটাতেই কোনোমতে দিন পার করছে ও। তারউপর কোন মুখে ওকে বলবো এইসব? "
হিমেলের মা কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন। বিড়বিড় করতে করতে পাশের ঘরে গেলেন। হিমেল উঠে এসে দেখে সম্পূর্ণা শুয়ে আছে গুটিসুটি হয়ে। হিমেলকে দেখে উঠে বসে ধীর গলায় বলল, " তোমার মা ঠিকি বলেছে। আমাদের একটা ঘরের প্রয়োজন। এইভাবে অন্যের ঘরে ঘুমাতে নিশ্চয়ই ফুফুর খারাপ লাগে। কাল তুমি এইগুলো বিক্রি করে টিন কিনে নিয়ে এসো। এইগুলো দেখে বাবা মায়ের অনুভূতি আমি পাই না। বরং কষ্ট লাগে।"
সম্পূর্ণার কথা শুনে হিমেল সম্পূর্ণার কোলে মাথা রেখে," একদিন দেখবে আমাদের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। সেদিন তোমাকে আমি অনেক অনেক গহনা কিনে দিব।" 
সম্পূর্ণা মুচকি হেসে," লাগবে না আমার এইসব। এইগুলো চিন্তা বাদ দিয়ে কালকের কথা ভাবো। মিস্ত্রি খবর দিয়ে কোনো মতে হলেও ঘরটা ঠিক কর।"
-" দেখি কী করা যায়। সকাল তো হোক।"
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন