ঝরা ফুলের কান্না - পর্ব ০৭ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


কেটে গেল একটা মাস। কোনো ভাবেই সম্পূর্ণাকে হিমেলের কাছ থেকে সরাতে পারছে না।আতিকা বেগম নিজের ঘরে গিয়ে দেখে সাইফুল ইসলাম দম মেরে বসে আছেন অন্যমনস্ক হয়ে।
তিনি কাছে গিয়ে বসে বললেন,"এখনো ভালো ছেলের খোঁজ পাওনি?"
সাইফুল ইসলাম স্থির হয়ে আতিকা বেগমের দিকে তাকিয়ে, " ছেলে পাওয়া কী এতই সহজ? প্রেম করেছে বলে তো যার তার সাথে বিয়ে দেওয়া যায় না। ওকে এত বুঝাই আদীলের মা ওর কী কথাগুলো কানাই যায় না? ছেলেটা যদি ভালো হতো তাহলে বিশ্বাস কর টাকার দিকেও তাকাতাম না। বিয়ে দিয়ে একটা লাইন ধরিয়ে দিতাম।মেয়ে সুখে থাকবে ভেবেই বিয়েটা দিতাম।আমার কাছে কী মনে হয় জানো, ওর সাথে জ্বীন টিন থাকে না-তো?"
আতিকা বেগম কাছে গিয়ে বললেন," একটা কথা বলি?"
-" কী?"
-" বড় ভাবি বলছে কোন হুজুরে পানি পোড়া দেয় আবার না-কি তাবিজও দেয়। যদি ওই পানি সম্পূর্ণারে খাওয়াইতে পারি ও নাকি সব ভুলে আমাদের কথাই শুনবে।"
-" তুমি পাগল হয়ে গেছ আদীলের মা? এইগুলো আমার বিশ্বাস হয় না। এইসব তাবিজ পানি পোড়া বাদ দিয়ে মেয়েটাকে আরেকটু বুঝাও।"
-" আর কত বুঝাবো? তুমি ওর শরীরে মাইরের দাগগুলো দেখছ? খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দিয়েছি হাতে, চুল টেনে মেরেছি,পিঠে মাইরের দাগ ছাড়া কিছু নাই। আমি আর এইটা ছাড়া উপায় দেখি না।"
সাইফুল ইসলাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখে পানি মুছে নিয়ে," ঘটক তো লাগিয়েছি। দেখি কী হয়!"
হঠাৎই দরজা জোরে ধাক্কানো চেঁচামেচি শুনে দুজনে দৌড়ে গিয়ে দেখে সম্পূর্ণার চেঁচামেচি।আতিকা বেগম বললেন," দেখেছ আবার শুরু হয়ে গেছে। এইভাবে আটকিয়ে রাখা যায়?" সাইফুল ইসলাম কিছু না বলে দরজা খুলতে যাবে তখনই আতিকা বেগম বললেন," ওকে দরজা খুলো না। যদি খুলে দাও তাহলে ও আবার তাবিয়ার ফোন কিংবা আমার ফোন দিয়ে হিমেলের সাথে কথা বলবে। কত লুকানো যায় ওর থেকে ফোন?"
সাইফুল ইসলাম কিছু বলতে যাবে তখনই ভেতর থেকে শুনা যায়," কতদিন আমাকে আটকিয়ে রাখবে তোমরা? যদি ভেবে থাকো এইগুলো করলে আমাকে হিমেলের থেকে সরানো যাবে তাহলে ভুল ভেবেছ। তাই ভালোই ভালোই আমাকে হিমেলের কাছে যেতে দাও। তাবিয়া এসে আতিকা বেগমকে রুমে চলে যেতে বললেন। 
-" বাবা আপনার ছেলে কথা বলবে।"
সাইফুল ইসলাম তাবিয়াকে বলল," যা হয়েছে আদীলকে বলার দরকার নেই। ও শুনলে চিন্তা করবে।"
-" বাবা আমি বলতে হয়নি। লামিয়া ভাবি না-কি ফোন দিয়ে সব বলেছে। আপনার ছেলে বলল আপনার সাথে কথা বলবে তাই আমি ফোন নিয়ে এসেছি। এই নিন।"
সাইফুল ইসলাম বললেন," রেখে দাও। আমি রাতে ফোন দিয়ে কথা বলে নেব। ওকে বলবে রাতে আমার ফোনে কল দিতে।
-" ঠিক আছে বাবা।"

পরের দিন সকাল সকাল আতিকা বেগম কোথায় গেলেন তাবিয়া জানে না। সাইফুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বলতে পারেননি। তাবিয়া তাই নিজেই নাশতা বানিয়ে সাইফুল ইসলামের সামনে দিল। সম্পূর্ণার জন্য ট্রেতে করে নিতে যাবে তখনই আতিকা বেগম এসে বললেন," বড় বউ, খাবারের সাথে যখনই পানি দিবে তখনই এই পানিটা সাথে মিলিয়ে দিবে।"
ব্যাগ থেকে বলতটা বের করে টেবিলের উপর রাখলেন।
তাবিয়া উচ্চস্বরে বলল," কিসের পানি?"
আতিকা বেগম বিরক্তিকর গলায় বললেন," তুমি আস্তে কথা বলতে পারো না? ও শুনলে এইসব খাবে? বউ মানুষ আস্তে কথা বলো। তোমাদের বাপু লজ্জাশরম কিছু নাই। আর আমাদের সময় দশ বছরেও কথা বলতাম না শ্বশুর বাড়ির লোক কী ভাববে। কত ভেবে চিন্তে উত্তর দিতাম। এইগুলো পড়া পানি। লামিয়ার সাথে গিয়ে নিয়ে আসছি।"
তাবিহা কিছু না বলে গ্লাসে বতলের থেকে পানি মিশিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণার দরজা খুলে দেখে সে খাটের কিনারায় বসে পা দোলাচ্ছে। তাবিয়া কিছুটা অবাক হয়ে," মা মা এইদিকে আসুন। দেখুন সম্পূর্ণা কী করছে।
আতিকা বেগম গিয়ে দাঁড়াতেই সম্পূর্ণা বলল," পড়া পানি নিয়ে আসছ কী আমার জ্বীন দৌড়াতে? হিমেলের ভর করা জ্বীন এত সহজে যাবে না। পড়া পানি, তেল পড়া যা আছে নিয়ে আসো সমস্যা নেই। আতিকা বেগম বললেন," বড় বউ, ট্রেটা রেখে চলে আসো। যখন আশেপাশে পানি পাবে না তখন এমনিই খাবে। খাবার রেখে তাবিয়াকে নিয়ে এসে দরজায় আবার তালা লাগিয়ে দিলো। 

তাবিয়া আবার দুপুরে ভাত নিয়ে গেল সকালের খাবার এখনো পড়ে আছে। রাতে গেল সারাদিনের খাবার পড়ে আছে। পরেরদিন সকালে আবার সেই একই কাহিনি, দুপুরে আগে তাবিয়া আর না পেরে এক গ্লাস জুস বানিয়ে নিয়ে গেল।
-" সম্পূর্ণা এইটা কীভাবে সম্ভব? মানুষ পানি না খেয়ে থাকতে পারে? এই নাও জুস খাও। এইটা তো আর পানি না।"
সম্পূর্ণা ম্লান হেসে," পানি দিয়েই তো বানিয়েছ। তোমরা পারবে না। আমি মরে যাব তবুও হিমেলের কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না।"
তাবিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে, " তুমি ওর জন্য এত পাগল। কই ও তো তোমার কথা ভাবলো না। তোমার তো খবর নিলো না।"
-" ও নিবে কেমন করে? তোমরাই আমাকে আটকিয়ে রেখেছ।"
তাবিয়া জুসের গ্লাস রেখে আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলো। তিনদিন হয়ে গেল। সে একগ্লাস পানি খায়নি। 
আতিকা বেগম ভেজা চোখে দরজা খুলে দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। সম্পূর্ণা কেমন যেন পাগলের মতো দৌড়ে বাহিরে কলে গিয়ে হাতের তালুতে করে পানি খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । পানি খেয়ে শরীরটা যেন দুলছে। নিজের ঘরে না এসে লামিয়াদের ঘরে গিয়ে দেখে লামিয়ার শ্বাশুড়ি সামনের দরজায় বসে তরকারি কাটছে। জেঠি আমাকে এক প্লেট ভাত দেন।"
লামিয়ার শ্বাশুড়ি অবাক হয়ে বলল," ভাত হয়েছে কিন্তু কিছু তরকারি তো চুলার উপরে আর কিছু আমি কাটতে নিয়ে আসছি। লামিয়া এসে শ্বাশুড়িকে বলল," মা কালকের তরকারি আছে আমি ওইটা দিয়েই দিচ্ছি। লামিয়া প্লেটে করে ভাত আর একটা বাটিতে তরকারি নিয়ে এসে সম্পূর্ণাকে দিলো। সম্পূর্ণা সিঁড়িতে বসে গাপুরগুপুর করে খেতে লাগলো। ভাতগুলো নিমিষে শেষ করে," ভাবি আমাকে আরেক প্লেট ভাত দাও। লামিয়া ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার এনে দিলো। ভাত খেয়ে উঠে যেতেই লামিয়া বলল," এইসব পাগলামি তুই করে কেন নিজের জীবনটাকে শেষ করছিস? তুই এখনো ছোট। তোর অদূর ভবিষ্যত পড়ে আছে। যেখানে সব মেয়ে ভালো স্বামী, ভালো ঘর, ভালো সংসার চায়। কিন্তু তুই কী চেয়ে হিমেলকে ভালোবেসেছিস? তোর মা বাবা ভাইদের কথা চিন্তা কর। " 
সম্পূর্ণা করুণ স্বরে বলল, " সামান্য কয়টা ভাত খাইয়ে খোটা দিয়ে দিলা? ঠিক আছে আর খাব না। তবুও হিমেলের নামে আমাকে কিছু বলিও না ভাবি। আমি জানি ও ভালো ছেলে। ও আমায় ভালো রাখবে।"
লামিয়া হতভম্ব হয়ে, "খোটা দিলাম!"
-" হ্যাঁ। না হলে কী আর এইগুলো বলতে? খাওয়াইছো দেখেই তো বলছ।"
-" আচ্ছা ঠিক আছে তোকে আর কিছু বলবো না। তোর যখন খুশি এসে খেয়ে যাস।"
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে চলে এলো। আতিকা বেগম সব দূর থেকে দেখে চোখে পানি মুছে কাঁদতে কাঁদতে বললেন," সারাজীবন মানুষকে খাইয়ে আসছি। আজ আমার নিজের মেয়েই খাবারের জন্য অন্যের দরজায় হাত পাতে। বড় বউ কিসের জন্য কার অভিশাপ লাগছে? আমার মেয়েটা কী সত্যিই এমন পাগল হয়ে যাবে?"
তাবিয়া ভেজা গলায় বলল, " মা আপনি এইভাবে কাঁদবেন না। আপনি এইভাবে কাঁদলে সম্পূর্ণার উপর সত্যিই অভিশাপ চলে যাবে। আল্লাহকে ডাকুন। উনিই ভরসা।

দুইদিন লামিয়াদের ঘরে যখন তখন না খেয়ে শুধু দুপুরেই ভাত খেত সম্পূর্ণা। আর সারাক্ষণ এমনিই দিন কাটাতো। একদিন দুপুরে খাওয়া শেষ করে আসার পথে দেখে লামিয়া আর তার মা দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
সে দৃশ্য দেখেই পরেরদিন লামিয়াদের ঘরেও খাবার বন্ধ করে দিলো। লামিয়া যখন এসে বলল," কিরে আজ ভাত খাবি না? সম্পূর্ণা হালকা মাথা নেড়ে, দোকান থেকে কলা আর পাউরুটি খেয়েছি। খিদে নাই।"
-" ভাত খাবি না কেন?"
-" তোমার ঘরেও যে পড়া পানি চলে গেছে সেটা আমি বুঝেছি।"
-" কিসের পড়া পানি?"
-" নাটক টিভিতে গিয়ে দেখাও। কাল আমি সব দেখেছি। এখন যাও। "
লামিয়া আর কিছু না বলে ওর রুম থেকে বেরিয়ে এসে," চাচি পড়া পানি দিয়েছেন ও জানলো কী করে? 
এইভাবে না খেয়ে থাকবে কতদিন?"
আতিকা বেগম কিছু না বলে সম্পূর্ণার রুমে গিয়ে," তুই টাকা পেলি কোথায়? আর তুই দোকানে গেলি কখন? "
-" বাড়ির সামনে দোকান যখন ইচ্ছে যেতেই পারি। আর আমি খেতে টাকা লাগে না৷ সাইফুল ইসলামের মেয়েকে বাকিতে দিলে তাদের লস নাই। টাকা ওরা ঠিকি পাবে।"
আতিকা বেগম ফিরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। 

কেটে গেল টানা একটা মাস। দোকানের খাবার ছাড়া সম্পূর্ণা ঘরে এক গ্লাস পানিও খেত না। আজ দুপুরে যখন দোকানে গেল তখন রাস্তায় হিমেলকে দেখলো রিকশা থেকে নামতে। কাধে একটা ব্যাগ। মনে হচ্ছে কোথাও থেকে এই মাত্র এসেছে। সম্পূর্ণা কথা বলার আগেই হিমেল তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। সম্পূর্ণা আর দোকানে না গিয়ে ফিরে এলো। সারাদিন পায়চারি করেছে৷ এইভাবে আর কতদিন। না খেয়ে থাকতে থাকতে যেন নিজেকেও এখন চেনা যায় না। শুকনো কাঠের মতো সোনালী শরীর খানা দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। 
চারদিকে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আতিকা বেগম আজান শেষ হতেই নামাজ পড়তে গেলেন। তাবিয়াও নিজের রুমে। সাইফুল অসলাম মসজিদে। 
লামিয়াদের ঘরের পানি শেষ হওয়ার কারণে বাহিরে কলে আসছে অজু করতে। হঠাৎ দেখে সম্পূর্ণা ভূতুড়েভাবে এক দৌড়ে রাস্তার মাথায় গিয়ে হিমেলদের ঘরে ঢুকে গেল। লামিয়া অজু শেষ করে ভেবেছিল নামাজ পড়া শেষ হতেই ও ফিরে আসবে। হিমেল আজ বাড়ি এসেছে লামিয়াও দেখেছে। লামিয়া আর কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেল। নামাজ শেষ করে উঠতেই দেখে আতিকা বেগমের চিৎকার সম্পূর্ণাকে পাওয়া যাচ্ছে না। লামিয়া বেরিয়ে এসে বলল," ও এখনো ঘরে আসেনি?"
-" না তো। তুই দেখেছি কোথায় গেছে?"
লামিয়া ভয়ে বলল," না দেখিনি। তবে হিমেলদের ঘরে দেখতে পারো।কারণ হিমেল দুপুরে বাড়ি এসেছে। আতিকা বেগম, লামিয়া, তাবিয়া গিয়ে দেখে সম্পূর্ণা হিমেলর পা জড়িয়ে পড়ে আছে ওকে রাখার জন্য।
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন