জল ফড়িঙের খোঁজে - পর্ব ২৫ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


দুপুর দুটো বাজে। সৌহার্দ্য আর তুর্বী দুজনে সৌহার্দ্যর কেবিনে বসেই কাজ করছে। সৌহার্দ্য কাজ করছে আর আড়চোখে তুর্বীকে দেখছে। তুর্বীর সেদিকে নজর নেই ও একমনে ডিজাইন আঁকছে। ল্যাপটপে চোখ রেখে সৌহার্দ্য বলল,

" লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে তো লাঞ্চ করবে না?"

তুর্বী মাথা তুলে তাকালো সৌহার্দ্যর দিকে তারপর পেন্সিলের ক্যাপ লাগাতে লাগাতে বলল,

" হুম। আমি ক্যান্টিনে যাচ্ছি। আর আপনিও খেয়ে নিন।"

" চুপচাপ বস। খাবার নিয়ে এসছি আমি।"

সৌহার্দ্যর মুখে এই কথা শুনে বেশ অবাক হল তুর্বী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,

" নিয়ে এসছেন মানে?"

সৌহার্দ্য নিচে রাখা খাবারের ব্যাগটা উঠিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,

" এখন থেকে আমার সাথে বসেই লাঞ্চ করবে। বাড়ি থেকে দুজনের খাবারও নিয়ে আসব আমি।"

" কেন? আমিতো ক্যান্টিনেও খেয়ে নিতে পারি তাইনা?"

সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

" এখানে খেতে সমস্যা কোথায়? নাকি কেউ কিছু বলতে পারে সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছো?"

তুর্বী তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল,

" আরে দূর! এসব আমি কোন কালেই ভাবি না।"

" আচ্ছা ফাইন একসাথেই খাবো।"

" বেটার, এখন ঝটপট সার্ভ করে দাও।"

তুর্বী হাত ভাজ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল অর্থাৎ 'আমি পারব না'। সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

" বস থেকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে সাহস বেড়ে যাচ্ছে তোমার ইদানিং। মুখে মুখে তর্ক করছ?"

তুর্বী সৌহার্দ্য দিকে মেকি একটা হাসি দিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল অর্থাৎ ' যা খুশি ভাবুন আমার কী?' সৌহার্দ্য ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। এই মেয়েকে কিছু বলে কোন লাভ নেই। একে যদি বিয়ে করে, তবে বিয়ের পর ওর অবস্থাটা কী হবে সেটা কল্পনা করেও বেচারা শিওরে উঠছে। সেসব কল্পনা জল্পনা বন্ধ করে খাবারের বক্সগুলো বেড় করে টেবিলে রাখল, তারপর নিজেই দুটো প্লেটে খাবার সার্ভ করল। একটা প্লেট তুর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

" নিন ম্যাম খেয়ে নিয়ে উদ্ধার করুন।"

তুর্বী প্লেট নিজের কাছে নিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে খেতে শুরু করে দিল। সৌহার্দ্য কয়েক সেকেন্ড তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও প্লেটটা হাতে নিয়ে বলল,

" তুর্বী? আমি তোমাকে তুর বলে ডাকতে পারি? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড দেন!"

তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকালো, পরে মুখের খাবার শেষ করে বলল,

" এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে? যদিও এই নামে আমাকে একমাত্র রিখিয়া ডাকে। অাপনিও আজ থেকে ডাকতে পারেন। আমার প্রবলেম নেই।"

সৌহার্দ্য মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তুর্বীও নিজের মত করে খাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ পর তুর্বী বলল,

" আচ্ছা আমি আপনাকে আপনি করে কেন বলছি? আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড, সো তুমি করে বলাই উচিত রাইট?"

" হুম একদম রাইট। কিন্তু অফিসে থাকাকালীন কারো সামনে তুমি বলার দরকার নেই।"

" ওকে ফাইন।"

খাওয়ার সময় ওরা আর কোন কথা বলেনি। খাওয়া শেষ করে দুজন আবার কাজে মনোযোগ দিল। কাজ করতে করতে তুর্বী আর সৌহার্দ্য দুজনেরই ঘাড় ব্যাথা করছে। তাই সৌহার্দ্য পিওনকে বলে দুই মগ কফি অানালো। সৌহার্দ্য কফি খেতে খেতেও টুকটাক কাজ করছিল। কিন্তু তুর্বী উঠে কেবিনের সাথে জয়েন্ট ব্যালকনিতে চলে গেলো। রেলিং এ ভর দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে কফি খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই সৌহার্দ্য ওর পাশে এসে দাঁড়াল। তুর্বী তাকাতেই সৌহার্দ্য বলল,

" আচ্ছা এর আগে তোমার কোন রিলেশন ছিলোনা এটাতো ক্লিয়ার। কাউকে ভালোও লাগেনি কখনও?"

তুর্বী হেসে দিয়ে একটু উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,

" লেগেছিল তো। আমি যখন ইন্টারে উঠলাম একটা ছেলে এসছিল। এতো কিউট যে কি বলব। এতো কিউট কোন ছেলে হতে পারে ভাবিও নি। পুরো ক্রাশ খেয়ে গেছিলাম। উফফ! এখনও মনে পরলে দিল ধাক ধাক করে।"

সৌহার্দ্যর এবার একটু রাগ হচ্ছে। ওর সামনে অন্য একটা ছেলের এভাবে প্রশংসা করছে? ও কী বুঝতে পারছেনা যে সৌহার্দ্যর রাগ হচ্ছে ভীষণভাবে। এখন তো মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করেই ভুল করছে। এসব ভাবতে ভাবতে তুর্বী আবার বলল,

" ওনার্স সেকেন্ড ইয়ারেও একটা ছেলেকে ভালো লেগেছিল। যদিও দেখতে খুব একটা ভালো না কিন্তু পার্সোনালিটিটা জোস। কী আর বলব আপনাকে। আর.."

" থাক আর বলতে হবেনা।"

সৌহার্দ্য রাগ আর বিরক্তির মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বলল,

" হয়েছে। আর বলতে হবেনা।"

" থাকবে কেন শুনুন না, লাস্ট ওয়ান।"

" বললাম তো থাক।"

কিন্তু তুর্বীতো কথা শোনার পাত্র না। ও বলবেই। তাই বলল,

" আরে আপনাকে যেদিন ফার্স্ট দেখলাম গাড়িতে। ফুল কালো পরে ছিলেন। কিছুক্ষণের জন্যে চোখ আটকে গেছিল। ভালোরকমের ক্রাশ খেয়েছিলাম কিন্তু। মানতে হবে।"

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টি অন্যরকম হয়ে উঠল। তুর্বীর চোখ সৌহার্দ্যর চোখে পরতেই সৌহার্দ্যর চাহনী দেখে হঠাৎই একটু লজ্জা পেল। নিজেকে সামলে চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য তুর্বীর হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে এলো। তুর্বী একটু অবাক হয়ে তাকাল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে তুর্বীর চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিতে দিতে বলল,

" তারমানে তোমার এডাল্ট বয়সের ক্রাশ আমি? আর এডাল্ট বয়সের ক্রাশগুলো কিন্তু অনেকটা পাকাপোক্ত হয় তাইনা?"

তুর্বী ভ্রু নাচিয়ে বলল,

" আচ্ছা?"

সৌহার্দ্য তুর্বীর কপালে কপাল লাগিয়ে বলল,

" হুম। পার্মানেন্ট হতে চাও না-কি?"

তুর্বী সৌহার্দ্যর কাধে হাত রেখে বলল,

" আপাতত টেম্পোরারই থাক। পরেরটা পরে দেখা যাবে স্যার!"

" তুমি করে বলার কথা ছিল ওকে।"

" হুম।"

" হুম?"

" হুম।"

সৌহার্দ্য হেসে দিল সাথে তুর্বীও। দুজনের মধ্যেই কিছু অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। এইরকম অনুভূতির সাথে দুজনের কেউই পরিচিত নয়।

_____________

বিহান আর রিখিয়া দুজনে একটা বিল্ডিং এর ছাদে বসে আছে। এই বিল্ডিং এরই রেস্টুরেন্টে এসছিল ওরা। ওখান থেকেই ছাদে এসছে। ছাদে দুজনে পাশাপাশি বসে থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,

" চুপ করে আছো কেন?"

" এমনিই। এই নিরব পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছে।"

" নিরবতা! খুব অদ্ভুত জিনিস তাইনা? মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ভাবনাকে বাইরে বেড় করে নিয়ে আসতে পারে। কতরকম চিন্তা এসে ভর করে মাথায়।"

রিখিয় বিহানের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,

" এতো গম্ভীর কথাও বলতে পারেন?"

বিহান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

" আমি সবকিছুই পারি। শিল্পী মানুষতো তাই হয়ত।" 

" নতুন কোন পেন্টিং করেন নি?"

" করেছিতো। দুটো। কেন?"

" আমাকে দেখালেন না এখনও?"

" দেখিয়ে দেব সময় করে। কিন্তু হঠাৎ এতো আগ্রহ?"

" প্রেমে পরে গেছি।"

বিহান চোখ বড়বড় করে তাকাল রিখিয়ার দিকে। রিখিয়া হেসে দিয়ে বলল,

" আরে আপনার পেন্টিং এর। আপনার প্রেমে পরতে বয়েই গেছে। আপনি আর যাই হোক প্রেমে পরা টাইপ ছেলেদের মধ্যে পরেন না।"

" হ্যাঁ সেটা ঠিক। আমার প্রেমে পরা যায় না। ইন ফ্যাক্ট পরা উচিতও না।"

এটুকু বলে বিহান একটু হেসে আবার আকাশের দিকে তাকাল। রিখিয়া ভাবল যে বিহান কষ্ট পেল না তো? কিন্তু ও তো সম্পূর্ণটাই মজা করে বলেছিল। তাই কথাটা ঘোরাতে রিখিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

"বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চলুন আজ ফিরে যাই।"

বিহান বলল,

" কেন? নিস্তব্ধ এই সন্ধ্যায়, দমকা হাওয়ার মধ্যে আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে তোমার কোন আপত্তি আছে?"

বিহানের কথা শুনে একটু অবাক হয়ে তাকালো। বিহান মুচকি হেসে বলল,

" কী? ভিজবেনা?"

রিখিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রিখিয়া তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালো, বিহানও দাঁড়ালো। রিখিয়া একটু দৌড়ে যেতে নিলেই বিহান হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বৃষ্টির গতি বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। দুজনেই ভিজে চুবচুবে হয়ে যাচ্ছে। বিহান একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রেখে দিয়েছে রিখিয়াকে। বিহানের মুখ থেকে ফোটায় ফোটায় পানি রিখিয়ার মুখে পরছে। রিখিয়া ঠিক করে তাকাতেও পারছেনা। অনেক কষ্টে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান মুখে এখনও বাঁকা হাসি লেগে আছে। নিজের চার আঙুল দিয়ে আলতো করে রিখিয়ার গালে স্লাইড করে বলল,

" সবসময় পালাতে চাইলেই কী পালানো যায় ম্যাডাম?"

বিহানের এরকম কন্ঠস্বরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল রিখিয়ার মধ্যে। তবুও নিজেকে সামলে বলল,

" ছা-ছাড়ুন।"

" সত্যিই ছেড়ে দেব?"

বিহান কথাটা এমনভাবে বলল যে রিখিয়ার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। এই 'ছেড়ে দেব' শব্দটা কেন যেনো নিতে পারলোনা ও। কিছু না ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বিহানকে। বিহান হতভম্ব হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিও নিজ গতীতে পরেই যাচ্ছে। বিহান রিখিয়ার পিঠে হাত রাখতেই হালকা করে কেঁপে উঠল ও। হুস এলো যে কী করছে সে। তাই চমকে গিয়ে নিজেই ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল বিহানের থেকে। বিহানের দিকে তাকাতেও পারছেনা ও লজ্জাতে। তাই ওখানে না দাঁড়িয়ে একপ্রকার দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। বিহান ও মুচকি একটা হাসি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেজা চুলগুলো নেড়ে নিজেও রিখিয়ার পেছনে গেল।
.
.
.
চলবে...........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন