সেদিন সন্ধ্যায় বিভান বাসার সবাইকে ডেকে জড়ো করে।ওকে দেখতে বেশ গম্ভীর লাগছিলো।কেউ বুঝতে পারছিলো না বিভান হঠাৎ সবাইকে এভাবে কেন ডাকছে?ড্রয়িংরুমে জড়ো হতে থাকে বাসার সবাই।বাবা মা এসে এক হলো সবার পর।প্রিয়াশা আদনান এসে দাঁড়ালো।সাঁঝ পূর্নাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে।বেলা হুমায়রাকে ঘুম পাড়িয়ে এলো সবে।কুঞ্জন আর লাবনী বিভানের দুপাশে বসেছে।সবার দিকে একবার তাকিয়ে বিভান বলল,
''আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জানি কাল যা হয়েছিলো বাসার সবাই খুব চিন্তিত হুমায়রাকে নিয়ে।চিন্তা হওয়াটা অস্বাভাবিক ও কিছু নয়।তবে হুমায়রার জন্য যা ভেবেছি সেটা ওর নিশ্চয়ই ভীষন উপকারে আসবে।সেটা হলো হুমায়রাকে ইন্ডিয়াতে নেয়ার কথা ভাবছি। ওখানে ও আমাদের সাথে থাকবে পড়াশুনা করবে,ওর সকল দায়িত্ব আমার।আমি ওর এমন পরিবর্তন করবো যেন ও কোন পুরুষের সাহায্য ছাড়াই জীবনে এগিয়ে যেতে পারে।এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন সফল নারী হয়ে গড়ে উঠতে পারে।এসব কিছুতেই আমি আমার সব টুকু দিয়ে ওকে সাহায্য করবো।ও এমন একটা পর্যায়ে চলে যাবে যেখান থেকে ওকে পিছে ফিরে তাকাতে হবেনা।হুমায়রা যেমন বেলা আদনান নিশাদ কুঞ্জন লাবনী ওদের বোন আমার ও বোন।তাই ওর জন্য এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া আমার।"
কথাটা বলেই থামলো বিভান।জুলেখা বানু জামাইয়ের কথা শুনে কাঁদছেন।ইকরাম রাহমান অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন বড় জামাইয়ের দিকে।জীবনে কোন পূন্য করেছিলেন বলে এই জামাইকে পেয়েছেন।ভাবতেই বুকটা ভরে এলো ওনার।নিশাদ আদনানের ম্লান চোখজোড়া ভরে এলো।বেশ ভালো ভেবেছে ভাই।অন্তত ওদের বোন খুব ভাল থাকবে সেটা বুঝতে মোটেই দেরি হলোনা।বিভান শ্বশুর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
''বাবা আমি আপনার মতামতের অপেক্ষায় কিছু বলুন।"
ইকরাম রাহমানের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে।বলতে থাকেন,
''অমত নাই আমার আব্বা!!! অমত নাই।যেহানে আমার হুমু ভালো থাকবো হেইয়ানেই নিয়া যাও।অ জীবনে কিছু করলে হেইডা তো অর জন্য ভালোই হইবো।তুমি বাবা আমারে কতোটা নিশ্চিত করতাছো বইলা বুঝাইতে পারতামনা।তুমি করো যা লাগে করো।"
তখন নিশাদ আর আদনান বলতে লাগলো,
''আব্বা ঠিক বলছেন ভাই আপনি করেন। আপনি ভালো ভেবেছেন হুমায়রার জন্য।কোন সাহায্য লাগলে আমরা আছি।"
বিভান মায়ের দিকে তাকায়।মা ভীষন কাঁদছেন।ও বলল,
''মা আমি জানি আপনার খুব কষ্ট হবে।কিন্তু জানেন মা হুমায়রাকে ভালো দেখলে আপনার চেয়ে বেশি সুখী আর কেউ হবেনা কেউ না। কান্না করবেননা মা দোয়া করবেন যেন ও জীবনে খুব ভালো ভাবে এগিয়ে যেতে পারে।"
জুলেখা বানু কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন,
''দোয়াতো করিই জামাই।কিন্তু মাইয়াডারে এত দূরে ফাডানো খুব কষ্টের হইবো আমার লাইগা।আমি তো মা আমার তো কষ্ট অয়।অনেক কষ্ট অয়।"
বেলা মায়ের পাশে বসে বলল,
''আম্মা ওখানে গেলে তো আমাদের কথা হইবোই।তখন তো হুমায়রা আমার লগেই থাকবো।আমি ও তো একাই থাকি ঐখানে তোমার জামাই অফিসে গেলে।তখন দুই বোন মিলে একসাথে থাকতে পারমু।তোমার বেলারে বিশ্বাস করো মা হুমায়রা রে খুব ভালো রাখমু।"
জুলেখা বানু আর কিছু বলতে পারেননা। তবে সেদিন ওনার চেহারায় এমন একটা কিছু দেখতে পেয়েছিলো ওরা যেন ওনি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছেন তার হুমায়রাকে নিয়ে।
এরপর আরো তিন চার দিন পেরিয়ে যায়। এরই মাঝে বিভান প্রত্যেকদিন এক ঘন্টা করে হুমায়রাকে নিয়ে কাউন্সিলিং এ বসতো।ওকে খুব করে বুঝাতো।কারন হুমায়রা অনেক বেশিই ভেঙ্গে পড়েছিলো সেই রাতের ঘটনাটিকে ঘিরে।ওকে বুঝাতে বসলেই হুমায়রা চিৎকার করে কেঁদে উঠতো ওকে থামাতো বেলা আর সাঁঝ মিলে।অপরদিকে বাসার সবাই হুমায়রাকে খুব বেশি সঙ্গ দিতে শুরু করে।একদিন লাবনী বেশ ভয় নিয়ে হুমায়রার রুমে প্রবেশ করেছিলো।হুমায়রা খাটে বসেছিলো।চুল গুলো খুব বেশি শুষ্ক হয়ে গেছে।চেহারার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে গেছে একেবারে।লাবনী বোনের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে এনে চুপচাপ বোনের পাশে এসে বসে।হয়ত কথা বললেই ধমক খেতে হবে।তাই চুপচাপ বসেই ছিলো লাবনী।হুমায়রা হঠাৎ লাবনীর দিকে তাকিয়ে বলল,
''কিরে চুপচাপ বসে কেন?সবসময় এসে মাথা খাস এখন চুপচাপ কেন?"
লাবনী যেন একটু সাহস পেলো।বলতে লাগলো,
''মাথা খেয়ে তো তোর ধমকই শুনেছি।"
হুমায়রার ভেতর থেকে কম্পিত নিশ্বাস বেরিয়ে আসে।কিছুই বলতে পারেনা।চোখের কোনা গড়িয়ে অশ্রু বেয়ে পড়তে থাকে।লাবনী বুঝতে পারে বোনের ভীষন কষ্ট হচ্ছে।লাবনী বোনকে জড়িয়ে বলতে থাকে প্লিজ কান্না করিসনা সব ঠিক হয়ে যাবে তো।আমরা সবাই তোকে ভালবাসি আপু অনেক ভালবাসি।হঠাৎ তখন পূর্না এসে হাজির সেখানে।হুমায়রা ভাগনীকে দেখে চুপ হয়ে গেলো।বাচ্চাটা এখানে আসার পর থেকে হুমায়রা ওর সাথে ও ঠিকমতো কথা বলেনি।এখন চুপ থাকতে পারেনা।দুহাত বাড়িয়ে বাংলায় বলল,
''কোলে আসো মা।"
তবে খালার কথায় পূর্নার মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেলোনা।তখন লাবনী বলল,
''আপু ও বাংলা বুঝে না তো।"
হুমায়রা বুঝতে পেরে হিন্দিতে বলল,
''বেবি কোলে আসো।"
একয়েকদিন হুমায়রার সাথে তেমন কথা না হওয়ায় পূর্না বুঝতে পারছিলোনা কি করবে?এ মানুষটার সাথে ওর তেমন কথাই হয়নি তাহলে কিভাবে কোলে উঠবে।
তবে লাবনী ওর সব দ্বিধা ভুলিয়ে বলল,
''মামনি ও তোমার খালামনি হয়।যাও খালামনির কোলে।"
পূর্না দৌড়ে এসে হুমায়রার কোলে বসে যায়।পূর্না ওর কোলে বসতেই হুমায়রার চোখ ভিজে আসে।তখনই পূর্না অবাক কন্ঠে বলল,
''তোমলা তবাই এতো কাঁদো কেন?"
হুমায়রা কিছু বললনা শুধু ভাগনীকে বুকে জড়িয়ে রাখলো।
হুমায়রার ঘুম যেন হয়না এখন আর।রাতে চিৎকার করে উঠে। সবাই জেগে যায় ওর চিৎকারে।সাঁঝ বেলা ওকে সামলায়।একয়েকদিন সাইমন একদিন পরপরই এসে ওকে দেখে গেছে।এরই মাঝে বিভান হুমায়রার জন্য পাসপোর্ট রিনিউ করতে দেয়।এভাবে চারদিন কেঁটে গেলো ওদের জীবনে।
.....................এদিকে সেদিন অফিসে পৌছে প্রিয়াশা বসের রুমে যাওয়ার সময়ে আদনানের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকায়।ওর চাহনিটা আদনানের অন্তরকে মুহূর্তের জন্য বিষাদে ভরিয়ে তোলে।আরো বেশি চিন্তিত লাগতে থাকে আদনানের।কারন কয়েকদিন যাবৎ মেয়েটাকে বেশ চিন্তুিত লাগছিলো আদনানের।প্রিয়াশার মাঝে বেশ পরিবর্তন দেখা গিয়েছিলো।ও বসের কফি চা অন্যকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় বসের কাজ নিজে করবার নামে অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেয়।আর বসের রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর ওর চেহারায় যেন স্বাধীনতার চিত্র ফুঁটে উঠে।
ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলতে থাকে আদনানকে।সেদিন কাজের মাঝে আদনান বসের রুমে যাওয়ার জন্য নক করে।তবে কোন সাড়া না পেয়ে দরজা খুলে দেখলো প্রিয়াশা বুক শেলফ থেকে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করছে আর বস ওর সাথে একদম লেগে দাঁড়িয়ে।প্রিয়াশার চোখে পানি প্রচন্ড ভয় ফুঁটে উঠেছে।ও বারবার স্যারকে সরাতপ চাইছে কিন্তু ওনি ওকে স্পর্শ করছে কানে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলতেই প্রিয়াশা ধাক্কা দিয়ে বলল,
''স্যার প্লিজ!!!সরে যান আমি মেরিড।আপনি ভুল করছেন।"
সাথে সাথে সরে আসে আদনান।যতোটাসময় সেখানে দাঁড়িয়েছিলো শরীর ভীষন কাঁপছিলো।এ কি ও দেখলো ও?ওর আড়ালে প্রিয়াশার সাথে বস এমন করছে আর ওর প্রিয়াশা ওকে একটাবার ও জানানোর প্রয়োজন ও মনে করে নি।কাজ গুলো তো আজকাল থেকে হচ্ছেনা অনেকদিন যাবৎ হচ্ছে।প্রিয়াশা ওকে একটাবার ও বলতে পারেনি।ওর থেকে লুকিয়েছে স্যারের এমন অসভ্যতার কথা গুলো।কিন্তু কেন?আদনান তো এখন আর পর কেউ নয়।প্রিয়াশার হাসবেন্ড ও।তাহলে কেন লুকালো প্রিয়াশা?ভাবতেই বেশ অবাক লাগতে থাকে সাথে ভীষন রাগ লাগতে থাকে আদনানের।
সেদিন লাঞ্চে দুজন পাশাপাশি বসে।প্রিয়াশা নিজেকে ঠিক রাখতে এটা ওটা বলছিলো।কিন্তু আদনান তেমন কিছুই বলছিলোনা বরং হু হা করে উত্তর করছিলো।ব্যাপারটা বেশ অবাক করে প্রিয়াশাকে।বুঝতে পারছিলোনা ও আদনানের এহেন আচরনের কারন।
লাঞ্চ আওয়ারের পর ওরা যে যার ডেস্কে চলে যায়।
সন্ধ্যায় দুজনে বেরিয়ে আসে ওরা।প্রিয়াশা বলছিলো,
''কেমন গেলো আজকের দিন?"
আদনান শক্ত গলায় জবাব দিলো,
''জেনে কি করবা?কিছুকি জানানোর প্রয়োজন বোধ তুমি করো?"
প্রিয়াশার অবাক লাগে খুব।লোকটা এভাবে কেমন করে বলতে পারলো?প্রিয়াশা বলল,
''এভাবে বলছেন কেন আদনান?"
আদনান কিছু বললনা।এমনিতেই বসের কার্যকলাপে বেশ বিরক্ত প্রিয়াশা তারওপর লোকটা ঠিক মতো কথা বলছেনা।আদনানকে স্বাভাবিক করতে প্রিয়াশা বলল,
''কাজের চাপ খুব। "
''কেন স্যার তোমাকে কাজ কমিয়ে দেয়না?বেশ ভালোই তো ট্রিট হচ্ছে তোমার সাথে।"
কথাটা কানে আসতেই প্রিয়াশা অবাক হয়ে বলল,
''কি বললেন?"
''কিছুনা।প্লিজ কথা বলোনা মাথা ভীষন ব্যাথা করছে।"
কথা বাড়ায়নি প্রিয়াশা। বলে উঠলো,
''বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়েন। চা করে দিবো কড়া করে।"
কিন্তু ওর কথার জবাব দেয়নি আদনান। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও।প্রিয়াশা বুঝতে পারলো আদনানের কিছু হয়েছে।খুব রেগে আছে ওর ওপর কিন্তু কেন সেই কারনটা ওর জানা নেই।
তবে নিজের স্বামীর এরুপ ভালো লাগছেনা ওর।
!!!!
সেদিন প্রিয়াশার সাথে কোন কথাই বলেনি আদনান।ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো প্রিয়াশার।কিন্তু কি করবে ও?বুঝতে পারছেনা লোকটা কি নিয়ে রেগে আছে?এমন কি করে ফেলেছে ও?ভেবেছিলো অফিস থেকে আসার পর এক কাপ চা খেলে রাগ কমে যাবে।হয়ত টায়ার্ডনেসের কারনে রেগেছিলো কিন্তু কি ছুই হলোনা।ঘরে আসার পর ও তেমন কথাই বলছিলোনা।সন্ধ্যায় নাস্তা করে সেই যে বেরিয়ে গেলো আসার কোন নাম গন্ধ নেই লোকটার।প্রিয়াশা চেয়ে ও স্বাভাবিক থাকতে পারছিলোনা। সাঁঝ আপু আজ চলে যাবে।কারন নতুন বিয়ে হয়েছে বেশি দিন থাকাটা মানায় না।তাই মাই বলেছেন ওকে চলে যেতে।এদিকে সাঁঝের যেতে একদম ইচ্ছে করছেনা।বোনটাকে এ অবস্থায় রেখে কি করে যাবে ও?সাইমন ও প্রথম প্রথম বলছিলো,
''আম্মা হুমায়রার সাথে ও থাকুক না।আমি আসা যাওয়ার মধ্যে থাকবো।আর দাদি ও কিছু বলবেনা।"
কিন্তু জুলেখা বানু বললেন,
''না আব্বা সেটা কি অয়?নতুন বিয়া অইছে তোমাগো।ও এইহানে পইড়া রইলে কেমন লাগে কও?আইজ তোমার শ্বশুররে বাড়িিওয়ালা কইতাছিলো মাইয়া বিয়ার ফর এহনো ঘরে কিল্লাই ফইড়া রইসে।বিয়ার পর জামাইর বাড়িই মাইয়াগোর সব বাফের বাড়ি আইয়ে তো মেহমান অইয়া।"
সাইমন কিছু বলতে পারলোনা।কারন এখন কিছু বললে সেটা তর্ক হবে।ও জানে সাঁঝের মন এখানেই পড়ে থাকবে হুমায়রার জন্য।
শাশুড়ীর কথার সাথে পেরে না উঠেই শেষ পর্যন্ত সাঁঝকে নিতে আসার জন্য রাজি হলো।
এদিকে রান্নার দায়িত্ব বেলা আর প্রিয়াশার ওপর।প্রিয়াশা এমন সময়ে ও কাজে মন দিতে পারছেনা।লোকটার জন্য অনেক চিন্তা হচ্ছে।বেলা মাংসে মশলা মাখাচ্ছে আর প্রিয়াশা প্লেট বাটি ধোয়ার কাজ করছে।ওর চোখ জানালার বাহিরে।বেলা বলল,
"'প্রিয়াশা লবন নেই কৌটায় এনে দিবে?"
কিন্তু প্রিয়াশার কোন খবর নেই।ও একমনে ধুয়ে যাচ্ছে।তবে হয়ত মনে জোর দিয়ে কাজ করছে।বেলা দুবার ডাকার পর ও কোন উত্তর এলো না প্রিয়াশার থেকে।বেলা গলা ঝেড়ে জোরে বলল,
''প্রিয়াশা শুনছো?"
প্রিয়াশা এবার একটু কেঁপে উঠে।পাশে তাকিয়ে বলল,
''জি আপু।কিছু বলছিলেন?"
বেলা একটু অবাকই হলো।বলল,
''তোমার কিছু হয়েছে কি?বলো।"
প্রিয়াশা বলল,
''না আপু কি হবে?বলেন কি বলছিলেন। "
''অনেক ডাকলাম।কিছু বললেনা।"
''সরি আপু। বলেন কি লাগবে?"
''আপাতত লবন নেই।একটু এনে দিবে?"
প্রিয়াশা দৌড়ে গিয়ে লবনের প্যাকেট এনে দিলো।বেলা বলল,
''কি হয়েছে বলো তো?অফিস থেকে ফিরার পর থেকে দেখছি দুজনেই কেমন হয়ে আছো।কথাও বলছিলেনা।আদনান ও বের হয়ে গেলো।"
প্রিয়াশার কান্না পাচ্ছে।কিভাবে বলবে লোকটা কোন এক অজানা কারনে ওর ওপর রেগে আছে।প্রিয়াশা কোন মতে সামলে বলল,
''আপু ওনার কি আছে জানি।আর অফিসে ও খুব চাঁপ।তাই একটু টেনশান আর কিছুনা।"
''ওহ।"
মৃদু হাসলো বেলা।হঠাৎ পূর্না কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে বলল,
''মামী কি কলো?"
প্রিয়াশার ঠোঁটে মুহূর্তে হাসি ফুঁটে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল,
''কাজ করি মা।কিছু বলবে?"
''আমিও কব্বো।"
বলেই ঝাড়ু নিয়ে ঘরে লাগাতে শুরু করে পূর্না।এদিকে পূর্না কে কাজ করতে দেখে জুলেখা বানু হেসে খুন।বলতে লাগলেন,
''ওই বেলার আব্বা দেহো তোমার নাতনী কি করে?"
বেরিয়ে এলো বেলা আর ইকরাম রাহমান। বেলা মশলা মাখা হাত ধুয়ে নেয়।লাবনী টুক করে পূর্নার এই ছবিটা তুলে নিয়ে বলল,
''ওরে আম্মুটা কতো হেল্প করে।"
তারপর ভাগনীর হাত থেকে শলা রেখে ওকে কোলে তুলে নিয়ে হুমায়রার রুমে এলো।সেখানে বিভান ওকে বুঝাচ্ছিলো।তখনই লাবনী গিয়ে বলল,
''ভাইয়া একটা জিনিস দেখবেন?"
পিছে ফিরে বিভান।তারপর বলল,
"কি দেখাবে ছোট গিন্নী?"
লাবনী পূর্নার সেই ছবিটা দেখিয়ে বলল,
''দেখেন আপনার মেয়ে কাজ করে।"
হুমায়রা ও হেসে ফেলে টুক করে।বিভান মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''বাবা পরে কোলে নিবো।লাবনী ওকে নিয়ে যাও তোমার বোনের সাথে কথা বলি।"
''ওকে।"
বেরিয়ে এলো লাবনী।বিভান হুমায়রার দিকে ফিরে বলল,
''দেখো যা হয়েছিলো সেটা এ্যাক্সিডেন্ট।এটাকে ভেবে কেন পিছিয়ে পড়বা?দেখো হুমায়রা আল্লাহ তা'লার নিকট শোকর আদায় করো যে সময় মতো চলে গিয়েছিলাম। আল্লাহ তা'লা চাইলে সব ঠিক করে দিতে পারেন শুধু তোমাকে চেষ্টা করতে হবে।"
হুমায়রার চোখে পানি চলে আসে।বলল,
''ভাই চেষ্টা করছি বাট ভুলতে ও পারছিনা।"
বিভান আবার ও বুঝাতে শুরু করে।এদিকে ঘন্টাখানেকের মাঝে সাইমন ও চলে আসে।সাঁঝ কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিয়েছে।নিশাদ ও এলো পনের মিনিটের মতো হবে।হুমায়রার এ কাহিনীর পর থেকে ওর কোন কিছুই ভালো লাগেনা।কয়েকদিন যাবৎ ইমতিয়াজের কল গুলো এ্যাটেন্ড করতে ও পারছেনা।কি করবে বুঝতপ পারছেনা।কিভাবে বোনটাকে সামাল দেবে ও?আজকাল কাজে ও মন বসাতে পারেনা। ইদ্রিটাকে ও বড্ড দেখতে মন চসয় কিন্তু ও জানে ওখানে গেলে নিশ্চয়ই কেঁদে দেবে।যে মানুষটা বাবা হারানোর শোকে এমনিই জর্জরিত তাকে কি বলবে ও?এর থেকে ভালো হবে নিজে একটু স্বাভাবিক হয়ে মেয়েটার কাছে যাবে।সাঁঝ ভাইয়ের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে বলল,
''ভাই আমি চলে যাবো ওনার সাথে। "
''হঠাৎ?"
ভ্রু কুঁচকায় নিশাদ।সাঁঝ বলল,
''না ভাই অনেক দিন হলো।আবার আসবো।দাদি হয়ত মুখে কিছু না বললে ও ওনার হয়ত ভালো লাগছেনা।চলে যাই আবার আসবো কিছু দিন পর।নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
''আচ্ছা।আসি তুই।হুমায়রার যে অবস্থা আমার নিজেরই ভালো লাগছেনা কি করবো? বুঝতে ও পারছিনা।"
সাঁঝ বলল,
''বিভান ভাই অনেক চেষ্টা করতেছে।আমার মনে হয় এই শক থেকে অনেক সময় লাগবোনা বের হইতে।"
....................রাত এগারোটা।রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে আদনান।চোখের সামনে ঐ দৃশ্য আসতেই দম আটকে যায় আদনানের।ইচ্ছে হচ্ছিলো লোকটাকে ঐখানেই গেড়ে দিতে।কিন্তু প্রিয়াশা কেন বলেনি ওকে?কিসের ভয়ে বলেনি?এখনো ওর সাথে এত কিসের জড়তা?ভাবতেই কষ্টু গুলো দানা বাঁধতে শুরু করে হৃদয় জুড়ে।
হঠাৎ কল আসে আদনানের ফোনে।বেজে উঠে ফোন টা।কল রিসিভ করে দেখে সাঁঝ কল করেছে।কল রিসিভ করতেই সাঁঝ রেগে বলল,
''কই তুই?"
''আছি। কেন?"
সাঁঝ মন খারাপ করে বলল,
''চলে যাইতেছি।গাড়িতে বসলাম। তোরে বলে আসতে পারিনি।সেই যে বের হলি ঘরে আসলিই না। কি হইছে বলবি?"
''কিছুনা।তুই চলে যাইতেছিস কেন হঠাৎ?"
''থাকলেই তো ঘর থেকে বেরিয়ে যাস। কেন থাকবো তোদের বাসায়?"
রেগে গেলো আদনান।বোন এভাবে কেন বলছে।ও বলল,
''এভাবে কথা বলা শিখলি কবে থেকে?"
''মজা করছিলাম ইউ ইডিয়ট।ভাবি কে বলে এসেছি।সামনের সপ্তাহে আমাদের বাসায় দাওয়াত চলে আসিস।"
''দেখা যাক।"
''আসতেই হবে। তুই বাসায় চলে যা।অনেক শীত পড়ছে।থাকিসনা বাহিরে।"
''ওকে।আচ্ছা রাখি পরে কথা হবে।দাদিরে সালাম দিস।"
''আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ রাখলাম।"
হাঁটতে হাঁটতে ঘরের সামনে কখন চলে এলো খেয়াল ছিলো না আদনানের।ফোন কেঁটে ভিতরে ঢুকে গেলো।ঘরে আসতেই জুলেখা বানু জিজ্ঞেস করতে লাগলেন,
''এতক্ষন কই ছিলি?তোর বোইন চইলা গেলো।তুই আছিলিনা।আমার মাইয়াডা কতো কাইন্দা কাইটা গেলো গা।"
আদনান বলল,
''ওর সাথে কথা হইছে মা।"
জুলেখা বানু এবার বললেন,
''হাত মুখ ধুইয়া বয় খাওন দিতাছি।"
''না মা খামুনা।পেট ভরা আমার।"
জুলেখা বানু অবাক হয়ে বললেন,
''বাসাত এতো রান্না বান্না হইলো। কই খাইলি তুই?"
''খাইছি আম্মা আমি ঘুমামু।"
বলেই রুমে চলে গেলো আদনান।এদিকে কিছুক্ষন পর প্রিয়াশা রুমে এসে ওর পাশে শুয়ে পড়ে হাত মুখ ধুয়ে।আদনান চুপ করে শুয়ে আছে।প্রিয়াশা বলল,
''কি হয়ছে আদনান? কথা বলেননা কেন?সারাদিন বাসায় ও এলেননা আপু চলে গেলো।"
আদনান শান্ত কন্ঠে বলল,
''প্রিয়াশা তুমি কিছু লুকাচ্ছো?"
''কি লুকাবো?বুঝতে পারছিনা।"
আদনান নিজের রাগ দমিয়ে আবার ও বলল,
’'প্রিয়াশা বলো কি লুকাচ্ছো তুমি?"
''কিছুনা এভাবে বলছেন কেন?"
আদনান খাট থেকে উঠে দরজা লক করে রেগে বলল,
''তাহলে অফিসে যা দেখলাম তোমার সেখানে মত আছে। এটা তো বুঝাতে চাইছো?"
অবাক কন্ঠে প্রিয়াশা বলল,
''কিসে মত আছে?কিছু বুঝতে পারছিনা।"
আদনান চেঁচিয়ে বলল''না বুঝার ভান ধরছো কেন?মনে করছো কিছুই দেখিনা?স্যারের সাথে এতো কিসের লাগালাগি তোমার?"
প্রিয়াশার বুঝতে দেরি হলোনা।বুঝতে পারছে আদনান স্যারের অসভ্যতামি দেখে ফেলেছে।কিন্তু ওকে কেন এভাবে বলছে?লোকটা ওকে কেন অবিশ্বাস করছে? প্রিয়াশা কাঁদতে লাগলো।বলল,
''আস্তে কথা বলুন প্লিজ।এভাবে বলছেন কেন আমাকে?আমার সত্যি দোষ নেই।"
চেঁচিয়ে উঠে আদনান।বলল,
''যদি দোষ তোমার নাই থাকে তাহলে কেন বলোনি আমাকে?বলো।কেন জানাও নি আমাকে?"
প্রিয়াশা কেঁপে উঠে।তারপর কেঁদে বলতে লাগলো,
''প্লিজ কথা শুনুন।একটু ধীরে বলুন সবাই শুনবে।আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ আদনান।"
''আমাকে তুমি জানাওনি প্রথমত।আর এখন বলছো মাফ করে দেই।এটা অবশ্যই আজকালকার ঘটনা নয় প্রিয়াশা অনেকদিন ধরেই চলছে।এখন তো তোমার হাসবেন্ড আমি। কেন বলোনি তাহলে?
''জব নেয়ার পর থেকেই চলছিলো এসব?চাচা চাচী এতো বাজে আচরন করতো ওনাদের কারনেই জব নিয়েছিলাম।কিন্তু তখন কাউকে বলতে পারছিলাম না।স্যার যেদিন জানলো আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন সেদিন আমাকে বলে আপনাকে কিছু বললে আপনাকে নাকি চাকরী থেকে বের করে দেবে আর এমন অবস্থা করবে যেন আপনি আর কোথাও চাকরী না পান।তখন আমি কি করতাম বলেন?এমনিতেই চাকরী পাচ্ছিলেননা আপনি।এটা চলে গেলে আমার ভীষন কষ্ট হতো তাই সেদিন চাকরী ছাড়ার কথা বলেছিলাম কিন্তু আপনি না করে দিলেন।"
''আনবিলিভেবল প্রিয়াশা ওনার ভয়ে তুমি আমাকে এত বড় কথাটা জানাওনি।এই অন্যায় সহ্য করে যাচ্ছিলা তুমি?তোমার আমাকে বলার দরকার ছিলো।শুনো ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।সুতরাং এমন মানুষদের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকাটা একদমই ঠিক না।অন্যায় মুখ বুজে কেন মেনে নিচ্ছো?শিক্ষিত মেয়ে তুমি?আর সেখানে তুমি একা না অনেকেই আছে।ভালো করোনি প্রিয়াশা আমাকে না বলে ভালো করোনি তুমি।"
প্রিয়াশা কাঁদতে লাগলো আদনান কে জড়িয়ে। বলতে লাগলো,
''প্লিজ মাফ করে দিন আর কখনো হবেনা।"
আদনান শান্ত গলায় বলল,
''যাও ঘুমাও।আমার ও ঘুমাতে হবে।পরে ভাববো কি করা যায়।"
বলে লাইট নিভিয়ে দিলো আদনান।সেরাত ওদের আর কোন কথাই হলোনা।