আকাশটা বেশ মেঘলা হয়ে আছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি চলে আসতে পারে। ছাদ থেকে জামা কাপড় নামিয়ে এনে ইয়াসমিন বেগমের ঘরে গিয়ে শোনে ইশরাত বলছে," এত কিছু করো তারপরেও তো যাচ্ছে না। মা এই মেয়ের ধৈর্য শক্তি বেশি। না হয় এত কাজকর্ম করে কিন্তু শাদাবের কাছে মুখ ফুটে কিছু বলেও না। আর বড় ভাবিকে কিছু বললেই ভাইয়ার কাছে বলে দেয়। আর তখন ভাইয়া আমাদের চোখের দিকে তাকিয়েও কথা বলে না।"
সম্পূর্ণা খাটে জামাকাপড়গুলো রেখে চুপচাপ সামনে দিয়ে চলে এলো। রুমে এসে শৈলীকে কোলে নিয়ে বসে আছে। শাদাব বাহিরে থেকে এসে সম্পূর্ণাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে," বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। বেশ ঠান্ডা পড়বে মনে হচ্ছে। শৈলীকে গরম জামাকাপড় পরিয়ে রাখো।"
কথাটা বলে শাদাব ড্রয়ার থেকে একটা তোয়ালে বের করে মাথা মুছতে মুছতে বলল, " মন খারাপ কেন? হিমেলকে দেখে?"
কথাটা বলতেই সম্পূর্ণা চমকে উঠলো।আসার পর থেকে হিমেলের কথা তার তেমন মনেই ছিল না। কিন্তু শাদাবের মুখে শুনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে, " তুমি হিমেলকে দেখেছ?"
শাদাব হেসে," যার সাথে তুমি এত কাহিনি করলে তাকে চিনবো না? ছেলেটার সাহস আছে।সেদিন দেখলে না আমার সাথে পরিচিত হলো। আমি তখনই বুঝেছি। তবে তোমার অভিনয়ের জবাব নেই। আমার হাতটা সরিয়ে নিলে ভেবেছ আমি বুঝতে পারবো না?"
-" আমাকে নিয়ে তোমার এত সন্দেহ কেন? তুমি কী মনে করো আমার বাচ্চা রেখে আমি হিমেলের কাছে যাব?"
শাদাব গম্ভীর কণ্ঠে বলল," চেঁচিও না। মা শুনতে পাবে। আর মায়ের সামনে নিজের আগের স্বামীকে নিয়ে জাহির করতে যেও না। মা জানে কিডনি নেই কিন্তু এত কাহিনি জানলে তোমায় এই বাড়ি থাকতেও দিবে না। আসোলে কী জানো আমি আটকে গেছি। না পারছি তোমাকে ছাড়তে না পারছি তোমাকে ফেলতে। তোমার অবস্থা এখন কী জানো? কচু তরকারির মতো। চুলকানির জন্য গিলে খেতেও পারছি না আবার স্বাদের জন্য ফেলতে পারছি না।"
সম্পূর্ণা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, " ফেলে দেও না!কেউ তো নিষেধ করেনি। একরকম তুমি কর অন্য দিকে তোমার ফ্যামিলি। তোমরা আমাকে পেয়েছ কী বলবে? আমি চুপ করে থাকি বলে সবাই আমায় কথা শুনাবে? আমার দুর্বলতাকে তুমি কাজে লাগিয়ে আমাকে ব্যবহার করছ এইটা কী তোমার মনে হয় না?
আমাকে একটা কথা বলো এই বাড়িতে আসার পর তুমি মন থেকে বলতে পারবে আমাকে ভালোবেসেছ?"
শাদাব ভ্রু কুঁচকে বলল," আমি তোমায় ভালোবাসিনি!"
-" না ভালোবাসোনি।তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কী ওইটা আমার ভালো করে জানা আছে।"
শাদাব দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে সম্পূর্ণার বাহুডোর শক্ত করে ধরে," কী জানো তুমি? বলো কী জানো?"
সম্পূর্ণা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে," বউকে নগ্ন অবস্থায় উত্তেজনায় মেতে উঠা। এই ছাড়া আর কিছু আছে তোমার মনে?"
শাদাব সম্পূর্ণা কথা শুনে থ হয়ে গেল। আস্তে করে সম্পূর্ণাকে ছেড়ে দিতেই দেখে ইয়াসমিন বেগম আর ইশরাত দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াসমিন বেগম এগিয়ে এসে বললেন," মসজিদে মাইকটা কী এনে দিব তোদের জন্য? কথাটা বলে সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে," তোমার এত বড় সাহস কী করে হলো আমার ছেলের সাথে এইভাবে খারাপ আচরণ করার?"
সম্পূর্ণা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াসমিন বেগম আরও এগিয়ে এসে বললেন," ওর বাপকে খবর দে। ওদের মেয়ে ওরা নিয়ে যাক। এমন বেয়াদব মেয়ে থাকার দরকার নেই। এমন বেশ্যা মেয়ের জন্য দুইটা বিয়ে না দশটা হলেও এদের বিষ কমবে না। নিজের হাতে নিজের ছেলের কপালটা নষ্ট করছি। এখন এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে আমার ছেলেকেই বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে।"
শাদাব বিরক্তিকর মুখে বলল, " মা তুকি থামবে? আর আমাদের মাঝে তুমি কেন কথা বলতে আসছ? বাবাকে তুমি কম জ্বালাতন করো? তবুও তো বাবা মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়। সম্পূর্ণার জায়গায় তুমি থাকলে আমার বাবাকে খুক করতেও হাত কাঁপতো না। কিন্তু ও শুধু ওর মনের কথাই প্রকাশ করেছে। একদিকে ভালোই হয়েছে। আমার ব্যাপারে ওর ধারণাটা জানতে পেরেছি।"
-" তুই কী বললি? আমি তোর বউয়ের চেয়ে খারাপ? ইশরাত দেখেছিস আমার ছেলেকে কী তাবিজ করছে আল্লাহ জানে। এই মেয়ে এতকিছু করলো এখন ভালো হয়ে গেল?"
-" মা আমি তোমাকে খারাপ বলিনি। আর ও আমাকে কিচ্ছু বলেনি। উল্টো আমিই ওর সাথে বাজে আচরণ করেছি। তোমরা তোমাদের কাজে যাও। এইরুমে থাকলে কথা বাড়বে শুধু শুধু।"
সেদিনের পর থেকে শাদাব সম্পূর্ণাকে ছুঁয়ে দেখে না। কিছু দরকার হলেই নিজেই নিজের কাজ করে। শৈলী কান্না করলেও একটু আদর করে আবার রেখে দেয়।
ঠিকমতো বাড়িতে খাওয়াদাওয়াও করে না। মাঝরাত করে বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ে সে। ছয়দিন সম্পূর্ণা কিছু বলেনি। কিন্তু আজ আর সে চুপ থাকবে না। রাত দুইটা, শাদাব সদর দরজা দিয়ে ঢুকে নিজের রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখে সম্পূর্ণা বসে আছে। সম্পূর্ণাকে দেখে কিঞ্চিত অবাক হলেও কিছু না বলে ওয়াসরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সম্পূর্ণা দাঁড়িয়ে আছে।
-" কিছু বলবে?"
-" তোমার কী মনে হয় না তুমি বাড়াবাড়ি করছ?"
-" কী করেছি আমি? তোমাকে স্বাধীনতা দিচ্ছি। আমি তোমাকে শুধু নগ্নভাবে কাছে পেতে ভালোবাসি। এখন তো তুমি খুশি। তাহলে রাত জেগে কিসের অপেক্ষা করছ?"
সম্পূর্ণা মুখে কিছু না বলে শাদাবকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
শাদাব স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে, " কান্নার কী আছে? তুমিই তো এটাই চেয়েছিলে তাই না?"
সম্পূর্ণা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল," আমি তোমাকে বুঝতে পারি না। আসোলে আমার একবার মনে হয় তুমি আমায় খুব ভালোবাসো।আবার তোমার খারাপ আচরণ দেখলে মনে হয় তুমি আমাকে ভালোবাসোই না। শুধুমাত্র রক্ষিতা হিসেবে রেখেছ।"
শাদাব ম্লান হেসে বলল, " আর কী কী মনে হয়?"
-" আমি আর কিচ্ছু বলব না। তোমার যা ইচ্ছে করিও। সত্যি বলছি আমি কিচ্ছু বলবো না।"
শাদাব সম্পূর্ণাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল," আমি তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু যখন তোমার বিশ্রী অতীতগুলো আমার মনে হয় আমার মাথা ঠিক থাকে না। আমি মানুষ আমি মহান ব্যক্তি নয় তোমার সব ভুলে যাব। তোমার অতীত জেনেই কিন্তু আমি বিয়ে করেছিলাম কিন্তু কিডনির ব্যাপারটা আমি মানতে পারছি না। আর তুমি যা শুনিয়েছ এর জন্য দায়ী তুমি। আর আমি এসব ভাবলেই আমি ঠিক থাকতে পারি না।"
সম্পূর্ণা আর কিছু বলতে পারলো না। সত্যিই তো সবকিছুর জন্য সে একাই দায়ী। হিমেলের প্রেমে সে অন্ধ ছিল। মেয়েদের এই বয়সে কেন তারা নিজেকে আটকাতে পারে না। কিন্তু ছেলেগুলো কেন এত আয়োজন করে ঠকায়?ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। শুধু টাকা আর মোহতেই ডুবে গেছে সব।
শৈলীর বয়স এখন চার। শাদাব এর মাঝে কয়েকবার এসে ঘুরে গেছে বাড়িতে। এর মাঝেই সম্পূর্ণার ফেসবুকে গল্প পড়ার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। সব কাজ শেষেই রাতের বেলা গল্প পড়া তার নেশা হয়ে গেল। এর মাঝেই গল্প পড়া শুরু করে আফরার (রাবেয়া সুলতানা) ফেসবুক থেকে। পরাণ প্রিয়া গল্পটা পড়ার পর থেকেই সম্পূর্ণা আরও ভালো লাগা কাজ করেছিল। আফরা নোয়াখালীর মেয়ে সেটা সম্পূর্ণার জানাই ছিল না। এর মাঝে শাদাব আবার বাড়ি এলো। দুইমাস না যেতেই শুনে সম্পূর্ণা আবার কনসিভ করেছে। শাদাব খুশি হয়ে সম্পূর্ণাকে একটা চেইন লকেট উপহার দিয়েছিল। ইয়াসমিন বেগম বলেই ফেললেন এবার আমার নাতি আসবেই। শাদাব আমার নাতি এলে একটা গরু খাওয়াবো। এতিমখানায়ও দেওয়া হবে।" শাদাব একগাল হেসে বলল," আল্লাহর ইচ্ছে মা!"
কনসিভ হয়ার কয়েকদিন পরেই শাদাব আবার চলে গেল। শাদাব যাওয়ার একমাস পরপরই সম্পূর্ণা বাপের বাড়ি এলো। এবার শাদাবকে বলেছে দুইমাসের আগে ওই বাড়ি যাবে না।শাদাবও যেন অল্পতেই রাজি হয়ে গেল।
শৈলী নানার বাড়ি যেন মাতিয়ে রাখত একাই। শৈলী তাবিয়ার থেকেও লামিয়ার কাছে থাকতে বেশি পছন্দ করতো। আজও তার বিপরীত হয়নি। সকাল থেকে একবারও সে এই ঘরে আসেনি। তাই সম্পূর্ণা নিজে গিয়ে দেখে শৈলী লামিয়ার ছোট মেয়ের সাথে ভাব জমিয়েছে। আর লামিয়া বসে বসে ফোনে কথা বলছে।
ফোন শেষ করে লামিয়া সম্পূর্ণাকে বসতে দিয়ে," কি'রে তুই তো ঘর থেকে বের হোস না। আজ সূর্য কোন দিকে উঠলো?"
-" এমনি ভাবি। এখানে আসার পর থেকে ঘুম আর ঘুম। এত ঘুম কেন বাড়ছে বুঝি না। আচ্ছা বাদ দাও। তুমি এতক্ষণ কার সাথে কথা বললে?"
-" আমার চাচাতো ভাই। ও মাঝেমধ্যে ফোনদিয়ে আমার খবর নেয়। তোর ভাইয়ার সাথেও কথা বলে। ওর মা অসুস্থ তাই আমাকে ফোন দিলো আমি ওই বাড়ি গেছি কি-না।"
লামিয়া উঠে চা বসিয়ে দিলো চুলায়। সম্পূর্ণা লামিয়ার ফোন হাতে নিয়ে," তোমার চাচীর কী হয়েছে?"
-" ক্যান্সার। যাব যাব বলেও যাও হয় না।"
সম্পূর্ণা কথা বলতে বলতে ফোনের গ্যালারিতে একটা বাচ্ছা ছেলের ছবি দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,"ভাবি এই বাচ্চাটা কে?"
ফোনটা লামিয়ার দিকে তাক করে ধরতেই লামিয়া হেসে বলল," আরে এই ছেলেটা আমার এই চাচাতো ভাইয়ের। ও মাঝেমধ্যে আমার এইখানে ওর ছেলের ছবি পাঠায়? কেন তুই দেখেছিস না-কি আগে?"
সম্পূর্ণা দ্বিধা কন্ঠে বলল," ওর মায়ের নাম আফরা (রাবেয়া)?
-" হ্যাঁ, কিন্তু তুই কীভাবে চিনিস?"
-" ভাবি সত্যই উনি তোমার ভাইয়ের বউ?"
-" তোকে মিথ্যা বলবো কেন? তোকে যখন আমাদের বাড়ি নিয়েছিলাম তখন তো আমার চাচাতো ভাই বিয়ে করেনি। তাই দেখিসনি।"
-" কিন্তু এইটা কীভাবে সম্ভব? আচ্ছা!আমার সাথে উনাকে কথা বলিয়ে দিতে পারবে?"
-" আসোলে ও আমাদের বাড়ি থাকে না কয়েকমাস হলো। আমাদের বাড়িতে সব আলাদা হয়ে যাওয়ার পর ও অন্য জায়গায় থাকে। তবে আমাদের বাড়িতে যখন আসে তখন কথা বলিয়ে দিতে পারবো।"
সম্পূর্ণা শান্ত গলায় বলল," তুমি যখন তোমার চাচীকে দেখতে যাবে আমাকে নিয়ে যেও।"
লামিয়া সম্পূর্ণার কথায় হকচকিয়ে গেল। যে মেয়ে বাপের বাড়ি আসে না সে মেয়ে আমার বাপের বাড়ি যাবে? তাও আবার আফরার কথা শুনে!"
লামিয়া সম্পূর্ণাকে এবার প্যাঁচিয়ে ধরেছে। সত্যি করে বলতো আফরার সাথে তোর কী সম্পর্ক?"
অনেক চাপাচাপির পর সম্পূর্ণা বলল," ভাবি লেখালেখি করে তাই না?"
লামিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে, " জানি না তো। তুই জানিস কীভাবে?"
-" ফেসবুকে। উনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে। ভাবি প্লিজ একবার দেখা করিয়ে দাও।"
লামিয়া কথা আর না প্যাঁচিয়ে বলল," আচ্ছা ঠিক আছে আফরা মনে হয় এখন আমাদের বাড়ি। ওর শ্বাশুড়ি অসুস্থ তো তাই। তুই শাদাবের থেকে বলে নিস। আমরা দুই একদিনের ভেতরেই যাব।
.
.
.
চলবে...................................