বিহানের সাথে অনাথ আশ্রমে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েই ফ্লাটে ফিরেছে রিখিয়া। বিহানই ড্রপ করে দিয়েছে ওকে। ওর জীবনের সেরা দিনগুলোর মধ্যে একটা ছিল আজকে। অনাথ বাচ্চাগুলোর সাথে কিছুটা সময় কাটানোতে যে কতটা শান্তি আর আনন্দ থাকে সেটা এর আগে বোঝেনি। ফ্লাটে এসে রুমে এসে দেখে তুর্বী নেই এখানে। ও বেশ অনেকটা অবাক হল। তুর্বী কী আসেনি এখনও? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে ব্যালকনি তে তাকিয়ে ওর মেজাজটা খারাপ হল। কারণ তুর্বী রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এতো করে বারণ করে এরকম করতে, মেয়েটাকে কিন্তু মেয়েটা শোনেই না। হুটহাট কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হবে? রিখিয়া ব্যাগটা রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে তুরের হাত ধরে টেনে রেলিং থেকে নামিয়ে বলল,
" এসব কী তুর? কতবার বলেছি তোমাকে এরকম করবে না?"
তুর্বী মাথা চুলকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
" আরে আমি ভালোভাবেই ধরে রেখেছিলাম তো।"
" দুর্ঘটনা জানিয়ে ঘটেনা।"
'' আচ্ছা তোর এতো দেরী কেন হল? কোথায় গিয়েছিলি?"
" বিহানের সাথে দেখা করতে।"
তুর্বী ভ্রু বাঁকা করে বলল,
" বাহ! ভালোই তো শুরু হয়েছে তোদের।"
রিখিয়া হেসে রেলিং এ হেলান দিয়ে বলল,
" হ্যাঁ হ্যাঁ মজা নিতে থাকো। আজ তোমার প্রেজেন্টেশন ছিল না? কেমন হল?"
" জানিনা। কিন্তু আমার প্লানটাই এপ্রুভ হয়েছে।"
" আরেহ বাহ! দ্যাটস লাইক মাই গার্ল।"
তুর্বী কলারটা উঠিয়ে একটু ভাব নিয়ে বলল,
" দেখতে হবে কে করেছে বুঝলি।"
" তো তোমার বস কথা বলেছে পরে তোমার সাথে?"
" বলতে চেয়েছিল ইগনোর করে চলে এসছি। মামাবাড়ি নাকি হ্যাঁ? যখন ইচ্ছে সবার সামনে অপমান করবে। আবার ইচ্ছে হলে ডেকে মিষ্টি কথা বলবেন। আর আমিও সেভাবে নাচবো? হতেই পারেনা।"
রিখিয়া তুর্বীর পিঠে চাপড় মেরে বলল,
" বড় হও এবার।"
তুর্বী খিলখিলিয়ে হেসে দিয়ে বলল,
" তো আমাকে দেখে কী বাচ্চা লাগে? আমার কথা ছাড় তুই এটা বল যে বিহানের জন্যে কিছু ফিল করিস। "
রিখিয়া হাসি থামিয়ে দিল। ও নিজেও বুঝতে পারছেনা আদোও বিহানের জন্যে ও কিছু ফিল করে কী না। তবে বিহানের আশেপাশে থাকতে ওর ভালোলাগে। বিহানের করা দুষ্টুমিগুলো ও এনজয় করে। যেই বিহানকে একদিন ওর অসহ্য লাগত সেই বিহানকেই একদিন না দেখলে ওর কাছে দিন অসম্পূর্ণ মনে হয়। এই অনুভূতির নাম ওর জানা নেই। তবে এটুকু জানে যে ওর অনুভূতি আছে। অবশ্যই আছে।
___________
আরো দুটো দিন কেটে গেল, এরমধ্যে সৌহার্দ্য তুর্বীর সাথে কথা বলতে চাইলেও তুর্বী ইগনোর করে চলেছে। শুধুমাত্র অফিসিয়াল কথা ছাড়া কোন কথাই বলে না। সৌহার্দ্য অফটপিক কোন কথা বললেই তুর্বী এড়িয়ে যায়। এমনিতেই সৌহার্দ্য রায়হান পরিচয়ে অফিস, S.R. পরিচয়ে রেডিও স্টেশন সামলাতে সামলাতে বেচারা হিমসীম খাচ্ছে তারওপর এই মেয়েটা। কী করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। এই মেয়েটাকে কে বোঝাবে যে ওর বাড়তি বকবক, দুষ্টুমি, বাচ্চামো এসব না দেখলে ওর ভালোলাগেনা। একদম ভালোলাগেনা।
মিসেস নাহার আজ রান্নাঘরে জমিয়ে রান্না করছেন। মেয়ে আর জামাই এসছে। তার চেয়ে বড় কথা বিহানও এসছে। শফিক রায়হান তো আপাতত আর এই বাড়িতে নেই তাই সৌহার্দ্য জোর করেই নিয়ে এসছে। তিন ভাইবোন আর দুলাভাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে এখন। কিন্তু সৌহার্দ্যর মনোযোগ আড্ডায় কম অন্যদিকে বেশি। বিহান ব্যাপারটা লক্ষ্য করে হালকা করে একটা ধাক্কা মেরে বলল,
" সমস্যা কী? কী ভাবছিস।"
সৌহার্দ্য হালকা চমকে উঠল, এরপর মাথা নেড়ে 'কিছুনা' বোঝালো। নুসরাতের হাজবেন্ড ইকবাল বলল,
" আরে শালাবাবু বলে ফেলতো। আমরাইতো।"
বিহান বলল,
" ওয়ান সেকেন্ড, তুর্বীকে নিয়ে কিছু হয়নিতো।"
নুসরাত একটু অবাক হয়ে বলল,
" তুর্বী?''
সৌহার্দ্য বাঁধা দেওয়া সত্ত্বেও বিহান ওদের সবাইকে সবটা খুলে বলল। সবটা শুনে নুসরাত বলল,
" বাপড়ে আমার ভাইটাও তাহলে প্রেমে পরতে পারে?"
সৌহার্দ্য কিছু না বলে হাসল। কিন্তু নুসরাতকে বলল না 'এমন কিছুই না'। কেন বলল না নিজেও জানেনা। তবে কী সত্যিই প্রেমে পরেছে? এসব ভাবনার মাঝে বিহান বলল,
" কী হয়েছে সেটাতো বলবি এবার?"
ইকবাল আর নুসরাতও বারবার জোর করছে বলার জন্যে তাই বাধ্য হয়ে সৌহার্দ্য বলেই দিল সবটা। সবটা শুনে বিহান আবার ওর সেই বিখ্যাত দমফাটা হাসি দিল। ইকবাল আর নুসরাতও মিটমিটিয়ে হাসছে। সৌহার্দ্য বলল,
" হাসিস না ইয়ার। ঝামেলায় আছি।''
এরমধ্যেই মিসেস নাহারের ডাক পরল আর নুসরাত আর ইকবাল উঠে চলে গেল। বিহান কোনমতে হাসি থামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সৌহার্দ্যর কাঁধে হাত রেখে বলল,
" ব্রো। নিজের ফর্মে গিয়ে ট্রায় কর, ঠিক হবে।"
বলে ডাইনিং এ চলে গেল। সৌহার্দ্যও চুপচাপ ভাবতে বসল।
____________
সন্ধ্যার পর তুর্বী সব গুছিয়ে নিয়ে তুর্বী ঠিকভাবে রেডি হয়ে বেড় হল অফিস থেকে। পার্কিং এরিয়া পাস করার সময় পেছন থেকে 'তুর্বী বলে ডেকে উঠল'। তুর্বী পেছনে তাকিয়ে দেখল সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বীকে দাঁড়াতে দেখে সৌহার্দ্য এগিয়ে আসল। তুর্বী স্বাভাবিকভাবে বলল,
" কিছু বলবেন স্যার?"
" চল আমার সাথে।"
" কোথায়?"
" কাজ আছে।''
" অফিসিয়াল কিছু?''
'' না।"
" আমি এখন কোথাও যাবোনা স্যার। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে ফিরতে হবে।"
সৌহার্দ্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে তুর্বীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
" তুমি আমাকে না করছ?"
তুর্বী ইতস্তত করে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,
" দেখুন স্যার। আপনি আমার বস, সেটা অফিসের ভেতরে। এখন অফিস টাইম শেষ হয়ে গেছে। সো ইউ কান্ট ওর্ডার মি নাও।"
" আরে আমার কথাটাতো শোন?"
" সরি, বাট আমার সময় নেই।"
অন্যসময় হলে তুর্বী ঠিক শুনতো কিন্তু এখন তো ও সৌহার্দ্য ওপর যথেষ্ট রেগে আছে। তাই ইচ্ছে করেই কথা শুনছেনা। শুনবেও না। সেদিন এভাবে সবার সামনে অপমান করার সময় মনে ছিল না। তুর্বী চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে বলল,
" কথাগুলো ইমপর্টেন্ট।"
তুর্বী ত্যাড়াভাবে জবাব দিল,
" আমার ফেরাটা আরও বেশি ইম্পর্টেন্ট।"
সৌহার্দ্যর এবার একটুখানি রাগ লাগছে। মেয়েটা তো কোন কথাই শুনতে চাইছে না। এসবের কোন মানে হয়? ও নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে আঙ্গুল দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
" লাস্ট টাইম বলছি। যাবে কী না?"
তুর্বী ঘাড়ত্যাড়ার মত করে বলল,
" নাহ মানে হল নাহ।"
সৌহার্দ্য হঠাৎ করেই তুর্বীকে কোলে তুলে নিল। তুর্বী বোকার মত তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। ও ভাবেও নি সৌহার্দ্য এমন কিছু করবে। সৌহার্দ্য তুর্বীকে গাড়িতে বসিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে তুর্বী কিছু বুঝে উঠতে পারল না। ও সবটা ঠিকভাবে বুঝতে বুঝতে সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট করে ফেলেছে। তুর্বী সৌহার্দ্যকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে কিন্তু ও কোন উত্তরই দিচ্ছে না ও ওর মত গাড়ি চালাচ্ছে।
পার্কের একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে সৌহার্দ্য আর তুর্বী। তুর্বী দুইহাত এক করে থাই এর ওপর রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আসলে পার্কে এনে বসানোর পরেও তুর্বী কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করেছে। সৌহার্দ্য 'সরি' বলায় শান্ত হয়েছে। বেশ কয়েকবার 'সরি' বলার পর তুর্বী বলেছে ভেবে দেখছে। আর সেই ভাবা এখনও চলছে। সৌহার্দ্য এবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,
" ম্যাম? ভাবা হয়নি?"
তুর্বী আড়চোখে একবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
'' সরি এক্সেপ্ট করতে পারি একটা শর্তে।"
সৌহার্দ্য অবাক হল। সরি এক্সেপ্ট করার জন্যেও শর্ত? তবুও বলল,
" সেটা কী?"
তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে ঘুরে বসে উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
" আমার বয়ফ্রেন্ড হবেন? বিয়ে কমিটমেন্ট কিচ্ছু দরকার নেই। জাস্ট বয়ফ্রেন্ড। হ্যাঁ?"
সৌহার্দ্য বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
" জাস্ট ফ্রেন্ড শুনেছিলাম। জাস্ট বয়ফ্রেন্ড কী জিনিস?"
তুর্বী হাসি মুখেই চঞ্চলতার সাথে বলল,
" মানে হল আমরা রিলেশন এ থাকব। কিন্তু কোন কমিটমেন্ট, ন্যাকামো, সিরিয়াসনেস লাইক 'তোমায় ছাড়া এ জীবন ব্যর্থ' এসব লেইম জিনিস থাকবেনা। শুধুই টাইম পাস ওয়ালা রিলেশনশীপ। এগ্রি? নাকি অন্য ছেলেদের মত আপনিও এটা শুনে ইউটার্ন মারবেন?"
.
.
.
চলবে.........................................