রংধনু - পর্ব ৭০ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


দিনটা ছিলো শুক্রবার।কারোর অফিস স্কুল কলেজ নেই।তাই রান্না বান্নার ঝামেলা একটু বেশিই ছিলো।বেলা রান্না করছে। সাঁঝ প্রিয়াশা এটা ওটা এগিয়ে সাহায্য করছে ওকে।এদিকে বিভান সকাল থেকে হুমায়রাকে কাউন্সিলিং করছে।বি ভানের মনে হচ্ছিলো হুমায়রার মাঝে ধীরে ধীরে বেশ পরিবর্তন আসছে।এমন হতে থাকলে আর বেশি দেরী হবেনা হুমায়রার স্বাভাবিক হতে।এদিকে সামনের সপ্তাহে ইন্ডিয়া চলে যাবে ওরা।তাই একটুপর বের হবে ভিসার কাজে।বিকেলে রওনা দেবে ও আর বেলা।পূর্না সেই সকাল থেকে কুঞ্জনের সাথে বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।অবশ্য মামা খালাদের পেলে কিছুই লাগেনা ওর।সবার আদরে থাকে ছোট্ট মেয়েটি।সাইমন কাল রাতেই চলে গিয়েছিলো। সাঁঝ যেতে চাইছিলো না কারন বেলা চলে যাবে।বোনের সাথে কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে চায় ও।সাইমন কে অবশ্য যেতে দিতে চাইছিলোনা ওরা তবে বাসায় দাদি আর মিতুল একা।বাসায় একজন পূরুষ মানুষ থাকলে ভালো হয়।তাই সাইমন চলে গিয়েছে।বেলা রান্না চড়িয়ে ডাল ঘুটছে।সাঁঝের রুমে এসে ইকরাম রাহমান বড় জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
''বাবা নামাজে যাইবানা?"
বিভান হুমায়রার থেকে মুখ ঘুরিয়ে পিছে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
''জি বাবা।আমি রেডি আপনারা তৈরি হয়ে নিন।"
ইকরাম রাহমান বললেন,
''আইচ্ছা। আদনান ও রেডি হইয়া আছে।তুমি আইসা পড়ো জলদি।"
''জি।"
কিছুক্ষনের মাঝে কুঞ্জন ও এসে পড়েছে।পূর্নার হাতে গোলাপী বর্নের কটন ক্যান্ডি।এসেই ক্যান্ডিটি নিয়ে দৌড়াতে আরম্ভ করলো।মেয়ের হাতে চকলেট দেখে বেলা রেগে বলল,
''এভাবে টাকা কেন নষ্ট করিস?এগুলো কিনে দিলি।পেট খারাপ করবে ওর।"
কুঞ্জন হেসে বলছিলো, 
''আরে আপা একদিন খেলে কিছু হবেনা।"
''হুম।যা নামাজে যা। আব্বা খুঁজছিলো তোকে।"
কুঞ্জন আচ্ছা বলে পূর্নাকে চুমু দিয়ে চলে গেলো মসজিদে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে।নিশাদ বেলাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলো ও ইদ্রিকে নিয়ে বের হবে নামাজ শেষে।মসজিদে যাওয়ার সময় নিশাদ খেয়াল করে আদনান বেশ চুপচাপ।আজ সকাল থেকেই বেশ চুপচাপ আদনান।ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলছিলো নিশাদকে।নামাজের সময় সালাম ফিরানোর পর নিশাদ খেয়াল করে আদনানের চোখের কোনে জমে আছে অশ্রু। বেশ চিন্তা হতে থাকে নিশাদের।নামাজ শেষে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে নিশাদ আদনানকে আলাদা করে বলেছিলো,
''কি হইছে তোর বলবি?"
আদনান হাসার চেষ্টা করে বলল,
''কি হবে ভাই?আমি ঠিক আছি।"
নিশাদ শক্ত গলায় বলল,
''তোকে ঠিক লাগছেনা।"
আদনান মাথা নেড়ে বলল,
''ভাই কি যে বলিস।কিছু হয়নি........"
নিশাদ ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
''বাসায় যা।আমার ফিরতে সন্ধ্যা হবে।"
আদনান কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
''ভাত খাবিনা?"
নিশাদ বলল,
''নাহ বাহিরে খাবো।তোরা বাসায় যা।"
''আচ্ছা।"
আদনান বাকি সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।বাসায় ফিরে দেখলো বেলা আর সাঁঝ কেবল নামাজ পড়ে উঠেছে।প্রিয়াশা নামাজ পড়া শিখেছে দুটো সুরা দিয়ে।ইখলাস আর সুরা ফাতিহা ছিলো ওর শেখা দুটো সূরা।ঘরে ঢুকতেই মন টা বেশ ভালো হয় সবার পৃর্নার হুটোপুটি দেখে।সারাঘরে বাচ্চাটা দৌড়ে হাসতে থাকে।পূর্না দৌড়াতে দৌড়াতে বিভানের গায়ের সাথে ধাক্কা খেতেই পিছন দিকে পড়ে বসে যায়।বিভান মৃদু হেসে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, 
''এত দুষ্টু করতে হয়না মা।পড়ে গিয়ে ব্যাথা লাগবে তো।"
পূর্না বলল,
''লাব্বেনা।পুলনা অনেক স্তং।"
বিভান হেসে মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আমার মাটা খুব স্ট্রং.........."
জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায় পূর্না।বিভান মেয়েকে নামিয়ে বলল,
''বাবা পরিষ্কার হয়ে আসি মা।তুমি যাও নানুর কাছে।"
পূর্না নেমে দৌড়ে কই যেন চলে গেলো।আদনান রুমে এসে পাঞ্জাবি খুলে মেলে দেয় তখনই প্রিয়াশা রুমে প্রবেশ করে।আদনান পিছনে তাকিয়ে কিছু বলেনা।প্রিয়াশাকে বেশ মলিন দেখাচ্ছে।আদনান পাঞ্জাবি মেলে দিয়ে খাটে বসে বলল,
''তোমরা খেয়েছো?"
প্রিয়াশা মাথা নেড়ে বলল,
''কেমনে খাবো।আপনারা আসলেন কেবল।"
''হুম।প্রিয়াশা আমি কি করবো বলো তো?"
প্রিয়াশা আদনানের কাঁধ চেঁপে দিতে দিতে বলল,
''বুঝতে পারিনা আদনান।বাসায় কি বলবেন?সামনে কি করবেন?ভেবেছেন?"
আদনান মাথা নেড়ে বলল,
''জানিনা প্রিয়াশা।সত্যিটা জানার পর আব্বা ভাই কতোটা কষ্ট পাবে।"
প্রিয়াশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদনানের কাঁধ চাঁপতে থাকে।এদিকে বেলা সাঁঝকে ডেকে বলল,
''সবাইকে খাইতে ডাক।আমার বের হতে হবে।"
সাঁঝ ডাকতে চলে গেলো সবাইকে।বেলা কাপড় বের করছিলো ওর আর বিভানের।কিছুক্ষনের মাঝে টেবিলে সবাই একত্রিত হলো খাওয়ার জন্য।জুলেখা বানু এসেই বললেন,
''আমার নিশাদ কইরে?"
আদনান বলল,
''ভাই কাজে গেছে।কইলো বাহিরে খাইবো।"
''অহ।"
সবাই খেতে থাকে।খাবার শেষে সাঁঝ রুমে এসে দেখলো সাইমনের কল এসে আছে।সাঁঝ কল দিলো সাইমনের নম্বরে।কয়েকবার রিং হতেই সাইমনের অভিমানী কন্ঠ শোনা গেলো।বলতে লাগলো,
''কল দিলে যে?"
সাঁঝ একটু হেসে বলল,
''আপনার কল দেখেই দিলাম।কেন কেঁটে দিবো?"
সাইমন একটু রেগে বলল,
''কাঁটো কাঁটো!!!!কাঁটবাই তো।এখন সবার সাথে আছো আমাকে কি মনে থাকবে?"
সাইমনের এমন কথায় হাসি পেলো সাঁঝের।বলল,
''অদ্ভুত।রান্না বান্নায় ব্যাস্ত ছিলাম।এভাবে বলছেন কেন?"
''হুম।সবার কি খবর?"
''আছে।কি বলবেন বলেন।চা বসায় আসলাম।"
সাইমন রেগে বলল,
''আরে এতো রাখি রাখি কেন করছো?"
''বললাম তো চা বসায় আসছি।"
''চা বানাতে গেলে কথা বলা যায়না?"
সাঁঝ অনেকটা রেগে গেলো।বলতে লাগলো,
''হয়েছে টা কি আপনার?
সাইমন বলল,
''রেগে যাচ্ছো কেন?আজিব তো।"
''হ্যা রাগার অধিকার তো কেবল আপনাদের।আমরা তো মানুষই না।"
''এটা কখন বললাম সাঁঝ?"
সাইমন চটে গেলো।সাঁঝ বলল,
''শুনেন বলতে হয়না সব।কথায় বোঝা যায়।"
সাইমন রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সাঁঝের নাকের সামনে পোড়া গন্ধ আসতেই সাঁঝ রেগে বলল,
''আপনার সাথে প্যাঁচাল পাড়ার সময় আমার নেই।গেলাম আমি।"
বলেই কল কেঁটে চলে গেলো সাঁঝ।সাইমনের বুঝতে দেরি হলো না সাঁঝ প্রচন্ড রেগে বসেছে।
.....................এদিকে একটা ক্যাফেটেরিয়ার দুপাশের দুটো চেয়ারে বসে আছে ইদ্রি আর নিশাদ।নিশাদ মাথা নামিয়ে বসে আছে আর ইদ্রি নিশাদের দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে আছে।নিশাদের শরীর কাঁপছে।ইদ্রি বলল,
''প্লিজ ভাববেননা।ঠিক হয়ে যাবে সব।আপনি এমন করলে বাসার বাকি মানুষ গুলোর খেয়াল কে রাখবে?"
নিশাদ মাথা তুলে তাকায় ইদ্রির দিকে।ভাবছিলো মেয়েটা কতোই না রাগ করে থাকবে ওর ওপর।হয়ত অনেক কষ্টে মানাতে হতো মেয়েটাকে।কিন্তু ইদ্রিকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা একদমই রেগে নেই বরং নিশাদকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর।নিশাদ বলল,
''তুমি আমার ওপর রেগে নেই?"
ইদ্রি বলল,
''রাগবো কেন?হুমায়রা আপুর তখন আপনাকে দরকার ছিলো।তাই আপনি আমার কাছে আসতে পারেননি।আমি বুঝতে পারি আপনার সমস্যা।"
নিশাদ বলল,
''ইদ্রি আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার সাথে কিছুটা সময় একা থাকতে।"
ইদ্রি নিজে ও কাঁদতে চায় তার ভালবাসার মানুষটিকে ধরে।ইদ্রি বলল,
''বাসায় ভাইয়া আর মা কেউ নেই।চলুন রুম ভাড়া করি।"
ইদ্রির হঠাৎ এ কথায় নিশাদের কিছু টা লজ্জা হলো।নিশাদ বলল,
''না সেটা কেন?গাড়িতে বসি চলো।"
ইদ্রি নিজের কথাটাকে আরো দু একবার ভেবে ভীষন লজ্জা পেলো।তারকর বলল,
''চলুন।"
গাড়িতে দুজন বসে ড্রাইভারকে বেরিয়ে যেতে বলে ইদ্রি।ড্রাইভার চলে যেতেই ইদ্রি নিশাদকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।বলছিলো,
''জানেন আপনার ওপর গত কয়েকদিন যাবৎ খুব রাগ হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন।আমার খুব কষ্ট হতো জানেন।রাতে ঘুম হতোনা আমার একটুও।বুক ধড়ফড় করতো খুব।দম বন্ধ হয়ে আসতো।কাল ভাইয়া যখন বলল আপনার কথা তখন রাগটা ধরে রাখতে পারিনি।বারবার মনে হচ্ছিলো আপনার কতো কষ্ট হচ্ছে।আপনি কিভাবে আছেন?কেন এমন হয় বলেন?আপনাকে ভালবাসি বলেই তো নাকি?প্লিজ এভাবে আর দূরে থাকবেননা।জানাবেন আপনার সব কষ্টের কথা।আমার সহ্য হয় না আপনার থেকে দূরত্ব।"
কাঁদতে থাকে ইদ্রি।নিশাদ ওকে বুকে জড়িয়ে নেয় শক্ত করে।ইদ্রির কোমড় জাপটে ধরে একহাতে অপরহাতে পিঠের ওপর এলিয়ে পড়া চুল গুলোয় হাত বুলাতে থাকে।
ইদ্রি নিশাদের বুকে মাথা রেখে কেঁদে কেঁদে বলছিলো,
''আপনার কাছে একটা আবদার।"
''জি বলো।"
আপনি আমাকে একঘন্টা করে সময় দিবেন আবার?প্লিজ।শুধু আপনার কথা শুনবো।যা বলবেন সব কথা শুমবো।আপনি আমার সামনে থাকলেই হবে।প্লিজ থাকবেন?"
নিশাদ ইদ্রিকে সামনে এনে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
''আসবো ইদ্রি।"
ইদ্রি আবার ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার প্রিয় মানুষটিকে।

!!!!

এরই মাঝে দুদিন পার হয়ে গেলো।আদনান সুযোগ খু্ঁজছিলো কিভাবে পরিবারকে জানাবে চাকরী না থাকার কথা।আজকাল রাতে ঘুম হয়না ওর প্রিয়াশা কারোরই।সারারাত দুজনের ওপাশ এপাশ করে কেঁটে যায়।সকাল হলে দুজনে কোন এক বাহানা দিয়ে ঘরেই থেকে গেছে।কিন্তু এভাবে কয়দিন?সবার মনে তো সন্দেহ চলে যাবে।এ ভেবে আদনানের ঘুম হচ্ছিলোনা রাতে।তাই শোয়া থেকে উঠে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে।প্রিয়াশা শুয়ে আদনানকে দেখছে।আজ দুই রাত ধরে লোকটা এমন করছে।প্রিয়াশা শোয়া থেকে উঠে বসে আদনানের পিঠে হাত রেখে বলল,
''ঘুমোবেন না?"
আদনান দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে তারপর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল,
''কি করবো প্রিয়াশা?বাসায় চাকরীর কথা না বলে কি ভুল হচ্ছে আমার?আব্বা ভাই কি বলবেন ওনারা?কি করবো বলো তো?আমার চিন্তা হচ্ছে।আবার ও ভাইয়ের ওপর চাপ পড়ে গেলো।"
প্রিয়াশা আদনানের পিঠ দুহাতে জড়িয়ে বলল,
''দেখুন একদিন না একদিন বলতেই হবে।আর এসময়ে পরিবার থেকে বড় সাপোর্ট কেউ দেয়না।আপনি বলে দিন।হয়ত কোন ভালো পরামর্শ ও পেতে পারি আমরা।কি বলেন?"
আদনান মন খারাপ করে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল,
''বলার তো দরকার।কিন্তু ভয় হচ্ছে আব্বা কষ্ট পাবেন......ভাইয়ের ও ভালো লাগবেনা।"
প্রিয়াশা আদনানকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
''দেখুন বলে দিন।কষ্ট সাময়িক সময়ের জন্য।আর আমাদের খুশি হওয়া দরকার যে স্যার যোগ্য শাস্তি পেয়েছে।আর আমরা আবার ও জব খুঁজবো খুব জলদি।আপনি পারলে কাল বলে দিন বাসায়।"
প্রিয়াশার দিকে তাকিয়ে আদনান যেন স্বস্তি পেলো।ও নিজের পরিবারকে খুব ভালো করে চেনে। বিশেষ করে ভাইকে।হয়ত ভালো আইডিয়া পেয়ে ও যেতে পারে।ভেবেই প্রিয়াশাকে কাছে টেনে ওর কপালে চুমু দিয়ে একটু সরে আসে আদনান।প্রিয়াশা বলল,
''চলুন ঘুমাই।"
আদনান ওকে থামিয়ে বলল,
''ঘুম না আমার মানসিক শান্তি লাগবে।সেটা তুমি দেবে।"
প্রিয়াশা মৃদু হেসে বলল,
''বলুন কি করবো?"
আদনান ওর ঠোঁটে আঙ্গুল চেঁপে বলল,
''আমি নিজেই নিয়ে নিবো।তুমি কথা বলোনা।"
বলেই প্রিয়াশার গলায় মুখ ডুবিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয় দেয় আদনান।তারপর উষ্ণ ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে থাকে স্ত্রীকে।
এদিকে সারারাত ধরে সাইমনের কল এসেই যাচ্ছে সাঁঝের ফোন।আজ দুটো রাত ধরে সাঁঝ ঘুমোতে পারছেনা।লোকটা অসভ্যতা শুরু করেছে।এতো কথা বলতে মন চাইলে সামনে এসে বলনা রে ভাই।ফোনে কি বলবি?ফিসফিস করে বলে উঠে সাঁঝ।পাশে বেলা ঘুমিয়ে। ওর গায়ের ওপর লাবনীর হাত পা উঠে আছে।সাঁঝের ফোনের দিকে একপলক তাকিয়ে বেলা বলল,
''হয়েছে কি বলবি?"
সাঁঝ বিরক্তি নিয়ে বলল,
''আর বলিস না তো।হুদাই রাগ দেখায়।আবার কল দিয়ে সরি ও বলবে।তার সরির জন্য পড়ে আছি।"
বলেই গাল বাঁকালো সাঁঝ।বেলা স্মীত হেসে বলল,
''বাহ এতো রাগ কেন আমার বোনটার?কি হয়েছে বল?"
সাঁঝ বলল,
''আমাকে কখনো বুঝতে চায়না।কেন এমন করে বল তো?সবসময় কি ফোন নিয়ে বসে থাকি বল?"
বেলা বোনের কাছে এসে বলল,
''শোন সাইমন ছেলেটাকে যা দেখলাম আমার মনে হয়েছে তোকে খুবই ভালবাসে।আর সেজন্য একটু বেশি পজেসিভ।এমন ভালবাসা পাওয়া যায়নারে।রেগে থাকিস না।ছেলেটা কত বার কল করেছে খেয়াল আছে?কতো চিন্তা করছে।কথা বল প্লিজ।"
সাঁঝ বলল, 
''না বলবোনা।ভাল লাগছেনা আমার।"
বলেই সোজা হয়ে শোয় সাঁঝ।বেলা কিছু না বলে মৃদু হেসে  শুয়ে পড়ে।পরদিন সকালে আদনান সোফায় এসে বসে।নিশাদ সাঁঝ অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে।পূর্না সাঁঝের উড়না নিয়ে দৌড়াচ্ছে লাবনীর পিছে শাড়ী পরবে বলে।বিভান  মেয়ের দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠে পূর্না।কোথা থেকে যেন জুলেখা বানু এসে নাতনীকে কোলে নিয়ে বললেন,
''এই জামাই ওরে বকেন কিল্লাই।আমার নানু মনি কান্দতাছে না?"
পূর্না নানুর কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।নিশাদ টেবিলে বসে নাস্তা করছে আর পাশে বিভান আর তারপর সাঁঝ আর ইকরাম রাহমান।বিভান বলল,
''আদনান প্রিয়াশা তোমরা ও খেয়ে নাও। অফিসে যেতে হবে তো।"
আদনান এসে খেতে বসলো। কিন্তু প্রিয়াশা আসছেনা।বিভান বলল,
''প্রিয়াশা আসো।"
প্রিয়াশা পাকঘর থেকে বলল,
''ভাইয়া আপনারা খেয়ে নিন।"
বিভান আর কিছু বললনা।নাস্তার পর আদনান নিশাদ আব্বা আর বিভানকে ডেকে আনে সাথে বেলা সাঁঝ আর জুলেখা বানু ও আছেন।প্রিয়াশা সবার পিছে এসে দাঁড়ায়।আদনান মন খারাপ করে বলল,
''একটা কথা বলার ছিলো যেটা আরো আগেই বলার দরকার ছিলো।কিন্তু বলতে পারিনি।ভয় হচ্ছিলো আমার।"
নিশাদ কিছুটা চিন্তিত সুরে বলল,
"'কি হয়েছে বলবি?
আদনানের চোখ ভরে আসে। এতদিন কষ্টের ফল এভাবে শেষ হয়ে যাবে ভাবতেই বুক ফেঁটে আসছে।এমবিএ করার পর থেকে চাকরী খুঁজতে খুঁজতে কতো হয়রানি হতে হয়েছে।যাও ভালো একটা চাকরী পেয়েছিলো কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সেটা ত্যাগ করতে হলো।আদনান বলল,
''আমার জব টা নেই ভাই।চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছি।"
ইকরাম রাহমান চেঁচিয়ে বললেন,
''ছেড়ে দিলি মানে?"
নিশাদ বাবাকে সামলে বলল,
''আব্বা আমি বলতেছি।আদনান কি হয়েছে বল?"
আদনান সবটা খুলে বলল।তারপরই কেঁদে উঠে গুঁমড়ে।তখনই নিশাদ এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
''কাঁদিসনা।ভালো করেছিস।আরো ভাল জব পাবি তুই।চিন্তা করিসনা।আমরা সবাই তোদের সাথে আছি।বাচ্চাদের মতো কাঁদতে হয়না।বড় হয়েছিস তুই।আমি ব্যাবস্থা করবো একটু সময় দে আমাকে।"
পিছন থেকে প্রিয়াশা বলল,
''ভাইয়া একটা কথা বলবো?আপনি কিছু মনে না করলে?"
নিশাদ ভাইকে ছেড়ে দিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলল,
''বলো।"
প্রিয়াশা মাথা নিচু করে বলল,
''ভাইয়া আমরা একটা এনজিও খুলতে পারি।অনেক মেয়েই আছে এমন হ্যারেসমেন্টের শিকার হচ্ছে।এমন আরো অনেক সমস্যা আজকাল দেখতে পাই আমরা তাইনা ভাইয়া?হুমায়রার মতো অনেক মেয়েই তো ভাইয়া নির্যাতিত হয়েেছে হয়ে আসছে।আমি এমন মেয়েদের জন্য কাজ করতে চাই ভাইয়া।এখন আপনারা যা কল্যান মনে করেন।"
প্রিয়াশা চুপ হয়ে গেলো।বিভান বলল,
''খুব ভালো সিদ্ধান্ত।করতে পারো।ইনফ্যাক্ট আদনান তুমি ও কাজ করতে পারো।পাশাপাশি জব ও করো। আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য করবো।তোমরা শুরু করো তাহলে।"
বিভানের কথায় নিশাদ আর ইকরাম রাহমান ও রাজি হলেন।নিশাদ বলল,
''আমি ও আছি তোদের সাথে।"
সাঁঝ বলল,
''আমি ও কাজ করবো ওখানে।"
আদনান হেসে ফেলে।নিশাদ আর সাঁঝ যে যার কর্মস্থলে চলে যায়।
........................এদিকে ইদ্রিকে কলেজে পাঠিয়ে মাকে নিয়ে হাসপাতালের জন্য বেরিয়ে পড়ে ইমতিয়াজ।মা ইদানীং ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।কাল রাতে ইমতিয়াহের রুমের সামনে এসে মাথা ঘুরে যায় ওনার।তাই আর দেরী করার সাহস পেলোনা ও।সকালেই মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হলো।এদিকে ইদ্রির দিন গুলো পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।নিশাদ ওর কথা রাখছে।প্রত্যেকদিন একঘন্টা করে দেখা হয় নাহলে ফোনে কথা হয়।ভাবতেই বেশ লাগে ইদ্রির।আজকাল নিজেকে ওদের বাড়ির বড় বৌ লাগে।সেদিন যখন পূর্নার সাথে কথা বলল।পূর্না ওকে মামী বলে ডাকছিলো ওর সেই ছোট্ট মুখ দিয়ে আনন্দে ইদ্রির ভেতরটা নেচে উঠে।খুব ইচ্ছে হয় এক কাপড়ে লোকটাকে বিয়ে করে নিতে।কলেজের ক্লাশ শেষে বেরিয়ে আসে ইদ্রি।ঘরের দিকে মন টানছেনা ওর।কিছু দূর এগুলেই তার কর্মস্থল।লোকটার দেখা পাওয়া যাবে ওখানে।ভেবেই ইদ্রি ড্রাইভারকে বলল নিশাদের অফিসের দিকে গাড়ি ঘোরাতে।সেখানে পৌছে জানতে পেলো একটা মিটিং এ আছে নিশাদ।রাগ হলো ইদ্রির।এতক্ষন কি করবে ও?তাই সবাইকে বলল,
''এ অফিসের ম্যানেজার মিঃ নিশাদ রাহমানের হবু স্ত্রীও। "
যার কারনে ওকে এটা ওটা এনে খাওয়াতে লাগলো সবাই।"
ব্যাপারটা উপভোগ করছিলো ইদ্রি।এদিকে নিশাদ মিটিং শেষে বেরিয়ে দেখলো ইদ্রিকে সবাই ভীষন আপ্যায়ন করছে।বেশ অবাক হয় ও।ইদ্রি এখানে কি করছে।নিশাদ কাছে যেতেই বসের এ্যাসিস্ট্যান্ট বলেন,
''কি নিশাদ বড় সুন্দর মাইয়ারে বিয়া করবা আর জানালাও না।"
নিশাদ মৃদু হেসে বলল,
''ইদ্রি এখানে তুমি কি করছো?"
ইদ্রি খাবার প্যকেট রেখে নিশাদের কাছে এসে বলল,
''দেখা করতে এসেছিলাম।আপনি তো ব্যাস্ত ছিলেন মিটিং এ তাই সময় কাঁটাচ্ছিলাম।"
ইদ্রির হাত ধরে নিশাদ বলল,
''চলো রুমে গিয়ে কথা বলি।"
ইদ্রি বলল,
''চলুন।"
নিশাদ ওকে রুমে এনে গ্লাস আটকে টেবিলে একটু বসে বলল,
''এখন বলো সেখানে কি করছিলে?সত্যি করে বলো ওদের কি বলেছো?"
''আপনার সাথে দেখা করতে এলাম। আপনি তো মিটিং এ ছিলেন।তাই ভাবলাম আপনার বৌ হওয়ার সুবিধাও নেই।"
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
''বাহ এত এগিয়েছো?"
''না বললাম আপনার হবু স্ত্রী আমি।বিয়ে তো খুব জলদি করবো।"
''বিয়ের খুব শখ ম্যাডামের?"
মৃদু হাসে নিশাদ।ইদ্রি বলল,
''সেটাতো সেই কবে থেকেই।আপনিই করছেননা।আমি তো এক কাপড়ে আপনার বৌ হতে রাজি।"
নিশাদ মজার সুরে বলল,
''আমার আদর পেতে এত উতলা হয়ে যাচ্ছো?"
ইদ্রি মাথা নেড়ে বলল,
''আগে সেটাই মনে হচ্ছিলো বাট এখন অন্য কারনে।"
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
''কি?"
''পূর্নার সাথে গল্প করবো।ও আমাকে মামী মামী বলে ডাকবে।খুব মজা হবে তাইনা।বাবা আমাকে বৌ মা বলে আদর করে ডাকবে।আদনান আর কুঞ্জন ভাইয়া ভাবি বলে ডাকবে।আমি বড় বৌ হবো।কতো দায়িত্ব থাকবে।খুব মজা হবে তাইনা?কত গুলো আপু পাবো। গল্প করবো সারাদিন রাত।"
নিশাদ মুখ শুকনো করে বলল,
''আর আমি।"
ইদ্রি মজা করে বলল,
''আপনি এককোনায় পড়ে থাকবেন।আমি সবার সাথে গল্প করবো।"
ইদ্রির কথা গুলো নিশাদের ভীষন ভালো লাগছিলো।ও যেন ইদ্রির মাঝে নিজের বাসার সুন্দর একটা পরিবেশ দেখতে পাচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন