রংধনু - পর্ব ৬৫ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


হুমায়রাকে পরিষ্কার জামা পরিয়ে বের করে আনে বেলা সাঁঝ এতক্ষনে গরম পানি রুমাল আর ঔষধ এনে বসে আছে খাটের ওপর।এদিকে জুলেখা বানু মেয়ে আর বিভান কে এভাবে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বেশ অস্থির হয়ে পড়েন।বিভান কথা বলা শেষ করতেই ওকে ধরে বলছিলেন,
''বাবা আমার মাইয়ার কি হইছে?কওনা বাবা।"
বিভানের ভীষন খারাপ লাগছে।শাশুড়ীকে কিভাবে বুঝাবে যে হুমায়রাকে রেপ করার চেষ্টা করা হচ্ছিলো।ও না গেলে আজ কতোবড় দুর্ঘটনায় পড়তে হতো কে জানে?বিভান খেয়াল করছে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে জুলেখা বানুকে।বেশ অসুস্থ ও দেখাচ্ছে।বিভান শাশুড়ী কে বসিয়ে বলল,
''আম্মা চিন্তা করবেননা।আসলে কিছু বাজে ছেলে ওর সাথে বেয়াদবী করার চেষ্টা করছিলো।আমি ওদের মেরে ভাগিয়ে দিয়েছি।আপনি চিন্তা করবেননা সব ঠিক আছে।"
জুলেখা বানু কাঁদতে শুরু করলেন। বলছিলো, 
''এমন কেন হইলো মাইয়াডার লগে?কই গেছিলো মাইয়াডা না কইয়া?অহন মাইয়াডার কি হইবো?"
ইতোমধ্যে নিশাদ আর আদনান তড়িঘরি করে ঘরে প্রবেশ করে।দরজা খোলার শব্দে বিভান সাইমন আর ইকরাম রাহমান সেদিকে তাকায়।নিশাদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
''হুমায়রা কই?"
বিভান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''সাঁঝের রুমে।"
হঠাৎ ইকরাম রাহমান পাশ থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন,
''আনছো কেন ওরে?মইরা যাইতে দিতা।এমন মাইয়ার বাঁইচা থাকার কোন অধিকার নাই।আইজ আমি এইডারে মাইরা ফালামু। "
বলেই হাতে শলা নিলেন ইকরাম রাহমান।বলতে লাগলেন,
''অনেকদিন ওর এসব নোংরামী দেখতেছিলাম।কিছু কইতে পারিনাই। আইজ তো একদম নাক কইটা দিলো।কাউরে না কইয়া ঘর থেকা বাইর অইয়া গেলো।কতো বড় সাহস হারামজাদি মাইয়ার।"
ইকরাম রাহমানের হঠাৎ এভাবে রেগে যাওয়ায় অবাক ওরা সবাই।জুলেখা বানু কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন,
''এমন কইরা কইওনা তোমারই তো মাইয়া।তুমি এমনে কইলে কই যাইবো অয়?"
''জাহান্নামে যাক তর মাইয়া,মইরা যাক।আইজ নিজ হাতে এই আপদরে শেষ কইরা ফালামু।"
বলেই শলা নিয়ে ছুটলেন সাঁঝের রুমের দিকে।এদিকে এতক্ষন বাবার কথা শুনে কান্নার বেগ বেড়ে যায় হুমায়রার।সাঁঝ আর বেলা ওকে সামাল দিচ্ছিলো।ইকরাম রাহমান এসেই বলতে লাগলেন,
''ঐ হারামজাদী মইরা যাইতে ফারোস নাই কেন?"
বলেই শলা দিয়ে বাড়ি মারলেন হুমায়রার গায়ে।এদিকে বেলা বোনকে জড়িয়ে ধরায় ওর পিঠের ওপর শলার মোটা শক্ত জায়গাটা এসে লাগে।এদিকে পূর্না প্রিয়াশার কোলে ছিলো।এমন পরিস্থিতিতে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা।এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি তারওপর মায়ের গায়ে হাত তোলার ব্যাপারটা কোন ভাবেই নিতে পারছিলোনা পূর্না।চিৎকারে কেঁদে উঠে পূর্না।কেঁদে কেঁদে বলছিলো,
''মাকে মেলোনা, মেলোনা। "
আদনান প্রিয়াশাকে ইশারা করলো পূর্নাকে নিয়ে সরে যেতে।এদিকে বেলার গায়ে শলার বাড়ি লাগায়  স্তব্ধ হয়ে যান ইকরাম রাহমান।শলাটা নিচু করে ফেলেন।পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সাইমন সেখানে আসার সাহস পাচ্ছিলোনা।বেলা অশ্রু সজল দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাতে পারেনি আর না পেরেছে ছোট ভাইবোন কিংবা স্বামীর দিকে তাকাতে।নিশাদের ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগেনি।আব্বা কেন এমন রেগে গিয়ে গায়ে হাত তোলে।ওর এসব ভালো লাগেনা একদম।কই এখন হুমায়রাকে সাপোর্ট করবে কিন্তু এসব না করে ওকে মারতে গেলো।নিশাদ রেগে বলল,
''আব্বা এসব কি?এভাবে গায়ে হাত তোলার মানে কি?যা হতে যাচ্ছিলো সেটা এ্যাক্সিডেন্ট।আপনি এভাবে কেন ওর গায়ে হাত তুলতে গেলেন?আব্বা এ বয়সে এমন মানায়না।আজ যে আপনে আপার গায়ে হাত তুললেন ব্যাপারটা বিভান ভাই পূর্নার সামনে কেমন লাগলো?আর প্রিয়াশা বৌ মানুষ।সবার সামনে আপার গায়ে হাত তুললেন।ব্যাপারটা কেমন লাগলো?"
নিশাদকে বাবার সাথে এমন আচরন করতে দেখে বেলা কেঁদে বলল, 
''প্লিজ এমন ব্যাবহার করিসনা দোহায়।কিছু হবেনা।"
ইকরাম রাহমান শলা নিয়ে দ্রুত পদে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।নিশাদ আর আদনান হুমায়রা কে দেখছে। ওর শরীরের কাঁটা দাগ গুলো জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে ফুলে গেছে।বেলা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো,
''কেন ওকে নিয়ে বসলাম না?কেন বুঝালামনা?আজ এসব হয়ে গেলো ওর সাথে সব আমার কারনে।ওকে নিয়ে বসার দরকার ছিলো বুঝানোর দরকার ছিলো।নিশাদ বোনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
''আপা এভাবে বলিসনা প্লিজ। এভাবে বলিসনা।তোর কোন দোষ নাই।সাঁঝের বিয়ে গেলো সবাই কম বেশি ব্যাস্তই ছিলো এখানে তোর দোষ নেই আপা।"
বেলা কাঁদতে থাকে।এদিকে জুলেখা বানু হুমায়রাকে ধরে কাঁদছে।চোখে পানি সাঁঝের ও।নিশাদ হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
''আপা ওকে কিছু খাইয়ে দে।আমি ঔষধ আনতে যাচ্ছি।"
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নিশাদ।বিভান নিশাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হুমায়রার দিকে তাকায়।হুমায়রা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, 
''আপা এমন কিছু হবে আমি বুঝতে পারিনি। মাফ করে দে আমাকে।আমি বুঝিনি কিছু। আমার কি হবে আপা?"
বলেই বেলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে হুমায়রা।বিভান বলল,
''বেলা ওকে খাইয়ে দাও কিছু।"
বেলা হুমায়রাকে সরিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।হুমায়রার সামনে এসে বিভান বসে।ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল,
''চিন্তা করোনা।কিছু হবেনা তোমার?অনেক বড় বিপদ হতে পারতো।চিন্তা করোনা।বাবা একটু রেগে আছেন সব ঠিক হয়ে যাবে।"
হুমায়রা কিছু বলতে পারছিলোনা।আজ নিজের ওপর লজ্জা হচ্ছে।ভীষন লজ্জা হচ্ছে।নিজের বিশ্বাসকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।এ কাকে বিশ্বাস করলো কাকে ভালবাসলো?এ কি হয়ে গেলো ওর সাথে?হুমায়রাকে খাইয়ে দিয়ে ঔষধ দিয়ে শুইয়ে দেয় বেলা।এদিকে সাঁঝ সাইমনকে খাইয়ে দিয়ে বলছিলো,
''দেখেন আপনি চলে যান।বাসার যে পরিস্থিত আপনার ভাল লাগবেনা।বাসায় চলে যান।আমি ওর সাথে থাকবো কিছুদিন।দাদি কে কিছু বলবেননা।"
সাইমন প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল,
''এখানে বলার কি হলো?আর তাছাড়া এই পরিবারটা আমার ও।কিছু হবেনা।যাচ্ছি তাহলে কিছু লাগলে জানিও।আর হুমায়রার সাথে সাথে থেকো।"
বলে স্ত্রীর কপালে ছোট্ট চুমু দিয়ে চলে যেতে থাকে সাইমন।সাঁঝ ওর হাত ধরে বলল,
''রাগ করবেননা প্লিজ।আসলে এত কিছু হয়ে গেলো বুঝতে পারছিনা।"
''ইটস ওকে।সবার খেয়াল রেখো।"
সাইমন বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখনই ওকে থামায় আদনান।বলল,
''কই যাও সাইমন?"
''ভাই বাসায় যাই।সাঁঝ থাকবে।"
''তা তুমি যাও কেন?"
ভাইয়া আসলে হুমায়রাকে এখন আপনাদের লাগবে। তাছাড়া দাদি আর মিতুল বাসায় একা।আমি আসা যাওয়া করতে থাকবো।সমস্যা নেই।"
আদনানের খারাপ লাগলো।আসলে যা হলো কারোর হাত নেই।তা কিছু খেয়ে যাও তুমি।"
সাইমন মৃদু হেসে বলল,
''খেয়েছি ভাইয়া।আপনারা ওর খেয়াল রাখবেন।ছোট মানুষ ওর তো কোন দোষ নেই।"
আদনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।সাইমন বেরিয়ে যায়। এদিকে আজ রাতে ঘুম নেই কারোর চোখে।পূর্নাকে ঘুম পাড়িয়েছে প্রিয়াশা।জুলেখা বানু ভীষন অসুস্থ পড়েছে।সাঁঝ স্যালাইন বানিয়ে নিয়ে আসে মায়ের জন্য।বেলা ঘুমন্ত হুমায়রার মাথা হাতিয়ে দিচ্ছে।এ কি হয়ে গেলো ওর পরিবারে?ছোট বোন টার সাথে কি হয়ে গেলো?কি দোষ ছিলো বেচারীর?ভাবতেই ভীষন কান্না পেতে থাকে বেলার।হঠাৎ রুমে প্রবেশ করে বিভান।বেলার সামনে এসে বসে।বেলা বিভানের হাত ধরে বলল,
''কই পেয়েছিলেন?"
বিভান মন খারাপ করে বলল,
''বাসার পিছনের বড় জায়গা আছেনা।একটা বিল আছে যে।"
বেলা অবাক হয়ে গেলো।ওরা ওখানে কখনোই যায়না।বেলা ভাবছে হুমায়রা কেন গেলো?বেলা বলল,
''হুমায়রা কেন গেলো ওখানে?"
''কেমনে বলবো বেলা?সেটা হুমায়রা ভাল বলতে পারবে।তাছাড়া হুমায়রার কাছ থেকে এসব জানতে চাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।"
বেলা কম্পিত শ্বাস ছেড়ে বোনের দিকে তাকায়।বিভান বলল,
''আমি কিছু ভেবেছি ওকে নিয়ে।"
''কি?"
বিভান বেলার দিকে তাকায়।এদিকে নিশাদ রুমে বসেছিলো চুপচাপ।চোখের কোনা গড়িয়ে অশ্রুঝড়ছে।হঠাৎ মনে হলো বাবার রুম থেকে নাক টানার শব্দ।নিশাদ চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।বাবাকে একবার দেখে আসা উচিৎ।কি করছে বাবা কে জানে?নিশাদ রুমে এসে দেখলো ইকরাম রাহমান খাটে শুয়ে কাঁদছেন।নিশাদ লাইট জ্বালিয়ে বাবার পাশে বসতেই চোখ উল্টে ছেলের দিকে তাকান।নিশাদের বুকটা কেমন করে উঠে।ও বলল,
''আব্বা কি হইছে? কাঁদেন কেন?"
ইকরাম রাহমান উঠে বসেন।দুহাতে চোখ মুছে নেন।কিন্তু আজ এই অশ্রুর যেন শেষ নেই।কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন,
''তোরা আমারে যাই কস যাই ভাবোস আমি তো বাপ।মেয়ের এই অবস্থা আমার ভালা লাগে বল?আমার মাইয়া তো।কি কইরা লাইলো মাইয়াডা।"
নিশাদ বলল,
''আব্বা জানিনা ও কি করেছে।কিন্তু ওর তো এখানে হাত নেই আমাদের কারোর নাই।আজ বিভান ভাই না গেলে আরো বড় বিপদ হতে পারতো।তেমন তো কিছু হয়নাই।আমাদের হুমায়রা ভালো আছে।হ্যা ও ভেঙ্গে পড়বো কিন্তু আমাদের তো ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা ওর সাথে থাকতে হইবো।আমার এমন করলে ওর কতো কষ্ট হইবো বলো।"
ইকরাম রাহমান কাঁদতে লাগেন।আজ কেন যেন বড় জামাইটার শ্রদ্ধা বোধ আসছে ভালবাসা জাগছে।যে জামাইকে এত বছরে ভালবাসতে পারেনি।বের করে দিয়েছিলো আজ সেই বড় জামাইয়ের কারনে ঘর সম্মান বাঁচলো।তবে এই ভালবাসা আজ না সেইদিন জন্মেছিলো যেদিন থেকে বিভান ওদের বাসার অনেক দায়িত্ব নিয়েছিলো।নিজের মতো করে সব সামাল দিচ্ছিলো আজ মনে হচ্ছে বেলা ভুল মানুষের কাছে যায়নি বরং ওনি সঠিক মানুষটাকে চিনতে ভুল করেছিলো।ইকরাম রাহমান আর অপেক্ষা করতে পারেননা।বললেন,
''জামাই কই?"
''কে সাইমন? আব্বা।"
ইকরাম রাহমান মাথা নাড়িয়ে বললেন,
''আমার বড় জামাই আমার বেলার জামাই।কই আমার হীরার টুকরাডা?
বাবার কথায় নিশাদের খুব ভাল লাগতে শুরু করে যে আব্বা তাহলে ভাইকে মেনে নিয়েছে।নিশাদ বলল,
''আমার সাথে আসেন আব্বা।"
ইকরাম রাহমান নিশাদের সাথে উঠে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।বিভান ড্রয়িংরুমে বসে ফোন চালাচ্ছে।নিশাদ বলল,
''ভাই আব্বা কথা বলবে।"
বিভান ফোন রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''জি বাবা বলেন।"
ইকরাম রাহমান এসে জামাইকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
''আমার বড় জামাই মাফ কইরা দিও আমারে।"
শ্বশুরের মুখে এমন আদর সুলভ কন্ঠে বিভানের চোখে পানি চলে আসে।বলতে লাগলো,
''আব্বা এভাবে বলবেননা।আপনারা বাবা মা।মাফ চাইবেননা প্লিজ।আমরা দোষ করেছিলাম সেই জন্য শাস্তি পেয়েছি।"
''দোষ করোনাই আব্বা।তোমারে চিনতে ভুল করছিলাম।আইজ আমার সম্মান ফিরায় দিছো।তোমারে কি কইয়া ধন্যবাদ দিমু।"
বিভান শ্বশুর কে জড়িয়ে বলল,
''এভাবে বলেননা আব্বা।আমরা আপনার ছেলে মেয়ে।ধন্যবাদ দেবেননা দয়া করে।হুমায়রা আমার ছোট বোন যেমন নিশাদের।ওরা তো আমাদের ছেলে মেয়ে বেলা আর আমার।তো আমরা না করলে কে করবে বলেন?"
ইকরাম রাহমান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন বিভানকে।কিছু বলতে পারছিলেননা।আজ নিজের বেলার ওপর গর্ব হচ্ছে ভীষন।মেয়েটাকে না বুঝে বের করে দিয়েছিলো আর আজ ওনার সম্মান তার বড় জামাই বাঁচিয়ে এনেছে ভাবতেই হৃদয়ের এক কোনে ভীষন ভালো লাগা কাজ করতে থাকে।

!!!!

কিছুসময় পর সরে আসেন ইকরাম রাহমান।বিভান চোখ মুছে নিচ্ছে।আজ কেন যেন কান্না পেলো ভীষন। বাবার ভালবাসা বোধহয় এমনই হয়।বাবারা বুকে টেনে নিলে বুঝি এভাবে চোখে পানি চলে আসে,হৃদয়ের গভীরে এমন  সুন্দর অনুভূতি হয় সেটা জানা ছিল না বিভানের।ইকরাম রাহমান নিজের চোখ মুছে নিয়ে বিভানের দিকে তাকান।বিভান এবার উপরে তাকিয়ে মৃদু হেসে নিশাদ আর বাবার দিকে তাকায়।তারপর বলল,
''আপনার বেলার সাথে কথা বলবেননা বাবা?"
ইকরাম রাহমান অস্থওর দৃষ্টিতে মেয়েদের রুমের দিকে তাকাতে থাকেন।তারপর বললেন,
''আমার মাইয়া কই?"
নিশাদ পিছন থেকে বলল,
''আব্বা আপা আর সাঁঝ দুজনেই ক্লান্ত।হুমায়রারে ঘুমের ঔষধ দিয়া ঘুম পাড়ানো হইছে।এখন যাইওনা।"
ইকরাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে তাকায় তারপর বলল,
''আইচ্ছা।"
নিশাদের দিকে তাকান ইকরাম রাহমান।তারপর বিভান আর ওর হাত দুহাতে বন্দী করে বললেন,
''আমার হুমুর দিকে খেয়াল রাখিস তোরা।আর বিভান আমার বেলা আর নাতনীর দিকে খেয়াল রাইখো।বিভান শ্বশুর কে বুকে টেনে বলল,
''বাবা আমি আমার বাবাকে দেখিনি।খুব বেশি মনে ও পড়েনা বাবার কথা।আপনি আমার বাবা।আমি আপনার মেয়ের অমর্যাদা কখনোই হতে দেবোনা।বিশ্বাস করেন বাবা।"
ইকরাম রাহমানের চোখ ভরে আসে সুখের অশ্রুতে।বলতে লাগলেন,
''নিশ্চিত করলা বাবা।আমি অহন শান্তি পামু।"
বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন।বিভান চোখ মুছে নিশাদকে বলল,
''তোমার তো ঘুম পাচ্ছে বোধহয়।চলো ঘুমাই।"
ম্লান কন্ঠে নিশাদ বলল,
''আজ কি ঘুম পাবে ভাই?অনেক চিন্তা হচ্ছে হুমায়রার জন্য।কি হয়ে গেলো ওর।"
বিভান বলল,
''এটা স্বাভাবিক নিশাদ।চিন্তা হবেই।সব ঠিক হয়ে যাবে।তুমি চিন্তা করোনা।অনেক বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে গেলাম আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। চলো তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে ঘুমাই।"
''ওকে ভাই।"
এদিকে রাত পেরিয়ে সকাল হলো।ফজরের নামাজ আদায় করে বেলা কিছুক্ষণ কুরআন শরীফ তিলওয়াত করে নাস্তা বানায় সবার জন্য।হুমায়রার জন্য তরল খিচুড়ী চড়িয়েছে একপাশে। অনেক জ্বর এসেছে মেয়েটার।গা পুড়ে যাচ্ছে।রাতে কয়েকবার বমি করেছিলো।বেলা পরিষ্কার করে গায়ের কাপড় বদলে দিয়েছিল।চোখ ভরে আসে বেলার।নাস্তা বানিয়ে পাকঘর থেকে বেরুতেই সাতটা বেজেছে।আম্মা আব্বা নিশাদ উঠে গেছে সাথে প্রিয়াশাও।বেলা বেরিয়ে আসতেই প্রিয়াশা বলল,
''আপু আপনি নাস্তা বানিয়ে ফেলেছেন?"
বেলা মৃদু হেসে বলল,
''বানালাম তো।হুমুর জন্য খিচুড়ী বানালাম অনেক জ্বর।"
''ওহ।সরি আপু কখন এত বেলা হলো বুঝিনি।"
''সমস্যা নেই।সবে সাতটা বাজে।আদনান উঠেনি?"
প্রিয়াশা মাথা নেড়ে বলল,
''না উঠেনি।"
''ওহ।"
বেলা রুমে গিয়ে হুমায়রার কপাল স্পর্শ করে দেখলো।জ্বর কম আছে একটু তবে এখনো আছে।এতক্ষনে সাঁঝ উঠে বসলো।তারপর বলতে লাগল,
''উঠছে সবাই?"
''হুম।"
সাঁঝ খোলা চুল খোঁপা করতে করতে বলল,
''আপা তোর রাতে অনেক কষ্ট হইছে না?"
ভ্রু কুঁচকালো বেলা।বলল,
''কেন?"
''ঘুমাতে পারিসনি তো।"
''আমার বোনের জন্যই করলাম এখানে কষ্টের কি হলো?"
''তাও আপা।"
''তোর মাথা।উঠে ফ্রেশ হয়ে যা অফিস আছে তো।"
''হুম।"
হঠাৎ দরজা নক করে রুমে আসলো নিশাদ।হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বেলাকে বলল,
''ওর কি অবস্থা আপা?"
বেলা ম্লান কন্ঠে বলল,
''রাতে জ্বর আসছিলো।বমি করছে কয়েকবার।তিনবার জামা পাল্টানো হইছে।"
নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটে বসে হুমায়রার কপাল ছুঁয়ে বলল,
''এখনো অনেক জ্বর।"
''আরো ছিলো।"
নিশাদ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
''আপা কাল এক সাংঘাতিক কাহিনী ঘটলো।"
বেলা অবাক হয়ে বলল,
''কি?"
নিশাদ কাল রাতের বাবা আর বিভানের পুরো ঘটনা খুলে বলতে থাকে।এই কাহিনী শোনার সময় বেলার চোখে পানি চলে আসে।কেঁদে দিয়ে বলল,
''ওনার অনেক শখ ছিলো আব্বা এভাবে আদর করবে বুকে জড়ায় নিবে আমাদের মেনে নেবে আল্লাহ তাহলে ওনার ডাক শুনেছেন।"
নিশাদ বলল,
''কাঁদিস না আপা।কাল আব্বা তোরে ও খুঁজছিলো।"
বেলা চোখ মুছে উপরে চেয়ে বলল,
''সত্যি?"
''হ।আমি বললাম তোরা শুয়ে পড়েছিস তাই আসে নাই।"
''তোদের নাস্তা দেই দাঁড়া।আব্বা সেই কখনো উঠলো।"
নিশাদ বোনকে থামানোর চেষ্টা করে বলল,
''আপা পরে।একসাথে বসবো সবাই।"
''আরে তোদের অফিস আছে তো।"
বলেই বেলা বেরিয়ে এসে পাকঘরে গিয়ে নাস্তা রেডি করে টেবিলে সাজায়।এরই মাঝে বিভান আদনান উঠে গেলো।সাঁঝ ও বেরিয়ে এলো চুল বেঁধে সুন্দর করে।নাস্তার পর বেলা সবার চা দিয়ে ইকরাম রাহমানের সামনে এসে ওনার দিকে চা ধরে।ইকরাম রাহমান কাপটা রেখে মেয়ের হাত চেঁপে ধরে কেঁদে উঠে নিঃশব্দে।
বেলা ও কেঁদে ফেলে।ইকরাম রাহমান কান্না জড়িত কন্ঠে বলছিলেন,
''আম্মা পারলে আব্বারে মাফ কইরা দিস।তোদের অনেক কষ্ট দিছিলাম।জামাই মানুষডারে চিনতে ভুল করছিলাম।আমার বড় মাইয়ার থাকি দূরে থাকতে খুব কষ্ট হইছিলো এই তের চৌদ্দ বছর।আইজকা আর কোন কষ্ট নাই।আমার মাইয়া আমার নাতনী আমার বড় জামাই আছে আমার সাথে।আর কিছু লাগবোনা আমার।"
বেলা বাবার সামনে বসে ওনাকে জড়িয়ে কান্না শুরু করে।বলছিলো,
''আব্বা আমারে মাফ করে দিও।আমার ভুল হয়ে গেছিলো।"
''নারে বেলা মা আমার তোর ভুল ছিলোনা। ঐ ইদরীসের কাছে গেলে তোরে হয়ত হারায় ফালাইতাম।"
এদিকে ওদের কান্নার শব্দে বাসার সবাই জড়ো হয়ে যায়।পূর্না বিভানের কোলে উঠে ছিলো।মাকে কাঁদতে বলছিলো,
''মা আল নানা বাই কান্না কলে কেন?"
বিভান আদুরে কন্ঠে বলল,
''তোমার মায়ের ওপর নানা রেগে ছিলো।আজ রাগ নেইতাই কাঁদছে।"
''ওহ।"
কিছুক্ষন পর সবাই নিশাদ আদনান আর প্রিয়াশা অফিসের জন্য রেডি হতে থাকে।সাঁঝ জানালো আজ হুমায়রার সাথে থাকবে।আপা একা একা কতোদিক সামাল দিবে?বেলা অনেক বার নিষেধ করার পর ও সাঁঝ কথা শুনেনি।
.....................................এদিকে ইদ্রির মাঝে বেশ পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।ও এখন নিয়মিত কলেজ যাচ্ছে তবে এখন ও মাঝে মাঝে কেঁদে উঠে বাবার কথা ভেবে।শরীরটা ও খুব শুকিয়ে গেছে।মেয়ের কথা ভেবে বেশ চিন্তা হয় সৈয়দা বেগমের।নিজের শরীরটাও আজকাল তেমন একটা ভাল যায়না।মাঝে মাঝে মনে হতে থাকে হয়ত বেশি দিন বাঁচবেনা।লোকটা চলে গেলোই বা কতোদিন হলো?ছত্রিশ বছরের বৈবাহিক জীবনের অবসান এভাবে হবে ভাবতে বেশ কষ্ট হয় ওনার।ইদ্রি নাস্তা করে নিজের রুমে চলে গেলো।কলেজে গেলে ও বেশ চুপচাপ থাকে মেয়েটা।আজ কলেজ যাবেনা ইদ্রি। সৈয়দা ও কিছু বলেননি মেয়েকে।ইমতিয়াজ নাস্তা করছিলো মায়ের সামনে বসে।সৈয়দা বেগম স্মীত স্বরে বললেন,
''হ্যারে ইমতিয়াজ নিশাদ আসেনা যে এখন?"
ইমতিয়াজ ছোট শ্বাস ছেড়ে বলল,
''আসবে মা।ও বলল ইদ্রি ওকে কল দিয়ে আসতে বললই আসবে।"
''জানিস আজ কাল ছেলেটার ওপর বড় ভরসা হয়ে গেছে।কতো সুন্দর করে ইদ্রিকে সামলে নিলো দেখলি?"
ইমতিয়াজ মাথা ঝাঁকায় তারপর বলল,
''মা তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।"
সৈয়দা বেগম বললেন,
''বল।"
''জানিনা কিভাবে নিবা।তবে বলা উচিৎ মনে হলো।"
''আরে বল না আব্বু।"
''নিশাদ ইদ্রি একে অপরকে খুব ভালবাসে।"
সৈয়দা বেগম অবাক হয়ে গেলেন।ইমতিয়াজ বলতে থাকলো,
''আমার মনে হয়না মা ইদ্রি নিশাদের কাছে যত ভালো থাকবে আর কারো কাছেই থাকবেনা।এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছা।"
ছেলের কথায় সৈয়দা বেগম কেমন চিন্তায় পড়ে গেলেন।আর কিছু বলতে পারেননা।ইমতিয়াজ নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে যায় অফিসের জন্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন