ঝরা ফুলের কান্না - পর্ব ১০ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


পরেরদিন সকালেই মিস্ত্রি এসেছে। হিমেলের মা মিস্ত্রিকে বলল আজ থেকে যা লাগবে সম্পূর্ণাকে বলার জন্য। মিস্ত্রির সাথে কামলার মতো খেটেখুটে সন্ধ্যার আগেই ঘরটা ঠিক হয়েছে। আজও সন্ধ্যায় গোসল করে যখন ভাত খেতে গেল পাতিলটা খালি পড়ে আছে। সম্পূর্ণা হিমেলের মা'কে বলল," ফুফু ভাত নাই?"
-" না নাই। ঘরে চাল নাই। পাশের বাড়ি থেকে এক বাটি নিয়ে আসছি আসার সময়। ওইগুলো আমি আর হিমেল খাইছি। তুই এককাজ কর। বয়ামে মুড়ি আছে পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে নে।" সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে পেটে ক্ষুধা নিয়ে মুড়ি পানিতে ভিজিয়ে চিনির পটে দেখে চিনিও নাই। হিমেলের মাকে বলতেই বলল," মুড়ি খাইতে চিনি লাগে? লবণ দিয়ে মেখে খেয়ে নে।"
সম্পূর্ণা টলমল চোখে কোনোমতে খেয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়লো। 
প্রতিদিন এইভাবেই যাচ্ছে তার দিন। বিয়ের দুইটা মাস কখন পার হয়ে গেল হিমেল টের না পেলেও সম্পূর্ণা ঠিকে পেয়েছে। এই দুইটা মাস যুগে পরিনত হয়েছে। 
পনের দিন থেকে হিমেল গ্যারেজে কাজ করে নিয়মিত। হঠাৎই বাড়ির একটা ছেলে এসে," হিমেল ভাইয়া আপনার মায় সম্পূর্ণা ভাবিরে বেদম মার মারতেছে।'
হিমেল অবাক হয়ে," কী বলিস?"
-" হ তাই তো আমি ছুটে এলাম। এই নেন। সাইকেলটা নিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি যান।"

হিমেলের মা রান্না ঘরের বাঁশের সাথে সম্পূর্ণার চুল গুলো প্যাঁচিয়ে মেহগনি গাছের মোটা ঢাল দিয়ে ইচ্ছে মতো মারছে। 
সম্পূর্ণা যখন দূর্বল হয়ে পড়ে তখন লাথি দিয়ে চুল টেনে উঠানে নিয়ে ফেলেছে। "
লামিয়া দৌড়ে এসেও থমকে গেছে হিমেলের মায়ের গালিগালাজ শুনে। অনেকেই গিয়ে আতিকা বেগম আর সাইফুল ইসলামকে বলেছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। সবাই চুপ করে বসে আছে। লামিয়া আবার দৌড়ে সাইফুল ইসলামের পায়ে পড়ে," আপনার আল্লার দোহাই লাগে কাকা। আপনি সম্পূর্ণারে নিয়ে আসেন। এইভাবে থাকলে মরে যাবে।"
সাইফুল ইসলাম শান্ত গলায় বললেন," তুমি তোমার ঘরে যাও। তুমি এই বাড়ির বড় বউ। শুধু শুধু নিজের মানসম্মান নিচে নামিও না ওর পক্ষে কথা বলে।"

হিমেল সাইকেল রেখে এসে দেখে, সম্পূর্ণা এখনো উঠানেই বসে কাতরাচ্ছে। হিমেল এসে বুকের সাথে মিলিয়ে," কী হয়েছে তোমার? মা কেন তোমাকে মারছে?"
সম্পূর্ণা শুধু মাথা নাড়িয়ে পানি চাইছে। হিমেল দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে পানি এনে দিয়েছে। পানি খেয়ে সম্পূর্ণা বলল," আমারে নিয়ে একটু খাটে শুয়ে দাও। আমি উঠতে পারছি না।"
হিমেল কাঁদো কাঁদো হয়ে সম্পূর্ণাকে নিয়ে শুয়ে দিয়ে," মা ও মা, তুমি ওরে এইভাবে মারছ কেন? কী করছে ও?"
-" কী আর করবো? রান্না করতে দিছি গিয়া দেখি ওইখানেই মাটিতে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। যে আমি বলেছি তখনই আমার মুখে মুখে তর্ক। আমি কী ওর তর্ক শুনার জন্য তোরে মানুষ করছি? তুই কী আমার জন্য ভাড়া কইরা লোক নিয়ে আসছোস?"
কথাগুলো বলে বিড়বিড় করতে করতে হিমেলের মা বাহিরে চলে গেলেন। হিমেল সম্পূর্ণার পিঠে মালিশ করে দিতে দিতে," তোমাকে বলেছিলাম না? মায়ের সাথে তর্ক করতে না। তাহলে কেন করেছ?"
সম্পূর্ণা শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তবুও আস্তে আস্তে বলল," আমি কতদিন ঠিক করে খাইনি। ভাত চাইলেই ফুফু মুড়ি খাইতে বলে। শেষ কবে খাইছি জানি না। হয়তো তাই শরীর খারাপ করছে। রান্নাঘরে মাথাটা কেমন জানি করে উঠলো তাই শুয়ে গেলাম৷ তখন আমি বুঝতেই পারিনি ওইটা রান্নাঘর ছিল। কিন্তু ফুফু এসে আমাকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে উঠিয়ে অনেক কথা শুনাতে লাগলো। মা বাবা তুলেও গালাগালি করছিল। তাই আমি আর সহ্য করতে না পেরে বলেছিলাম আপনি আমার বাবা মা'কে গালাগালি না করে নিজের বাবা মাকে করেন। তাহলে কবরে থেকেও তারা আপনার জন্য দোয়া করবেন। তারপর ফুফু কী করলো আমি বুঝে উঠতে পারিনি।"
হিমেল সম্পূর্ণার ক্ষত জায়গায় মলম লাগিয়ে দিয়ে," তুমি বসো। আমি আসছি।"
হিমেল বাজারে গিয়ে হোটেল থেকে বিশ টাকার ভাত আর ত্রিশ টাকার তরকারি নিয়ে এসেছে। সাথে বাসের দুইটি টিকেট। 
সম্পূর্ণাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে কোনো রকম জামাকাপড় কিছু গুছিয়ে ব্যাগে নিলো। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়েছে তখন সম্পূর্ণাকে ডেকে মাথা আঁচড়াতে বলল।"
-" এত রাতে মাথা আঁচড়াবো কেন?"
-" আস্তে কথা বলো। মা উঠে যাবে। আর উঠে গেলেই যেতে পারবে না।"
-" কোথায় যাব আমরা?"
-"চিটাগং। "
-" এত রাতে?কিন্তু কেন?"
-" আরে রাত বেশি হয়নি। আমি চাই না তুমি এইভাবে কষ্ট পাও। আমি জানি মা যখন তোমার গায়ে একবার হাত তুলেছে তাহলে এখন বারবার তুলবে। এরচেয়ে বরং চলো আমরা এইখান থেকে চলে যাই।"
-" আমরা গিয়ে কোথায় থাকবো হিমেল? তোমার কাছেও তো টাকা পয়সা নেই।"
-" আরে চিন্তা করো না। গ্যারেজে যে কয়দিন কাজ করছি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসেছি। দেখি না! গেলে একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নিবো। চিটাগং সব আমার চেনা।"
সেদিন বেরিয়ে পড়লো হিমেল আর সম্পূর্ণা। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারেনি। সকালে হিমেলের মায়ের আহাজারি আর আর্তনাদে কেঁপে ছিল বাড়ির উঠান। তবে সম্পূর্ণার জন্য নয় শুধুই হিমেলের জন্য। সম্পূর্ণার বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গালাগালি করছে দেখে সাইফুল ইসলাম বেরিয়ে এলেন।
তিনি ধমকের স্বরে বললেন, "কী হয়েছে তোর? তোর ছেলে মরছে না-কি এমন মরা কান্না করছিস?"
-" তোর মেয়ে মরছে হারামজাদা। তোর মাইয়ার কারণে আজ আমার ছেলে আমারে রাখি কোথায় গেছে কে জানে? তাড়াতাড়ি তোর মাইয়ারে বল আমার ছেলেরে আমারে ফিরত দিতে। না হলে আমি চেয়ারম্যানকে জানাবো। থানায় মামলাও করবো।"
-" যা কর। তুই কী মনে করছোস? কাল যে তুই আমার মেয়েকে এইভাবে মারছস আমি কিছু জানি না? তোর কপাল ভালো আমি তোর গায়ে হাত তুলিনি এখনো পর্যন্ত। তুই যা কোথায় যাবি যা। আমি যদি একবার নামি তাহলে সারাজীবন প্রস্তাবি মা ছেলে মিলে।"
সাইফুল ইসলাম কথাগুলো বলে দরজা লাগিয়ে দিলেন। সেই দিন থেকে হিমেলের মা প্রায়সময় গিয়ে ঝগড়াঝাটি করতেই থাকতো।
আর এইদিকে হিমেল প্রথম দিকে ভালোই ছিল আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে লাগলো। সাথে সাথে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়ে গেল। যে আমাকে মারার জন্য বাড়ি ছেড়ে ছিল। একদিন যেই আমাকে প্রাণেই মেরে ফেলতে চেয়েছে। কথাটা শুনতেই কেমন যেন। তাই না?"

আফরা কান্নাক্লান্ত চোখে সম্পূর্ণার কাঁধে হাত দিয়ে," হিমেলকে ছেড়ে আসার পর বিয়েটা করে নিলে? নাকি এখনো হিমেলের ঘরেই আছো?"
সম্পূর্ণা আফরার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল," জীবনে তো আরও রহস্যময় কাহিনি ঘটে গেছে। হিমেলের থেকে আসার পর আমার দিক থেকে ডিভোর্সটা হয়ে যায়। হিমেল আর বাড়ি আসেনি। বাবা থানায় মামলা করেছিল অবশ্য হিমেলকে পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রামের ঠিকানা দিয়েছিলাম পুলিশ গিয়ে সেখানেও পায়নি। জানি না তখন কোথায় গিয়েছিল। একবছর পরে আজমল আংকেলের এক আত্মীয় এসেছিল আমাকে দেখতে। তিনিই নিয়ে এসেছিলেন তাদের। মেজ ভাইয়া তখন বাড়িতে এসেছে বিয়ে করার জন্য। বাবা বলেছিল যদি এইখানে আমার বিয়েটা হয় তাহলে ভাইয়ার সাথে একসাথেই অনুষ্ঠান করে বিয়েটা হবে। এক বছরে হিমেলের দেওয়া কষ্টগুলো ভুলতে ইচ্ছে করছিল। কেন জানি মনে হচ্ছিল হিমেলকে একবার সুযোগ দিলে ভালো হতো না? মনের কোণে আবার শয়তান বাসা বেঁধে ছিল। কিন্তু তাবিয়া ভাবি বুঝে ফেলেছে আমার মনের কথা হয়তো। তিনিই বুঝালেন রাতভর। আবার মনকে শান্ত করলাম। মেজ ভাইয়ার বিয়েটাই আগে হয়েছিল। কারণ সেদিন পাত্র পক্ষ আমাকে দেখে গিয়ে কিছু জানায়নি। শুধু বলেছিল পরে জানাবে। বাবা ভেবেছিল তারা হয়তো আর আসবেন না। তাই মেজ ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে যায়। ভাইয়ার বিয়ের একমাস যেতেই ছেলে পক্ষ আবার আসে সাথে তাদের ছেলেকে নিয়ে। সেদিন এসেছিল শাদাব, তার মা,বোন, বড় ভাইয়ের বউ, আর ছোট ভাই। সাথে আজমল আংকেলেও ছিলেন। ছেলের মা হঠাৎই আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিতেই বাবা হতবাক হলেন। আজমল আংকেলের দিকে তাকিয়ে বললেন," আংটি পরানোর কথা তো ছিল না আজ? তাহলে? আংকেল বাবাকে আস্বস্ত করে বললেন," আমিই বলেছিলাম কারণ আমাদের সব তো দেখাশোনাই আছে। তাহলে শুধু শুধু দেরি করে কী হবে?" বাবা আর কথা বাড়ালেন না। শাদাব হঠাৎ করে মুখ ভেঙে বলল," আমার সাথে আলাদা কথা বলা যাবে কি-না?" 
সবাই এক কথায় রাজি হয়ে গেল। সেদিন শাদাবকে দেখে আমার মনে হয়েছিল ওভার স্মার্ট, অহংকারী, রাগী, গম্ভীর। কিন্তু এইগুলো মনে হলে কী হবে! পরিবারের খুশি মানে আমার খুশি। নিজের রুমে এসে খাটের কিনারায় বসলাম।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন