ছোট ভাইয়ের কথায় কোনভাবেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলোনা নিশাদ।একদিকে কলিজার টুকরা বোনটা চলে যাওয়ার কষ্ট বেস্টফ্রেন্ড কে অজান্তে দিয়ে ফেলার কষ্টের কারনে মনে প্রচন্ড যন্ত্রনার প্রভাব অপরদিকে ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথায় কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা নিশাদ।কোনমতে সামলে বলল,
''মাথা খারাপ তোর?কি বলছিস?"
আদনান নিশাদের হাত জড়িয়ে ধরে বিনয়ের সুরে বলল,
''ভাইয়া আমি কখনো এভাবে চাইনি।কিন্তু কি করতাম বল মেয়েটাকে অজান্তে ভালবেসে ফেলেছিলাম।তারপর আজ সকালে আমাকে কল দিয়ে বলে ওর চাচা চাচী ওকে মেরে ফেলতে চাইতেছিলো আর ওর কাজিন ওকে অনেক অত্যাচার করছিলো।ভাইয়া তখন আমি কি করতাম বুঝতে পারিনি।ওকে বাঁচিয়ে আনার জন্য আর কোন ভালো উপায় পাইনি আমি।আমাকে মাফ করে দে ভাই। "
নিশাদ কি করবে?..... কি বলবে?.. বুঝতে পারছেনা।এ কি হয়ে গেলো ওদের সাথে। তারওপর মেয়েটা নাকি হিন্দু ছিলো।সেটা সমস্যা নয় সমস্যা হলো বাবা।প্রচন্ড রাগ করবেন কষ্ট পাবেন।তাছাড়া মেয়েটার দোষ নেই।বাঁচার আকাঙ্খা সবার থাকে।মেয়েটার ও আছে।কথা গুলো ভাবতে ভাবতে আদনানের পিছে কান্নারত প্রিয়াশাকে দেখতে পায় নিশাদ।এদিকে আদনান ওর দিকে চেয়ে আছে অসহায় দৃষ্টিতে।নিশাদ বলল,
''তুই ওকে সামলা।আমি দেখি কি করা যায়।"
বলেই আদনানের সামনে থেকে সরে আসে নিশাদ।মাথা কাজ করছেনা।বাবা মা কান্না করছেন।দুজনের ভীষন মন খারাপ।বেলা ও কান্নারত অবস্থায় পূর্নাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে।পাশে বিভান কুঞ্জনকে স্বান্তনা দিচ্ছে।বোনের চলে যাবার মুহূর্তে কুঞ্জন ভীষন কাঁদছিলো।এখন মোটামুটি শান্ত হয়েছে তবুও চোখে পানি জমে আছে।নিশাদবিভান আর বেলার সামনে এসে বলল,
''কুঞ্জন পূর্নাকে নিয়ে তুই হুমায়রা আর লাবনীর কাছে যা।আপা আর ভাইয়ের সাথে কথা আছে আমার।"
কুঞ্জন বাধ্য ছেলের মতো ঘুমন্ত পূর্নাকে কোলে নিয়ে সরে যায় সেখান থেকে।বিভান আর বেলা নিশাদের দিকে তাকায়।ওর চেহারায় কেমন ঘোর চিন্তার ছোঁয়া।বিভান বলল,
''সব ঠিক আছে নিশাদ?কি হয়েছে তোমার?"
নিশাদ কিছুটা ভেবে বলল,
''ভাই আদনান কি করলো বুঝতে পারছিনা।"
বেলা অবাক হয়ে বলল,
''কি করলো আদনান?কি হইছে নিশাদ?"
নিশাদ অস্থির বোধ করছে।খুব কষ্টে বলল,
''আদনান প্রিয়াশা মেয়েটাকে বিয়ে করে এনেছে।এখন আমাকে জানালো।"
নিশাদের কথায় বিভান বেলার দিকে তাকায়।বেলা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে।বিভান নিশাদের দিকে চোখ সরিয়ে এনে বলল,
''মানে কি নিশাদ?আদনান বিয়ে করলো,কাউকে না জানিয়ে।কেন?
বেলার চোখেও যেন সেই একই প্রশ্ন।নিশাদ সব খুলে বলে দেয় বিভান বেলার কাছে। সব শুনে বিভান একটু চিন্তা করে ধীরস্থীর ভাবে বলল,
''শুনো যা হয়েছে হয়ে গেছে।আদনান খারাপ কিছু করেনি।সেই মুহূর্তে ও হয়ত ভাবার সময় পায়নি।তাই বলে মেয়েটাকে তো আর শাস্তি দেয়া যাবেনা তাইনা?এখন চুপচাপ থাকো। বাসায় গিয়ে বাবা মাকে সব বলে দিবো।তুমি বরং প্রিয়াশা আর আদনানকে বাসায় পাঠিয়ে দাও।আমরা ও যাই ওদের পিছন পিছন।এখানে কিছু বলা যাবেনা।কারন অনেক মানুষ এখানে।"
নিশাদ মাথা নেড়ে আদনানকে গিয়ে জানালো ও যেন প্রিয়াশাকে নিয়ে বাসায় চলে যায়।আদনান ভাইয়ের কথা মতো বেরিয়ে যায় প্রিয়াশাকে নিয়ে।নিশাদ বিভান বেলা বাবা মা আর বাকি সবাইকে নিয়ে রওনা হয় বাসার উদ্দেশ্যে।সারা রাস্তা নিশাদকে খুব চিন্তিত লাগছিলো।বিভান বারবার বলছিলো,
''নিশাদ ভেবোনা।সব ঠিক হবে।"
নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছিলো,
''কিভাবে না ভাববো।আব্বা তুলকালাম করবে।"
''আমি আছি তো।সব ঠিক হয়ে যাবে।"
জবাবে নিশাদ ছোট্ট শ্বাস ছাড়ে।বাসায় যাবার পর সবাই ঘরে ঢুকে।ইকরাম রাহমান পাঞ্জাবি বদলিয়ে রুমে এসে বসার পর বিভান নিশাদকে বলল সবাই কে আসার জন্য ড্রয়িংরুমে।তারপর শ্বশুরের পাশে এসে বসে তারপর বলল,
''বাবা একটা কথা আছে আপনার সাথে।জানার দরকার আপনার।"
ততক্ষনে সবাই এসে জড়ো হয়েছে।ইকরাম রাহমান ভ্রু কুঁচকে বিভানের দিকে চেয়ে বলল,
''কি?"
নিশাদ পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর তারপাশে আদনান।বিভান বলল,
''বাবা আদনান ওর কলিগ মেয়েটাকে বিয়ে করে এনেছে আজ সকালে।"
কথাটা শুনে জুলেখা বানু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগেন।আদনানকে বলতে শুরু করলেন,
''কিরে আব্বা জামাই কি কয় এডা?
ইকরাম রাহমান চোখ রাঙ্গিয়ে আদনানের দিকে তাকিয়ে গলায় তীব্র ক্ষোভ এনে বললেন,
''কিরে জানোয়ারের পুত কি শুনতাছি?"
বিভান আবার ও বলল,
''বাবা উত্তেজিত হবেননা।ও ভুল কিছু করেনি।যাই করেছে যথেষ্ঠ কারন ছিলো।"
''আমগোরে না জানায় বিয়া কইরা ফালছে নিজের বড়ডার আগে।আর তুমি কইতাছো কোন ভুল করে নাই?অবশ্য তুমিই তো তোমার বৌরে ভুলাই ভালাই বিয়া কইরা নিছিলা।আর তোমার বৌ তো না জানাইয়া গেছিলো গা।"
বাবার এমন কথায় নিশাদ কিছু বলতে নিলে বিভান থামিয়ে দিয়ে বলল,
''নিশাদ কিছু বলোনা।আমি বলছি বাবাকে।"
নিশাদ চুপ হয়ে গেলো।তবে ওর খারাপ লাগছে বাবা ভাইকে কথা শুনালো নিজের ছেলের জন্য।
বিভানের খারাপ লাগলে ও নিজেকে সামাল দিয়ে বলল,
''বাবা তের বছর আগে যা করেছিলাম সে ভুলের ভার আজ ও কাঁধে বহন করে বেড়াচ্ছি কেন জানেন?আপনি সন্তুষ্ট ছিলেননা।আমার বাবা নেই।আমরা এই তেরটা বছর পুরোপুরি সুখী ছিলাম না।কারন আপনি অসন্তোষ ছিলেন আমাদের ওপর। সে যাই হোক কিন্তু বাবা আদনান মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে।মেয়েটার ওপর তার চাচা চাচী চাচতো ভাই খুব অত্যাচার করছিলো।আদনান ওকে ভালোবাসতো।আর তাছাড়া মেয়েটা আদনানকে বিয়ে করতে চায়নি।শুধু নিজের অতীতটাকে তুলে ধরেছে ওর সামনে।আদনান ওকে বিয়ে করে এনেছে।এখন বাবা মেয়েটার জায়গায় যদি আজ আপনার কোন মেয়ে হতো তখন আপনি কি করতেন বাবা?বিয়েটাকে মানতেননা?বলেন বাবা। আর মেয়েটা তো বাঁচার জন্য আপনার ছেলের জন্য অনেক বড় স্যাক্রিফাইস করেছে।নিজের ধর্ম বদলেছে।হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছে।এখন বাবা আপনিই বলেন আপনি তো মুরব্বি অবশ্যই ভালভাবে চিন্তা করে বলেন মেয়েটা এ বাসার বৌ।ওকে কি আপনি তাড়িয়ে দেবেন ওর ধর্ম ত্যাগ করার পর ও নাকি বাসার বৌ হিসেবে গ্রহন করবেন কোনটা?আপনিই বলেন।"
পাশ থেকে আদনান এসে বাবার পায়ের কাছে বসে বলল,
''আব্বা মাফ করে দেন ।আমি সত্যিই দুঃখিত এভাবে না জানায় কাজ টা করে ফেললাম। আব্বা মাফ করে দাও আমারে। "
জুলেখা বানু বললেন,
''কিছু কওনা কেন?পোলা তো ভুল করে নাই।মাইয়াডারে বাঁচায় আনছে।কিছু কও তুমি।"
নিশাদ বাবার দিকে চেয়ে আছে।ইকরাম রাহমান অনেক ভেবে বললেন,
''বিয়া যেহেতু কইরা ফালাইছে।কিছু করার নাই।অহন মাইয়াডা এই বাসার বৌ।বিছানা পাতি করো।ওদের রুম গোছায়া দাও।আমি ঘুমামু অহন। "
বলেই উঠে দাঁড়ান ইকরাম রাহমান।নিজের রুমে যাওয়ার মুহূর্তে সাঁঝের রুমের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো বেলা প্রিয়াশা আর লাবনী বসে আছে।প্রিয়াশা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে শ্বশুরের দিকে তাকায়।তবে ওনি কিছু না বলে নিজের রুমে চলে যান।
বেলা কিছু বলতে চেয়ে ও পারেনি।
.............................তমার ফ্ল্যাটের সামনে গাড়ি এসে থামে।এতক্ষন ঘোরের মাঝে আটকে ছিলো ইমতিয়াজ।কিছুক্ষন আগে সাঁঝের বিয়েটা মেনে নেয়ার অভিনয় করলে ও মন থেকে কিছুতেই মানছেনা এই বিয়েটা।হঠাৎ গাড়ি থামায় ইমতিয়াজ কিছুটা চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখলো তমার বাসার সামনে ওরা।ইমতিয়াজ বলল,
''এখানে থামলি কেন?আমার বাসা তো পিছনে ছেড়ে গেছে।"
তমা বলল,
''তোর মন খারাপ।তাই ভাবলাম একসাথে চা কফি কিছু খাই আর একটু আড্ডা ও দেই।তোর মনটাও ভালো হয়ে যাবে।"
ইমতিয়াজ বলল,
''নারে দোস্ত ভালো লাগছেনা।আমি বাসায় যামু।মা আর ইদ্রি বাসায়।"
তমা ইমতিয়াজকে জোর করে বের করে এনে বলল,
''চল তো।বাসায় চলে যাস। বেশি রাত হয়নি।"
ইমতিয়াজ না চাইতেও চলে আসে তমার সাথে। তমা ইমতিয়াজকে ওর রুমে নিয়ে আসে।তমা ওর পাশে এসে বলল,
''ভাবছি চলে যাবো।সব বিক্রী করে দিবো।"
ইমতিয়াজ মলিন কন্ঠে বলল,
''চলে গিয়ে কি করবি?এখানে থেকে যা না?"
তমা বলল,
''কার জন্য থাকবো বল?কে আছে?"
ইমতিয়াজ বলল,
''হুম তাও ঠিক। তা কবে যাবি?"
তমা চোখজোড়া ছোট করে বলল,
''আমাকে পার করে দেয়ার এতো জলদি কেন তোর?"
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
''তুই বলছিলি চলে যাবি।তাই বললাম।কারন ভিসার ব্যাপার স্যাপার আছে।"
তমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
''হুম।"
ইমতিয়াজের চোখের সামনে সাঁঝের বৌ সাজটাই ভাসছে।এ দিনে নাকি একটা মেয়েকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে।ইমতিয়াজের আজ মনে হলো কথাটা সত্যি।সাঁঝকে ভীষন সুন্দর লাগছিলো বৌ সাজে।তবে সাজ টা ওর জন্য নয় বরং সাইমনের জন্য।সাইমন ছেলেটা নিশ্চয়ই খুব ভালো। দেখতে ও বেশ।লম্বা, চেহারা সব দিক থেকেই সুন্দর।ওদের একসাথে কতোটা মানাচ্ছিলো।হয়ত সে জায়গায় আজ ইমতিয়াজ নিজে ও থাকতে পারতো।হয়রে নসিব।তমা ইমতিয়াজ কে চুপ দেখে বলল,
''আবার ও ভাবনার জগতে চলে গেলি।বোস তোর জন্য কফি করে আনি।"
ইমতিয়াজ মাথা ঝাঁকায়।তমা বেরিয়ে আসে।ইমতিয়াজ তমার রুমে বসে ছিলো।হঠাৎ ওর চোখ পড়লো লাল চকচকে মলাটের একটা পুরোনো ডায়েরীর দিকে।ডায়েরীটা দেখে মনে পড়লো তমা কখনো কাউকে ধরতে দিতোনা।একবার ভূবন শুধু ধরেছিলো তখন তমা দৌড়ে এসে কি মার ওকে।ইমতিয়াজ একটু হেসে ডায়েরীটা হাতে নেয় সকল সংকোচ ত্যাগ করে।ডায়েরীর প্রথম পাতা উল্টাতেই চমকে উঠে ইমতিয়াজ।ডায়েরি টি জুড়ে ছিলো তমার ভাল লাগার ভালবাসার কত শত কথা কবিতা সবই শুধু একজনের জন্যই আর সে হলো ইমতিয়াজ নিজের।ইমতিয়াজ অবাক হয়ে পাতা উল্টাতে থাকে।ওর মাথা কাজ করছেনা।ইমতিয়াজের সাথে ওর প্রথম দেখা প্রথম কথা সেই তারিখ সেই সাল।ষোল বছর আগের সব।ইমতিয়াজ ভাবতেই পারছেনা কেউ কিভাবে এত বছর ধরে ওকে অজান্তে এতোটা ভালবেসেছে।কিভাবে পারলো?
তমার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ইমতিয়াজ ডায়েরী রেখে সোজা হয়ে বসে।তমা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,
''নে খা।"
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে মগ হাতে নিয়ে খেতে থাকে।কফি শেষে ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে তমাকে বলল,
''আমি বলা পর্যন্ত তুই কোথা ও যাবিনা,কোথাওনা।নাহলে পা ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেব।"
কথাটা বলেই ইমতিয়াজ তমার বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই।
!!!!
সেদিন রাতে রাত বারোটায় সাইমনদে বাসার সামনে এসে গাড়ি থামে সাঁঝ আর সাইমনের বিয়ের গাড়ি।দাদির গাড়ি আরো আগে পৌছে গিয়েছিলো। পুরো গাড়িতে সাঁঝ ভীষন কাঁদছিলো।সাইমনের ভীষন খারাপ লাগছিলো।সাঁঝের কান্না স্বাভাবিক।এভাবে মা বাবা ভাই বোনকে ছেড়ে আসা একটা মেয়ের জন্য কতোটা কঠিন সেটা শুধু সেই বুঝে।কিন্তু সাইমনের ভালো লাগছেনা সাঁঝের কান্না।সাইমনের চোখও অজান্তে ভিজে এসেছিলো।চোখ মুছে সাঁঝের হাত ধরে সাইমন।সাঁঝ কাঁদতে কাঁদতে সাইমনের কাঁধে ঢলে পড়েছিলো।ও বলছিলো,
''আমার অনেক খারাপ লাগছে।কি ভাবে চলে আসলাম সবাইকে ফেলে?আম্মা কিভাবে কাঁদছিলো বড় ভাইয়া।আমার খুব মনে পড়ছে সাইমন।"
সাইমন সাঁঝের পিঠে হাত রেখে বলতে লাগলো,
''সাঁঝ সব ঠিক হয়ে যাবে।খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক।কিন্তু এটা বাস্তব। এভাবে একদিন না একদিন আসতে হতো।আমাদের মা দাদীরা এসেছে,বড় আপা ও তো চলে গেছিলো তাইনা?এখন অনেক কষ্ট হবে তোমার।কিন্তু একসময় সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।"
সাঁঝ কাঁদতে থাকে।কিছএ বলতে পারলোনা।ও জানে সাইমনের কথা গুলো সত্যি কিন্তু পরিবারকে ছেড়ে আসার যে এতকষ্ট বুঝতে পারেনি ও।ঘরে পৌছানোর পর সাঁঝের চোখ আলো লাগতেই চোখ খুলে ও।গাড়ির জানালার পাশে দাদি আর মিতুল দাঁড়িয়ে।মিতুল ছোট একটা লাইট ধরে রেখেছে সাঁঝের সামনে।সাইমন বেরিয়ে ধমকে বলল,
''এই বেয়াদব এগুলো কেমন কথা?চোখের সামনে লাইট ধরেছিস কেন?ভদ্রতা জানিস না?"
সাঁঝ ভাঙ্গা গলায় বলল,
''হয়েছে ছাড়ুননা।ছেট মানুষ ও।"
মিতুল বলল,
''দেখলে ভাবি তোমার জামাই বকছে আমায়।"
দাদি রেগে বলল,
''মিতুল চুপ থাক।আমার নাত বৌকে বাহিরে আসতে দে।"
সাইমন গিয়ে সাঁঝের পাশের জানালা খুলে দিলো।সাঁঝ বেরিয়ে আসতেই দাদি ওকে বুকে টেনে নেয়।সাঁঝের চোখ ভরে আসে।দাদী বলল,
''কলিজা টা ভরে গেলো নাত বৌকে বুকে নিয়ে।"
দাদি সামনে এসে সাঁঝের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
''কতো সুন্দর লাগছে আমাদের সাঁঝকে।একদম পরী বৌ আমাদের।সাইমন ভিতরে চল।অনেক রাত হয়ে গেছে।"
বলেই সাঁঝকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে প্রবেশ করেন দাদী।পিছনে সাইমন আসতে থাকে।ড্রাইভার লাগেজ ভিতরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।নিচে কিছু নিয়ম পালন করে দাদী বলল,
''সাইমন বৌকে নিয়ে রুমে যা।দুজনেই তো ক্লান্ত।"
সাইমন মাথা ঝাঁকিয়ে সাঁঝকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠতে থাকে।সাইমনের একহাতে সাঁঝের লাগেজ।আর অপর হাতে সাঁঝকে ধরে রেখেছে।রুমের দরজা খোলার মুহূর্তে মিতুল বাঁধা দিয়ে বলল,
''এত জলদি না আগে টাকা দাও।"
সাইমন ভ্রু কুঁচকে বলল,
''যা এখান থেকে।কিসের টাকা লাগবে?"
মিতুল ঠোঁট উল্টে বলল,
''বারে এতো সহজে রুমে যাবে।আগে গেটের টাকা দাও।"
সাইমন বলল,
''কোন টাকা না।সর তুই।"
মিতুল কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
''ভাবি দেখোনা ভাইয়া কি করছে?"
সাঁঝ নিজের হাতের ছোট্ট পার্সটা থেকে দুহাজার টাকা মিতুলকে দিয়ে বলল,
''গেটের টাকা।"
মিতুল অবাক হয়ে বলল,
''ভাবি তুমি কেন?"
সাঁঝ বলল,
''ভাইয়া দিলো আর ভাবি দিলো একই তো।ভাইয়াটা তোমার ভাবিটাও তোমারই।নিয়ে নাও।"
মিতুল ভীষন খুশি হয়ে সাঁঝের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আই লাভ ইউ ভাবি।তুমি বেস্ট আর ভাইয়া ওয়েস্ট।"
বলেই জিভ বের করে সাইমনকে ভেংচি দিয়ে দৌড়ে যেতে লাগলো মিতুল।সাইমন রেগে বলল,
''তোকে তো।"
সাঁঝ হাসছিলো এতক্ষন।এখন সাইমনের হাত ধরে থামিয়ে বলল,
''ইস ও ছোট তো।এমন করেন কেন?"
সাইমন সাঁঝকে বলল,
''মাথায় উঠিও না।যে বাঁদর টের পাবে সামনে।"
সাঁঝ হেসে বলল,
''আপনার থেকে কমই হবে।"
সাইমন ভ্রু কুঁচকে বলল,
''আমি বাঁদর!!!
সাঁঝ হেসে মাথা ঝাঁকায়।সাইমন চুপচাপ দরজা খুলতেই ওরা দেখলো রুমটা ভীষন সুন্দর করে সাজানো।সাঁঝ রুমটা দেখে অবাক।এত কম মানুষ ওরা কিন্তু ঘর সাজালো কে?এতসুন্দর হয়েছে যে সাঁঝ চোখ ফেরাতে পারছেনা।সাইমন লাগেজ রেখে বলল,
''কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।"
সাঁঝ নিজের লাগেজ থেকে জামা বের করে ফ্রেশ হতে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই সাঁঝ দেখলো সাইমন বিছানায় শুয়ে।ওর সাদা শরীর টা জ্বলজ্বল করছে।পরনে সাদা প্যান্ট।সাঁঝ সাইমনের খালি শরীরের দিকে তাকাতে পারলোনা।নিচে তাকায় ও।লোকটা এমন হয়ে আছে কেন?তার কি লজ্জা লাগছেনা নতুন বৌয়ের সামনে এভাবে থাকতে?সাঁঝকে একবার দেখে আবার সামনে তাকায় সাইমন।তারপর বলল,
''খাটে এসে বসো।"
সাঁঝ ওর দিকে না তাকিয়ে বলল,
''এমন হয়ে আছেন কেন?"
সাইমন ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
''কেন?কেমন হয়ে আছি আমি?"
বলেই শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায় সাইমন।সাঁঝের পুরো শরীর কাঁপছে।সাইমন ধীরে ধীরে সাঁঝের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
''আমি তো বাঁদর তাইনা?"
সাঁঝ অবাক দৃষ্টিতে সাইমনের মুখের দিকে তাকায়।তাকে বাঁদর বলেছে বলে লোকটা খালি গায়ে শুয়ে থাকবে।তবে সাইমনের চেহারায় আজ ভীষন রকমের মায়া ভর করেছে।সাঁঝের বুকটা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে এলো।কেমন এক গভীর লজ্জা ওর ওপর এসে ভর করেছে।সাইমন সাঁঝের দিকে আরো এগিয়ে এসে ওর কপালের সাথে কপাল লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
''এই বাঁদরের বাঁদরামি থেকে বেঁচে দেখাও মিসেস রুদ।"
সাঁঝ কিছু বলতে যাবে তখনই সাইমন ওকে পাঁজাকোলে নিয়ে খাটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।সাঁঝ বলছিলো,
''আ'ম সরি আর বলবোনা বাঁদর নামান প্লিজ।"
সাইমন কিছু না বলে সাঁঝকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর পাশে এসে শোয়।তারপর সাঁঝের গালে কপালে আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল,
''ভয় পাচ্ছো কেন এই বাঁদরকে?বললাম না আজ শেষ তুমি!!!"
সাঁঝ ধীরে বলল,
''আমি ওভাবে বলিনি।"
''বাট ওভাবেই নিয়েছি আমি ম্যাম।বলেই সাঁঝের কপালে ঠোঁট ছোঁয় সাইমন।সাঁঝ কেঁপে উঠে।সাইমন ওকে টেনে বসিয়ে দিয়ে ওর অনেক কাছে এসে বসে।সাঁঝের দুগালে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
''জানো বিশ্বাস হচ্ছেনা আজ তুমি আমার বৌ।তোমার ভাইয়ের সাথে দেখা করার আগে মনে হচ্ছিলো তোমাকে হারিয়ে ফেলবো।কিন্তু ভাই এত অসাধারণ ভাবতেই পারিনি।তোমাকে না পেলে আমি হয়ত থাকতে পারতামনা।বেঁচে থেকে ও মরে যেতাম।তুমি দাদী আর মিতুল ছাড়া আমার কেউ নেই।তবে আজ তোমাকেই পাইনি শুধু পুরো পরিবার পেয়ে গেলাম।বাবা মা ভাইবোন সব আছে।ধন্যবাদ সাঁঝ আমার জীবনে আসার জন্য।"
সাঁঝের চোখ ভরে আসে। সাইমন ওকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে একটু সরে আসে।সাঁঝের চোখজোড়া বোজা।সাইমন সাঁঝের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
''আজ এই রাতটা কে আমার নামে করে দাও না।আজ তোমা সাথে মিশে একাকার হতে চাই।আজ আমাকে নিজের করে নাও।অনেক অপেক্ষা করেছি এই রাতটার।"
সাঁঝ সাইমনের কাঁধ খামচে ধরে ওর ঠোঁটজোড়া আলতো করে ছুঁয়ে একটু সরে এসে লজ্জায় চোখ কুঁচকে নেয়।সাইমন মৃদু হেসে সাঁঝের ঠোঁটজোড়ায় ঠোঁট ডুবিয়ে ওকে নিয়ে শুয়ে পড়ে।ভরিয়ে দিতে প্রিয়তমা সহধর্মিণী কে উষ্ণ ভালবাসায় যেখানে কোন সংকোচ নেই নেই কোন ভয়।আজ রাতটা তো ভালবাসার গান গাইবে এই দুই দম্পতির সুখের দিনের আশার আলো জ্বলবে চারিদিকে।
........................এদিকে ইকরাম রাহমান রুম থেকে যেতেই বিভান উঠে দাঁড়ায়।তখনই আদনান আর নিশাদ ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।বিভান হেসে বলল,
''বাবা মেনে নিয়েছে ঘরের মেজ বৌটাকে।খুব ভালো লাগছে আমার।"
আদনান বিভানকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
''ভাই মাফ করে দিয়েন। আমার জন্য আব্বা আপনাকে কথা শুনাইলো।"
বিভান হেসে বলল,
''সরি বলোনা শালা বাবু।বাবার রাগ জায়েজ।ওনাকে অসন্তুষ্ট করে বিয়ে করেছিলাম।এখন শুধু প্রিয়াশাকে সময় দাও।মেয়েটার দরকার তোমার সাপোর্ট আর ভালবাসার।আর আমার ভাইদের জন্য করেছি সব।আর কিছুইনা।"
আদনান সামনে এসে দাঁড়ায়।নিশাদ মন খারাপ করে বলল,
''ভাই আমি সরি।আসলে আব্বাকে থামাতে পারি নাই।"
''আরে পাগল কিছু হবেনা।অন্তত বুঝলাম বাবা আমাদের ওপর অনেক রেগে নেই।সময়ের সাথে সাথে এই রাগটাও চলে যাবে।আদনান তুমি গিয়ে ঘুমাও।নিশাদ আমি তোমার আপার থেকে ব্রাশ নিয়ে আসি। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।"
নিশাদ মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের রুমের পানে পা বাঁড়ায়।বিভান বেলার রুমে আসতেই বেলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''আব্বা কি বলল?"
বিভান হেসে বলল,
''মেনে নিয়েছে প্রিয়াশাকে।"
প্রিয়াশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''ধন্যবাদ ভাইয়া।আমার ভীষন ভয় লাগছিলো না জানি বাবা কতোটা রেগে আছেন। "
বিভান একটু শব্দ করে হেসে বলল,
''রেগে থাকাটা অস্বাভাবিক নয় প্রিয়াশা।ওনি বাবা আর ওনার অমতে ছেলে মেয়ে এমন কিছু করলে তো রাগ হবে তাইনা?সবারই তো ছেলে মেয়েদের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে তাইনা?যাইহোক এখন তোমার দায়িত্ব তুমি এই বাবাটার খেয়াল রেখো।ওনার কষ্ট হয় এমন কিছু করোনা।"
প্রিয়াশা অশ্রুসজল দৃষ্টিতে স্মীত হাসে।তারপর বেলা আর বিভানের দিকে চেয়ে বলল,
''আপনারা হয়ত কথা বলবেন আমি আসি তাহলে।"
বিভান একটু হাসলো।প্রিয়াশা বেরিয়ে এলো।প্রিয়াশা চলে যেতেই বেলা এগিয়ে এসে বিভানকে জড়িয়ে ধরে। ওর গলায় সন্তুষ্টির স্বর।বেলা ধরে আসা কন্ঠে বলল,
''আপনাকে বাবা কি বলেছে শুনেছি।আমাকে হয়ত কখনো মাফ করবেনা আব্বা।খুব কষ্ট দিয়েছি তাইনা বিভান।"
স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় বিভান। বলতে লাগলো,
''বেলা এখন ওনার রাগ টা কমে এসেছে।সেটা ও শেষ হয়ে যাবে।তুমি কেঁদোনা।অনেক বছর অপেক্ষা করেছিলাম।আল্লাহ আমাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেননা।ভরসা করো।"
বেলা সরে আসে বিভান থেকে।তারপর বলল,
''কিছু লাগতো?"
বিভান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''ব্রাশ লাগতো।"
বেলা মৃদু হেসে বিভানের ব্রাশ এনে ওর হাতে ধরিয়ে দেয়।হঠাৎ পূর্না কোথা থেকে এসে যেন বেলার কোলে উঠে বলল,
''আদকে তোমাদেল তাতে গুমাবো।"
বিভান মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''বাসায় গিয়ে তিনজনে একসাথে ঘুমাবো ওকে?"
পূর্না হেসে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়।"
এদিকে নিশাদ রুমে আসতেই ওর ফোন বেজে উঠে।ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইদ্রির নম্বর থেকে কল এসেছে।নিশাদ কল রিসিভ করতেই ইদ্রি কান্না জড়িত কন্ঠ শুনতে পেয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠে।ইদ্রি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো,
''আপনি আসেননি কেন?আমার ঘুম পাচ্ছেনা।বাবা ও আসেনা।কি করবো আমি?আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে নিশাদ।"
নিশাদ বোনের বিয়লর কারনে ইদ্রির কাছে যেতে পারেনি আজ।নিজেকে ভীষন অপরাধী মনে হতে থাকে ওর।বলল,
''সরি ইদ্রি বুঝোই আজ সাঁঝের বিয়ে ছিলো।খেয়েছো?"
''আম্মু জোর করে খাইয়েছে।আমার আপনাকে লাগবে নিশাদ।প্লিজ আসুন।"
''কাল আসবো।লক্ষীটা ঘুমাও।কাল আমাকে পেয়ে যাবে।"
''ঘুম আসছেনা তো।"
নিশাদ খাটে বসে বলল,
''কথা বলছি তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।"
ইদ্রি আর কিছু বলল না।নিশাদ কথা বলতে থাকে।আবার গান ও গাচ্ছিলো।একসময় নিশাদ ইদ্রির কোন জবাব না পেয়ে বুঝলো পুতুল টা ঘুমিয়ে গেছে।নিশাদ ফোনটা সামনে এনে নম্বরটির দিকে চেয়ে রইলো অনেকটা সময় যাবৎ।