ঝরা ফুলের কান্না - পর্ব ১৫ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


শাদাবের বাবা এসেছেন সম্পূর্ণাকে দেখার জন্য সকালে। সম্পূর্ণা এসে সালাম করতেই তিনি বললেন,"ওই বাড়িতে কবে যাবি তুই?"সম্পূর্ণা ম্লানমুখে বলল," আব্বা দুইদিন থেকেই চলে যাব।"
শাদাবের বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে," তোর বাবা বাড়িতে নেই?"
-" আপনি বসুন আব্বা, বাবা এখুনি চলে আসবে।"
সম্পূর্ণাও পাশে বসলো। শাদাবের বাবা বললেন," এই বাড়িতে বেশি থাকিস না তুই। আমার কথা শুনতে তোর খারাপ লাগলেও বলছি। শাদাবের কান ভাঙানোর জন্য ওই বাড়িতে লোকের অভাব নেই। তুই আসার পর থেকে শাদাবের কান ভাঙানো শুরু হয়েছে।" কথাগুলো শুনে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার শ্বশুর মিথ্যা কথা বলেন না। তিনি সরকারি চাকরি করতেন।রিটার্ন হয়েছে প্রায় ছয়মাস যাবত। বাড়িতে তিনি খুবই গম্ভীরমুখে চলাফেরা করেন। সম্পূর্ণা এই কয়েকদিনে যতটুকু বুঝেছে তিনি খুব ভালো মনের মানুষ। বাহিরে থেকে কঠোর মনে হলেও ভেতরে তুলোর মতো নরম। সম্পূর্ণা মুখে কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই দেখে, তাবিয়া নাশতা নিয়ে এসেছে। বাবাও বাহিরে থেকে এসে শাদাবের বাবাকে দেখে কোলাকুলি করে নিলেন। দু'জনেই অনেক কথা বলছেন। যাওয়ার সময় তিনি আবারও বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতেন। সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। 
বিকেলে শাদাব ফোন দিয়েছে। সম্পূর্ণা ছাদে বসে পাশের বাড়ির উঠানে জন্টুরা খেলছে সেদিকে তাকিয়ে আছে। শাদাব ফোনদিতেই সম্পূর্ণা রিসিভ করলো।
-" আসসালামু আলাইকুম।"
-" রাখো তোমার সালাম। আচ্ছা তুমি সারাদিন রুমের ভেতর কী করো?"
-" বুঝলাম না!"
-" না বুঝার কী আছে? ভাবি আর আপুর সাথে টুকটাক কাজকর্ম তো করতে পারো। না-কি সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে?"
-" টুকটাক কাজ করবো?"
-" কেন? তুমি কাজ জানো না? তখন তো ওই ছেলের সাথে ঠিকি পালিয়ে গিয়ে ঘরের ছাউনি পর্যন্ত দিছ? এখন আমার বাড়িতে তোমার সামান্য কাজ করতেও এত অনিহা? দেখ সম্পূর্ণা, মা বাবার বয়স হয়েছে। তাদের একটু সেবা যত্ন করো। তারা সারাজীবন বেঁচে থাকবে না। একদিন তুমিও শ্বাশুড়ি হবা। তখন তোমার ছেলে মেয়েরাও এমন করবে।"
সম্পূর্ণার দীর্ঘশ্বাসে যেন পাখিরাও শুনতে পেল। শাদাব আবার বলল," দুই মাস পর আমি চলে আসবো। এই কয়েকটা দিন ভালোভাবে চলো। আমি আসলে তোমার কাজ করতে হবে না। তোমার কাজ আমিই করে দিব।"
-" আমি কী একবারও বলেছি আমি কাজ করতে পারবো না?"
-" না বললে করো না কেন? সারাদিন রুমে কী আছে? এমন তো না আমি আছি।" শাদাবের উচ্চস্বরে কথাগুলো কানে লাগছে তার। শাদাব আবার বলল," কাল বাড়ি চলে যেও। মা অসুস্থ, আমাকে টাকা পাঠাতে বলল ২ লাখ।"
-" কিসের জন্য এত টাকা?"
-" বললাম না মা অসুস্থ? আর আমার মাকে টাকা দিবো সেটাতেও কী তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?"
-" আমি কখন বললাম?"
-" ওকে এখন রাখছি। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো।"
শাদাব ফোন রেখে দিলো। সম্পূর্ণার সকালের কথা মনে পড়লো। শাদাবের বাবা তাহলে ইঙ্গিত ঠিকি দিয়েছিল শুধু সেই বুঝেছে দেরিতে। তাবিয়া ছাদের জামাকাপড় নিতে এসে দেখে সম্পূর্ণা মন খারাপ করে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে পোলাপানগুলোর দিকে। তাবিয়া জামাকাপড় হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে," মন খারাপ কেন আমাদের রানীর?"
-"ভাবি শাদাব ফোন দিয়েছে।"
-" তাহলে খুশি না হয়ে মন খারাপ কেন?"
-" জানো, এখন ওদের বাসার মোটামুটি সব কাজ আমিই করি। বড় ভাবি শুধু রান্নাটা বসিয়ে দেয়। কিন্তু শাদাব বলে আমি না-কি কোনো কাজই করি না। হয়তো ওরাই তাকে বলেছে।"
কথাটা শুনে তাবিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবার সহজ হয়ে বলল," আরে দূর বাদ দাও তো এইসব। শাদাব যখন বুঝতে পারবে দেখবে ঠিক হয়ে যাবে। এখন নিচে চলো। এক কাপ চা খাও। আশিকরা আবার রাতে রওনা দিবে। "
সম্পূর্ণা তাবিয়ার সাথে নিচে চলে এলো। 
 
পরেরদিনই সম্পূর্ণা শাদাবের বাড়ি এলো। শাদাবের মা বলল," তুমি এত সকাল চলে এলে কেন? আরও কয়েকটা দিন থাকতা।"
-" আপনার ছেলেই তো আসতে বলেছে।" 
-" ও বললে তুমি আসবা না-কি? এসে যখন গেছ ইশরাত জামাকাপড় কতগুলো বালতিতে ভিজিয়ে রেখেছে। ওইগুলো ধুয়ে ছাদে দিয়ে আসো। বড় বউ বাপের বাড়ি গেছে। না হলে ওকে বলতাম।"
সম্পূর্ণা কিছু না বলে জামাকাপড় ধুতে গেল। তার হঠাৎ মনে হলো ইনি তো পুরাপুরি সুস্থ। কিন্তু শাদাব যে বলল ইনি অসুস্থ! সম্পূর্ণার মাথায় কিছু ঢুকছে না। 
রাতে আজ সম্পূর্নাই রান্না করেছে। বিকেলে শাদাবের বাবা একটা কাতল মাছ এনেছে। ইয়াসমিন বেগম বললেন," রাতের জন্য বেশিকিছুর দরকার নেই। মাছ ভাজা,ডাল,আর কাচা কলার ভর্তা হলেই চলবে। সম্পূর্ণাও তাই করলো। 
কিন্তু যখন খেতে বসলো ইশরাত তার দুই ছেলেকে চার পিস মাছ খাইয়েছে। ইয়াসমিন বেগম আর ইশরাতও খেয়ে চলে গেল। যখন শাদাবের বাবা খেতে এলো মাছ এক পিস আছে। শাদাবের বাবা বললেন, তুই খেয়েছিস?"
-" আপনি খান আব্বা। আমি পরে খেয়ে নিব।"
-" মাছ দেখি এক পিস। তুই খাবি না? আমাকেই দিয়ে দিলি?"
-" আমার মাছ খেতে ভালো লাগে না। আপনি খান।"
-" আরে আমি খেয়ে নিব? না তুইও বস। এক সাথে ভাগ করে খাই। আর এত বড় মাছ কয়েকটা পিস বেশি ভাজি করলেই তো পারতি। না-কি সেটাও হুকুম পাস নাই?"
-" আপনি খান। আমি মাছ তেমন একটা খাই না।" 
শাদাবের বাবা আর কিছু বললেন না। তিনি খেয়ে উঠে গেলেন। সম্পূর্ণা ডাল আর ভর্তা দিয়ে খেয়ে নিলো। 

ইয়াসমিন বেগম ডাক্তারের কথা বলে দুইদিনের জন্য বাহিরে চলে গেলেন।সাথে ইশরাতকেও নিয়ে গেলেন।ইশরাত যাওয়ার সময় ইশরাতের দুই ছেলেকে সম্পূর্ণার কাছে হাসিব আর রিফাতকে রেখে গেল। হাসিব এইসএসসি ফাইনাল দিবে আর রিফাত ক্লাস নাইনে। ইশরাত যাওয়ার সময় বলল," হাসিব যখনই বাসায় আসবে তখন যা চায় দেওয়ার জন্য। সম্পূর্ণাও মাথা নাড়লো। কারণ আসার পর থেকে সম্পূর্ণা দেখেছে হাসিব অন্য রকমের। কিছু চাইলে দেরি হতে পারে না। তাহলেই ভাংচুর শুরু করে দেয়। কিন্তু রিফাত বিপরীত। সে খুবই শান্ত আর ভদ্র। 
হাসিব বিকেলে বাসায় এসে জানতে পারে তার মা আর নানি ঢাকায় গেছে ডাক্তার দেখাতে। সম্পূর্ণা কথাটা বলতেই বলল," আপনি আমাকে আগে জানান নাই কেন? আচ্ছা বাদ দিন এখন। আমাকে কিছু নাশতা দেন খেয়ে বেরিয়ে যাব। রাতে দেরি হবে আসতে।"
-" ঠিক আছে। তুমি বসো আমি নাশতা নিয়ে আসছি। রিফাতকে বলিও যেন তাড়াতাড়ি বাসায় আসে।"
হাসিব কিছু বলল না। সম্পূর্ণা রান্নাঘরে গিয়ে চা বানালো সাথে পান্তুয়া বানিয়ে দিলো। হাসিব খেয়ে আর দেরি করলো না। বেরিয়ে পড়লো।
রিফাত সন্ধ্যায় বাসায় এসে পড়তে বসেছে। শাদাবের বাবাও রাত দশটার সময় এসেছেন। তিনি বাজারের দোকান কেনার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিলেন। বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। তাই তিনি ভাবছেন পেনশন দিয়ে একটা দোকান নিয়ে নিবেন। 
তিনি রাতে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বললেন," শাদাবকে বলিও আমাকে ফোন দিতে। দোকানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো।"
-" ঠিক আছে আব্বা।"
-" হাসিব আসেনি?"
-" না, সে তো বলে গেল আসতে দেরি হবে।"
-" তাহলে তুই অপেক্ষা করিস না। টেবিলে খাবার রেখে শুয়ে পড়। আসলে আমি দরজা খুলে দিব।"
সম্পূর্ণা তাই করলো। সে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। তবে দরজাটা আটকতে সে ভুলেই গিয়েছিল। শাদাবের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়েছে তার মনে নেই। 
হাসিব আসতেই রিফাত গিয়ে দরজা খুলে দিলো। শাদাবের বাবা গভীর ঘুমে ছিল বলে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পায়নি। রিফাত হাসিবকে বলল," ভাইয়া, মামী তোর জন্য টেবিলে খাবার রেখেছে। বলেছে তোকে খেয়ে শুয়ে যেতে। আমি গিয়ে ঘুমাচ্ছি।"
-" তুই এখনো ঘুমাসনি?"
-"না, কাল আমার একটা পরীক্ষা আছে। তাই পড়ছিলাম।"
-" তুই যা আমি খেয়ে যাচ্ছি।"
হাসিব হাত ধোয়ার জন্য বেসিং এ যাওয়ার সময় দেখে সম্পূর্ণার দরজা খোলা। সে উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে চোখটা যেন সেদিকেই লেগে গেল। গায়ে ওড়না নেই, চুলগুলো সামনে এসে পড়েছে কিছুটা।সম্পূর্ণা গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। হাসিব সম্পূর্ণার ঘুমান্ত চেহারাটা দেখে লোভ সামলাতে পারলো না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে। মাথার পাশে থাকা ফোনটা সরিয়ে সাইড বক্সের উপরে রাখলো হাসিব।
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন