তোকে ঘিরে - পর্ব ১৬ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


আকাশে সূর্যের দেখা নেই! ঘন কালো হয়ে ঢেকে আছে সকালের আকাশ! বেলা বারোটা বাজলেও প্রকৃতি ধারন করেছে সন্ধ্যার আভাস! এ কেমন ভয়ংকর অন্ধকার? গা ভয়ে শিউরে উঠে দুমকা হাওয়ার শীতল পরশ পেয়ে!! মনের মধ্যে খারাপ কিছু নিয়ে পূর্বাশঙ্কা অনুভব হচ্ছে! যেন ঘোর কিছু অনুচিত ঘটবে। পূর্ণতা ভার্সিটির লেকচার গ্যাপ দিয়ে আড্ডাস্থল হিসেবে ক্যান্টিনে এসেছে। আজ ওর মন ভালো লাগছেনা। কি নিয়ে যে তীব্র ভয় অনুভূত হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। শুধু মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে! ক্যান্টিনের ভেতর সবগুলা লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টিময় আবহাওয়ায় সবাই ক্যান্টিনে কফি বা চা খেতে ভীড় করছে। আয়মান এখন আগের তুলনায় বেশ সুস্থ, মাথায় পেচানো ব্যান্ডেজের পরিবর্তে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো হয়। রাজিবের কোনো খোঁজ নেই। আয়মান ওর মেসে গিয়েছিলো কিন্তু রাজিব দেখা করতে চায়নি। পূর্ণতা কল দিয়ে আয়মান ও শ্রেয়াকে তথানুযায়ী ক্যান্টিনে আসতে বললো। পূর্ণতা ওদের অপেক্ষায় টেবিলে হাত রেখে তাতে গাল লাগিয়ে ক্যান্টিনের জানালা দিয়ে কালো অন্ধকার করা আকাশ দেখছে। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে পূর্বের সাথে দেখা হয়না। সেই যে দেখা হয়েছিলো গাড়িতে! তাতেই যেনো পূর্ণতার রূহ আটকে আছে! বাসায় এখন মায়ের সাথে প্রচুর ঝগড়া হয় পূর্ণতার। এইতো ভার্সিটি আসার আগে নাস্তার টেবিলে বলে উঠে,

- বিকেলে তোর বাবার দেখা একটা ছেলেপক্ষ আসবে। তুই যথাসময়ে রেডি থাকবি। 

পূর্ণতা ভেবেই পায়না মা কেনো বিয়ে দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে গেছে! ও কি পরিবারের জন্য কঠিন বোঝাস্বরূপ হয়ে গেছে? ও পরিবারের একমাত্র মেয়ে! সেখানে থাকবে ওকে নিয়ে আদর, কদর, বহু সমাদর! এদিকে মা পাগলপ্রায় হয়ে গেছে বিয়ে দেওয়ার জন্য! আর পাড়া প্রতিবেশীর নিন্দুক আন্টিরা তো আছেই আগুনে ঘি তেল ঢালতে! পূর্ণতা নাস্তা না খেয়ে বলে উঠলো,

- মা আমাকে একটু সময় দাও? আমি একটু নিজেকে গোছাতে চাই। আমি চাই না হুটহাট একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সারাজীবন পস্তাতে। 
- হ্যাঁ সময় দেই!পরে আনিশার মতো কীর্তিকলাপ করবি! তাই না!
- আনিশা আপুর উদাহরণ টানছো কেন? সব মেয়েরা কি তার মতো কাজ করবে? অবশ্যই না।
- মেয়েজাত তো। ভুলি কিভাবে! তুই তো এখনো ওই বান্দার নাম উচ্চারণ করার সাহস পাস না! তোহ্? তোর বিয়ে করতে সমস্যা কি!

বারবার একই খোটা শুনতে শুনতে পূর্ণতার মাথা বিগড়ে গেছে। পূর্ণতা অনেকটা না ভেবেই রাগত সুরে বলে উঠলো,

- তুমি নাম শুনতে চাইছো না? ঠিকআছে শুনো তাহলে! উনার নাম পূর্ব। আয়াশ ওয়াসিফ পূর্ব। আরো খবর চাও? তাও শুনো! উনি তোমার বাবার বন্ধু ওয়াসিফ নানার বড় নাতী! শুনছো সব? এবার থামবা? আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ছাড়ো মা! অনেক হইছে প্লিজ! আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা। 

পূর্ণতার মা হতভম্ব হয়ে হাত থেকে পরোটার প্লেট ছেড়ে দিলে ফ্লোরের সাথে তুমুল যুদ্ধ পাকিয়ে চুরমার হয়ে যায় কাঁচের প্লেট! পূর্ণতা হকচকিয়ে পানি খাওয়া আটকে মায়ের থমকানো মুখটা দেখলো। মা এতো চমকালো কেন? পূর্ণতা টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলতেই মায়ের কাছে এসে কাধে হাত রেখে বললো,

- প্লেট ফেলে দিলে কেন? 
পূর্ণতার মা শুধু ঢোক গিলছেন। চোখের পলকটা পযর্ন্ত ফেলছেনা এমন কঠিন ভাবে হতভম্ব হয়ে গেছে জাস্ট নামটুকু শুনে। পূর্ণতা জিজ্ঞাসু সুরে আরো একবার বললো,

- মা? প্লিজ! কিছু তো বলো? কি হয়েছে? এমন রিয়েক্ট করছো কেন? 
থমথমে গলায় মা বললেন,
- তুই যার নাম উচ্চারণ করলি তাকে চিনিস?ভালো করে জানিস কি করে?
- তুমি এভাবে রসকসহীন গলায় কথা বলছো কেন?
- যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর ভালোভাবে দে পূর্ণতা! কোনোরূপ মিথ্যা বা বানিয়ে বলার চেষ্টা করবিনা!
পূর্বর ব্যাপারে যতটুকু জানে সবটাই বলে দিলো পূর্ণতা। খোদেজা মেয়ের দিকে তাকিয়ে হতভাগার মতো বলে উঠে,
- তুই কি ভুলে যাচ্ছিস রাজনীতি কি জিনিস? 
- মা আমি উনার কর্ম দেখে ধর্ম কেনো বিবেচনা করতে যাবো? উনি যা ইচ্ছা করুক। নীতিবিরোধী কিছু না করলেই চলবে। 

পূর্ণতার উত্তর শুনে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কষিয়ে চড় মারে খোদেজা। পূর্ণতা গাল ধরে কিছুটা দূরে ছিটকে গেলে খোদেজা গর্জন করে বলে উঠে,

- তুই আমাকে কখনোই বুঝলি না পূর্ণতা!আজীবন ভেবেই গেলি মা খারাপ! আমাকে কখনো মূল্য দেয়না! আরে? তোর বাপ যেখানে ব্যবসা দাড় করাতে যেয়ে ঋণের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছিলো আমি নিজে তোর দিকে তাকিয়ে তখন হাসপাতালে দিনরাত খেটেখুটে নিঃস্ব হয়েছি! নিজের ইনকামের টাকায় তোর আর তোর বাবার সকল চাহিদা পূর্ণ করেছি! তোর বাপ এখন আবার ব্যবসা দাড় করিয়েছে! কিন্তু? তুই কখনো ভেবেছিস মা কেন খারাপ ব্যবহার করে? তুই সর্বদা নিজেরটা নিয়ে ভাবিস! তুই একটা স্বার্থপর মেয়ে হয়েছিস পূর্ণতা! ছোট থেকে বড় করলাম তোকে ওই পলিটিশিয়ানের হাতে তুলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য? আমি এই রাজনীতি, নেতা, টেতা নিয়ে প্রচুর ভয় পাই! কখন কাকে কোন সময় জবাই করে ফেলে! মরতে তোকে আমি ওই ছেলের হাতে তুলে দিবো?তোর বাপ কিভাবে মুখ সেলাই করে থাকলো এতোদিন? আজ তোর বাপ আসুক! 

- কিরে কাঁদোস কেন?

পূর্ণতার ভাবনার উনুনে পানি ঢেলে চেয়ারে বসে প্রশ্ন করলো আয়মান। পূর্ণতা চোখ মেলে টেবিলের উপর থেকে মাথা উঠিয়ে দেখে সামনের চেয়ারে আয়মান বসেছে ও পাশে শ্রেয়া! পূর্ণতা চোখ মুছতেই আয়মানের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

- আমার মনটা ভালো না। প্রচুর খারাপ লাগছে। প্রচুর বেশি খারাপ লাগছে।
- কেন?, আয়মান ভ্রু কুন্ঞ্চিত করে বললো!

পাশ থেকে শ্রেয়া চেয়ার টেনে পূর্ণতার খুব কাছে এসে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
- আন্টি কোনো ঝামেলা করেছে? বল পূর্ণতা!!
পূর্ণতা মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে মাথা টেবিলের দিকে নুয়ে বলে উঠে,

- মা-কে পূর্বের ব্যাপারে সব বলার পর থেকে মন বসে গেছে শ্রেয়া। কি যেনো অঘটন ঘটবে!! মনটা ভালো সংকেত দিচ্ছেনা। 

আয়মান চট করে বলে উঠলো,
- বইন মনটারে স্যাটেলাইট বানাইস না প্লিজ! ওইটা সংকেত দিতে পারেনা।

শ্রেয়া ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলো,
- তোর নষ্টালজিক কথাবার্তা অফ কর ইবলিশ! একটা থাপ্পর লাগাবো! পূর্ণতা? আন্টিকে সব বলার পর কি হয়েছে? আন্টি কি খারাপ কিছু বলছে যেটা শুনে তোর মন খারাপ?
পূর্ণতা জোরে নিশ্বাস ছেড়ে হালকা গলায় বলে উঠে,
- মা বলছে উনার সাথে বিয়ের চিন্তাভাবনা কথা নিছক! একটা পলিটিক্স করা ছেলেকে বিয়ে করা মানে নিজের হাতে নিজের মৃত্যু গ্রহন করা।

আয়মান আশ্বস্ত গলায় পূর্ণতাকে বুঝিয়ে বললো,
- পূর্ণতা? পূর্ব তোকে 'লাভ ইউ' বলছে? বিয়ে করতে চাইছে? কোনোপ্রকার ফোর্স করছে যা তুই নিতে পারোস না? আমার তো মনে হয়না, পূর্বর মতো মানুষ এগুলার একটাও করছে। জাস্ট আমি এটুকু বলতে চাই, বিয়ের চিন্তা আপাতত সাইডে ফালা। আগে পূর্বর স্ট্রেটেজি বোঝার ট্রায় কর। এক সপ্তাহ হইছে পূর্ব তোর সাথে যোগাযোগ করেনাই। বুঝিস ব্যাপারটা! তোর চাইতে হাজারগুণ বেশি ছটফটানি ওর হইতাছে। মাথা ঠান্ডা কর। আমি তিনটা ক্লোড কফি অর্ডার দিয়া আসতাছি। 

আয়মানের অর্ডার করা কোল্ড কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবছি পূর্ব এখন কোথায় থাকতে পারে! উনি কি আমাকে একটুও মিস করছেন না? আয়মানের তথ্যমতে, ছেলেদের মধ্যে অস্থিরতার বেগ বেশি। তবে পূর্ব কি নিজেকে মহাপুরুষের মতো কন্ট্রোল করছে? কিন্তু কেন? আমি কফিতে আরেক চুমুক দিয়ে মোবাইল গেমস খেলা আয়মানের দিকে তাকিয়ে বলি,

- দোস্ত শোন না? তোর কি মনেহয় পূর্ব আমায় মিস করছে? 
আয়মান গেমসের দিকে মগ্ন হয়ে জবাব দিলো,
- টিস্যু যেমনে একফোঁটা পানি দেখলে শুষার জন্য উইঠে পইরে লাগে! ওমনে মিস করতাছে! কাগজে লেইখা নে।  

এই আয়মানের জিলাপি মার্কা উত্তর শ্রেয়ার মগজে ঢুকতেই ওর দৃষ্টি রাগান্বিত করে দিলো। শ্রেয়া রেগে গিয়ে বললো,

- ছি! তোর এই ঘুতুঘুতু মার্কা এক্জেম্পাল শুনলে গা ঝাড়া দেয় আয়মান!
- বাইরে ড্রেনের পানিতে একবার চুবানি খা! তাও আমার মাথা নষ্ট করিস না। 
- তুই কি বললি!
- ওলে বাবুটা...উর্দু ভাষায় বলছি বুঝেনাই!! 
- তুই আমাকে বাবু বললি?
- হারামজাদা! তুই আমার ভাষা বোঝার ক্ষমতা নিয়া পয়দা হইছোস? আলকাতরা চেচাস কেন? চুপ যা!

মানে, আমার এখন ইচ্ছা করছে হাত উঠিয়ে ঠাস ঠাস করে দুটোর গালের চামড়া লাল করে দেই! 'সময় নাই, গময় নাই, বাবু একটা টিকেট দেন!' -- এই প্রবাদের মতোই ওরা যখন তখন ঝগড়া শুরু করছে! আমি ভয়ংকর রাগে চেচিয়ে বলে উঠি,

- তোরা যদি কামড়া কামড়ি বন্ধ না করিস! আমি স্যান্ডেল খুলে দুটোর গাল শেষ করবো! 
 আয়মান আমার কথা শুনে লাজুক ভঙ্গিতে গাল টুকটুক করে হেসে বললো,

- তুই দুষ্টু দুষ্টু কথা বলিস না তো। আমি ভালো পোলা। 

ওমা! আমি দুষ্টুমির কি কথা বললাম? ওরা দুটো ঝগড়া করছে থামতে বলেছি তাতে দুষ্টু কথা কি করেছি? 

- ওই ছাগল! আমি দুষ্টু কথার কি বললাম? 
- তুই না খুবই পাজি হয়ে গেছিস পূর্ণতা। পূর্বর সাথে থাকতে থাকতে তুই এখন ওর মতো দুষ্টু কথা বলিস। 
- কি আশ্চর্য! 
- শ্রেয়ার সাথে কখন আমি কামড়া কামড়ি করছি বইন? এই আখ্যা দিস না প্লিজ! আমার ফিউচার বউ কষ্ট পাইবো। 

আমি শ্রেয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু বলবো তার আগেই শ্রেয়া ফিক করে হেসে দেয়। শ্রেয়ার হাসিতে আমরা দুজনও অট্টহাস্যে ফেটে পরি। হায়রে কপাল! কেউ আমাকে এই দুটোর হাত থেকে রক্ষা করো!! এই পায়ে পরে ঝগড়া! এখন আবার খিটখিটিয়ে হাসি! কই যে যাবো আমি!!

বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে নূরানী ও আমি টিভি দেখতে বসেছি হঠাৎ দরজায় ক্রি ক্রি করে কলিং বেল বাজলো। নূরানী দরজা খুলতে গিয়েছে আমি সোফায় বসে তাকিয়ে আছি সেদিকে। কে যে আসলো!! একটু পর নূরানী ফিরে এসে রুমের দরজায় দাড়িয়ে বলে উঠলো,

- আপা, আপনের বন্ধু রাজিব ভাইয়ে আইসে। হেরে আপনের রুমে বসতে বলছি।

রাজিব? ও কেন বাসায় আসলো? এতোদিন গুম থাকার পর এখন কেন বেহায়ার মতো আসলো? পূর্বর ব্যাপারে যেই ভয়াবহ মিথ্যা বলেছে ইচ্ছা তো করছে ওর জিহবাটা কেচি দিয়ে কেটে দেই! আমি কোল থেকে মোবাইল নিয়ে সোফা থেকে পা ফেলে রুমের দিকে যেতে যেতেই আয়মানকে কল করি,

- আয়মান! দোস্ত শোন শোন!! রাজিব এখানে! তুই আর শ্রেয়া তাড়াতাড়ি আয়! জলদি! 

আমি কল কেটে আমার রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি রাজিব আমার আলমারি খুলে আমার টিশার্টে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে! এই দৃশ্য দেখে আমার চোখের কোটর বৃহৎ হয়ে গলা ভেদ করে দারুন এক ধমক এলো!

- রাজিব! তুই এটা কি করছিস! 

 রাজিব চমকে উঠে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে আমাকে দেখে চটজলদি টিশার্টটা রেখে আলমারি আটকে দিলো। আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে ! রাজিব কি করছিলো এটা? আমার গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠেছে দৃশ্য দেখে! রাজিব খুব ধীরপায়ে আমার সামনে এসে অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

- তুই আমার দিকটা ভাববি না পূর্ণ?
- পূর্ণ ডাকবি না রাজিব! আমার লাস্ট ওয়ার্নি!
- হা হা, তোকে রাগলে কি অদ্ভুত কিউট লাগে! তুই জানিস? 
- তুই এখানে কি করতে এসেছিস রাজিব! কেন এসেছিস! একটু আগে কি করলি এটা! 
- তোর গায়ের মিষ্টি গন্ধটা খুব করে মিস করছিলাম পূর্ণতা। আমি তো কখনো তোর থেকে দূরে দূরে থাকতাম না। তুইও পাশেই থাকতি । এই প্রথম দূরে..
- ছি! ছি! তুই আমার বন্ধু হওয়া...
- ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব থাকেনা। হয়তো সেটা ভালোবাসার দিকে এগুবে নয়তো ঘৃণার দিকে। 
- তোর ফিলোসফি শোনার ইচ্ছে নেই রাজিব! বেরিয়ে যা এখান থেকে! 
- আচ্ছা? পূর্ণতা? আমি কি দেখতে খুব খারাপ? আমাকে ভালোবাসা যায় না? 

রাজিবের মুখে উপচে পরা দুঃখ প্রকাশ পাচ্ছে কিন্তু আমার এতে কিছুই করার নেই। আমি ওকে বন্ধুবেশে ভাইয়ের মতোই দেখেছি যেমনটা আয়মানের জন্যে দেখি! রাজিব আমার দিকে একধাপ এগিয়ে এসে বললো,

- চুপ করে আছিস তার মানে তুইও আমাকে ভালোবাসিস!! ঠিক না পূর্ণ? আমিও তোকে ভালোবাসি! বহু আগে থেকেই ভালোবাসি পূর্ণ। কিন্তু সময় ও সুযোগ কখনো পাইনি। আজ বলছি! তোকে ভালোবাসি। 

- তোর কষ্ট হলেও সত্যি আমি তোকে বন্ধুর মতোই দেখেছি রাজিব। তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু কখনো বন্ধুর চেয়ে বেশি হওয়া আমার পক্ষে পসিবল না। তুই আমার ভাই ব্রাদারের মতো দোস্ত!

রাজিব হঠাৎ ওর অসহায় চেহারার মুখোশ পাল্টে মুখের আভাস রণচন্ডী রূপে পরিবর্তন করলো! রাজিবের নাক ফুলে উঠছে হিংস্রতার নিশ্বাস ছেড়ে! হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে! 

পূর্ণতা কপাল কুচঁকে কিছু বুঝবে তার পূর্বেই রাজিব ওর উপর হামলা করলো! পূর্ণতাকে দরজার সাথে চেপে নিজের শরীরের ভর ওর উপর ছেড়ে হাত উচু করে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। পূর্ণতা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলে রাজিব ওর মুখ চেপে গলা থেকে ওড়না টেনে ফ্লোরে ছুড়ে! পূর্ণতা প্রাণপণে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে! রাজিব ওকে ছাড়ছেনা! পূর্ণতা ছটফট করতে করতে একপর্যায়ে কেদেঁ দেয়! বাইরে থেকে দরজায় লাগাতার ধাক্কা দিয়ে চেচামেচি করছে নূরানী!

- আপা? পূর্ণতা আপা? দরজা খুলেন আপা! ও রাজিব ভাই আপনে আপার লগে কি করতাছেন! দরজা খুলেন কইতাছি!ও আপা!! আপা গো!!

রাজিব পূর্ণতার কোমরের কাছ থেকে কামিজ উঠিয়ে পেটে হাত রাখতেই পূর্ণতা চোখ কুঁচকে বদ্ধমুখেই চিৎকার দিয়ে উঠে! রাজিবের গলায়, ঘাড়ে, হাতে অজস্র নখ ঢুকিয়ে ছিলে দেয়! রাজিব উফ শব্দটাও করছেনা! পূর্ণতার নখের আচড়ও যেন অদ্ভুত আনন্দ দিচ্ছে রাজিবকে! পূর্ণতাকে ছুঁয়ে দেখার মধ্যে যেন ভালোবাসার ইন্দ্রজাল অনুভব করছে! রাজিব পূর্ণতার কপালে চুমু দিলে পূর্ণতা দুহাতে ধাক্কা দিয়ে উঠে! রাজিব পুরুষত্বের শক্তি খাটিয়ে পূর্ণতার কপাল থেকে চুমু দিতে দিতে গালে নামলে ধস্তাধস্তি একপর্যায়ে হতবিহ্বল পূর্ণতা স্থির হয়ে যায়। মাথার ভেতরটা দপদপ করছে পূর্ণতার, নার্ভের অতিরিক্ত উত্তেজনায় হাত ঠান্ডা হয়ে শরীর অসাড়তাপূর্ণে নেমে যাচ্ছে। রাজিব এদিকে পেটে হাত রেখে খামচে ধরে পৈশাচিক লালসায় নিমজ্জিত হলে চোখ বন্ধ করে পূর্ণতা সাহায্যের জন্য আল্লাহ্কে ডাকে! এই মূহুর্তে পূর্বকে খুব মনে পরছে পূর্ণতার! পূর্বের সেই ওয়াদা, ' আবার দেখা করবো ', সেই অব্যক্ত অনুভুতি, 'বুকে আসো প্লিজ', সেই অস্থির গলা, 'কাঁদছো কেন?'। পূর্ণতা হু হু করে কেদেঁই যাচ্ছে। পূর্ব একবার আসুন প্লিজ! আমি মরে যাবো! রাজিব আমাকে ছাড়বেনা পূর্ব! আমাকে মেরে ফেলবে!! হঠাৎ দরজায় নূরানীর আহাজারীর পাশাপাশি শোনা গেল একজোড়া অস্থিরচিত্ত গলা!

- কুত্তার বাচ্চা! শালা তোরে আমি জবাই করমু! দরজা খোল শালা! দরজা খোল!!তোর কল্লা নামামু! দেখ তোরে কি করি!!

- রাজিব দরজা খোল বলছি! তুই আজ পার পাবিনা!! পূর্ণতাকে ছাড়!!

আয়মান ও শ্রেয়ার কন্ঠ পেয়ে রাজিবের হিংস্রতা বেড়ে গেছে! পূর্ণতার ঘাড়ে একহাত রেখে আরেকহাতে পূর্ণতার মুখ চেপে কানে কামড় দিচ্ছে রাজিব! পূর্ণতার চোখের পানি রাজিবের হাতের উপর পরছে। পূর্ণতার চিৎকার বাইরে যাচ্ছেনা! আয়মান কোনো উপায় না পেয়ে শেষে নিজেই দরজায় লাত্থি মারে! দরজার ছিটকিনি আলগা হয়ে খুলে যেতেই সজোড়ে ধাক্কা খেয়ে রাজিব পূর্ণতার থেকে ছিটকে উল্টে ফ্লোরে যেয়ে পরে। দরজার ধাক্কায় পূর্ণতা পিঠে ব্যথা পেয়ে অন্যদিকে ধপাস করে পড়ে যায়! আয়মান ভেতর ঢুকে পূর্ণতার দিকে না তাকিয়ে শ্রেয়াকে ইশারা দেয় পূর্ণতাকে ধরার জন্য! শ্রেয়া ফ্লোর থেকে ওড়না উঠিয়ে পূর্ণতাকে ঢেকে বেরিয়ে যায় পাশের রুমে! আয়মান এলোপাথাড়ি মারতে মারতে রাজিবের নাক দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছে! যেকোনো মূহুর্তে আয়মানের উত্তম মধ্যম ধোলাই খেয়ে সিরিয়াস একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যাবে! আয়মান রাজিবের বুকের দুইপাশে পা রেখে মুখে ঘুষি মেরে বললো,

- তুই বন্ধু নামের কলঙ্ক! আমাদের বন্ধু নামক সুন্দর সম্পর্কটারে তুই কলঙ্কিত করলি শালা! পূর্ণতারে তুই ভালোবাসিস? বা* বাসিস! তোর বাচাঁর অধিকার নাই!! তুই পূর্ণতার সাথে...

আয়মানের চোখ ভিজে আসে। রাজিব আহত চোখে পিটপিট করে তাকালে আয়মান আরেকটা ঘুষি দিয়ে বলে উঠে

- আজকের পর থেকে না আমরা তোরে চিনি! না তুই আমাদের! মরে গেছিস তুই! আর জীবনেও তোর দূষিত চেহারা দেখতে চাইনা!!

সুদূর মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আযানের সুর। নীল আকাশের কালো মেঘগুচ্ছ এখন বেগুনি রঙে ফুটে উঠেছে। দিনের আলো রাতের আধারে সজ্জিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্ণতা বিছানায় সটান হয়ে ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেমে থেমে চোখের অশ্রু ফেলছে। পূর্ণতার বাঁ পাশে বিছানায় আসন করে বসে নিরবে কাদঁছে শ্রেয়া। আয়মান পূর্ণতার ডানদিকে বিছানায় পিঠ লাগিয়ে বসেছে। নেভি ব্লু রঙের ল্যাভিস শার্টের দুটো বোতাম খুলে বির্মষ দৃষ্টিতে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। রাজিবকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর থেকে কেউ একটা ওয়ার্ডও উচ্চারন করেনি। সবচেয়ে বেশি থমকে গেছে পূর্ণতা। ডান কানটায় রক্ত জমে লাল হয়ে আছে। হাতের কয়েকটা জায়গায় নখের দাগ। রাজিব ভয়াবহ রকমের ক্ষতি করতে পারেনি পূর্ণতার। কিন্তু পূর্ণতার মনে খুব গভীরে দাগ কেটে গেছে আজকের ঘটনা। জালিমের হাত থেকে বেঁচে গেছে ঠিকই কিন্তু জোরপূর্বকের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। নূরানী ট্রেতে করে আয়মান ও শ্রেয়ার জন্য লেবুর শরবত এনে টেবিলে রাখে। পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে ওড়নায় মুখ চেপে অশ্রু ফেলে। একটু পর আয়মানের দিকে তাকিয়ে কান্না কন্ঠে বলে উঠে,

- আয়মান ভাই, খালাম্মায় আইলে কি কমু? খালাম্মায় আপারে বকবো। 

আয়মান স্তম্ভিত কন্ঠে ফ্লোরে তাকিয়ে বলে উঠে,

- আন্টিকে কেউ কিছু বলবিনা। সব ঠান্ডা হোক। আমি নিজেই বলবো। 

শ্রেয়া ফুপিয়ে কেদেঁ দুহাতে মুখ ঢাকে। আয়মানের কানে শ্রেয়ার কান্নাধ্বনি গেলে হালকা ঢোক গিলে বলে উঠে,

- চুপ কর শ্রেয়া। পূর্ণতা পাশে। তোর কান্না দেখলে পূর্ণতা কষ্ট পাবে। 

শ্রেয়া হেচকির তালে কেঁপে উঠে চোখ মুছে পূর্ণতার দিকে তাকালো। সকালে বলেছিলো ওর মনটা খারাপের দিকে টানছে। কিছু অঘটন ঘটার আগাম পূর্বাভাস পাচ্ছে। কেউ বিশ্বাস করেনি। হাসিতে উড়িয়ে দিয়েছে। মাঝেমাঝে মেয়েদের গাট ফিলিংগুলো সত্যি হয়। এই গাট ফিলিং মন থেকে একটা ইঙ্গিত দেয় --- 'তোমার সাথে কিছু খারাপ ঘটবে'! অনেকে সেটা মেনে নিজেদের নিরাপদ রাখে। অনেকে অবিশ্বাস করে মনের ভুল হবে নিজেদের বিপদে ফেলে। আয়মান অনেকক্ষন নিরবতা পালন করে পূর্ণতার শূন্যচোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

- বইন? কিছু তো বল। কাদিঁস না। আমারে আর শ্রেয়ারে একটু বকা দে না। ওই পূর্ণতা...

আয়মানের কথা শুনে শ্রেয়ার চোখ আবার ঝাপসা হয়ে আসে। নূরানীও দৌড়ে পালায় সেখান থেকে। হয়তোচোখের নোর্নজল গুলো এবার বাধ মানবেনা। পূর্ণতা কিছুকালব্যাপী নিরব থেকে রোবটের মতো ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠে,

- পূর্বকে চাই...
.
.
.
চলবে...................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন