শাদাবের বন্ধুর সাথে কথা বলার ফাঁকেই সম্পূর্ণা ঘুমিয়ে গিয়েছিল। শাদাবের কানে ব্লুটুথ থাকার কারণে কথা বলতে বলতে ভুলেই গিয়েছিল সে ফোন কাটার কথা। হাসিব এসেই সম্পূর্ণার পাশে বসে মুখের সাথে মুখ লাগাতে যাওয়ার আগেই সম্পূর্ণার নিজেকে ভারি মনে হতে লাগলো। হঠাৎই চোখ খুলে হাসিবকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসে," হাসিব তুমি এইখানে?"
কথাটা কানে ভাসতেই শাদাব চুপ করে শুনতে লাগলো।
হাসিব এক ফালি হাসি দিয়ে, " মামী আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন?"
সম্পূর্ণার চোখেমুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ধমকের স্বরে বলল," ভয় পাচ্ছি মানেটা কী? তুমি এত রাতে কী করছ সেটা তো বলবে?"
-" মামী একবার! একবার আপনাকে ভালোবাসি?"
সম্পূর্ণার শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। শরীরের শিরা-উপশিরা বন্ধ হয়ে আসছে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল," তুমি যাও এইখান থেকে। আমি তোমার মামী। আর মামী মানে মা। মা'কে কখনো অসম্মান করতে নেই হাসিব। যাও তুমি এইখান থেকে। হাসিব ঘাড় বাঁকা করে বলল," আমি তো যাব না। আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগে মামী। কিচ্ছু হবে না। আমি কাউকে বলবো না। প্লিজ মামী একবার! আপনি একবার করলে কী হয়?"
সম্পূর্ণা উঠে ওড়নাটা নিয়ে হাসিবকে দুই ধাক্কা দিয়ে সরালো। নিজেকে সামলে কঠোর গলায় বলল," আমি তোমাকে যাতে বলছি যাও। বলছি না যাইতে? তুমি যদি আমার সাথে আর একবার বেয়াদবি করছ তো আমি এখুনি আব্বাকে ডাকবো। আব্বা, আব্বা।" হাসিব আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতের ব্যাপার রিফাতের চোখ এড়ায়নি। কিন্তু বড় ভাই কী করতে যাচ্ছিলো? হাসিব যেতেই সম্পূর্ণা দৌড়ে দরজাটা লাগিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সেদিন সারারাত সম্পূর্ণা ঘুমায়নি। কিছুক্ষণ পর পর শব্দ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সকালেই হাসিব ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সম্পূর্ণা সারাদিন না খেয়েই ছিল। গলা দিয়ে কোনো খাবার তার যাচ্ছে না। আল্লাহ তাকে এইভাবে বাঁচিয়ে দিলো!শাদাব আজ একবারও কল করেনি তাকে। শাদাবকে কী বলবে কথাটা? ছিঃ কী করে বলবে এমনটা?
তবুও শাদাবকে কল দিলো সে। কিন্তু শাদাব ফোন রিসিভ করে পরে ফোন দিবে বলে রেখে দিলো। বিকেলেই ইয়াসমিন বেগম এস বাড়ি মাথা করছেন চিল্লাপাল্লা করে। সম্পূর্ণা কিছুই বুঝলো না। ইনি আবার কেন চেঁচাচ্ছেন? শাদাবের বাবা এসে দেখে ইয়াসমিন বেগম একেরপর এক গালি আওড়াচ্ছে আর ইশরাত পাশে বসে নিস্তব্ধ হয়ে আছে।
-" খান* মা* ঘরে নিয়ে আসলে কী আর ঘর শান্তি থাকবো? এইসব মাইয়া বারো ব্যাটার সাথে থাকছে। এখন কী আমার ছেলেরে ভালো লাগবো? লাগবো তো কচিকাঁচা ছেলেপেলেরে। ভাগ্য ভালো আমার নাতি আমারে বলছে। না বললে জানতাম? ইশরাত, শাদাবকে কল দে। আমি একটু কথা বলি। বলবো কী ঘরে রেখে গেছোস? মানসম্মান তো আর কিছুই রইল না। লোকে জানাজানি হলে মুখ দেখাতে পারব এই সমাজে? এর থেকে শাদাবরে বলি এর বাপ মা এসে নিয়ে যাইতে।"
-" সম্পূর্ণা এইগুলো শুনে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ লাল বানিয়ে ফেলেছে। শাদাবের বাবা কোনো কিছুর আগামাথা বুঝলেন না। তিনি দোকানে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রিফাত এসে সব বলল। সকালেই হাসিব ভালো সাজার জন্য নানির কাছে ফোন দিয়ে সম্পূর্ণার নামে বাজেভাবে বলেছে। নিজে যা করছে তার বিপরীত কথাবার্তা বলছে।আর সেগুলো শুনেই ইয়াসমিন বেগম গরম হয়ে আছেন। শাদাবকে কল দেওয়ার পর রিসিভ করে, সালাম দিলো সে। ইয়াসমিন বেগম সালামের উত্তর না দিয়েই বলল," তোর বউ রেখে গেছিস কী আমাদের মানসম্মান ধুলায় মিশানোর জন্য? কী করছে তোর বউ জানিস?"
হাসিব যদি আমাকে সকালে না বলতো তাহলে আমরা জানতামই না। বাবারে এই বউ এই বাড়ি রাখা যাবে না। এই বাড়ি রাখলে আমার নাতিগুলোকে নষ্ট করে ছাড়বে। তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। কিছু একটা কর।"
শাদাব শান্ত গলায় বলল," তোমার বলা শেষ হয়েছে মা?"
-" তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি।"
-" হাসিব কোথায়?"
-" ওর ঘরে।কেন?"
-" ডেকে ফোন লাউডস্পিকারে দাও।"
ইয়াসমিন বেগম তাই করলেন। হাসিবকে ডেকে নিয়ে এসে ফোন লাউডস্পিকারে দিলেন। শাদাব বলল," হাসিব তোর মামী তোকে এতগুলো কথা বলল তুই সুযোগ নিলি না?"
ইশরাত কথাটা শুনে পাশ থেকে বলল," শাদাব তুই এইসব কী বলছিস? আমার ছেলের এসবের বয়স হয়েছে?"
শাদাব ধমক দিয়ে বলল," তোর ছেলে যদি মামীর কাছে একবার চাইতে পারে,ভালোবাসার কথা বলতে পারে। তাহলে ছেলের আর কত বয়স হলে বুঝবি তুই? দেখ আপু, কাল রাতে কী হয়েছে আমি সব জানি। আর আমার মা, মা তুমি বড় বড় যে কথা বলছ নাতির ব্যাপারে তুমি সব জানো? তোমার কী মনে হয়? সম্পূর্ণা এমন কাজ করলে তোমার নাতি তোমার কাছে গিয়ে বলতো? জীবনেও বলতো না। কাল রাতে আমি ফোনেই ছিলাম। যা হয়েছে আমি না দেখলেও সব শুনেছি। যখন শাদাব সব খুলে বলল তখন ইয়াসমিন বেগম চুপ হয়ে গেলেন। ইশরাত তো বিলাপ ধরে কান্না জুড়ে দিলো। মা ভাই পালটে গেছে। বিয়ে করেছে তো এখন সব আমার ছেলের দোষ দিতে চাইছে। মা শাদাব জীবনেও এমন ছিল? এখন বউয়ের কথায় আমার ছেলেটাকে বাড়ি ছাড়া করতে চাইছে।"
ইশারাতের কান্না দেখে শাদাব বলল," তুই শুরু করেছিসটা কী? তোর ছেলেকে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবো না। কিন্তু সে অন্যায় করেছে তাকে বল সম্পূর্ণার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে। আমি আবার ফোন করে যেন শুনতে পাই হাসিব ক্ষমা চেয়েছে।"
কথাটা বলে শাদাব ফোন রেখে সম্পূর্ণাকে ফোন দিলো।
সম্পূর্ণা কান্নার জন্য গলা থেকে কথা বের হচ্ছে না। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল," তুমি কী বিশ্বাস করছ আমি খারাপ চরিত্রহীন?"
-" তা নয়তো কী? তোর কী মনে হয় তুই ভালো? তুই দরজা খুলে ঘুমালি কেন? তোরে আমি ফোন দিছি তুই আমার সাথে কথা না বলে ঘুমাচ্ছিস?আমি চলে আসছি কয়দিন হয়েছে? এর মধ্যে তোর আরেকজন দরকার পড়ছে! এইটা আগে বলতি আমি নিজেই চলে আসতাম। কুত্তী রেডি থাক আমি দুই দিনের ভেতর আসতেছি।
সম্পূর্ণা বলল," তোমার যা ইচ্ছে করো তবুও আমাকে ভুল বুঝো না। বিশ্বাস করো আমি ঘুমে ছিলাম।আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে কথা শেষ করে দরজা লাগিয়ে দিব। ওর মা ছিল না। খাবার টেবিলে দিয়েছি কি লাগবে না লাগবে দিতে হবে না? যদি না দিই তাতেও তো আমার কথা শুনতে হবে। আমি কী করতাম?"
-" আমি মানছি তোমার দোষ নেই। কিন্তু ছেলেটা যখন তোমাকে বলল একবার দিতে তাহলে তুমি তখন ওকে কষিয়ে একটা চড় দিলে না কেন? যা হবার আমি দেখতাম। তুমি তখন ছেলেটাকে ভদ্রভাবে যেতে বলছ।সম্পূর্ণা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এত শান্ত ছিলে কীভাবে? "
-" আমি কী করতাম? যদি ও অন্যকিছু করে বসতো?"
-" রাবিস। তোর এসব কান্না থামা। তোর এত সমস্যা জেনেও আমি তোকে নিয়ে সংসার করছি। তোর একটা কিডনি নেই জেনেও নিজেকে বুঝিয়েছি। কিন্তু তুই? তুই আমারে ভালো থাকতে দিবি না। তুই বিশ্বাস কর তোকে দেশে রেখে দেখছি আমি শান্তি পাব না। আমি চলে আসবো তুই এই কথা মনে রাখিস।"
শাদাব আরও অনেক ধমকিয়ে ফোন রেখে দিলো। ইয়াসমিন বেগম হাসিবকে নিয়ে এসেছে মাপ চাওয়ার জন্য। হাসিব সহজেই মাপ চেয়ে চলে গেল। সম্পূর্ণা অবাক হলো। ইয়াসমিন বেগম এত সহজে মেনে নিলেন? এইটা কীভাবে সম্ভব!
শাদাব সত্যিই কয়েকদিন পর বাড়ি চলে এলো। সম্পূর্ণার দেখা শোনাও করে আবার কথা বলতে একচুল ছাড় দিতে রাজি না সে। কয়েকমাস যেতেই সম্পূর্ণাকে নিয়ে ডাক্তার কাছে গেল। আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জানতে পারলো মেয়ে হবে। শাদাব কথাটা শুনে বেশি খুশি হতে পারলো না। কিন্তু সম্পূর্ণাকে কিছু বলেনি। বাড়িতে আসতেই ইয়াসমিন বেগম জিজ্ঞেস করতেই শাদাব কিছু না বলে নিজের ঘরে গেল। সম্পূর্ণা দ্বিধা গলায় বলল, " মেয়ে হবে।"
ইয়াসমিন বেগম কথাটা শুনে," আমি আগেই জানতাম এমন কিছুই হবে। আল্লাহর কাছ থেকে একটা ছেলে চাইতে পারো নাই?"
-" আল্লাহর কাছে চাওয়ার আগেই তো আপনি বলে দিলেন মেয়ে হবে। তাহলে আল্লাহর কাছে চাইলে আর হতো? মা একটা কথা বলি। আপনারা যেটা করছেন এইটা শেরেক।মানুষ গায়েবি কিছু বলতে পারে না। তারা শুধু অনুমান করে। আর এই অনুমানটাই শেরেক।" কথাগুলো বলে সম্পূর্ণাও চলে গেল। ইশরাত হা করে তাকিয়ে থেকে বলল," মা ও কী তোমায় জ্ঞান দিয়ে গেল?"
.
.
.
চলবে.....................................