সাইফুল ইসলাম বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন। শরীরের শক্তি যেন ক্ষয়ে গেছে। আমার মেয়ে হয়ে ওর মন রুচি এতটা নিচে নামতে পারে আমার জানা ছিল না।
আতিকা বেগম দূর থেকে কথাগুলো শুনেই সম্পূর্ণার গালে পিঠে দুই তিনটা চড় থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন।
তাবিয়া এসে," মা কী করছেন? ও এখনো ছোট।"
-" কিসের ছোট? আগে তো মনেই করতাম ছোট। কিন্তু ছোটোর মতো কাজ করছে? বেয়াদব মেয়ে একটা। তুই কী ভাবছিস আমারদের মান সম্মান ডুবিয়ে তুই ওই পোলার সাথে গিয়ে ভালো থাকবি? কোনোদিনও না। তুই ওই পোলার নাম মুখে নিলেও তোর নাম আর এই বাড়িতে উচ্চারণ করবো না।"
সাইফুল ইসলাম কাছাকাছি আসতেই তিনি বললেন," পড়িয়ে কী লাভ হবে? মান সম্মান যাওয়ার থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া ভালো। বিয়ের পর জামাই পড়ালে পড়াক।"
-" আতিকা তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ও এখনো ছোট।"
-" ছোট ছোট বলিও না। আমারে যখন বিয়ে করছ তখন কী আমি ধামড়ি ছিলাম? তুমিও তো আমার ক্লাস এইটে বিয়ে করছিলা। তখন মনে ছিল না আমি ছোট না বড় ছিলাম। ওর বয়সেই কিন্তু তোমার বড় পোলা দুনায় আসছে।"
সাইফুল ইসলাম করুণ স্বরে বললেন," এখন কী সে আগের দিন আছে? আর তুমি এখন তোমার কোন বয়সে বিয়ে হয়েছে এইটা প্রমাণ করলে ছোট হয়ে যাবে না। বুঝেছ?"
-" কিহ্ ! আমি ছোট হওয়ার জন্য প্রমাণ দেখাচ্ছি?"
তাবিয়া এবার ধমকের স্বরে বলল," মা আপনারা থামবেন? আপনারা ভুলে যাচ্ছে কী থেকে কোথায় চলে যান। সম্পূর্ণার বিয়ে দিতে হবে না। ও পড়ালেখা করবে। কলেজে ভর্তি করালেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন সবাইকে দেখবে নতুন নতুন মানুষদের জানবে। দেখবেন হিমেলের মতো ছেলের কথা ও ভুলে যাবে। রেজাল্ট বেরিয়েছে সম্পূর্ণার। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। খবরটা শুনে সাইফুল ইসলাম তাবিয়াকে ডেকে বললেন," সম্পূর্ণাকে নিয়ে তিনি বাজারে যাবেন। ও যে মিষ্টি পছন্দ করবে সেটাই আনা হবে এবং সবাইকে দেওয়াও হবে।
রাস্তা দিয়ে বেরুতেই দেখে হিমেল দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণা যেন এখন আসবে সে আগে থেকেই জানতো। সম্পূর্ণা নিচের দিকে তাকিয়ে বাবার সাথে চলে গেল। তখনই হিমেলের মা অন্য বাড়ি থেকে কাজ করে আসার পথে হিমেলকে দেখে বললেন," শুনেছি পাশের বাড়ির রোকনদের গ্যারেজে নাকি লোক নেয়। সেখানেও তো যেতে পারিস। মাস শেষে কিছু টাকা হয়। অন্তত নিজের হাত খরচ তো চালাতে পারতি।
হিমেল ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল," গ্যারেজের কাজ আমার সহ্য হয় না।"
-" নবাবের পোলা জন্মাইছে। কপালে করে তো নিয়ে আসছ নাই নবাবি।তাহলে নবাবের মতো কথা বলস কেন?"
-" বাদ দাও এখন। কী খাব সেটাই বলো। আমি বাহিরে যাব।"
-" বাটিতে তরকারি আছে, কালকের পান্তাভাত দিয়া খেয়ে যা। আমি তো আর নবাবের বউ না তোরে ভালো ভালো খাওয়াব। নিজে রোজগার করেই ভালো খাইস।"
হিমল কথা না বলে খেতে বসলো৷ হঠাৎ করে বলল," মা সম্পূর্ণারে তোমার কাছে কেমন লাগে?"
-" আমার কাছে কেমন লাগে দিয়ে কী হবে?"
-" আরে বলো না?"
-" বড়লোকদের মাইয়ারা খারাপ হলেও ভালো হয়। তবে সম্পূর্ণা খারাপ না,ভালো৷ শুনছি কার সাথে নাকি লটরপটর চলতেছে। কী জানে বাবা, এখনকার মেয়েদের বুঝা যায় না।"
-" লটরপটর আমার সাথেই চলতেছে।"
-"কী!"
কথাটা বলেই দৌড়ে এসে হিমেলের সাথে বসে, " বলস কী তুই? তুই কী পাগল হয়ে গেছস?"
-" পাগল হবো কেন? আমি ঠিক আছি।" কথাটা বলেই হিমেল পানির গ্লাস নিয়ে এক ঢোক পানি খেলো।
হিমেলের মা হিমেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে," বাবারে তুই আমার একটা মাত্র সন্তান। তুই আগুনে হাত বাড়িয়ে শুধু শুধু হাত পোড়ানোর কী দরকার?"
-" মা চুপ করো তো? মেয়ে যদি ঠিক থাকে আগুন আমায় চুল ছিড়তেও পারবে না।"
-" তুই জেদ দেখাচ্ছিস বাবা। কোথায় ওরা আর কোথায় আমরা। ওদের মেয়ে ওদের মতো থাকুক।আমরা আমাদের মতো।মারামারি করে লাভ কী?
-" মা চিন্তা কর না আমাকে নিয়ে।দেখবে কয়েক মাস পর সম্পূর্ণা নিজে হেঁটে আমাদের বাড়ি আসবে।"
হিমেল খেয়ে উঠে চলে গেল। হিমেলের মা ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস পেলে আঁচলে মুখ মুছলেন।
সম্পূর্ণাকে কলেজে ভর্তি করানো হলো। সাইফুল ইসলাম নিজে দিয়ে আসেন আর নিয়ে আসেন। এই কয়েকমাসে সম্পূর্ণা পাগলের মতো হয়ে গেছে। হিমেলের সাথে দেখা যেন তাকে করতেই হবে। কলেজ থেকে ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া করে এদিকসেদিক কাউকে না দেখে এক দৌড়ে হিমেলদের ঘরে গেল। হিমেলের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সম্পূর্ণা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল," ফুফু হিমেল ভাই আছে?"
হিমেলের মা পাশে খাটের দিকে তাকিয়ে দরজা থেকে সরে গেলেন। সম্পূর্ণা মাথা নিচু করে হিমেলের মায়ের পাশ দিয়ে হিমেলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে, " আপনি আমাকে এখন আর একটা বার দেখতে আসেন না। কলেজে যাওয়ার সময় একটা বার রাস্তায় দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু না আপনি এখন স্বার্থপর হয়ে গেছেন। প্রেম যখন আমি বুঝতাম না। তখন আপনি আমাকে বুঝিয়েছেন। এখন আমি যখন আপনার প্রতি এত দূর্বল তখন আপনি সরে যাচ্ছেন?"
-" হিমেল ভাই আপনি একটা কিছু করেন না। আমি আর ওই ঘরে থাকতে চাই না। আমি আপনার কাছে থাকতে চাই। আমার আপনাকে না দেখলে ভালো লাগে না। সারাক্ষণ হাসফাস লাগে।"
হিমেলের মা এগিয়ে এসে," ওই, তুই কী কস নিজে জানস? আমার পোলার সাথে যা লটরপটর করছ আর করা লাগবে না। বন্ধ কর। তোদের বড়লোকের তো দোষ হবে না।যা হবে আমাদেরই। আল্লাহ যা একটু আশ্রয়ের স্থান মিলিয়েছে সেটাও যাবে। "
হিমেল বিরক্তিকর গলায় বলল," মা, তুমি তোমার কাজে যাও। আমি সম্পূর্ণার সাথে কথা বলতেছি।"
-" হিমেল তুই কেন বুঝছিস না বাবা।"
-" মা যাও তো।"
হিমেলের মা আর কথা বাড়ালেন না। তিনি নিজের কাজে গেলেন।
হিমেল সম্পূর্ণার হাত ধরে বলল," একটু ধৈর্য ধর।আমি একটা কিছু করতে পারলে তোমাকে নিয়ে আসবো। তোমাকে এখন নিয়ে আসলে তো খানাপিনায় কষ্ট করতে হবে।"
-" আমি তাতেও রাজি। আপনি না খেতে পারলে আমি খাব না। আপনার কাছে চাইব না।"
হিমেল ঘরের উপর আর আশেপাশের দিকে তাকিয়ে, " ওত বড় ঘর ছেড়ে পাটকাঠির ঘরে থাকতে পারবা?"
-" তুমি থাকতে পারলে আমি পারবো না কেন? আমি সব পারবো।"
হিমেল ম্লান হেসে," দেখি কী করা যায়। তুমি এখন যাও। এতক্ষণে হয়তো তোমার খোঁজ পড়ে গেছে।"
সম্পূর্ণার মনে হলো হিমেল ঠিকি বলেছে। এখানে এসেছে অনেকক্ষণ। মা হয়তো খোঁজ শুরু করে দিয়েছে।
তাবিয়া ছাদ থেকে এসে," মা ছাদেও তো নেই।"
-" লামিয়াদের ঘরেও তো নাই। আল্লাহ তুমি রহম কর। হিমেলের সাথে পালিয়ে যায়নি তো? বড় বউ একটু ঘাটলায় দেখেছ?
-" মা সবখানেই তো দেখলাম।"
কথাগুলো বলে আতিকা বেগম বলল," ঠিক আছে আমি রাস্তার দিকে এগিয়ে দেখি। " কথাটা বলে বসা থেকে উঠতে যাবে এমন সময় সম্পূর্ণা ঘরের ভিতরে ঢুকলো।"
আতিকা বেগম বললেন," কোথায় গেছিস তুই?"
সম্পূর্ণা আমতা আমতা করে হিমেল ভাইদের ঘরে। "
আতিকা বেগম তেড়ে এসে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে," কেন গেছিস? তোর শরীর বিলাইতে? হিমেলের কাছে শুইয়ে আসলি না-কি?" কথাগুলো বলে টেবিলের উপরে থাকা প্লেট দিয়ে পিঠে কয়েকটা বাড়ি দিয়ে," এত বুঝানোর পর তোর গায়ে লাগে নাই। তাহলে তুই আর মানুষ হবি না। জানোয়ার কোথাকার।এখন মনে হচ্ছে আল্লাহর কাছে একটা মেয়ে চেয়ে আমি পাপ করছি। যদি জানতাম নিজের ইজ্জত তুই মানুষের কাছে বিলিয়ে দিবি তাহলে কখনো চাইতাম না একটা মেয়ে।"
তাবিয়া আতিকা বেগমকে টেনে নিয়ে বসিয়ে, " মা আপনি ঠান্ডা হোন। আমি দেখছি। সম্পূর্ণা ঘরে যাও।"
সাইফুল ইসলাম বাজার থেকে এসে সব শুনে বললেন, " কাল থেকে কলেজে যাওয়া লাগবে না। সব বন্ধ। বাড়িতে থাকুক। আমি ছেলে দেখছি। ভেবেছি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াক। কিন্তু এখন দেখছি তা আর সম্ভব নয়।"
সবাই চুপ করে আছে৷ সম্পূর্ণা কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল। আসার সময় হিমেলের থেকে নাম্বার নিয়ে এসেছে ফোনে কথা বলার জন্য। হাতের তালুতে করে নাম্বারটা এনে ছিল সে। দৌড়ে গিয়ে একটা কাগজে লিখে রাখলো।
মায়ের মার যেন এখন শরীরে লাগে না তার। কতই বা মারবে?একদিন ঠিক চলে যাব। তখন খুঁজে পাবে না আর আমাকে। হিমেলের কাছে গিয়ে আমি ভালো থাকবো।
.
.
.
চলবে.......................................