প্রিয়দের কাল্পনিক সাক্ষাৎ - পর্ব ০৩ - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - ধারাবাহিক গল্প


জুলাই মাস। ক্যালিফোর্নিয়ার সকালটা আজ উষ্ণ, ঝরঝরে। নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ির ব্যালকণিতে এসে পড়ছে জুলাইয়ের মিষ্টি, সোনালি রোদ। বাড়ির পাশে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা পাম গাছ আর রেডউডের মাথায় ঝিলিক দিচ্ছে উচ্ছল, কিশোরী সূর্য। সেই সাথে ঝিলিক দিচ্ছে আয়ানের চঞ্চল মন। অস্থির পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরো ঘর। 

' আপনার কি শরীর খারাপ করেছে? বাবাও জিগ্যেস করলেন। খাবার টেবিলে কেমন অস্থির দেখাচ্ছিল আপনাকে। আজকের টিকেট কী ক্যান্সেল করে দেব?' 

অদিতির চিন্তিত কন্ঠে ফিরে তাকাল আয়ান। খয়েরী রঙের ঢিলেঢালা কুর্তি আর টাউজার পরে দাঁড়িয়ে আছে অদিতি। হাত খোপা করা চুলগুলোর কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়ে আছে কাঁধে। আয়ানের চোখদুটো ঝলমল করে উঠল। দ্রুত পায়ে অদিতির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অদিতিকে কাছে টেনে নিয়ে দাঁত বের করে হাসল। আয়ানের এমন ব্যবহারে সন্দিহান চোখে তাকাল অদিতি। মাথাটা একটু পিছিয়ে নিয়ে ডানহাতটা আয়ানের কপালের উপর রাখল। শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে দ্বিধা নিয়ে বলল,

' পাগলের চিকিৎসা করতে করতে ডাক্তারও পাগল হয়ে যায় এমন কোনো রেকর্ড কী আছে, ডক্টর?' 

' মানে?' 

' আনফরচুনেটলি আমার হাজবেন্ডও পাগলের ডাক্তার। আমি আমার পাগলের ডাক্তার নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তিত।' 

আয়ান চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল। ডানহাতে অদিতির মসৃণ কোমরে শক্ত একটা চিমটি দিয়ে বলল,

' মিস. সরি... মিসেস. ঝগড়ুটে! তুমি দিন দিন হাই লেভেলের ঝগড়ুটে হয়ে যাচ্ছ। আমার এতো সুন্দর রোমান্টিক মুডটাকে তুমি পাগলামির লক্ষণের সাথে তুলনা করে ফেললে?' 

কথাটা বলে সরে দাঁড়াল আয়ান। ডিভানের উপর বসে বেশ আয়েশ করে বলল,

' তবে আমি অবাক হইনি। একটা রোমান্টিক ইনভায়রনমেন্টকে সাঁড়াশি দিয়ে টেনে হিঁচড়ে ঝগড়ার ইনভায়রনমেন্টে পরিণত করায় ঝগড়ুটেদের প্রধান কাজ। আর তুমি তো তাতে মাস্টার।' 

অদিতি কোমরে হাত দিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। আয়ানের চিমটি দেওয়া স্থানে জ্বালাপোড়া করছে। কোমরের পাশটায় হাত বুলাতে বুলাতে আয়ানের মতো মুখভঙ্গি করে বলল,

' আমিও অবাক হইনি। এইযে আপনি বার বার আমাকে ঝগড়ুটে বলে প্রমাণ করতে চাইছেন তাতে বিন্দুমাত্র চমকাইনি আমি। পাগলের ডাক্তারদের কাজই হলো উল্টাপাল্টা যুক্তি দিয়ে ভালো মানুষকে পাগল প্রমাণ করা। আমার মতো সুস্থ,স্বাভাবিক মানুষকে ঝগড়ুটে প্রমাণ করা তো তাদের বাম হাতের কাজ। কি আর করা? পাগলের ডাক্তরকে বিয়ে করলে এতটুকু সহ্য তো করতেই হবে। হাহ্ নিয়তি।' 

আয়ান তেড়ে এসে বলল,

' ওহ হ্যালো! এয়ারপোর্টে এসে আধঘন্টা চিপকে থেকে জোরপূর্বক বিয়ে করেছ আমায়। জোরপূর্বক বাসরও করেছ। এখন পাগলের ডাক্তার বলে আন্দোলন? মেয়েরা এমনই, ধান্দাবাজ।' 

আয়ানের কথার প্রত্যুত্তরে তেড়ে এলো অদিতি। দু'জনের মুখোমুখি সংঘর্ষের আগেই দরজায় কড়া নড়ল। দরজার বাইরে থেকে কেউ একজন সবিস্ময়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, 

' তোমরা কি ঝগড়া করছ নাকি?' 

দুই জোড়া চোখ ঘুরে গিয়ে পড়ল দরজায় দাঁড়ানো মানুষটির ওপর। তারপর পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করল। আয়ান ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে ডিভানে গিয়ে বসল। আমতা আমতা করে বলল,

' নো বাবা। উই আর গুড ফেলো অল দ্যা টাইম। অ্যাম আই রাইট ওয়াইফি?' 

অদিতি বাবার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। সতর্ক কন্ঠে প্রশ্ন করল,

' কোনো দরকার ছিল বাবা?' 

বাবা সন্দিহান চোখে দুজনকে পর্যবেক্ষণ করলেন। মৃদু হেসে বললেন,

' আমি তোমাদের শী অফ করতে যাচ্ছি, এটাই ইনফর্ম করতে এসেছিলাম। হ্যাভ আ গুড ডে গাইস।' 

অদিতি হেসে বলল,

' থেংকিউ বাবা।' 

বাবা দরজা থেকে সরে যেতেই এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়ল আয়ান। খুশিতে বাক বাকুম করতে করতে অদিতির গা ঘেঁষে দাঁড়াল। অদিতিকে আবারও কাছে টেনে নিয়ে বলল,

' এখন বাংলাদেশে বর্ষাকাল তাই না, সুইটহার্ট? ওয়াও! হাও রোমান্টিক ওয়েদার। আই অ্যাম সো এক্সাইটেড ওয়াইফি। এই খুশিতে তোমার ফালতু কটেজ বুক করার অপরাধটা মাফ করে দেওয়া হলো। ঝড়ো হাওয়ায় অন্ধকার ছনের কটেজে তুমি আর আমি। এমনটা ভেবেই কটেজটা বুক করেছ, তাই না বেবি?' 

এটুকু বলে বামচোখ টিপল আয়ান। অদিতি আয়ানের বাম পা'টা মারিয়ে দিয়ে বলল, 

' জি না। কটেজটার ন্যাচেরাল লুকটা দারুণ। আমি কখনও ওমন পরিবেশে থাকিনি। এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে প্লিজ তৈরি হোন। আমাদের এক ঘন্টার মধ্যে বেরুতে হবে।' 

আয়ান বাম পায়ের ব্যথাটা দাঁত চেপে সহ্য করে কুটিল দৃষ্টিতে তাকাল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে নিয়ে বলল,

' ওকে, চলো। দু'জন একসাথে তৈরি হবো।' 

অদিতি চোখ বড় বড় করে সরে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। দৃঢ় আপত্তি জানিয়ে বলল,

' কক্ষনো নয়।' 

অদিতির হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল আয়ান। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

' ইট'স ইউর পানিশমেন্ট ওয়াইফি। লেটস গো জান!' 

______________________ 

আকাশে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। পথ-ঘাট পিচ্ছিল, কাদাটে। সেই পিচ্ছিল রাস্তায় পা টিপেটিপে এগিয়ে যাচ্ছে সুন্দরী, চঞ্চলা একটি মেয়ে। মাথার ওপর কালো ছাতা। গায়ে সাদা-গোলাপী রঙের সালোয়ার কামিজ। পাতলা ঠোঁটদুটো অনবরত নড়ছে। রাস্তার মানুষের বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের মনে কথা বলে বলে এগিয়ে যাচ্ছে সে। রাস্তার কাদা, রাস্তা, আকাশ, বাতাস সবার সাথেই তার কতো কথা! কত ভাব! বড় রাস্তাটা পার হয়ে প্রিয়ন্তীদের বাড়ির গলিটার মোড়ে আসতেই থমকে গেল তার ঠোঁট। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবা পুরুষটির দিকে। কালো একটি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কি আয়েশ করেই না সিগারেট টানছে মানুষটা। বিশাল ম্যাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে ধমক দেওয়ার মুখভঙ্গিও কি দারুন! পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদেরকে ভয়ানক বিদঘুটে পরিস্থিতিতেও সুন্দর দেখায়। আরু মুহূর্তেই রাফিনকে সেই দলে যুক্ত করে নিল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কালো শার্ট পরিহিত চমৎকার সেই মানুষটির দিকে। কিছুক্ষণ চোখ ভরে দেখে নিয়েই দৌঁড়ে রাফিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল আরু। রাফিন নতুন কনস্ট্রাকশনের ম্যাপ দেখছিল। আরুর এমন ছুঁটে আসায় চোখ তুলে তাকাল সে। আরুর ছাতার পানিটুকু ছিঁটকে এসে পড়ল রাফিনের গালে। পানিটুকু এক হাতে মুছে নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল রাফিন। গোছানো, সুন্দর ভ্রু জোড়া বাঁকিয়ে চেয়ে রইল আরুর মুখের ওপর। অবশিষ্ট সিগারেটের ধোঁয়াটুকু আরুর মুখের উপর ছেঁড়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। আরু বার কয়েক খুকখুক করে কেশে নিয়ে নিজের ছাতাটা রাফিনের মাথায় ধরতে ধরতে বলল,

' আরেহ্ মিস্টার ভিলেন! আপনি এখানে একা একা বৃষ্টিতে ভিজছেন? আমাকে বললেই হতো, সঙ্গ দিতাম।'

কথাটা বলে হাসল আরু। পাশ থেকে একজন দরাজ কন্ঠে বলল,

' একা কেন ভিজবে? আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখছ না? মাইয়ার কলিজাটা দেখো! ফুটো এখান থেকে।'

আরু অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। তেড়ে এসে বলল,

' এতো বেশি কথা বলেন কেন? আপনাকে কিছু বলেছি আমি? জানেন না? হাম- তুমের মাঝে থার্ড পার্সোন ঢুকার নিয়ম নেই।' 

আরুর তেজে ছেলেটির চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগার। তবে, রাফিনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পকেট থেকে ছোট্ট একটা চাকু বের করল। চাকুটা উল্টেপাল্টে দেখে ঘাড়টা হালকা কাত করে আরুর দিকে তাকাল। আরুর মুখে তখনও ঝলমলে হাসি। রাফিন হঠাৎ-ই আরুকে নিশানা করে ছুঁড়ে মারল সেই চাকু। চাকুটি আরুর মাথার কাছটা ছুঁই ছুঁই করে গিয়ে বিঁধল সামনের দেয়ালে। আরু চোখ বড় বড় করে একবার রাফিন তো একবার দেয়ালের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে ভয়ের বদলে খুশিতে লাফিয়ে উঠল সে। শিষ বাজিয়ে বলল,

' ওয়াও! ওয়াও! দারুণ ছিল।' 

আরুর আনন্দে বিরক্তি ফুটে উঠল রাফিনের চোখে। আরুর দিকে চেয়ে শীতল কন্ঠে বলল, 

' পরের বার নিশানাটা তোমার চোখ বরাবর হবে। সো, স্টে এওয়ে ফ্রম মি।' 

কথাটা বলেই গাড়িতে উঠে গেল রাফিন। সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে থেকে ফিসফিসানি ভেসে এলো বাতাসে,

' এতোদিন গুন্ডাদের মাইয়াগো ডিস্টার্ব করতে দেখছি। আইজ প্রথম কোনো মাইয়াকে দেখলাম স্বয়ং গ্যাংস্টাররেই ডিস্টার্ব করতাছে। কলিযুগ। ঘোর কলিযুগ ভাই।' 

আরু আগের জায়গাতেই হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাসি দেখেই বুঝা যাচ্ছে, রাফিনের চোখ রাঙানো, রাগ কোনো কিছুই পাত্তা পায়নি তার চোখে, মুখে এবং ছোট্ট মনে।

___________________

শ্রীমঙ্গলের একটি নান্দনিক কটেজ সপ্তাহ দুইয়ের জন্য ভাড়া নিয়েছে শুভ্ররা। কটেজের বেশির ভাগ ঘরগুলোই খড় আর বাঁশের তৈরি। মনোরম, শান্ত পরিবেশ। সেই শান্ত পরিবেশ ঝাঁপিয়েই ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আজ। খড়ের চাল নিগড়ে জল পড়ছে উঠোনে। পাহাড়ি মাটি আর খড়ের রঙের মিশ্রণে অদ্ভুত এক রঙ তৈরি হচ্ছে পানিতে। কটেজের ছোট্ট বারান্দায় পাতা কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে রোদ। চোখদুটো বৃষ্টির পানিতে স্থির। মন মেজাজ ভালো নেই তার। ভীষণ অভিমানে বুক ভার হয়ে আছে। রোদের এই তীব্র অভিমানের মাঝেই শুভ্র এসে বসল পাশে। বার দুই কটেজের দরজার দিকে উঁকি দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

' এখানে বসে আছো কেন? ইশ! ভিজে যাচ্ছ তো। চলো ঘরে চলো। শুভ্রা ঘরে একা আছে।' 

রোদ নড়ল না। অনড় বসে থেকে চোখদুটো নিবদ্ধ রাখল আবছা হয়ে আসা পাহাড়ী বৃষ্টিতে। শুভ্রর দিকে তাকাল না। শুভ্র অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,

' কি হলো? উঠো। সারা শরীর ভিজিয়ে ফেলেছ প্রায়। ঠান্ডা লেগে যাবে। তোমার মেয়ের বয়স এখন আড়াই বছর রোদপাখি। গ্রো আপ নাও। এসব বাচ্চামো কবে যাবে?' 

রোদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। মুহূর্তেই টলমল করে উঠল তার চোখ। তেজ নিয়ে বলল,

' কখনোই যাবে না। তাই আমিই চলে যাবো। আপনি আমায় একটা টিকেট করে দিতে পারবেন? না, থাক। লাগবে না। আই ক্যান ম্যানেজ। আমি এক্ষুনি ঢাকা ফিরব। অবশ্যই আমার বাবার কাছে।' 

রোদের চোখে জল দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল শুভ্র। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল। উৎকন্ঠা নিয়ে বলল,

' তুমি কাঁদছ! কাঁদছ কেন? কেউ কিছু বলেছে?' 

রোদের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। শুভ্র তার অভিমান বুঝতে পারছে না। কিন্তু আগে পারত! তাহলে এখন কেন পারছে না? চিত্রা ঠিক বলে। পুরুষ মানুষের ঠিক নেই। ধীরে ধীরে ভালোবাসা কমবে তারপর বদলাবে ভালোবাসার ঠিকানা। রোদ ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে অন্যদিকে ফিরে বসে রইল। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে টপাটপ। শুভ্রর ধৈর্য্যর বাঁধ ভাঙলো এবার। ধমকে উঠে বলল,

' অযথা কাঁদছ কেন? সমস্যাটা কি? মেজাজ খারাপ করাবে না। কান্না থামাও।' 

শুভ্রর ধমকে চমকে উঠল রোদ। তার এখন আরও বেশি কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তাকে বুঝার চেষ্টা না করে উল্টো ধমকাচ্ছে। শুভ্র পাল্টে গিয়েছে। রোদ শুভ্রর দিকে না তাকিয়েই উঠে রুমে ঢুকে গেল। চুপচাপ জামাটা চেঞ্জ করে বিছানার এক কোণায় গিয়ে বসল। রাত থেকে পেট ব্যথা করছে তার। ব্যথার মাত্রা সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে। রোদ চোখ তুলে চারপাশে তাকাল। রুমটা আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে। বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে আছে তাদের ঘুমন্ত কন্যা। বিছানা হাতড়ে ফোনটা খুঁজে নিয়ে বার কয়েক ভাইকে ফোন লাগাল সে। ফোন রিসিভ না হওয়ায় মেয়ের একপাশে গা এলিয়ে দিল। প্রচন্ড কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল শরীর। দরজায় দাঁড়িয়ে তার সবটাই পর্যবেক্ষণ করছে শুভ্র। রোদকে এভাবে কাঁদতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ছে মস্তিষ্ক। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর একটা দিনের জন্যও তো এভাবে কাঁদেনি তার রোদপাখি। তবে আজ কেন? কিছুক্ষণের মাঝেই ফোন বাজল। রোদ রুদ্ধ কন্ঠে ভাইকে জানাল, তার ঢাকাগামী বাস অথবা ট্রেনের টিকেট চায় এবং তা কালকের মাঝেই। রাহাত বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, 

' তুই কাঁদছিস? শুভ্র কোথায়?' 

রোদ জোর দিয়ে বলল,

' আমি কাঁদছি না। তুই আমাকে ট্রেনের টিকেট করে দিবি কি-না বল।' 

' কালই গেলি আর আজই ফিরতে চাইছিস। কি হয়েছে বোন? আমায় বল। শুভ্র কিছু বলেছে?' 

রোদ রুদ্ধ কন্ঠে তেজ নিয়ে বলল,

' এতো জবাবদিহি চাইছিস কেন ভাইয়া? বিয়ে হয়ে গিয়েছে এইজন্য? এখন বাবার কাছে যাওয়ার জন্যও স্ট্যাম্প নিয়ে যেতে হবে? অনেক ধন্যবাদ ভাই। যাব না তোর বাড়ি। লাগবে না তোর টিকিট। ভালো থাক।' 

কথাটা বলেই ফোন কাটল রোদ। ভীষণ অভিমানে চোখ বেয়ে নামতে লাগল জল। কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল ছোট্ট শরীর। রাহাত একের পর এক ফোন দেওয়ায় ফোনটা বন্ধ করে ছুঁড়ে মারল দূরে। পেট ব্যথা করছে করুক। পারলে মরে যাক। কাউকে বলবে না সে। মরে গিয়ে শুভ্রকে আরেকটা বিয়ে করার সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে। শুভ্র এবার ধীর পায়ে এগিয়ে এলো কাছে। মেয়েকে একপাশে শুইয়ে দিয়ে রোদের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। মাথায় হাত বুলিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

' আমি সরি। শুভ্র তার রোদপাখিকে ননস্টপ সরি বলছে। সব দোষ শুভ্রর। একটু বলো কি করেছি আমি? সব ঠিক করে দেব আমি। এভাবে কেঁদো না। আমার ভয় করছে। তুমি জানো, আমি তোমার কান্না সহ্য করতে পারি না৷ আমার দোষ থাকলে বকো আমায়। মারো। তুমি আমার সাথে কথা বলছ না কেন?' 

রোদ উত্তর দিল না। শুভ্রর হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল। ব্যথাটা কি আগের রোগের সিনড্রোম বহন করছে? সে কি মারা যাচ্ছে? রোদ ধীরে সুস্থে বিছানা থেকে নামল। লাগেজটা টেনে নিয়ে গুছাতে বসতেই উঠে বসল শুভ্র। রোদের হঠাৎ এমন ব্যবহারে মনটা কু ডাকছে তার। রোদ চলে যেতে চাইছে মানে কি? রোদ কি কোনভাবে ওর থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে? রোদ চলে গেলে তার কি হবে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই যেন পাগল হয়ে গেল শুভ্র। দ্রুত পায়ে রোদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লাগেজটাকে লাথি দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। রাগ, ভয় আর দুশ্চিন্তায় রোদকে শক্ত করে চেপে ধরল। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,

' কি সমস্যা তোমার? কখন থেকে একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করছি। কানে যাচ্ছে না? সবসময় এমন বাচ্চামো ভালো লাগে না রোদ। মেয়ের সামনে চড় না খেতে চাইলে চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও। মাঝ দুপুরে এতো জ্বালা সহ্য হয় না।' 

শুভ্রর ঝাঁকুনিতে মাথাটা ঝিমঝিম করছিল রোদের। শুভ্রর কথাগুলো শুনে টলমলে চোখ তুলে তাকাল সে। একদম অন্যরকম কন্ঠে বলল,

' আমি আপনাকে অনেক জ্বালাই না?' 

রোদের কথাটা যেন বুকে গিয়ে লাগল শুভ্রর। বুকে চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। হঠাৎই রোদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শুভ্র। প্রিয়তমাকে নিজের বাহুডোরে পিষে ফেলার চেষ্টা করে ভারি কাতর স্বরে বলল,

' তোমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি রোদপাখি। তুমি কাঁদলে নিজেকে আমার পাগল পাগল মনে হয়। তাই বকে দিয়েছি। আমি সরি।' 

' আপনার একটা ম্যাচিউর বউ দরকার ছিলো।' 

' প্লিজ রোদপাখি। সরি। আমাদের আশেপাশের প্রত্যেকেই জানে। ইভেন তুমি নিজেও জানো, তুমি ছাড়া শুভ্র অচল। আমার বাচ্চা আর আমার জন্য তোমার থেকে পার্ফেক্ট কেউ হতে পারত না। আমার দোয়ায় সবসময় তোমাকেই চেয়ে এসেছি। এখনও চাই। ভবিষ্যতেও চাইব। এসব ফালতু চিন্তা কোথা থেকে আসে তোমার মাথায়?' 

রোদ দুর্বল হাতজোড়া শুভ্রর পিঠের উপর রাখল। কেঁদেকেটে ফুলিয়ে ফেলে চোখদুটো পিটপিট করে তাকাল। চোখের পাঁপড়িগুলো ভিজে ল্যাপ্টে আছে। টুলটুলে মুখটা ভীষণ আদুরে আর স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সেই মায়াভরা মুখটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কপালে গাঢ় চুমু খেল শুভ্র। বুকের ভেতর উথলে উঠা আবেগ নিয়ে প্রিয়তমার মাথাটা চেপে ধরল বুকে। সাথে সাথেই বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। রোদের চুলের ভাজে আরও একটা উত্তপ্ত চুমু দিয়ে নরম কন্ঠে প্রশ্ন করল শুভ্র, 

' এখন বলো, কি করেছি আমি? কাঁদছিলে কেন?' 

রোদ হাতের বাঁধনটা আরও একটু জোড়াল করে মৃদু কন্ঠে বলল,

' আমি কোনোভাবে মারা গেলে খবরদার দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না। আমার ঘরে নতুন বউ নিয়ে ঘুমাবেন। ভালোবাসবেন। হাসবেন। তা আমি সহ্য করব না। ভূত হয়ে এসে খুন করব আপনাকে। আর আপনার নতুন বউকে তো একদম টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলব। মাইন্ড ইট।' 

শুভ্র ভাবনাতীত বিস্ময় নিয়ে বলল,

' কি বলছ এসব?' 

রোদ জবাব দিল না। একহাতে নিজের চুলগুলো টেনে ধরে চোখ-মুখ কুঁচকাল। প্রচন্ড ব্যথায় যেন মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। শুভ্রর বুকে মাথাটা চেপে ধরে বিরবির করে বলল,

' খবরদার দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না।'  

এটুকু বলেই নিথর হয়ে গেল রোদের শরীর। চুল খামচে ধরা হাতটা গড়িয়ে পড়ল শুভ্রর বুকে। রোদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজের বুকের দিকে তাকাল শুভ্র। রোদের শুকিয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখটা টেনে তুলে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু কন্ঠে ডাকল,

' রোদ? এই রোদ? তোমার মুখটা এতো শুকনো কেন লাগছে? তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? রোদু?' 

রোদের সাড়া পাওয়া গেল না। শুভ্রর গলা শুকিয়ে এলো। রোদের গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে তাকে জাগানোর চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হলো না। শুভ্রর চিন্তা গুলিয়ে যাচ্ছে। কি হলো, কি হচ্ছে কিচ্ছু তার বোধগম্য হচ্ছে না। রোদকে নিজের সাথে চেপে ধরেই সাহেলকে ফোন লাগাল। প্রথমবারেরই ফোন রিসিভ হলো। ফোনের ওপাশে সাহেল সাড়া দিতেই শুভ্র খেয়াল করল সে কথা বলতে পারছে না। সব কথায় গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে। উচ্চারণ করা যাচ্ছে না। শুভ্র বার দুয়েক শ্বাস টেনে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল তার শরীর কাঁপছে। 

' হ্যালো? হ্যালো? এই শুভ্র? কথা বলছিস না কেন?' 

সাহেলের প্রশ্নের উত্তরে খসখসে কন্ঠে জবাব দিল শুভ্র, 

' রোদ সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। ওর সারা শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। একটা ডাক্তারের ব্যবস্থা কর দ্রুত। এখানে ডাক্তার পাওয়া যাবে?' 

সাহেল চমকে উঠে বলল,

' রোদ সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে মানে কি? কি হয়েছে ওর? তোর বউ সেন্সলেস হয়ে গেছে আর তুই এতো স্বাভাবিক কি করে? তোর কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, হাত থেকে জুসের বোতল পড়ে গিয়েছে। বেয়ারা ডেকে সেটা পরিষ্কার করে দিতে বলছিস।' 

শুভ্র একবার রোদের মুখের দিকে তাকাল। মেয়েটির চোখ-মুখ এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? শুভ্র আগে কেন খেয়াল করেনি? কখন থেকে সাফার করছে মেয়েটা? শুভ্র এতোটা কেয়ারলেস কি করে হলো? কথাগুলো ভেবেই নিজেকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র রোদের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে কথা বলার চেষ্টা করল। শুকনো কন্ঠে বার দুয়েক ঢোক গিলে নিয়ে বলল,

' বাজে কথা বাদ দিয়ে ডাক্তারের ব্যবস্থা কর।' 

সাহেল হতভম্ব হয়ে বসে রইল। রোদ সত্যিই অসুস্থ কিনা বুঝতে পারছে না। রোদ অসুস্থ হলে শুভ্রর এতো শান্ত হয়ে বসে থাকার তো কথা না। 

কটেজের নিজস্ব রেস্টুরেন্টে বসে আছে শুভ্রতা। ছোট্ট গালদুটো ফুলে আছে অভিমানে। বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। তার পাশের চেয়ারগুলোতেই বসে আছে আদ্র-রৌদ্র, অভ্র- রুহি, নাবিলা-সাদাফ। বাকিরা খেতে আসেনি। রোদকে নিয়ে শহরে যেতে হয়েছে। আদ্র নিজের প্লেটের লেগ পিসটা শুভ্রতার প্লেটে তুলে দিয়ে বলল,

' তোকে আমার চিকেনটাও দিয়ে দিয়েছি। জলদি খা। না খেলে পেট ব্যথা করে।' 

আদ্রর দেখাদেখি রৌদ্রও নিজের পাতের মাংসটা তুলে দিল শুভ্রতার প্লেটে। শুভ্রতাকে বুঝানোর ভঙ্গিমা করে বলল,

' মামণি এসে যদি দেখে তুই খাসনি। তাহলে মামণি অনেক রাগ করবে। তোর সাথে কথায় বলবে না আর। তাই না আম্মু?' 

রুহি রৌদ্রর কপালে চুমু দিয়ে মাথা নাড়ল। ছেলেদুটো দুষ্ট হলেও পরিস্থিতি খুব বুঝে। বোনের প্রতি তাদের কি টান! শুভ্রতার বড় বড় চোখদুটো টলমল করে উঠল। ছোট্ট, পাতলা ঠোঁটদুটো উল্টে দিয়ে বলল,

' আম্মু যাব।' 

নাবিলা শুভ্রতাকে কোলে তুলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আদর করল। অনেক খেলনা কিনে দেওয়ার লোভও দেখাল। রূপকথার গল্প শোনাল। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে শুভ্রতা। চোখ থেকে টপাটপ জল গড়াচ্ছে। অভ্র বাধ্য হয়েই শুভ্রকে ফোন লাগাল। শুভ্র ফোন ধরতেই বলল,

' কি অবস্থা? কখন ফিরবি? প্রিন্সেস আমাদের কান্নাকাটি করে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। কিছুই মুখে দিচ্ছে না। এতো জেদ।' 

শুভ্র ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

' মেয়েকে দাও ফোনটা।' 

অভ্র ফোনটা লাউডে দিয়ে বলল,

' মামনি? বাবা কথা বলে। বাবার সাথে কথা বলো।' 

শুভ্রতা টলমলে চোখে ফোনের দিকে তাকাল। ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলল। শুভ্র ব্যস্ত হয়ে বলল,

' আম্মু? কাঁদে না মা। লক্ষ্মী মেয়েদের কাঁদতে হয় না সোনা। আমার আম্মুটা তো লক্ষ্মী বাচ্চা তাই না? বাবা তোমায় অনেক আদর দেয়। বাবার কথা শুনো সোনা।' 

' আম্মু যাব।' 

মেয়ের কান্না আর হেঁচকির শব্দে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে শুভ্রর। শুভ্র আদুরে কন্ঠে বলল,

' অবশ্যই আম্মু যাবে। আম্মু আর বাবা তোমার জন্য অনেক অনেক মজা কিনছে। অনেক খেলনা কিনছে। তোমার খেলনা চাই না?' 

' আম্মু যাব। আম্মু কোতায়?' 

' আম্মু আছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রিন্সেসের আম্মু বৃষ্টিতে ভিজলে আম্মুর অসুখ করবে তো সোনা। বৃষ্টিটা কমলেই চলে আসবে আম্মু।' 

শুভ্রতা ডানহাতে চোখ মুছে মায়ের মতোই নাক টেনে অভিমানী কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে, 

' ছত্তি?' 

শুভ্র মৃদু হাসে। 

' একদম সত্যি। বাবা মিথ্যা বলে না। তুমি এখন মামনি আর ভাইয়াদের সাথে খেয়ে নাও। বাবা আম্মুকে নিয়ে জলদি চলে আসবে।'

শুভ্রতা জেদ ধরা কন্ঠে বলল,

' আম্মু সাতে খাব।' 

শুভ্র হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই। মেয়ে হয়েছে তার মায়ের মতো জেদী। যা মনে হবে তাই করবে। মায়ের মতো যুক্তিহীন জেদ নিয়ে বসে থাকবে। শুভ্রর অগোচরে মায়ের থেকে দুই-চারটা চড় থাপ্পড় খেয়েও মায়ের জন্যই পাগল থাকবে। মেয়েকে বলেই বা কি লাভ? মেয়ে তো তারই। সেও ওই এক ক্যাটাগরিরই মানুষ। সেও রোদ ছাড়া কিছু বুঝে না। তার মেয়েও রোদ ছাড়া কিছু বুঝবে না, এটাই স্বাভাবিক। শুভ্র ফোন কাটতেই পাশের টেবিল থেকে উঠে এলো মিষ্টি একটি মেয়ে। উজ্জ্বল শ্যামা মেয়েটির মাথায় বিশাল লম্বা চুল। হাসিটা ঝরঝরে, মায়াবী। মেয়েটি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিঃসংকোচে বলল,

' হ্যালো বেবি? তোমার সাথে কালই আমার দেখা হয়েছিল, মনে আছে?' 

শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে মেয়েটির চুলের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করা হয়েছে বুঝতে পেরে চুল থেকে চোখ সরিয়ে মুখের দিকে তাকাল। 

' তুমি আন্তি।' 

মেয়েটি হেসে ফেলল। রুহি-অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,

' আমি রাদিয়ানা আহমেদ রোজা। কাল শুভ্র স্যার আর রোদেলা ম্যামের সাথে দেখা হয়েছিল আমাদের। আমরা ওই পাশের টেবিলেই ডিনার করছি। আপনারা অনুমতি দিলে শুভ্রতাকে আমাদের টেবিলে নিয়ে যেতে পারি? অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে দেখছি, নিজেরই খারাপ লাগছে। বাচ্চারা আমায় খুব পছন্দ করে। আই থিংক, আমি ওকে খাওয়াতে পারব। মে আই?' 

রুহি হেসে বলল,

' চেষ্টা করে দেখতে পারেন।' 

আদ্র-রৌদ্র বাঁকা চোখে তাকাল। তাদের বোনকে অন্যকেউ নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। কিন্তু মায়ের ভয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না। শুভ্রতা বাধ্য মেয়ের মতোই রোজার কোলে চড়ে বসল। রোজার লম্বা লম্বা চুলগুলো বিস্ময় নিয়ে দেখতে লাগল। আঙ্গুলে পেঁচাতে লাগল। মন খারাপ, কান্না সব উবে গেল। মৃন্ময় মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছিল। রোজা শুভ্রতাকে নিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই চোখ তুলে তাকাল সে। স্বভাবসুলভ হেসে বলল,

' হ্যালো!' 

শুভ্রতা উত্তর দিল না। চুপচাপ মৃন্ময়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। রোজা আদুরে কন্ঠে বলল,

' হিরো সাহেবকে হাই বলো। তুমি জানো? এই হিরো দুষ্টুদের ডিসুম ডিসুম মারে। হিরোর অনেক শক্তি।' 

শুভ্রতা চোখ ফিরিয়ে রোজার দিকে তাকাল। মৃন্ময়কে আড়চোখে দেখে নিয়ে চোখ-মুখ নেড়ে বলল,

' আমাল বাবা ছুপাল হিলো।' 

রোজা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

' তোমার বাবা সুপার হিরো?' 

শুভ্রতা গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। রোজার চুলে হাত পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,

' আম্মু বলেচে।' 

শুভ্রতার কথায় হেসে ফেলল মৃন্ময়। শুভ্রতা নিজের মতো বলল,

' আমাল বাবা আমায় কোলে উথায়। আম্মুকেও কোলে উথায়। বাবাল অনেক ছক্তি। সবাল থেকে বেছি ছক্তি।' 

মৃন্ময় হাসি হাসি মুখে আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিল। বাচ্চাটির আধো আধো কথা শুনতে ভালো লাগছে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকা কেশবতী কন্যাটিকে আরও বেশি ভালো লাগছে। তীর্থ এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবার কুটিল দৃষ্টিতে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

' তোমার আম্মুকে তো আমিও উঠাতে পারব পিচ্চু। তার জন্য তোমার বাবার মতো অতো ফিট হওয়া লাগে নাকি?' 

কথাটা বলে খানিকটা ঝুঁকে এলো তীর্থ। কন্ঠটা খাঁদে এনে বলল, 

' তোমার আম্মু কিন্তু হেব্বি দেখতে পিচ্চু। আজ থেকে তোমার আব্বুকে বাদ দিয়ে আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আমাকে বাবা ডাকলে তোমায় অনেকগুলো চকলেট কিনে দেব। দরকার পড়লে, চকলেটের দোকান কিনে দেব। বুঝেছ?' 

তীর্থর কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল রোজা। শুভ্রতা কিছু বুঝতে না পেরে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। বড় বড় চোখ মেলে দুই একবার তীর্থ-রোজাকে দেখে নিয়ে রোজার চুলের দিকে মনোযোগী হলো। মৃন্ময় অতি সন্তপর্ণে রোজার হাস্যোজ্জল মুখটির দিকে তাকাল। তার হঠাৎ করেই মনে হলো, এই মেয়েটি পৃথিবীর সব থেকে সুখী মেয়ে। এই মেয়ের থেকে সুখী এই দুনিয়াতে দ্বিতীয় কেউ হতে পারে না। এমন করে প্রাণখোলা হাসি হাসা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp