রংধনু - পর্ব ৭১ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


আজকের দিন টা  কপোত কপোতিদের জন্য বিশেষ একটি দিনের মধ্যে একটি।ফেব্রুয়ারি মাসের চৌদ্দ তারিখ আজ।এ দিনটি আসলেই রাস্তা ঘাট,চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আর ধানমন্ডি লেকে বহু সংখ্যক জোড়াদের দেখা যায়।তারা একে অপরের সাথে বিভিন্ন প্রেমালাপে ব্যাস্ত থাকে।এমনকি ছেলেগুলো তাদের প্রেমিকাদের নানান পোজে ছবি তুলে দেয়।আর মেয়েগুলো আকর্ষনীয় সাজে নিজেদের সাজিয়ে তোলে।লাল টুকটুকে বৌ হয়ে ছেলে গুলোর হাতের ভিতর হাত ঢুকিয়ে ঘুরতে থাকে মেয়ে গুলো।লেকের এককোনায় ঘরের মতো করে দেয়া আছে।অপরপাশে ছেলে মেয়েরা ব্যাডমিন্টন কিং, ক্রিকেট খেলছে।আর মাঝে রাস্তা।সেগুলো দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নানানরকমের পথচারীরা। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কুঞ্জন।পাশের ওর আরো কয়েকজন বন্ধু ও আছে।আজকাল ইরাজদের সাথে তেমন একটা কথা বলেনা ও।ভালো লাগে না ওদের সাথে থাকতে।কুঞ্জন কে এমন দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখে সামনের বেঞ্চিতে বসে থাকা শাকিব নিজের হাতের গিটারের নিচের চিকন অংশ দিয়ে ওর পায়ে গুতো দিয়ে বলল,
''কিরে মামু প্রেম করবি নাকি?"
জবাবে শাকিবের দিকে তাকায় কুঞ্জন।মৃদু হেসে বলল,
''নারে মামা।লাগবোনা আমার।আমি এমনিতেই আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি।"
পাশ থেকে জুবায়ের বলল,
''আরে মামা বড় জ্বলে বুক।এদের প্রেম দেখলে ইচ্ছা করে গার্ডিয়ানগোরে বিচার দেই।"
তন্ময়  তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
''কেন তুই প্রেম করতে পারোছনা বইলা?আরে মিঞা হুন প্রেম করতে ও যোগ্যতা লাগে যেটা তোর একটু ও নাই।"
জুবায়ের দাঁত কেলিয়ে হাসলো সাথে ওর দামড়া মার্ক শরীরটা ও কেঁপে উঠে।হাসতে হাসতে বলল,
''শালা একটা গার্লফ্রেন্ড ও ধইরা রাখবার পারোস নাই।আবার আমারে কস।আমি আর কুঞ্জন পিওর চিঙ্গেল বুঝলি?"
কুঞ্জন শব্দহীন ভাবে হাসলো।পাশে মৃদুল গিটারের তার ঠিক করছে।আসার সময় দুটো তার খুলে গেছিলো।সেগুলো লাগাচ্ছে ও।ওদের সামনে দিয়ে একজোড়া কপোত কপোতি যাচ্ছিলো।মেয়েটা লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ী পরেছে আর ছেলেটা হলুদ পাঞ্জাবি। জুবায়ের হঠাৎ সবাইকে বলল,
''ঐ মামু দেখ ঐ দুইডা কাপল কি কিউট!!!!"
শাকিব বিস্ময় নিয়ে বলল,
''কি করবি তুই?"
জুবায়ের হেসে বলল,
''দেখনা কি করি।"
বলেই গলা পরিষ্কার করে জুবায়ের চিৎকার করে বলল,
''ঐ আপপু.......... আগের ভাইয়াটা আরো জোস ছিলো।"
কথাটা শুনেই অনেকেই ওদের দিকে তাকায়।ছেলেটা রেগে মেয়েটাকে কি যেন বলতে লাগলো।এসব দেখে কুঞ্জন হেসে বলছিলো,
''মামু তুই বহুৎ খারাপ।"
মৃদুল হঠাৎ বলল,
''এগুলো ঠিক না জুব্বা।কি করলি?কেমন ঝগড়া করছে ওরা।"
জুবায়ের বলল,
''আরে জেন্টলম্যান আইজ যদি নাসরীন এইহানে থাকতো তোমার আসল রুপ দেখতো সবাই চুপ থাকো।"
শাকিব বিরক্ত হয়ে বলল,
''কুঞ্জন গানধর হালা।"
মৃদুল সাথে সাথে গিটারে সুর তুলতে লাগলো।সবাই মিলো গান ধরে,
পরীর মুখে মিষ্টি হাসি
দেখতে চমৎকার।
এক নিমেষেই কাইড়া নিলো,
মনটা যে আমার।
তার গালেতে আছে হায়রে
ছোট্ট একটা তিল।
পলক পড়ার আগেই
বুকে মারলো প্রেমের ঢিল।
নাইরে নাইরে নাইরে
আমার বাঁচার উপায় নাই।
চাইরে চাইরে চাইরে
আমি পরীডারে চাই।
মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি
পরী আমার পাশে।
মনটা আমার চায়রে শুধু
পেতে তারে কাছে..................অনেকেই দূর থেকে কিংবা কাছ থেকে দাঁড়িয়ে গান শুনতে লাগে ওদের।ছেলেগুলো বেশ গাইছে বলে উঠে অনেকেই।গানের মাঝেই ইরাজ আর একটি মেয়েকে আসতে দেখে কুঞ্জন।মেয়েটা লাল শাড়ী পরেছে আর ইরাজ আর লাল পাঞ্জাবি। ইরাজ মেয়েটির হাত ধরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।মেয়েটার হাত ইরাজের হাতের মাঝে কিছুটা ছটফট করছে।যেন ছাড়াতে চাইছে।মেয়েটার চেহারায় কিছুটা বিরক্তির ভাব ফুঁটে উঠেছে।যেন জোর করে হাসছে ও।ইরাজ মেয়েটিকে কুঞ্জনদের কাছে নিয়ে এলো।সবাই ইরাজকে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলে ও সেটা প্রকাশ করেনি।শাকিব বলল,
''কিরে জিএফ নাকি তোর?"
ইরাজ বলল,
''হ মামু তোগো ভাবি।ওর নাম কবিতা।"
কুঞ্জন এখনো মেয়েটাকে দেখেনি।কিছুক্ষন পর ইরাজ বলল,
''আরে কুঞ্জন।তুই কল ধরিস না কেন?"
বলেই ইরাজ কুঞ্জনের কাছে এগিয়ে আসে।কুঞ্জন কিছু বলছিলোনা।ইরাজ দুগাল হাত দিয়ে চেঁপে বলল,
''কিরে চিনোস না?নাকি না চেনা ভান ধরিস?"
কুঞ্জন ওর গাল থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলছিলো,
''আমার ভালো লাগেনা। "
বলেই ইরাজের পিছে তাকাতেই কবিতাকে দেখতে পায় কুঞ্জন। মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই কুঞ্জনের যেন চারিদিক স্তব্ধ হয়ে গেলো।মেয়েটা ভীষন সুন্দরী।একদমই সাজ নেই মুখ।চোখে মুখে একদমই বিরক্তির ছাপ।মেয়েটাও কুঞ্জনের দিকে তাকায়।এরপর কিছুক্ষন চোখাচোখি হয়।হঠাৎ ইরাজ সরে এসে বলল,
''কবিতা ও কুঞ্জন।আমাদের সাথে সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলো।বেচারা নিজের বড় ভাইয়ের জন্য বাঁচলো।কুঞ্জন কিছুটা বিরক্ত হলো।ইরাজ ওদের মাঝে বসলো মেয়েটাকে নিয়ে।মেয়েটা কিছুটা দূরত্ব রেখে বসেছে ইরাজ থেকে।ইরাজ ওর হাত টেনে কাছে এনে বলল,
''কি বেবি এতো দূরে কেন বসলে?"
কবিতা নরম সুরে বলল,
''প্লিজ ইরাজ এমন করবেননা।"
মেয়েটাকে বেশ ছোট মনে হলো ওদের।ইরাজ বলল,
''কবিতা আমার হবু বৌ বুঝলি মামুরা?ও আমাদের কলেজে টেনে ভর্তি হলো।আমাদের ইন্টারের পর ওর সাথে বিয়ে।"
ইরাজের কথায় কুঞ্জন মেয়েটার দিকে তারপর ইরাজের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।ইরাজের কথা তন্ময় বলল,
''বাহ মামু সংসারী হয়ে যাবি।"
''হ মামু।"
বলেই হাসলো ইরাজ।কুঞ্জন বারবার না চাইতেও কবিতাকে দেখছে।যতোবারই কুঞ্জন কবিতাকে দেখেছে ততোবারই খেয়াল করলো কবিতা ওকে দেখছে।ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে কুঞ্জনের।ঘন্টাখানেক সেখানে কাঁটায় ওরা।ওদের সামনেই ইরাজ মেয়েটাকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছিলো।কবিতা ওকে সরিয়ে দিচ্ছিলো বারবার।ইরাজকে থামাতে মৃদুল বলল,
''ইরাজ যা করার ঘরে কর।পাবলিক প্লেসে না...........বাজে দেখায় ব্যাপারটা।"
ইরাজ তারপরও মেয়েটার সাথে হাতাহাতি করছিলো।শাকিব একপর্যায়ে বলে বসেছিলো,
''কিরে কবিতা ভাবি কি তোরে ভালবাসেনা?"
জবাবে বেশ রেগে যায় ইরাজ।মারতে যায় শাকিবকে।বলছিলো,
''ভালবাসবেনা কেন?অবশ্যই বাসে।কেন তোমার কি সহ্য হইতাছেনা।"
কবিতা যেন অনেকটা ভয় পেয়ে যায়।তন্ময় আর মৃদুল উঠে ওদের থামাতে থাকে।কুঞ্জন তখন আবার ও কবিতার দিকে তাকায়।একপর্যায়ে ইরাজ সবার সামনে কবিতারে গাল চড় লাগিয়ে বলল,
''বাসাত আয়া নে। দেখিস কি করি।"
বলেই মেয়েটাকে ফেলে চলে গেলো।কবিতা কাঁদতে লাগলো।শাকিব মৃদুল সহ বাকিরা অবাক হয়ে গেলো ইরাজের কাজে।ছেলেটা নাকি ওকে ভালবাসে।তাহলে এই কাজটা কেন করলো?শাকিব টিসু এগিয়ে দিলো কবিতার দিকে।বলল,
''কান্না থামান আপু।"
কবিতা মাথা নিচু করে চোখ মুছে নেয়।মৃদুল বলল,
''তোমার বাসা আর ইরাজদের বাসা কি একজায়গায়?"
মেয়েটা বলল,
''ওনার বাসায় যেতে পাঁচমিনিট লাগে আমাদের বাসা থেকে।"
শাকিব বলল,
''তুমি ছোট।সো তুমিই বললাম।বাসা কই?"
''ফার্মগেট।"
তন্ময় বলল,
''কুঞ্জন তোর বাসার কাছে তো।দিয়ে আসিস।"
জবাবে কুঞ্জন আড়চোখে কবিতার দিকে তাকায়।তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
....................এদিকে সাঁঝ অফিসের জন্য রওনা হয়েছে।আজ বাস না সিএনজিতে যাবে ও।ভেবেই সিএনজি নিয়ে রওনা হয় ও।সিএনজি চলছে।ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। সেখানে সাইমনের অনেক গুলো কল এসে আছে।কল করতে গিয়ে ও পারেনি সাঁঝ। লোকটা এমনই করে সবসময়।সবকিছুতে সে বেশি বুঝে।হঠাৎ সিএনজি থামালো কে যেন।ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে পাশে তাকাতেই সাঁঝ দেখলো সাইমন ওর পাশে বসেছে।সাঁঝ অপরপাশে তাকায় চোখঘুরিয়ে।লোকটাকে বড় ক্লান্ত লাগছে।মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছে।সাইমন বলল,
''ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করো।"
লোকটা গাড়ি ছাড়ে আবার।সাঁঝের হাত ছুঁতেই হাত ছাড়িয়ে নেয় ও।সাইমন বলল,
''এমন করছো কেন তুমি?আজ আমাদের বিয়ের পর প্রথম ভ্যালেন্টাইনস ডে।আর তুমি এতো রেগে আছো।সাঁঝ প্লিজ তাকাও আমার দিকে।"
সাঁঝ বলল,
''পারবোনা। চলে যান আপনি।"
সাইমন বলল,
''আমি যাবো না যতক্ষন পর্যন্ত না তাকাচ্ছো।প্লিজ কথা বলো।আর লাল পরোনি কেন আজ?"
সাঁঝ রেগে বলল,
''এসব পছন্দনা আমার।"
''কিন্তু আমার তো পছন্দ।আর গাড়ি থাকতে সিএনজিতে কেন আসলে?"
সাঁঝ বলল,
''গাড়ি আপনার আমার না।"
সাঁঝের কাঁধে হাত রাখে সাইমন বলল,
''যা আমার সবইতো তোমার।"
সাঁঝ সাইমনের হাত ফেলে দিলো।সাইমন রাগ সামলে বলল,
''সাঁঝ সুন্দর করে কথা বলো।গাড়িতে আমরা।"
সাঁঝ বলল,
''ওহ আমার কথা এখন ভালো লাগবেনা আপনার।কথাই বলবোনা আমি আর।"
সারাগাড়িতে আর কথা বললনা সাঁঝ।সাইমন এটা ওটা বলতে থাকে।অফিসে চলে আসে সাঁঝ।সিএনজও থেকে নেমে সাঁঝ ভাড়া দিতে গেলে সাইমন দিয়ে দিলো।সাঁঝ দ্রুতপায়ে হেঁটে অফিসে ঢুুকে যায় আর পিছু পিছু সাইমন ও।সাঁঝ নিজের কেবিনে এসে দরজা আটকাতে যাবে তখনই সাইমন ও ঢুকে ওকে জড়িয়ে ধরে জোর করে।
বলতে লাগলো,
''প্লিজ সাঁঝ রেগে থেকোনা। আমি থাকতে পারছিনা খুব কষ্ট হচ্ছে।"
সাঁঝের কান্না চলে আসে।তারপর ও সামলে নিলো নিজেকে।সরে এসে বসে বসলো নিজের আসনে।সাইমন ওর সামনে বসে বলল,
''সাঁঝ প্লিজ কথা বলো।"
সাঁঝ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
''কি বলবো বলুন?সমস্যা গুলো বুঝতেই চাননা আপনি।কি বলবো আমি?"
সাইমন ওর হাত চেঁপে ধরে বলল,
''ভুল হয়ে গেছে।আর হবেনা।কতোদিন হয়ে গেলো কথা ও বলছো না।এভাবে রেগে থেকোনা ভাল লাগছেনা আমার।"
সাঁঝ হাত ছাড়িয়ে বলল,
''অনেক কাজ আছে আমার।দয়া করে চলে যান।"
সাইমন রেগে সাঁঝের সামনে থাকা ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়ে ওর হাত টেনে দাঁড় করালো।সাঁঝ অবাক হয়ে বলল,
''কি করলেন?"
সাইমন ওকে চেঁপে ধরে বলল,
''কতক্ষন ধরে কথা বলার ট্রাই করছি।কি পেয়েছোটাকি তুমি?"
সাঁঝ বলল,
''এখন কথা বলতে পারবোনা বলেছি আমি।"
''দেখো সাঁঝ বাচ্চামো করোনা।এখন আর আগের সময়ে নেই আমরা।ম্যাচিউরড আমরা।তারওপর ম্যারিড আমরা।কথা বলতে পারবানা কেন?এখনই কথা বলবো।এখনই এসব ঠিক করবো।"
সাঁঝ কেঁদে ফেলে।কারন সাইমন চিৎকার করে কথা বলছিলো।সাঁঝ বলল,
''দেখুন এটা অফিস সাইমন।প্লিজ চলে যান।"
সাইমন ওকে কাছে টেনে বলল,
''কথা বলো আমার সাথে।আমি তোমার হাসবেন্ড।বুঝোনা তোমাকে ছেড়ে তোমার সাথে কথানা বলে থাকতে কতো কষ্ট হয় আমার?"
সাঁঝ একসময় রাগ ধরে রাখতে পারেনা।ঢলে পড়ে সাইমনের বুকে।কাঁদতে লাগলোও।বলতে লাগলো,
''ঠিক আছে।কথা বলবো। আমি ও মাফ চাচ্ছি ব্যাবহারের জন্য।কিন্তু অফিসে চিৎকার করবেননা প্লিজ।"
সাইমন এবার নরম হলো।সাঁঝের মুখ সামনে এনে চোখ মুছে দিতে দিতে বলল,
''আরো আগে বললেতো এতদূর এগুতো না।আমি ও সরি।মাফ করে দাও।"
সাঁঝ দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে সাইমনকে।সাঁঝের কপালে চুমু দিয়ে সাইমন বলল,
"ভালোবাসি বৌটা।খুব মিস করেছি।"
''আমি ও অনেক মিস করেছি।আপনাকে খুব ভালবাসি।"
সাঁঝকে সামনে এনে সাইমন বলল,
''আজ হাফ ডে করো।দুজন বের হবো।"
সাঁঝ হেসে বলল,
''স্যারকে আগে বলতে হবে।"
সাইমন সোফায় বসে বলল,
''ওকে বলে এসো।"
সাঁঝ কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

!!!!

বিকেল বেলা ঘরে ফিরে আসেন ইকরাম রাহমান চৌদ্দটা গোলাপ ফুল সহ।ঘরে প্রবেশ করেই দেখেন জুলেখা বানু টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছেন আর বেলা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে।বিভান ফোনে কি যেন করছে সোফায় বসে।ইকরাম রাহমান ফুল গুলো লুকিয়ে রুমে প্রবেশ করেন।তারপর জোরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন,
''জুলু কই তুমি?"
স্বামীর এমন ডাকে খুব লজ্জা পান জুলেখা বানু।লোকটাও না সবার সামনে এভাবে ডাকার কি হলো?ওমার বুঝি লজ্জা করেনা।ঘরময় মানুষ ভর্তি। মেয়ে আছে জামাইরা আছে আর ওনি?ভেবেই ছোট্ট শ্বাস ছাড়েন জুলেখা বানু।পাশে পাকঘরের দিকে তাকাতেই লজ্জায় শেষ হয়ে যান ওনি।প্রিয়াশা হাসছিলো শাশুড়ীকে তাকাতে দেখে বলল,
''আম্মা কি বানাবো?লাল চা না দুধ চা?"
জুলেখা বানু কিছু বলতে যাবেন তখন আবার হাঁক শুনতে পান স্বামীর।বললেন,
''জামাইরা আছে দুধ চা বানাইবা।"
বলেই রুমের দিকে পা বাড়ান জুলেখা বানু।বেলা হেসে ফেলে।ঘর ঝাড় দিয়ে পূর্নাকে ডাকতে থাকে।মেয়েটাও না কই কই চলে যায়।পূর্না লাবনীর কোলে বসে ফোনে বার্বিডল দের গান দেখছে।আর লাবনী ওকে চিনিয়ে দিচ্ছে বার্বিদের নাম।বেলা রুমে এসে বলল,
''এটা কেমন কথা মা?তোমাকে ডাকছিনা? জবাব দিবা আব্বু।"
লাবনী হেসে বলল,
''আপা তোর মেয়ে মোবাইলে ব্যাস্ত। ওর বাহিরের জগতের  কোন খবর নাই।বেলা রাগ হওয়ার ভান করে বলল,
''তোরা ওকে এসব দেখিয়ে শেষ করে দিলিরে?"
লাবনী আর পূর্না দুজনেই হাসতে লাগলো।লাবনী হঠাৎ বলল,
''আপা দুলাভাই তোকে কিছু দিবেনা আজ?"
বেলা হেসে বলল,
''ওনার এসব পছন্দনা।কিন্তু এমনি বাহিরে খাওয়াতো ওখানে।এসবে বিশ্বাস রাখেননা ওনি।"
লাবনী বলল,
''আরে আপা এসব ফাওল।আমার বান্ধবীরা আজ নিজের বিএফদের সাথে ঘুরতে গেছে।"
বেলা দুষ্টুমীর স্বরে বলল,
''কেন তোর নাই বয়ফ্রেন্ড?"
লাবনী মাথা নেড়ে বলল,
''না আপা ওসব করিনা।"
'"হুম।।"
এদিকে জুলেখা বানু রুমে আসতেই ইকরাম রাহমান দরজা চাঁপিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরতেই জুলেখা বানু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন।বলতে লাগলেন, 
''ভীমরতি ধরছেনি?এমন করো কেন?"
ইকরাম রাহমান বউকে আবার ধরে বললেন,
''জুলু এমন করো কেন?আমি তোমারে অনেক ভালবাসি তো "
জুলেখা বানু মুখ ভেংচি দিয়ে বললেন,
''এহহহ আইছে।হেতে ভালবাসে। বয়স দেখছোনি?"
ইকরাম রাহমান বললেন,
''আরে বৌ বয়স দিয়া কি কইরবা?ভালবাসা বয়স মানেনা।বুঝোনি?"
জুলেখা বানু রেগে বললেন,
''ফান কোনাই?"
ইকরাম রাহমান হাতে রাখা পান আর দুটো গোলাপ বৌয়ের দিকে ধরেন।বললেন,
''হ্যাপি ব্যালেন্টাইনস ডে।"
জুলেখা বানু হাসি মুখে দুটো গোলাপ আর পান নিয়ে লজ্জা মাখা হাসি হেসে বললেন,
''তুমিও না খালি শরম দাও।"
ইকরাম রাহমান স্ত্রীকে জড়িয়ে নেন বুকে।এদিকে প্রিয়াশা চা বানিয়ে সবাইকে দিতে থাকে।আদনান বাহিরে গেছে জায়গা দেখতে।যেখানে ওদের এনজিও এর অফিস টা হবে।প্রিয়াশা একবার ঘড়ির দিকে তাকায়।অজান্তেই মনটা কেমন করে উঠে।লোকটা ঠিক আছে তো?বিভানকে চা দিয়ে বেরিয়ে যেতে নেবে প্রিয়াশা তখনই বিভান বলল,
''প্রিয়াশা আদনান কখন আসবে?কল দিয়েছো?"
প্রিয়াশা ধীর কন্ঠে বলল,
''ভাইয়া ওনি বললেন বাসে উঠেছে।সময় লাগবে ফিরতে।"
''ওহ আচ্ছা।জায়গা পেলো?"
''খোঁজ চলছে।বাকি এম্পলয়িরাও খুঁজবে।"
''ভালোই হবে তাহলে।তোমার আপাকে দেখলে ডেকে দিও।"
''জি ভাই।"
প্রিয়াশা মৃদু হেসে হেঁটে রুমে চলে যায়।
.............................এদিকে কুঞ্জন আর কবিতা রিক্সায় পাশাপাশি বসেছে।এ প্রথম কুঞ্জন কোন অচেনা নারীর সাথে রিক্সায় বসেছে।কুঞ্জনের খুব লজ্জা হচ্ছে কিন্তু মেয়েটাকে তো ঘরে ফিরতে হবে।হঠাৎ রাস্তায় প্রচুর জানজট লাগলো।কবিতা কুঞ্জনের দিকে তাকায়।কুঞ্জন সামনে তাকিয়ে আছে।ছেলেটাকে তখন থেকেই বেশ চুপচাপ দেখছে কবিতা।যেখানে ইরাজ প্রচুর কথা বলে তবে সেগুলো খুব ভালো হয়না।কবিতার বেশ ভালো লাগছে অন্তত ইরাজ থেকে কিছু সময়ের জন্য ছাড় পেলো তো।কবিতা হঠাৎ বলল,
''ভাইয়া আপনার সাবজেক্ট কি?"
কুঞ্জন ওর দিকে না তাকিয়ে একটু হেসে বলল,
''সায়েন্স।তোমার?"
''আর্টস।"
কুঞ্জন কিছুটা নাক শিটকে বলল,
''অনেক লিখতে হয় তাই না?ভুগোল ইতিহাস পাতিহাস।"
কবিতা মুখ মলিন করে বলল,
''এভাবে কেন বলছেন?আর্টস ও ভালো সাবজেক্ট।"
''হুম বুঝলাম।"
দুজনেই আবার চুপ হয়ে গেলো।রিক্সা চলছে হঠাৎ হালকা ঝাঁকি লাগতেই কুঞ্জনের সাথে ধাক্কা খায় কবিতা।
দুজনেই লজ্জায় শেষ।কবিতা হাতের পিঠ ঘষতে ঘষতে বলল,
''সরি ভাইয়া।"
কুঞ্জন বলল,
''ইটস ওকে।আরে মামা ধীরে চালাও মেয়ে মানুষ আছে।"
রিক্সাচালক বললেন,
''আরে মামা আইজতো আপনেরা এমনিতেই আনন্দ করবেন।তাইলে হালকা ঝাঁকি লাগলে কি হয়?
কুঞ্জন রেগে বলল,
''মামা এতো কথা বলেন কেন?সবাইরে দেখে এসব ভাবার কারন নেই।বুঝলেন?গাড়ি চালান। "
লোকটা গজর গজর করে কি যেন বলতে লাগলেন।কুঞ্জন গুনগুন করে বলল,
''যত্তসব।এসব বাল ছালের প্রেম। "
কবিতা হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল,
''ইরাজ ও এসব বলে।তবে ওনার কথা গুলো.........."
বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেলো কবিতা।কুঞ্জন ওর দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
''বাদ দাও।"
কবিতা চুপ হয়ে যায়।কিছুক্ষন পর কবিতা চলে যায় আর কুঞ্জন ও বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এদিকে ঘরে পৌছে দেখলো বেলা বিভান বসে কথা বলছে।ঘরে ঢুকতেই বিভান ওকে ডেকে নেয়।কুঞ্জন যেতেই বিভান বলল,
''তুমি ফ্রি?!"
কুঞ্জন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''জি ভাই কেন?"
''বাজার করবা।"
কুঞ্জন অবাক হয়ে বলল,
''কিসের?"
বিভান ওর হাতে দুহাজার টাকা দিয়ে বলল,
''রুপচাঁদা মাছা, আর বারবিকিউতে যা লাগে সব।"
কুঞ্জনের মুখে হাসি ফুঁটে উঠে।বলল,
''ভাই আমার শখ ছিলো খুব মাছ দিয়ে বার্বিকিউ করার।থ্যাংক ইউ ভাই।,"
বেলা বলল,
''রেস্ট নিয়ে বের হয়ে যা।দেরি হবে নাহলে।"
কুঞ্জন দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে  বলল,
''রেস্ট লাগবেনা আপা গেলাম।"
বেলা হেসে বলল,
''সাবধানে যাস।"
কুঞ্জন বেরিয়ে গেলো।
...........................এদিকে হাতে গোলাপের তোড়া আর দু ডজন চুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে নিশাদ। আজকালকার মেয়োরাও না যে কি সব আবদার করে বুঝেনা ও।ইদ্রিদের বাসার সামনে এভাবে ফুল চুড়ি হাতে দাঁড়াতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে ওর।
আসত না ও আজ।তাও আবার এমন দিনে বিশ্বাসী নয় ও।ভালবাসা সারাজীবনের সেটা একদিনে দেখিয়ে কি হবে?কিন্তু পাজি বৌটার আবদার কি করে ফেলবেও?আজকাল বৌ বলতে বড় শান্তি লাগে।কোথায় যেন খুব আনন্দ হয়।আজ আসার কারন হলো সেদিন অফিসে ইদ্রি ওকে বলছিলো, 
''সেদিন একবার চুমু খেলেন।আর দিলেননা।এ কেমন ভালবাসা আপনার?আজ কিস ডে।"
নিশাদ টেবিল থেকে সরে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে ইদ্রির অনেক কাছে চলে আসে।ওদের মাঝে কোন ফাঁকা নেই।নিশাদ বলল,
''আমার ভালবাসা খুব পবিত্র কোন নোংরামো নেই।সেদিন যা হয়েছিলো সব আবেগে।বাট আমি তোমাকে ভালবাসি দিন কাল পাত্র ভেদে নয় সারাজীবনের জন্য।"
ইদ্রি মিষ্টি করে হাসে।তারপর হঠাৎ বলল,
''আমাকে গোলাপ চুড়ি কে দিবে?ফ্রেন্ডদের কি বলবো?"
নিশাদ ওর হাতের পিঠে চুমু দিয়ে বলল,
''গোলাপ আর চুড়ি চাও?"
ইদ্রি মাথা ঝাঁকায়।নিশাদ ওর গাল টিপে বলল,
''পেয়ে যাবে।"
ইদ্রি খুশিতে নিশাদকে জড়িয়ে ধরে জোরে বলল,
''ভালবাসি।"
''আমিও ভীষন ভালবাসি।"
ভাবতে ভাবতে মৃদু হাসতে থাকে নিশাদ।ফুল আর চুড়িতে একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে গেটের দিকে তাকাতেই ইদ্রিকে নেমে আসতে দেখে নিশাদ।
মেয়েটাকে সত্যি ওর বৌ লাগছে।একদম লাল শাড়ী পরেছে।কানে ছোট ঝুমকা হাত খালি অবশ্য।ইদ্রি বেরিয়ে এসে মিষ্টি হাসে নিশাদকে দেখে।তারপর বলল,
''এসেছেন?"
''হুম।"
ইদ্রি ফুল গুলো হাতে নিয়ে ঘ্রান নিয়ে বলল,
''উফ কি শান্তি।খুব ভাল লাগছে।থ্যাংক ইউ।"
নিশাদ হেসে বলল,
''বৌটা খুব খুশি?"
ইদ্রি হেসে বলল,
''খুব।"
নিশাদ মন খারাপ করে বলল,
''সরি আরেকটা বক্স চকলেট ছাড়া কিছু আনতে পারিনি।"
ইদ্রি অবাক চোখে নিশাদের দিকে তাকায়।তারপর বলল,
''চকলেট কেন আনলেন?খালি ফুল আর চুড়ি হলে হতো। "
''কিছু তো দেইনি তেমন।"
ইদ্রি রেগে বলল,
''আপনাকে পেয়েছি তো।আর কি?"
নিশাদের মুখে হাসি ফুঁটে উঠে। বলল,
''তুমি খুশি তো?"
ইদ্রি বলল,
''খুব।দিন চুড়ি গুলো পরিয়ে দিন।"
নিশাদ মৃদু হেসে ইদ্রির হাত ধরে চুড়ি ঢোকাতে শুরু করে।"
ইদ্রির হাত দেখতে লাগলো।কি যে ভাল লাগছে ওর হাত দুটোকে।নিশাদ এবার চকলেট বক্সটা ওর দিকে এগিয়ে দিলো।বলল,
''নিয়ে যাও।সন্ধ্যা হচ্ছে।"
ইদ্রি চকলেট বক্স ধরে বলল,
''পেয়েছি আমি।এবার এটা আপুদের দিবেন।ওনারা খুশি হবেন।"
নিশাদ অবাক হয়ে বলল,
''তোমার ভাল লাগেনা চকলেট?"
ইদ্রি হেসে বলল,
''লাগে খুব ভালো।কিন্তু আপুরাও তো আশা করবে তাদের ভাই কিছু না কিছু নিয়ে যাবে।পারলে এগুলোর সাথে আর কিছু কিনে বাসায় যান।পূর্না মামনি ও আছে।ওকে দিয়েন মামীর পক্ষ থেকে।"
বলেই ছোট্ট কিছু ক্লিপ নিশাদকে ধরিয়ে দেয় ইদ্রি।বলল,
''এটা ওর বড় মামী ওকে দিয়েছে।বলবেন কিন্তু।"
নিশাদ হেসে ইদ্রির কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন