রংধনু - পর্ব ৫৯ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


স্টেজের কাছে এগিয়ে যাচ্ছ নিশাদ।পাশ থেকে কুঞ্জন গান পাল্টে যাচ্ছে একের পর এক।নিশাদ স্টেজে এসে বোনের পাশে বসে।সাঁঝ ভাইকে দেখে অশ্রুসজল দৃষ্টিতে মৃদু হাসলো।নিশাদ হাতের আঙ্গুলে একটু হলুদ নিয়ে সাঁঝের দুগালে ছুঁইয়ে দিতেই চোখ ভরে আসে ওর।সাঁঝ ও কেঁদে ফেলে। নিশাদ ভাবছে কতোবার হাত ধরে স্কুলে নিয়ে গিয়েছে,ছোটবেলায় কোলে নিয়ে এ দোকান ও দোকান ঘুরেছে আর কতো আবদার করতো চকলেটের জন্য।আর আজ সেই ছোট্ট পুতুলটার গায়ে হলুদ ছোঁয়া।ভাবতেই নিশাদের শরীরের রন্ধ্রে কেমন এক অনুভূতির বাতাস বয়ে যেতে থাকে।বুকটা ভারি হয়ে আসতে থাকে।সাঁঝ একটু পুডিং নিয়ে নিশাদের মুখের সামনে ধরে কেঁদে বলল,
''ভাইয়া খেয়ে নে।"
নিশাদ চোখ মুছে পুডিং খেয়ে সাঁঝকে ও একটু কেক খাইয়ে দিয়ে ওকে বুকে টেনে নেয়।দুভাইবোনের মাঝে কিছুক্ষন আবেগঘন অশ্রুমিশ্রিত সময় কেঁটে যায়।কিছুক্ষন পর সাঁঝ সরে এসে চোখমুছে নেয়।নিশাদ বলতে লাগলো,
''একটু ইমতিয়াজের বাসায় যাবো আমি।বাকিরা এসে হলুদ দিয়ে যাক।"
সাঁঝ মাথা ঝাঁকায়।নিশাদ উঠে বেরিয়ে গেলো।তারপরই বাকি সবাই এসে একে একে হলুদ লাগাতে থাকে।বিভান হলুদ লাগাবার মুহূর্তে সাঁঝকে বলছিলো,
''একটু বেশি লাগাবো আমি।"
মৃদু হাসে সাঁঝ।জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
''কেন ভাইয়া?"
বিভান সাঁঝের কপাল গালে হলুদ লাগিয়ে দিতে দিতে বলছিলো,
''কারন আমার জীবনে তুমি আমার ভালবাসাটাকে এনে দিয়েছিলে।এজন্য তোমাকে বেশি লাগাবো।কারন প্রত্যেকটা হলুদের ছোঁয়া তোমার জন্য দোয়া বুঝলে?"
বিভানের কথায় সাঁঝের অপরপাশে বসে থাকা বেলা স্মীত হাসে।হঠাৎ কুঞ্জন পূর্নাকে ওদের কাছে এনে বলল,
''আপা ও নাকি এখানে আসবে বলে কান্না করতেছিলো।তোরা কি লাগাচ্ছিস সেটাও লাগাবে।"
বিভান মেয়েকে কোলে নিয়ে একটু মিষ্টি পূর্নার হাতে ধরিয়ে বলল,
''নাও আন্টিকে খাইয়ে দাও।"
পূর্না হাত বাড়িয়ে সাঁঝকে একটু মিষ্টি খাইয়ে দিলো।সাঁঝ ও পূর্নার মুখে একটু কেক দিতেই পূর্না বলল,
''আমি আন্তিল গালে লাগাবো।"
অপরপাশ থেকে বেলা জানতে চাইলো,
''কি লাগাবে মা?"
পূর্না বলল,
''তোমলা আন্তি গালে অলুদ কি লাগিয়েতো দে ওগুলা।"
বিভান পূর্নার আঙ্গুলে একটু হলুদ লাগিয়ে বলল,
''দাও আন্টির গালে লাগিয়ে দাও।"
পূর্না ওর ছোট হাতে সাঁঝের গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো।।
সবার হলুদ লাগানোর পর শুরু হলো খাবারের পর্ব।বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।অবশ্য খাবারের দায়িত্বও ছিলো বিভানের হাতে।বাবুর্চীর টাকা থেকে শুরু করে বাজার সব ও নিজেই করেছে।আদনান ও ছিলো ওর সাথে। খাবারের পরপরই ছিলো নাচের পর্ব।আদনান কুঞ্জন লাবনী খুব নাচছিলো।কিন্তু হুমায়রাকে বেলা সেখানে পায়নি।সেদিন রাত দশটা পর্যন্ত হলুদের অনুষ্ঠান চলছিলো।অনুষ্ঠান শেষে একে একে সবাই নামতে থাকে।বেলা আর আদনান সাঁঝকে নিয়ে নেমে আসে।বাসা ভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে।কারোর যাবার নাম ও নেই।বিভান যেন একটু অস্বস্তি অনূভব করছিলো।অগত্যা ওকে সবার মাঝে চুপচাপ হয়ে থাকতে হচ্ছিলো।মাঝে মাঝে হু হা করে উত্তর করছিলো।বিভান বাংলা শিখলেও গ্রামের লোকদের কথা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা।এদিকে সাঁঝ আর বেলা রুমে আসে।সাঁঝ নিজের তোলা কিছু ছবি সাইমনের ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ইবেলা সাঁঝকে ফ্রেশ হতে বলে পূর্নার লেহেঙ্গা খুলে দিতে থাকে।ছোট্টবাবুটা খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছে।সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি তারওপর এ কোল ও কোল এমন করতে করতে যেন অস্থির হয়ে উঠেছিলো পূর্না।শেষমেষ বাবার কোলে গিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও।
মেয়েকে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে সাঁঝের খাটে শুইয়ে দেয় বেলা।হঠাৎ রুমে প্রবেশ করেন ছোট মামী।এসেই জোরে বলতে লাগলেন,
''কিরে বেলা এইহানে কি করোস?"
ওনার এই চিৎকারে পূর্নার ঘুমন্ত চোখ সচল হয়ে উঠে।বেচারীর চোখের কোনায় অশ্রু এসে জমা হয়।ঘুমানোর আশা যেন মুহূর্তেই ভেঙ্গে চুরমাচুর হয়ে গেলো।বেলা বলল,
''জি মামী বাবু কে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম।"
মহিলা পূর্নার গাল টেনে দিয়ে বলল,
''তোর মাইয়ার নাম কিরে?"
পূর্না রেগে মামীর দিকে তাকায়।বেলা বলল,
''বিভাবতী শেখ পূর্না।পূর্না ওনি তোমার নানু হয় একজন।"
পূর্না রেগে মুখ ফুলিয়ে বলল,
''একন গুমাবো।"
মামী পূর্নার কথা বুঝতে না পেরে জানতে চাইলো,
''বেলা তোর মাইয়া কি কইলো?"
মৃদু হাসলো বেলা।বলল,
''মামী আসলে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করছিলো তারওপর সবাই আসে কোলে নিতে। দেখলেনই তো সবার কোলে যায়।তাই মনে হয় খারাপ লাগছে।আম্মু নানু কে সালাম দাও।"
পূর্না কাঁদো মুখে বলল,
''আততালামালাইকুম।"
''ওয়ালাইকুম আসসালাম। আইচ্ছা নানু মনি তুমি ঘুমাও।তা বেলা নিশাইদ্দা কই চইলা গেলো?সাঁঝরে হলুদ দিয়া যে গেলো আর ত আইলোনা। "
''কাজ আছে কোন বন্ধুর কাছে।তাই গেলো।এইতো একটু পর চলে আসবে।"
''অহ।"
..................................এদিকে বিকেল পাঁচটায় ও ইমতিয়াজের বাড়িটা একেবারেই নীরব হয়ে আছে।চারিদিকে কোন কথাবার্তা হাসি ঠাট্টা কিছু নেই।প্রিয়জন হারানোর বেদনা পুরো পরিবেশটাকে একদম গ্রাস করে ফেলেছে।সৈয়দা বেগম জায়নামাজে বসে কেঁদে যাচ্ছেন।স্বামী একজন নারীর অনেকবড় শক্তি। স্বামী থাকলে সবার কাছে মূল্য থাকে।স্বামী ছায়া স্বরুপ।কিন্তু এই ছায়াটাকেই হারিয়ে ফেলেছেন ওনি চিরজীবনের জন্য।ভাবতেই কান্নার দমকে চোখমুখ কুঁচকে এলো ওনার।রানুখালা পাশ থেকে হায় হুতাশ করছেন।বলছেন,
''ভাবি স্বামী যে কি অমূল্য রতন হেইডা সে চইলা যাওনের ফরই বুজা যায়।আমি ও তো তের বছর আগেই স্বামী হারাইছিলাম।তবে আমাগোর মইদ্ধে ফারথিক্য হইলো আমনের জনে আকাশের তারা অইয়া গেছে আর আমার জনে আরেক বেডি লইয়া ভাগছে।আমনের স্বামী আছিলো ভালা মানুষ।আমার ডা আছিলো লুইচ্ছা।মা বাফে জোর কইরা বিয়া বসায়া দিছিলো আমারে বারো বছর বয়সে।তহন কিছু বুঝতাম ও না।ভাবি আমার মনে হয় কি জানেন?আমার জনেরে ফাঁসাইছিলো ঐ বেডি। এতো খারাপ তো আছিলোনা লোকডা।"
সৈয়দা বেগম নামাজ শেষে সামনে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন,
''সবার ভাগ্যে ভালো স্বামী থাকেনা।সবাই সব পায়না।কিন্তু এ আল্লাহর কেমন বিচার?আমার দুটো অবিবাহিত ছেলে মেয়ে আছে।আল্লাহ ওদের জন্য হলেও ওনাকে বাঁচিয়ে রাখতো।আল্লাহ ওূের মুখের দিকে ও তাকায়নাই আমার মুখের দিকে ও না।"
রানুখালা বললেন,
''হভাবি আমনের অনেক বড় বিফদ অহন।কে জানে ইমতিয়াজ বাবা অহন বিয়া কইরালাইলে ইদ্রি মামুনির খুব বিফদ অইবো।"
সৈয়দা বেগম চোখ মুছে বললেন,
''উল্টাপাল্টা কথা বইলোনা খালা। আমার ছেলে এমন না।ওকে আমি খুব ভালো ভাবে চিনি।যাও তুমি তোমার কাজ করো।আমি ইদ্রিকে দেখে আসি।"
রানু খালা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো।সৈয়দা বেগম জায়নামাজ ভাজ করে উঠে দাঁড়ান।শুয়ে আছে ইদ্রি।বারান্দার থেকে শীতল দমকা হাওয়া ভেসে আছে।ওর চোখের কোনা আজকাল জ্বলে।বড় যন্ত্রনা হয়।নিজের দিকে কোন মন নেই ওর।শুধু আব্বুকে মনে পড়ে। তার কথাবার্তা আদুরে কন্ঠে ইদ্রি ডাক সব কিছু। ইদ্রি হাত উঠিয়ে চোখে আসা পানি মুছে নিয়ে ফোনে থাকা বাবার ছবি বের করে।সেখানে বাবা আর ও।ওদের সুইডেনে থাকাকালীন ছবি।বাবা আর ও পাশাপাশি বসে।ইদ্রি বাবার গাল জড়িয়ে হাসছে।ভোঁতা আওয়াজ করে কান্না করতে থাকে ইদ্রি।কান্নায় এতোটাই ব্যাস্ত যে পাশে বসে এসে দাঁড়িয়ে থাকা নিশাদকে ও খেয়াল করেনি ও।নিশাদ এসে পাশে বসে ছবিটার দিকে চেয়ে বলল,
''একেবারে আঙ্কেলের মতো হয়েছো দেখতে।"
ফোন সরিয়ে নিজের প্রেমিক পুরুষটার দিকে তাকায় ইদ্রি।তারপর কিছু না ভেবে নিশাদের কোলে মুখ ডুবিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ও।নিশাদ ইদ্রির মাথা হাতিয়ে বলতে লাগলো,
''বোকা মেয়ে।এভাবে কাঁদেনা।জানো আঙ্কেল যখন দেখবে তুমি ভালো আছো সুখী আছো তখন ওনি ও ভালো থাকবেন।তুমি এভাবে কাঁদলে ওনার কষ্ট হবে ইদ্রি।"
কাঁদতে কাঁদতে ইদ্রি বলতে লাগলো,
''সবাই বলে আব্বুর মতো হলে মেয়েরা নাকি অনেক ভাগ্যবতী হয়।কই আমি তো দূর্ভাগা।সবাই কেন বারবার বলছেন আব্বু নেই?আমার আব্বু আছে  অবশ্যই আছে।হয়ত অসুস্থ কিন্তু এর মানে এই না যে আমাকে ছেড়ে যাবে।আমার আব্বু কখনো যাবেনা আমাকে ছেড়ে।"
নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
''অবশ্যই আছে ইদ্রি।তোমাদের ছায়া হয়ে আছে।"
''তাহলে সামনে কেন আসেনা?"
ইদ্রির কথায় কোন জবাব পায়না নিশাদ।ওর গলা ধরে আসে।চোখের কোনা ভরে আসে।
মাথা তুলে নিশাদের দিকে তাকায় ইদ্রি।নিশাদ চুপচাপ ইদ্রির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
হঠাৎ ইমতিয়াজ ইদ্রির রুমে এসে বেশ অবাক হলো।নিশাদ এখানে। আজ তো সাঁঝের হলুদ।ইমতিয়াজ নিশাদের পাশে এসে দাঁড়াতেই দুবন্ধুর চোখাচোখও হলো।ইমতিয়াজ বলল,
''তুই এখানে?সাঁঝের না আজকে হলুদ?"
নিশাদ ম্লান হেসে বলল,
''হলুদ দিয়ে এসেছি।আর এখন ইদ্রি ও আমার কাছে ভীষন মূল্যবান ঠিক যেমন টা সাঁঝ। 
সাঁঝের কথায় ইমতিয়াজ হৃদয় ভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।সাঁঝের বিয়েটা যতোই ঘনিয়ে আসছে ওর জীবন থেকে সাঁঝ ততোটাই দূরে যাচ্ছে। এখন যদি  ও নিশাদের হাত জড়িয়ে বলতে পারতো দোস্ত সাঁঝের বিয়েটা ভেঙ্গে দে। ওকে আমি ভালবাসি বড্ড ভালবাসি।ওকে বিয়ে করবো আমি তুই শুধু বিয়েটা ভেঙ্গে দে।কিন্তু এমনটা করলে কি ওরা সুখে থাকবে?থাকবেনা কারন সাইমনকে হারানোর যন্ত্রনায় সাঁঝ যতোটা কষ্ট পাবে।তারচেয়ে বেশি কষ্ট হবে ইমতিয়াজের নিজের।এটা ভেবে যে কিভাবে ভালবাসার মানুষটার জীবন থেকে ভালবাসা কেড়ে নিলো ও?সাঁঝের প্রত্যেকটা যন্ত্রনা ওর জীবনে বিষ কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।

!!!!

জুবুথুবু হয়ে বসে আছে বিভান।গায়ে স্যান্ডোগেঞ্জী জড়িয়ে আছে আর পরনে সাদা পায়জামা।পাশে বেলা সাদা পাঞ্জাবী ইস্ত্রী করে দিচ্ছে।বিভান স্ত্রীকে দেখছে একমনে।বাংলাদেশ আসার পর থেকে বৌটার সাথে একটু সময়টাও কাঁটানো হয়না।সাঁঝের বিয়ের কাজে সবাই এতটাই ব্যাস্ত তারওপর বড় জামাই।সবার মাঝে থাকাটাই শোভা পায়। স্ত্রীর সাথে একান্তে সময় কাঁটানোটা বড় বেমানান লাগে।তবে দুদন্ড বললে তো তেমন কোন ক্ষতি হবার কথা নয়।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের পিঠে আরেকবার জোরে মারলো বিভান।মশা খুব বেশি এখানে।ওর হাতে পায়ে জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে আছে।মশার কামড়ের দাগ ভরে গেছে।বেলা মৃদু হাসলো।বলতে লাগলো, 
''কয়েল জ্বালিয়ে দিবো?"
স্ত্রীর কথায় বিভান তাকায় বেলার দিকে। তারপর মাথা নেড়ে বলল,
''না দরকার নেই।দম আটকে যায় আমার।"
বিভানের কথার জবাব না দিয়ে বেলা গলা উঁচিয়ে ডাকতে লাগলো,
''লাবনী এদিকে শোন।"
পাশের রুম থেকে লাবনীর দৌড়ে আসার শব্দ শোনা গেলো। দরজা হালকা ফাঁকা করে লাবনী বলল,
''জি আপা?"
বেলা স্ত্রীর সুইচ অফ করে বলল,
''এ্যারোসল আছে?"
লাবনী আছে বলে দৌড়ে চলে গেলো।বেলা বিভানের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল,
''অপেক্ষা করুন আসতেছে এ্যারোসল নিয়ে।"
বিভান মৃদু হেসে খাটে পা উঠিয়ে আরাম করে বসে। কিছুক্ষন পর লাবনী এসে এ্যারোসল মেরে চলে গেলো।
বেলা পাঞ্জাবী ভাজ করে ড্রয়ারে রাখছিলো।বিভান বলল,
''তা বিয়ের দিন কি পরবে তুমি?"
বেলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''গোয়া তে যাওয়ার সময় নতুন শাড়ীটা কিনলাম ওটা।"
''ঐযে বেগুনী কালার নেটের শাড়ীটা?"
''হুম।"
বেলা বিভানের পাশে এসে বসে।তারপর স্বামীর দিকে তাকায়।লোকটার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কি যেন বলতে চায় কিন্তু পারছেনা।বেলা বলল,
''কিছু বলবেন?"
বিভান মাথা নেড়ে বলতে লাগলো,
''না কিছুনা।ইন্ডিয়া যাওয়ার সময় হয়ে আসছে।"
বেলার মুখ মলিন হয়ে আসে।ধীরে বলল,
''হুম।"
হঠাৎ রুমে প্রবেশ করে নিশাদ পূর্নাকে কোলে নিয়ে।বিকেল থেকে পূর্না ওর কোলে যে চড়েছে আর নামছেইনা। বেলা উঠে দাঁড়ালো নিশাদ আসতেই।নিশাদের অপরহাতে একটি শপিংব্যাগ ঝুলানো।ও বলল,
''আপা ওকে নিয়ে বাহিরে গেসিলাম।এখানে একটা জামা আছে দেখ পছন্দ হয় কিনা?"
বেলা অবাক হয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভিতর থেকে একটা কালো স্যালোয়ার কামিজ বের করলো।জর্জেটের খুব সুন্দর পাথর দিয়ে কাজ করা।অফশোল্ডার হাতা।জামাটি বাবুদের।বেলার মনে হলো বেশ দাম নিয়েছে।বেলা একটু রেগে বলল,
''নিশাদ এগুলো কি?মাথা খারাপ তোর?কি দরকার ছিলো?"
পূর্নাকে জড়িয়ে নিশাদ বলল,
''আপা কি বলস?ও আমাদের মেয়ে না?প্রথম আসছে।ওকে কিছু দিতেই পারিনি।বাসার বড় মেয়ে ও।কতো গিফট পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু অপদার্থ মামা কিছুই পারেনি।"
বেলার চোখ ভরে আসে।ধরে আসা কন্ঠে বলল,
''এভাবে বলিস কেন?গিফটই কি সব?কতোগুলো মামা খালামনির আদর পাচ্ছে এগুলোই অনেক।"
বিভান মৃদু হেসে পূর্নাকে বলল,
''মামাকে থ্যাংক ইউ বলো মা।"
পূর্না নিশাদের গালে জোরে চুৃুমু দিয়ে বলল,
''থ্যাক ইউ মামা।"
নিশাদ পূর্নার গালে চুমু দিয়ে বেলাকে বলল,
''আপা গ্যারেজে আয়।আমার ফ্রেন্ডরা আসছে।আলপনা করতেছে।"
বেলা বলল,
''আসতেছি।"
তারপর বিভানকে বলল,
''একটা শার্ট পরে গ্যারেজে আসুন।আলপনা দেখে আসি।"
ততক্ষনে নিশাদ বেরিয়ে গেলো।বিভান শার্ট পরে বেলাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে।লাবনী কুঞ্জন হুমায়রা সবাই রেডি।ওরা নিচে এসে দেখলো ভূবন তীর্থ ফারহান কল্যান আদনান ওরা আলপনা আঁকছে।বেলা আর বিভানকে দেখে সবাই সালাম দেয়।তীর্থ বলল,
''আপা কেমন আছেন?"
''আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা কেমন আছো?"
''আলহামদুলিল্লাহ আপা।আপনার ভাই রে বিয়া দেননা কেন?আমরা তো সংসারী হয়ে গেলাম।নিশাদ তো এখনো সিঙ্গেল।"
বেলা হেসে ফেলল।আদনান কিছু বলতে চাইলে ও নিশাদ রাগী চেহারা দেখে চুপ রইলো।বিভান বলল,
''বিয়ে হবে।আমার শালা বাবু খুব মূল্যবান এই মূল্যবান মানুষের জন্য নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান বৌ লাগবে তাইনা?"
ভূবন বলল,
''জি অবশ্যই।দুলাভাই জানেন আপনার শালা কলেজ থেকে বড় আপুদের ক্রাশ ছিলো। "
নিশাদ এবার রেগে গেলো।তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
''চুপ কর।"
বিভান হেসে ফেলে ওদের কথায়।খুব সুন্দর করে বিভিন্ন রং এর ছোঁয়ায় আলপনা আঁকা হচ্ছে।ভূবন আর্টে তখন থেকেই পারদর্শী ছিলো।বড় ফুলের মাঝে বড় করে বর কনে এঁকে দিলো।সাঁঝ অনেকসময় পর নেমে এলো।ভূবন বলল,
''সাঁঝ কেমন আছো আপু?"
''জি ভাই ভাল।আপনি?"
''আলহামদুলিল্লাহ। দেখো তো কেমন হলো আলপনা?"
নিজের বিয়ের আলপনা দেখে লজ্জা পেলো সাঁঝ।মৃদু কন্ঠে বলল,
''সুন্দর ভাইয়া।"
তীর্থ বলল,
''খালি সুন্দর?অনেক কষ্ট করে আঁকতেছি।"
সাঁঝ হেসে বলল,
''খুব সুন্দর।"
কল্যান মজা করে বলল,
''শুনো সাঁঝ বিয়ের পর সাইমনকে বলবা ভাইয়ারা আলপনা আঁকছে।আমাদের যেন দাওয়াত করে।শেরাটনে খাওয়াতে বলবা।"
নিশাদ বলল,
''বোনের জন্য আঁকতেছিস আবার খাইতেও চাস?লজ্জা লাগেনা?"
কল্যান বলল,
''আরে মিঞা বাঁহাত ঢুকাস কেন?বোইনের লগে কথা বলতেছি।কি সাঁঝ দাওয়াত করবানা শেরাটনে?"
সাঁঝ বলল,
''হয়ত শেরাটনে খাওয়াতে পারবোনা কিন্তু নিজে রান্না করে অবশ্যই খাওয়াবো।"
পাশ থেকে ফারহান বলল,
''আলহামদুলিল্লাহ। কল্যান ভুড়িটা বাড়াইসনা হারামী।সাঁঝ ওকে দাওয়াত দিওনা।দেখলে তো ওর কতো বড় ভূড়ি।"
সাঁঝ হেসে ফেললো।অনেক রাত পর্যন্ত আলপনা করে ওরা সবাই মিলে খেয়ে নেয়।অনেকরাতেই চলে যায় নিশাদের বন্ধুরা।
খাওয়া শেষে সব ভাইবোন একত্রে জড়ো হয় ড্রয়িংরুমে।সবার মধ্যমনি আজ সাঁঝ।কাল এই মেয়েটা চলে যাবে শ্বশুর বাড়িতে।ওদের মাঝে আগের মতো থাকবেনা আর।সবার মনটাই বেশ খারাপ।কুঞ্জন ক্যামেরা এনে সবাইকে ভিডিও করছে।
এরই মাঝে নিশাদের ফোনে ইমতিয়াজের কল এলো।নিশাদ বেরিয়ে নিজের রুমে এসে কল রিসিভ করে।ইমতিয়াজ বলল,
''ডিস্টার্ব করলাম?"
নিশাদের বুক কেমন খালি হয়ে গেলো।কিছুটা রেগে বলল,
''কি বলিস এসব?তুই ডিস্টার্ব করবি কেন অদ্ভুত?কি হইছে?"
''কিছুনা।সব কেমন চলতেছে?"
''ভালোই।ভূবনরা এসে আলপনা করে গেলো।তা ইদ্রি আর আন্টি কেমন আছে?"
''মার কথা বলে লাভ নাই সারাদিন কান্না করে।ইদ্রি তুই যাওয়ার পর ভালো ছিলো।এখন আবার চিল্লাচ্ছে।থামছেইনা।"
নিশাদ বলল,
''পারলে এখন আবার আসতাম।এতো রাত হয়ে গেলো।"
''আরে এখন আসবি কেমনে।ওকে একটা ঘুমের ট্যাবলেট দিবো।ঘুমাক কিছুক্ষন তাহলে হয়ত ভালো লাগবে।"
নিশাদের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।কি হয়ে গেলো ওদের জীবনটা?দরকারের সময় ভালবাসার মানুষটাকে উপযুক্ত সময় দিতে পারছেনা ও।প্রেমিক হিসেবে ওর ব্যার্থতা হয়ত এখানেই।
কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে আসে নিশাদ।খেয়াল করলো ড্রয়িংরুমে বিছানা বিছানো।বিভান ওর রুমে আসার জন্য দাঁড়িয়েছে।নিশাদকে দেখে বিভান বলল,
''তুমি এখন ঘুমাবে?"
নিশাদ বলল,
''আপনার খারাপ লাগছে ভাই?"
বিভান বলল,
''একটু।"
নিশাদ বলল,
''এসে শুয়ে পড়ুন।কয়টাদিন এতো ধকল যাচ্ছে আপনার ওপর।"
''না তোমরা সবাই করছো আর জামাই হিসেবে আমার ও দায়িত্ব আছে তাইনা?"
নিশাদ হেসে বলল,
''জি ভাইয়া।"
বিভান ওর রুমে এসে একপাশে শুয়ে পড়লো।সাঁঝের কয়টাদিন যাবৎ ঘুম হয়না।কারন টা জানেনা ও।চোখ বুজলে কেমন এক অনুভূতি হয় যা একেবারে নতুন ওর কাছে।বেলার পাশ থেকে উঠে ডাইনিং রুমের দিকে এগুলো সাঁঝ।চেয়ারে আদনান ফোন চালাচ্ছে।সাঁঝকে দেখে বলল,
''ঘুমাসনা?"
সাঁঝ স্মীত হেসে বলল,
''পানি খেতে আসলাম।"
''ওহ।আচ্ছা শোন।তুই আমার থেকে পাঁচশত টাকা নিছিলি ক্লাশ টেনে থাকতে এখনো দিসনি।"
সাঁঝ বলল,
''ওয়েট।"
বলেই ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকা এনে আদনানকে দিতেই বোনের দিকে তাকায় আদনান।ছোট বেলা থেকেই ওরা ঝগড়াঝাটি করতো।কিন্তু এর মানে এই না যে সাঁঝকে ও পছন্দ করেনা।বরং বেশি ভালবাসে।আদনান মৃদু হেসে বলল,
''ভালবাসার দাম দিচ্ছিস বড় ভাইকে?"
সাঁঝ মলিন কন্ঠে বলল,
''তুইনা বললি।"
আদনান ফোন রেখে বলল,
''ইডিয়ট মজা করছিলাম।এটাও বুঝিসনা।কাল বিয়ে হয়ে গেলো সেটাও করতে পারবোনা।সাইমন ছেলেটা ভালোরে।ওকে জ্বালাসনা। বেচারা ভোলাভালা ছেলেটা।কিভাবে তোর মতো পেত্নীর পাল্লায় পড়লো।"
সাঁঝ কি বলবে বুঝতে পারছেনা। আদনান এখনো ওকে রাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।কিন্তু সাঁঝের এখন রাগ লাগছেনা বরং কান্না পাচ্ছে।কাল ওর পরিবারকে ছেড়ে কিভাবে চলে যাবে ও?সাঁঝ গুঁমড়ে উঠে।আদনান বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
''ভাইয়াকে মাফ করে দিস?অনেক বিরক্ত করছি।"
সাঁঝ আদনানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।
আদনান নিজেকে সামলাতে পারেনি।বোনের যাওয়ার দুঃখ অনেক বেশি হচ্ছে।
সে রাত পেরিয়ে সকাল হলো।নাস্তা শেষে আদনান উঠে দাঁড়ায়।হঠাৎ প্রিয়াশার কল আসে ওর নম্বরে।কল রিসিভ করে কিছু বলল না।পাঁচমিনিট কথা শুনে বলল,
''এক্ষুনি আসছি আমি।"
আদনান বেরিয়ে যাওয়ার ওদের জীবনে এমন একটি তাৎপর্যপূর্ন ঘটনা ঘটে গেলো যা দুজনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন