নীল চিরকুট
পর্ব ২৯
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
.
.
.
ক্যান্টিনে এতোগুলো মানুষের সামনে নীরার ক্রোধের এমন নগ্ন প্রকাশ ঘটবে তা কখনো চিন্তাই করতে পারেনি অন্তু। বন্ধুরাও নীরার এমন রূপে স্তব্ধ, বিস্মিত। একটু আগেই ক্যান্টিনের যে টেবিলটিতে চলছিল আড্ডার বহর সেখানে এখন ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। আড্ডার মাঝেই হঠাৎ ফোন বাজল নীরার। ফোন কানে নিয়ে বাইরে গেল ঠিক। কিন্তু ফিরে এলো ভয়াবহ রূপে। কথা নেই বার্তা নেই অন্তুর গালে কষে এক চড় বসাল। এমন কিছুর জন্য বন্ধুমহলের কেউই প্রস্তুত ছিল না। সবার চোখেই আতঙ্ক আর প্রশ্ন। রঞ্জনের মতো শান্ত ছেলেও আজ বিভ্রান্ত।
' আমার তোর প্রতি ঘেন্না হচ্ছে অন্তু। অতটা নীচ তুই কি করে? বারবার বলেছিলাম বন্ধুত্বটা রাখতে দে। বন্ধু হিসেবে বাঁচতে দে কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম নিমকহারামরা কখনও বন্ধু হতে পারে না। যে কুক্ষণে তুই আমার বন্ধুর তালিকায় যুক্ত হয়েছিলি সেই কুক্ষণকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি আমি। ওইদিনটি আমার জীবনে না এলেই পৃথিবীর সবথেকে সুখী মেয়ে হতাম আমি।'
রাগে শরীর কাঁপছে নীরার। চোখদুটোতে জল টলমল করছে। ফর্সা মুখটা হয়ে উঠেছে লাল। নম্রতা থতমত খেয়ে বলল,
' কি বলছিস এসব? এটা পাব্লিক প্লেস। আমরা পরে আলোচনা...'
নম্রতাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল নীরা,
' তুই চুপ কর নমু। দয়া করে আমার ব্যাপারে আর মাথা ঘামাতে আসিস না। আমার অন্তুর কাছে শুধু একটা প্রশ্নেরই উত্তর চাই। কেন ভেঙে দিলি বিয়েটা? বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে গিয়েছিল অন্তু। সবাইকে দাওয়াতও দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমার চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে তোর কি লাভ হলো? আমার একটা ছোট বোন আছে অন্তু। ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে ভাঙার মানে কী আদৌ জানিস তুই? আমার জীবন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তোর?
অন্তু জবাব দিল না। রাগে দুঃখে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য নীরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
' পাগলামো! পাগলামো! সত্যি করে বল তো, এই পাগলামো কিসের জন্য? আমার জন্য নাকি আমার সুন্দর শরীরের জন্য? তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও আমার ঘেন্না লাগছে এখন।'
অন্তু এবার চোখ তুলে তাকাল। নীরার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল। দুই জনের চোখেই সীমাহীন রাগ। অন্তু নীরার ডান হাতের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে কটমটে কন্ঠে বলল,
' যা করেছি বেশ করেছি। ভালোবাসি বলে দাম নেই, না? খুব তো বিয়ের জন্য নাচছিলি। যা কর এখন বিয়ে।'
নীরার এখন হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় বলে বোধ হচ্ছে। নীরা খুব জলদিই নিজেকে সামলে নিল। অন্তুর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
' তুই মরে যাচ্ছিস না কেন, বল তো? আই উইশ, এক্সিডেন্টের দিনটাই তোর শেষ দিন হতো।'
অন্তু দূর্বোধ্য হাসল। প্রচন্ড রাগে আবারও কষে চড় বসাল নীরা। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
' তোর হাসি আমার সহ্য হচ্ছে না।'
' আর তোর সুখ আমার সহ্য হচ্ছিল না।'
নম্রতা দুই হাতে মুখ চেপে বসে আছে। নীরা যথেষ্ট বাস্তববাদী মেয়ে। নিজেকে সংযত করার শক্তি তার প্রচন্ড। সেই নীরার এমন দশায় বুক বেয়ে কান্না আসছে নম্রতার। ক্যান্টিনের সবাই 'হা' করে মজা গিলছে। অবস্থা বেগতিক দেখে উঠে দাঁড়াল রঞ্জন। অন্তুকে টেনে সরিয়ে নিয়ে নম্রতাকে ইশারা করল। নাদিম হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। কাকে ধমক দিবে, কাকে সান্ত্বনা দিবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। প্রেম, ভালোবাসার মতো ঠুনকো বিষয়গুলো এই প্রগাঢ় বন্ধুত্বেও এতোবড় সংকট তৈরি করতে পারে? নম্রতা নিজেকে সামলে নিয়ে নীরার কাঁধে হাত রাখল। অসহায় কন্ঠে বলল,
' দোস্ত! সবাই দেখছে।'
নীরা উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ অন্তুর দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলল না। কারো দিকে এক পলক তাকাল না পর্যন্ত। অন্তুও রঞ্জনকে ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। তারপর বাইক নিয়ে নিরুদ্দেশ। বাকি চারজন দিশেহারা পথিকের মতো চেয়ে রইল। কাকে বুঝাবে? কাকে শাস্তি দেবে? দুই জনেই যে প্রাণ। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে হলের উদ্দেশ্য রওনা দিল নম্রতা। নীরাকে কোনোভাবেই একা ছাড়া চলবে না। কিছুতেই না। ছোঁয়া গাড়ির চাবিটা টেবিলের ওপর রেখে রঞ্জন আর নাদিমের দিকে তাকাল। শান্ত ও শীতল তাদের দৃষ্টি।
বিছানার পাশে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে আছে নীরা। হল ফাঁকা। প্রায় সময়টাতে প্রায় সবাইই হলের বাইরে থাকে। নীরা এই প্রথম হাউমাউ করে কাঁদছে। মুখে ওড়না গুঁজে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। মায়ের বলা কথাগুলো ঘুরেফিরে বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে,
' তোকে আমি পেটে ধরেছি এই দুঃখেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। হারামজাদী, তুই কী মরে যেতে পারিস না? এক বোতল বিষ খেয়ে মরে যা না। এক বছর ধরে পাত্র খুঁজতে খুঁজতে যাই একটা জুটলো সেটাতেও বাগরা। ঢাকায় তুই প্রেম করে বেড়াস? নাগর জুটাইছিস? আর কি কি করিস সেখানে? বিয়ে কেন ভেঙে দিল তারা? তোর কাকারা তো পারলে ঢোল পেটাচ্ছে পাড়ায়। আমি নাকি পড়ার নামে মেয়েকে ঢাকায় বে....'
নীরা আর ভাবতে পারে না। ওর সত্যিই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অন্তু এতো পাগল কেন? এতো বড় সর্বনাশটা কেন করল ও? এমন সর্বনাশা ভালোবাসা তো নীরার চাই না। অন্তু ওকে এতটা অসম্মান কি করে করল? পাড়ায় এখন নীরার জয়জয়কার। নীরা ঢাকায় প্রেম করে। প্রেমিকের সাথে তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা আছে বলেই বিয়ে ভেঙেছে। গ্রামের মানুষ নিশ্চয় আরও বিশ্রী বিশ্রী কথায় জর্জরিত করছে মাকে? এবার কী আরও পাত্র আসবে ঘরে? নীরা নিজের কথা ভাবছে না। তার ছোট একটা বোন আছে। যার বড় বোনের চরিত্রে এতো বড় দাগ তাকে বিয়ে দেওয়াটা কী অতো সহজ হবে? কি পোড়াকপালি নীরা। কেন এসেছিল সে ঢাকায়? কেন ভর্তি হয়েছিল এই অভাগা বিশ্ববিদ্যালয়ে? তার থেকে কোনো মধ্যবয়স্ক লোকের বউ হয়ে নির্যাতন সহ্য করাটাও কি ঢের ভালো ছিল না? নীরা রাগে-দুঃখে হাতের কাছে থাকা কাঁচের মগটা ছুঁড়ে মারল দূরে। প্রচন্ড শব্দে চুরমার হয়ে গেল কাঁচের মগ। অসচেতনতায় বিছানার নিচে থাকা অপ্রয়োজনীয় লোহার শিকরা ঢুকে গেল হাতে। নীরা শিক বের করা নিয়ে তেমন কোনো ব্যস্ততা দেখাল না। উদাসী ভঙ্গিতে বসে রইল। ভেসে যাক সব রক্ত। সে মরে গেলেই শান্ত হবে পৃথিবী। মায়ের লজ্জা, অন্তুর পাগলাটে ভালোবাসা সব ফুরাবে। নীরার মৃত্যুটাই তো চাই। কিন্তু এই মৃত্যুও বড় বিশ্বাসঘাতক। নিমোকহারাম। এমন সময়ে হন্তদন্ত করে ছুঁটে এলো নম্রতা। নীরাকে এমন অগোছালো হয়ে বসে থাকতে দেখে আঁতকে উঠল সে। ফ্লোরে রক্ত গড়াতে দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। তাড়াহুড়ো করে নীরার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ডানহাতটা তুলে নিয়ে চোখ-মুখ খিঁচে শিক টেনে বের করল। হাতটা ওড়না দিয়ে বেঁধে দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
' এসব কী নীরুপাখি? এতো কেন ভাবছিস তুই? দুনিয়া ভেসে যাক, আমি তোর সাথে আছি। যে তোর দিকে আঙ্গুল তুলবে তার আঙ্গুল কেটে রেখে দেব। কাঁদিস না সোনা। তুই কাঁদলে আমিও কেঁদে দেব। পরে কিন্তু থামাতে পারবি না।'
নীরা এবারে নম্রতার ওপর হামলে পড়ল। দুই হাতে জাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এই এক আশ্রয় তার। এই মেয়েটা তাকে একটু হলেও বুঝে। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। নীরার এমন কান্নায় ভেতরটা ফেঁটে গেলেও নিজেকে সামলে নিল নম্রতা। নীরাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে হসপিটালে যেতে রাজি করাল। লোহার শিক ঢুকে গিয়েছে ইনজেকশন দিতে হবে নয়তো ইনফেকশন হতে পারে। নীরা বুঝদার বাচ্চাদের মতো বুঝল। নম্রতার কথামতোই চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে শান্ত হলো।
নীরার হাতে ইনজেকশন আর ব্যান্ডেজের কাজ শেষ হয়েছে সেই অনেকক্ষণ আগে। এখন নীরার ব্রেইন ওয়াশের জন্য খাবারের নামে তাকে নিয়ে হাসপাতালের আশেপাশেই কোনো রেস্টুরেন্টে বসেছে রঞ্জন। নম্রতা ইচ্ছে করেই সাথে যায়নি। রঞ্জন খুব ভালো বুঝাতে পারে। নীরার এই ম্যান্টাল প্রেশার কমিয়ে আনার ক্ষমতা রঞ্জনের আছে। এই সময়ে রঞ্জন আর নীরাকে একা ছেড়ে দেওয়ায় উত্তম। তাছাড়া নম্রতারও বেশকিছু কাজ বাকি। মেডিক্যালে এসে ডাক্তারের খোঁজ না নিয়ে চলে যাবে তা তো হয় না। এই লোক আসলে করছেটা কী? এই দুনিয়ায় আছে? নাকি বিয়ে-শাদী করে সাজেক ভ্যালির মেঘে হাবুডুবু খাচ্ছে? নম্রতাকে তো জানতে হবে। নম্রতা আরফানের চেম্বারের সামনে এসে উঁকি দিল। চেম্বারের সামনে এসিস্ট্যান্টকে দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে আরফান আছে কি নেই সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। নম্রতা কপাল কুঁচকে আবারও উঁকি দিল। সাথে সাথেই পেছন থেকে কেঁশে উঠল কেউ। নম্রতা বিদ্যুৎ বেগে পেছনে ফিরে তাকাল। আরফান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে শ্লেষাত্মক হাসি,
' কি অবস্থা? কাউকে খুঁজছেন?'
আরফানের কথায় হেঁচকি উঠে গেল নম্রতার। বুকে হাত দিয়ে বার দুই হেঁচকি তুলে মাথা নাড়ল। আরফানও নম্রতাকে অনুসরণ করে মাথা নাড়ল। বলল,
' খুঁজছেন না?'
নম্রতা মিনমিন করে বলল,
' আমি কাকে খুঁজব?'
আরফান পকেটে হাত মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
' সেটা তো আপনিই ভালো জানেন।'
' আমি কাউকে খুঁজছি না।'
কথাটা বলে আবারও হেঁচকি তুলল নম্রতা। আরফান বেশ গম্ভীর কন্ঠেই বলল,
' তাহলে নিশ্চয় চুরি করতে এসেছিলেন।'
নম্রতা চোখ রাঙিয়ে বলল,
' হসপিটালে কেউ চুরি করতে আসে?'
আরফান আলগা কন্ঠে বলল,
' আসতেই পারে। চুরের কি আর ধর্মজ্ঞান আছে?'
নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
' কি এমন আছে আপনার চেম্বারে যে আমায় চুরি করতে হবে? আমাকে কি ভিখারি মনে হয়?'
আরফান হেসে বলল,
' না তা মনে হয় না। তবে...'
আরফানের কথার মাঝেই কয়েকবার হেঁচকি তুলল নম্রতা। আরফান ঠেস মারা কন্ঠে বলল,
' চেম্বারে বসুন, পানি খাওয়াই। হাজার হলেও আমাদের হসপিটালে চুরি করতে এসেছেন।'
নম্রতা চোখ রাঙাতেই কথা পাল্টাল আরফান,
' না মানে বেড়াতে এসেছেন। আপ্যায়ন তো করতেই হয়। চলুন ম্যাম।'
কথাটা বলেই চেম্বারের দরজার দিকে এগিয়ে গেল আরফান। দরজাটা খুলে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। নম্রতা 'না' করবে করবে করেও আর 'না' করতে পারল না। নম্রতা চেম্বারে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল। আরফান স্টেথোস্কোপটা টেবিলে রেখে শার্টের হাতা গোটাল। চেয়ার টেনে ধীরে স্থিরে নম্রতার মুখোমুখি বসল। টেবিল ওয়েটটা দুই আঙ্গুল দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে গভীর চোখে নম্রতার দিকে তাকাল। আরফানের এমন চাহনীর সামনে অসহায় হয়ে পড়ল নম্রতা। অস্বস্তিতে হাসফাস করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রশ্ন করল আরফান,
' কি খাবেন?'
' হঠাৎ এতো আপ্যায়ন?'
আরফান জবাব না দিয়ে বলল,
' কফি খেতে হলে বাইরে কোথাও বসতে হবে। যেতে চান?'
আরফানের চোখদুটো আটকে আছে নম্রতার ঠোঁটে। নিচের ঠোঁটের মাঝ বরাবর কালো, ছোট্ট তিলটিতে। গোলাপী রঙে ছোট্ট কালো তিলটা কি সুন্দর মানিয়েছে। এই একবিন্দু কালো রঙেই যেন পৃথিবীর সব নেশা ধ্বংস আজ। নম্রতা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। সাথে সাথেই ভিজে উঠল সেই অদ্ভুত সুন্দর তিল। কৃত্রিম আলোয় চিকচিক করে উঠল কালো রং। আরফান চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। তারপর আবারও আড়চোখে তাকাল নম্রতার ঠোঁটে। নম্রতা স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
' আমি কফি খাই না।'
' তাহলে কি খান?'
কথাটা বলে রহস্যময় হাসি হাসল আরফান। নম্রতা কপাল কুঁচকে বলল,
' হাসছেন কেন?'
আরফান এবারও উত্তর দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
' আপনার বিয়ের কী হলো?'
নম্রতা ফট করেই বলল,
' বিয়ের আবার কি হবে? বিয়ে হবে।'
' কবে হবে?'
' খুব শীঘ্রই।'
আরফান অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
' ও।'
কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল আরফান। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে নম্রতার পাশে এসে দাঁড়াল। আরফানকে এতো কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে দেখেই ধুকপুক করে উঠল বুক। গলা শুকিয়ে এলো। ভাবনাগুলো হয়ে পড়ল এলোমেলো। আরফানের কাটা কাটা আকর্ষণীয় চোয়ালের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল নম্রতা। ভারী জিহ্বা নেড়ে বলল,
' কি হয়েছে?'
আরফান চোখের ইশারায় পানির গ্লাসটা দেখিয়ে বলল,
' পানি খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলাম। পানি খাবেন না?'
নম্রতা বিভ্রান্ত চোখে আরফানের দিকে তাকাল। কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা নিয়ে আড়চোখে আরফানকে পর্যবেক্ষণ করল। আরফান একবিন্দুও নড়ল না। আগের জায়গাতেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দুটো আটকে রইল নম্রতার মুখে, ঠোঁটে। নম্রতা অস্বস্তি নিয়ে পানি খেলো। পানি খেতে খেতেই আড়চোখে আরফানের দিকে তাকাল সে। আরফান তাকিয়েই ছিলো। চোখে চোখ পড়ল। কিছুটা সময় এভাবেই, অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়েই কেটে গেল তাদের। নম্রতা গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই দুই হাত ভাজ করে টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল আরফান। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
' বিয়ের শপিং শেষ? একমাসে শেষ তো হওয়ার কথা, তাই না?'
নম্রতা হালকা কেশে বলল,
' বিয়ের শপিং কী অতো সহজে শেষ হয়? বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত চলতে থাকে।'
' তা হোক। কাল আপনি আমার সাথে লাঞ্চ করছেন। ঠিক একটায়।'
কথাটা বলে চঞ্চল চোখে নম্রতার ঠোঁটের দিকে চেয়ে রইল আরফান। নম্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,
' লাঞ্চ?'
' আপনি চাইলে ডিনারের দাওয়াতও দিতে পারি।'
আরফানের কথায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল নম্রতা। আরফানের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি দেখে বলল,
' আপনি মানুষটা খুব খারাপ।'
আরফান হেসে বলল,
' আপনার বিয়েটা সাকসেসফুল হবে বলে মনে হচ্ছে না।'
' হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়া মানুষ থেকে কোনোরূপ দাওয়াত আমি একসেপ্ট করি না।'
' কেউ একজন আমার কল রিসিভ করেনি।'
নম্রতা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
' বেশ করেছে। আমার পানি খাওয়া শেষ। এখন হলে ফিরব। পানির জন্য ধন্যবাদ।'
আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
' চলুন পৌঁছে দিই।'
নম্রতা সরু চোখে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
' আপনি কেন পৌঁছে দিবেন? হসপিটালে আসা সব পেশেন্টদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আছে নাকি আপনার?'
আরফান ফোনটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
' পেশেন্টদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেই। তবে হসপিটালে যারা চৌর্যবৃত্তি আর উঁকিঝুঁকি দিতে আসে তাদের পৌঁছে দেওয়া যায়। এদের বিশ্বাস নেই। অন্যকারো চেম্বারে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ফেলতে পারে। আমি রিস্ক নিতে রাজি নই।'
নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
' আমি একা যেতে পারি।'
আরফান হেসে বলল,
' আমিও পৌঁছে দিতে পারি।'
রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে নম্রতা আর আরফান। কারো মুখে কথা নেই। তবুও মনের সাথে মনের চলছে বিস্তর কথা দেওয়া নেওয়ার খেলা। রিক্সার ঝাঁকিতে অনিচ্ছায় ছুঁয়ে যাওয়া দুটো হাত। একটু স্পর্শেই শরীরময় শিহরণ। রাজ্যের অস্বস্তি আর ভাবনাতীত ভালো লাগা। মনজুড়ে কতই না অনুভূতির খেলা। পুরোটা রাস্তা অসহনীয় এক ঘোরের মাঝেই কাটিয়ে দিল নম্রতা। আরফানের ঠোঁটেও কথা ফুটলো না। হলের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎই নম্রতার হাতের উপর হাত রাখল আরফান। ডানহাতের মুঠোতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে দ্রুতই সরিয়ে নিল হাত। নম্রতা চমকে তাকাল। আরফানের ভাবলেশহীন মুখ তখন অন্যদিকে ফেরানো। আরফানের মনের ভাব বুঝা গেল না। নম্রতা হলের সামনে নেমে যেতেই প্রথম কথা বলল আরফান। কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে বলল,
' কাল তবে দেখা হচ্ছে। ভালো থাকবেন।'
আরফানের ফিরতি রিক্সাটির দিকে মোহাচ্ছন্নের মতো চেয়ে রইল নম্রতা। রিক্সাটা মোড়ের বাঁকে হারিয়ে যেতেই হাতের মুঠোয় থাকা কাগজটির দিকে তাকাল সে, ' নীল চিরকুট!'
.
.
.
চলবে..........................