পরদিন শুক্রবার।আজ সবাই ঘরে তাদের সময় কাঁটাতে পারবে।সকাল থেকেই নাস্তা বানানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে।আর আজ খুব সকালে পূর্না ও জেগে গেছে।জুলেখা বানু নাতনীকে ব্রাশ করিয়ে মুখ ধুইয়ে নিয়ে আসেন।ব্রাশ করার মুহূর্তে পূর্না চিৎকার করছিলো ও আর ব্রাশ করবেনা কিন্তু বেচারী জুলেখা বানু নাতনীর ভাষা বুঝেননা তাই জোর করে করিয়ে দিলেন।বিভান ঘুম থেকে উঠে গোসলে ঢুকে গেছে।বেলা নাস্তা রেডি করছে আর ইকরাম রাহমান বসে পেপার পড়ছেন।হুমায়রা ঘুমুচ্ছে।বিভান বেরিয়ে এসে ডাইনিংরুমে চলে এলো।সবার ছোট্ট একটা আড্ডা গড়ে উঠেছে হঠাৎ সে আড্ডা ভেঙ্গে ফোন আসে ইকরাম রাহমানের।সে কল এসেছে বাড়ি থেকে।ইকরাম রাহমান কল রিসিভ করে কানে ধরেন।অপরপাশ থেকে তার ছোট চাচা বলছেন,
''ইকরাম তোর ভাই ইহসাইন্নার ফোলা রাফসান তোগোর হুইত(পুকুরে) মাডি ঢাইলবো।
কথাটা শুনেই খুব রেগে গেলেন ইকরাম রাহমান।চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
''হিগার বাফের সাইধ্য আছেনি?খাড়ান আই আইতাছি।"
''হ আয় তুই।"
ইকরাম রাহমান ফোন কেঁটে রেগে ফুঁসছিলেন। ওনার কথায় সবাই বুঝতে পারছে বাড়িতে কিছু হয়েছে।নিশাদ বাবার হাত ধরে বলল,
''আব্বা কি হইছে?"
ইকরাম রাহমান বলতে লাগলেন,
''তোগোর দাদা আর লাই যে হুইর রাখছিলো খেয়াল আছেনি?হিগাত রাফসান মাডি ঢালি ভরাট কইরবো।"
নিশাদ রেগে গেলে ও বাবাকে সামলাতে বলল,
''আব্বা চিন্তা কইরোনা।আমি তোমার লগে বাড়ি যামু তারপর দেখমু তো কে কেমনে ফুকুর ভরাট করে।আইজকাই যামু বাড়িত।আব্বা রাফসান বাড়িত নি?"
ইকরাম রাহমান বললেন,
''বাড়িত তো থাওনের কথা।নাইলে ঢাকাত তন মেলা মাইরবোনি মাডি নোয়াখালীত।"
নিশাদ কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,
''যামু আইজ।"
বেলা ভাবছিলো ওরা সবাই মিলেই তো যেতে তাহলে পুকুর ভরাট করাও থামানো গেলো আর ওরা ও ঘুরতে পারলো। দাদা দাদির ও তো কবর জিয়ারত করতে পারবে আর হুমায়রার জন্য এই ট্রিপটাও বেশ ভালো হবে।
তাছাড়া আর আর অল্প কয়দিন আছে।আর কবে আসা হবে কে জানে?তাই এখন যাওয়াই ভালো।বেলা বলে উঠলো,
''চলনা সবাই যাই বাড়িতে।আসার পর তো যাওয়াই হলোনা আর হুমায়রার ও ভালো লাগবে।দাদা দাদির কবর আছে।"
নিশাদ বলল,
''আপা ঐখানে আমরা যাবো পুকুরের ঝামেলা সামলাইতে।তোরা গিয়ে........."
বেলা বলল,
''তোরা কথা বলবি আমরা ঘুরবো।আর তাছাড়া সারাদিন তো ঝগড়া করবিনা।আমরা রাতে সারাদিন কাঁটাবো কাল বিকেলে রওনা দিবো।"
পাশ থেকে তৎখনাৎ বিভান বলল,
''নিশাদ তোমার আপা ভুল বলেনি।চলো আমরা ঘুরে আসি।হুমায়রার ও ভালো লাগবে আর তাছাড়া আমরা আবার কবে আসি না আসি কখনো হয়ত যাওয়াও হবেনা।কি বলো আদনান?"
আদনানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো বিভান।আদনান চমকে উঠে বিভানের কথায়।ও ভাবছিলো কালকের কথা।বারবার সেই দৃশ্যটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে।বিভানের কথায় আদনান কিছু বলতে পারলোনা।চুপ করে রইলো।বিভান আবার বলল,
''আদনান কি হলো বলো?"
''কি বলবো ভাই?"
সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠে আদনান।বেলা অবাক হয়ে বলল,
''বাড়িতে যাওয়ার কথা হচ্ছে।চল যাই।"
আদনান স্ফীত হেসে বলল,
''চল যাই তাহলে।কবে?"
বেলা বলল,
''দুপুরের পর রওনা দেই চল।তাহলে প্যাকিং করাও হয়ে যাবে।"
সবাই রাজি হয়ে গেলো।হঠাৎ জুলেখা বানু বললেন,
''আমরা যামু সাঁঝরে কইবিনা?"
সাথে সাথে নিশাদ বলল,
''আপা ওরে কল দে।দেখ যাইতে পারবে কিনা?"
বেলা চায়ে চুমুক দিয়ে সাঁঝের নম্বরে কল লাগায়।কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হয়।অপর পাশ থেকে সাঁঝের কথা শোনা গেলো।বেলা বলল,
''কিরে কেমন আছিস?"
''আলহামদুলিল্লাহ আপা।তোদের কি খবর?"
''আলহামদুলিল্লাহ। দাদি, মিতুল আর সাইমন কেমন আছে?"
''ভালোই আপা।"
''হুম। সাঁঝ চল বাড়ি যাই।"
বেলার কথায় বিশ্বাস করতে পারছিলোনা সাঁঝ। অবাক হয়ে বলল,
''বাড়ি যাবি আপা?"
''অবশ্যই।যাবি তুই?"
''হঠাৎ বাড়ি!!"
বেলা বলল,
''আসলে রাফসান ভাই আমাদের পুকুরে মাটি ফেলে ভরাট করবে।তাই ভাবলাম এক সুযোগে গেলাম।চল।"
সাঁঝ চুপ হয়ে গেলো।সামনে মিতুল দাদি আর পাশে সাইমন।সাঁঝ বলল,
''আপা জানাচ্ছি।"
সাঁঝ কান থেকে ফোন সরিয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল,
''বাসার সবাই আমাদের বাড়ি যাবে।"
দাদি সাঁঝের কথায় বলে উঠেন,
''ওহ ভালোই তো।তুমি যাবা নাকি?"
সাঁঝ বলে উঠে,
''ইচ্ছা করছে দাদি।আপনি বললে যাবো।"
জাহনারা বেগম হেসে ফেলেন।বলতে লাগলেন,
''যাও।অন্তত সব ভাই বোন মিলে ঘুরে আসো।সাইমন ও যাক তোমাদের বাড়িতে।ওর তো যাওয়া উচিৎ।সাইমন!!!"
দাদির ডাকে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে সাইমন। দাদি বললেন,
''সাঁঝকে নিয়ে ওদের বাড়ি যা।তোর শ্বশুর বাড়ির সবাই যাবে।"
সাইমন মাথা ঝাঁকায়।এদিকে সাঁঝ হেসে ফেললো।ফোন ধরে বলল,
''আপা কখন যাবি?"
''দুপুরের পর।"
''আসবো আপা।আমি আর সাইমন আসবো।"
বেলা খুশি হয়ে বলল,
''চলে আয়।"
বেলা কল কেঁটে রান্না বসাতে চলে গেলো।সাথে প্রিয়াশাও যোগ দিলো।বিভান নিজেদের প্যাকিংশুরু করে দেয় আর নিশাদ উপর থেকে ব্যাগ নামিয়ে আনে।দুদিনের ট্রিপে যাবে ওরা শুনেছে বাড়িতে খুব শীত।এদিকে পূর্না ভীষন খুশি ঘুরতে যাবার কথা শুনে।ও জোরে হাসছে আর পুরো ঘর জুড়ে দৌড়াচ্ছে।একটার মাঝেই প্যাকিং কম্পলিট হলো কিছুটা।তবে বেলার প্যাকিং এখন ও হয়নি।রান্না শেষ করে টেবিলে খাবার দিয়ে প্যাকিং করতে থাকে ওর পূর্নার আর হুমায়রার।
হুমায়রা নিজের চুল ঝুঁটি করে বসে আছে।ছেলেরা বাবা মা সহ খেতে বসেছে।প্রিয়াশা পূর্নাকে খাইয়ে দিচ্ছে।কিছুক্ষনের মাঝেই সাঁঝ আর সাইমন চলে এলো ব্যাগ নিয়ে।সাইমন ও খেতে বসলো সবার সাথে।এদিকে বিভান নিশাদকে বলে বড় মাইক্রোবাসের ব্যাবস্থা করে নিয়েছে।সবাই একসাথে যাবে বলে ঠিক করেছে।
প্যাকিং সহ বাকি কাজ শেষ করতে করতে তিনটা বেজেই গেলো।সবাই রেডি হয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে ঘরে তালা মেরে।
বাসে উঠে বসে ওরা।
......................এদিকে আজ অনেক দিন হয়ে গেলো ইমতিয়াজের কোন খবর নেই।বেশ অবাক লাগে তমার।কি চাইছে ছেলেটা?ওকে এভাবে রেখে চলে গিয়েছে আর আসলো ও না কোন কথা ও হলোনা।রাগ লাগে তমার।ওর তো চলে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু ইমতিয়াজের কথায় যাওয়া হলো না ওর।ভাবতে ভাবতে শোয়া থেকে উঠে বসে তমা।বেলা তিনটা বেজে গেছে।অথচ ওর ঘুম ভাঙ্গলো নাা।কেমন অলসতা লাগছে ওর।উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় তমা।তারপর চুলোয় দুধ চড়িয়ে কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট কামড়ে ছিড়ে নেয়।নাস্তা করেই কাজে বসে যায় তমা।সময় কেঁটে যায় সেদিকে খেয়ালই নেই ওর।হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠায় সেদিকে তমা।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ইমতিয়াজ কল করেছে। তমা কল রিসিভ করে বলল,
''কিরে শয়তান আমাকে ঘরে আটকে উধাও হয়ে গেলি।"
''সরি বাট একটু ব্যাস্ত ছিলাম।তুই ফ্রি আছিস?"
''হুম কেন?"
''আমি আসছি তোর বাসায়।"
''হঠাৎ!!!"
''কেন আসতে পারবোনা?"
''না তেমন না।চলে আয়।"
''হুম রাখছি।"
তমা উঠে একটু রেডি হয়ে নেয়। চুল গুলো কে বাঁধে সুন্দর করে।টিশাট ট্রাউজার পাল্টে শাড়ী পরে নেয়।আজ কেন যেন সাজতে মন চাইছে তার জন্য।
ঘন্টাখানেক পর ইমতিয়াজ এলো।আজ ওকে ও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।একদম ফর্মাল গেটআপে ইমতিয়াজ। তমা কে দেখে ইমতিয়াজ বলল,
''কিরে শাড়ী পরেছিস।কেউ আসবে?"
তমা বলল,
''না কেউনা।কেন ভালো লাগছেনা?"
''অবশ্যই লাগছে।"
ইমতিয়াজ এসে সোফার ওপর বসে।তমা ওর পাশে বসে বলল,
''তা এতোদিন পর এলি যে?তোর মনে নাই ঘরে আটকে আছি আমি?"
''আসলে একটু চিন্তায় ছিলাম।"
তমার মনটা কেমন যেন করে উঠে।কি নিয়ে ভাবছিলো ইমতিয়াজ? তমা বলল,
''তুই ঠিক আছিস?"
ইমতিয়াজ তমার হাত ধরে বলল,
''তমা একটা কথা ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। "
''কি কথা?"
সাঁঝকে খুব ভালবাসি কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস ওকে পাইনি।তবে এতদিনে আমার মনে হলো তোকে আমার ভীষন প্রয়োজন।সাঁঝকে দূর থেকে ভালবেসে জীবন কাঁটাতে পারবো কিন্তু তোকে আমার প্রয়োজন অনেক।আমি সেদিন তোর ডায়েরী পড়েছিলাম।বুঝতে পারি তুই ও আমাকে ভালবাসিস।সেদিন থেকেই তোকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি।আর যতোই ভাবছিলাম তোর ভালবাসার প্রেমে পড়ে গেছি আমি।এবার আমাকে তোর ভালবাসাকে ভালবাসতে দিবি?বিয়ে করবি আমাকে?"
তমার শরীরটা মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো।নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা তমা।ইমতিয়াজ ওকে বিয়ে করতে চায়?যার ভালবাসার জন্য ষোল বছর যাবৎ অপেক্ষা করে এসেছে ও?তমার চোখ ভরে এসেছে।কম্পিত গলায় বলল,
''মজা করছিস না তো?"
ইমতিয়াজ তমার কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে বলল,
''তোর মনে হচ্ছে আমি মজার মুডে আছি?একদম না।তোকে আমার লাগবে।সারাজীবনের জন্য লাগবে।আমাকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য লাগবে। থাকবিনা?"
তমার গলা আটকে আসছে।কান্না গুলো আজ সুখের ধারা হয়ে বয়ে যাচ্ছে।আজ এই সুখের যে কোন শেষ নেই।তমা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
''অবশ্যই থাকবো।তোর সাথে থাকবো।
!!!!
মুহূর্তের মাঝেই জার্নিটা আমোদে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।হাসি উল্লাসে ভরে যেতে লাগলো পুরো গাড়ি।পিছনের সিটে বসেছে বিভান,নিশাদ, আদনান আর সাইমন।ওদের সামনের সীটে বেলা, সাঁঝ,হুমায়রা আর প্রিয়াশা আর সামনে ইকরাম রাহমান, জুলেখা বানু আর লাবনী।কুঞ্জন ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে আছে।সাঁঝের কোলে পূর্না ঘুমিয়ে।কুঞ্জন সিটের ওপর উঠে ক্যামেরা দিয়ে পিছনে সবাইকে ভিডিও করছিল।হঠাৎ ও বেলা বিভানকে বলল,
''ভাইয়া আপার কাঁধে হাত রাখেন।একটা ছবি তুলি খুব সুন্দর লাগতেছে।"
বেলা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়।নিশাদ চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টায়।বিভান কিছুটা সংকোচ বোধ করছে।সাঁঝ হেসে বলল,
''আরে ভাই রাখেন আপনারই বৌ।আপা ক্যামেরার দিকে তাকা।"
বোনের ডাকে বেলা মাথা তুলে মৃদু হাসে আর বিভান আলতো করে বেলার কাঁধে হাত রাখে।কুঞ্জন ছবি তুলে নেয়।তারপর সবাইকে নিয়ে ছবি তুলল ও।লাবনী হঠাৎ বলল,
''সাঁঝ আপু জার্নিটা বোরিং লাগছে।"
সাঁঝ ঠোঁট মৃদু চোখা করে বলল,
''আসলেই।কি করা যায়রে আদনান?ভাই কই?"
বলেই সাঁঝ পিছে তাকিয়ে দেখে নিশাদ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।বিভান বলল,
''একটা কাজ করো।গানের কলি খেলি চলো।কি নিশাদ খেলবা?"
নিশাদ পাশে তাকিয়ে বলল,
''শুরু করেন আপনারা আমি শুনবো।"
সাঁঝ বলল,
''না ভাই এটা হবে না তোকে ও খেলতে হবে।"
নিশাদ কিছু বললনা।সাঁঝ আবারও বলল,
''আগে আমি শুরু করলাম।"
বেলা বোনের দিকে তাকালো।এদিকে বিভান এখনো বেলার কাঁধ থেকে হাত সরায়নি।বেলা সবার চোখের আড়ালে স্বামীর হাতটা স্পর্শ করে।বিভান বেলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।এদিকে সাঁঝ গান ধরে,
দিন গেলো তোমার পথ চাহিয়া
মন পোড়ে সখিগো কার লাগিয়া
সহেনা যাতনা তোমার আশায় বসিয়া
মানেনা কিছুতে মন আমার যায় যে কাঁদিয়া
পুড়ি আমি আগুনে.................
লাবনী দুষ্টু হেসে পিছনে তাকিয়ে সাইমন কে বলল,
''ও ও জিজু দেখলেন আমার বোন কতো রোম্যান্টিক একটা গান গেলো ইসসস.........আপনিও গান না আপুর জন্য।"
সাইমন লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বলল,
''আমি কি গাইবো।তোমরা গাও শুনছি তো।"
বিভান বলল,
''আরে গাও সাইমন।ছোট শালী বলছে....... আবদারটা তো রাখো।"
সাইমন লজ্জা মাখা কন্ঠে বলল,
''কি গান?"
কুঞ্জন বলল,
''লাস্ট ওয়ার্ড এ ছিলো।এ দিয়ে গাইবেন।"
সাইমন গলা পরিষ্কার করে নিলো তারপর গান ধরলো,
এমনতো প্রেম হয়
ও… চোখের জলে কথা কয়
নিজে নিজে জ্বলে পুড়ে
ও… পাষাণে বাঁধে যে হৃদয়............
কুঞ্জন দুষ্টুমির সুরে বলল,
''ওহহো আপু তুই আমার দুলাভাইকে কি এমন কষ্ট দিলিরে..... "
সাঁঝ হাত উঠিয়ে বলল,
''থাপড়ামু......"
কুঞ্জন হাসতে থাকে।হঠাৎ ইকরাম রাহমান সবাইকে অবাক করে দিয়ে গান ধরলো,
আমি যে কে তোমার
তুমি তা বুঝে নাও
আমি চিরদিন তোমারি তো থাকবো
তুমি আমার আমি তোমার
এ মনে কি আছে
পারো যদি খুঁজে নাও
আমি তোমাকেই বুকে ধরে রাখবো..............
ইকরাম রাহমানের গানে সবাই অবাক।বাবা গান গাইলো। কুঞ্জন চিৎকার করে বলল,
''আব্বা আপনি এতো জোস গান গাইলেন।"
ইকরাম রাহমান হেসে বললেন,
''তোর আম্মার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওনের সময় গান ডা গাইয়া তোর আম্মারে শুনায়ছিলাম।হের পরের বছর বিয়া হইয়া গেছে।আর হের পরের বছর বেলা আইলো।"
জুলেখা বানু লজ্জায় কথাই বলতে পারলেননা।বরকে গুতো দিয়ে বললেন,
''জামাইরা আছে চুপ থাকো।"
এদিকে নিশাদ তো অবাক।আদনানের কানে কানে বলল,
"'আব্বা এতো ভাল গায় জানতাম না।"
লাবনী অধৈর্য হয়ে বলল,
''আরে গান গাও।গল্প হচ্ছে তো।"
বিভান বলল,
''দেখি নিশাদ তুমি গাও।"
নিশাদ বলল,
''আপনারা গান ভাই।আমি শুনবো।"
বেলা নাকচ করে বলল,
''একদম না।গাইতে শুরু কর।"
নিশাদ ছোট শ্বাস ফেলে গান গাইতে শুরু করে,
তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে।
ভাঙল কাঁচের আয়না।।
তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে।
এ ভাঙল বুকের আয়না।।
ভরা যৌবনে সাজাতে তোমাকে ষোলটি
ফাগুন লেগে গেছে।
তোমার অপরূপ ধরে রাখতে।
পাগল হল যে আয়না।।
আমি যেমন তোমারই ছিলাম
তেমন তোমারই আছি।
তুমি আয়নাকে প্রশ্ন করো।
শুনে নাও কী বলে আয়না।।
গান শেষে নিশাদ বলল,
''ভাই আপনি গান এবার,
বিভান বলল,
''হিন্দি গান গাইলে আব্বা আম্মা বুঝতে পারবেননা।কি করি?"
নিশাদ বলল,
''আরে গান ভাই।আমরা বুঝবো আপনি শুরু করেন,
বিভান হেসে গান শুরু করে,
কি করে বোঝাই,
কত যে ভালোবাসি
মনে পড়ে আজও
মধুর সে হাসি
একাএকা এভাবে বলো
আমি কি থাকতে পারি
কি করে বোঝাই
কত যে ভালবাসি।
মন ছাড়া নেই
আর কিছুই দেবার,
তোমায় ভালোবাসার উপহার,
বিভানের গানে সবাই হাত তালি দিতে শুরু করে।বেলা সেদিকে তাকাতে পারেনি।লজ্জায় ও শেষ।এরই মাঝে পূর্না উঠে গেলো।পুরোটা জার্নি গান ময় হয়ে উঠে।কুমিল্লা পৌছে ওরা মিয়ামী হোটেলে নেমে খেয়ে নেয় নাস্তা।বাড়ি পৌছুতেই সন্ধ্যা সাতটা বাজলো।বাড়িতে ভীষন শীত পড়েছে।সবাই বের হওয়ার আগে কিছু গরম কাপড় পরে নেয়।পূর্নাকে ও জ্যাকেট পরিয়ে দেয় বেলা।জ্যাকেট পরেই পূর্না নিশাদের কোলে চড়ে গাড়ি থেকে নেমে প্রথম নানা বাড়িতে পা রাখে।বাড়িতে কারেন্ট নেই মনে হচ্ছে।সাইমন ওদের ব্যাগ নিয়ে নেমে এসেছে।সাঁঝ লাবনীকে নিয়ে হাঁটছে আর প্রিয়াশা ওর সাথে সাথে।আর বিভান বেলা আর হুমায়রাকে নিয়ে।বেলার হাত ধরে নেয় বিভান কারন বেশ আঁধার পড়ে যেতে পারে।কুঞ্জন নিশাদের সাথে যাচ্ছে।সাঁঝ বারবার বলছে,
''ভাবি সাবধানে।রাস্তায় গর্ত থাকতে পারে।"
প্রিয়াশা শাড়ী সামলাতে সামলাতে বলছিলো,
'' জি আপু।"
আরো একটু হাঁটলেই সামনে বাড়ি।বেলা স্বামীর হাত জোরে চেঁপে ধরে এক পর্যায়ে কারন বেশ পিচ্ছিল কোথাও পা রেখেছিলো ও।বিভান হঠাৎ করেই বলল,
''বেলা ঠিক আছো?"
বেলা ধীর কন্ঠে বলল,
''জি।"
ওরা একপর্যায়ে বাড়ির সামনে আসতেই ছোট দাদি বেরিয়ে এলেন।বেলা অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারছিলোনা।তবে কিছুটা ধারনা করেই এগিয়ে যায়।কুঁজো বৃদ্ধাও এগিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
''কিরে বেলা ননি?"
বেলা চিনতে পেরে সালাম দিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে বলল,
''জি দাদি ভালা আছেননি?"
''হ তোগো কি খবর?"
''আলহামদুলিল্লাহ দাদি।"
পাশ থেকে বিভান সালাম দেয় দাদিকে।সালাম শুনে দাদি বেলার থেকে সরে এসে বিভানকে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
''হেতে কেরে?"
সাঁঝ পিছন থেকে সালাম দিয়ে বলল,
''দাদি হেতে আন্নের নাতিন জামাই।আপার জামাই।"
মহিলা বিভানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
''ওরে বেলার জামাই।ভালা আছোনি দাদা?"
''জি দাদি।আপনি?"
''কুব বালা।তোমাগো দেই মন শান্তি হাইলো।"
এরপর ওনি সরে এসে বলেন,
''সাঁঝ তোর জামাই কোনাই?"
সাইমন সাঁঝের পাশে দাঁড়ানো ছিলো।দাদি বলতেই ও এসে দাদির সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল,
''ভালো আছেন দাদি?"
''ভালা।সাঁঝ তোর জামাইনি হেতে?"
লাবনী হেসে বলল,
''হ দাদি।"
সাইমনকে ও জড়িয়ে ধরে দাদি।হঠাৎ হুমায়রাকে দেখে বললেন,
''কিরে হুমা তর মুহে হাসি নাই কিল্লাইরে?বেলা হিগার কি অইছে?"
বেলা বলল,
''না দাদি কিছুনা।"
সাঁঝ আবার ও বলল,
''দাদি খালি জামাই আসেনি নতুন ও বৌ আসছে আদনান ভাইয়ার।"
''হাছানি?কই দেই তো হেতিরে?"
সাঁঝ প্রিয়াশাকে দেখিয়ে বলল,
''এইযে।"
"'নিশাদের বৌনিরে হেতি?"
''আরেনা আদনান ভাইয়ের।"
"'নিশাদের বৌ কোনাই?"
''বিয়া কইরলেই না আইবো।"
দাদা পিছন থেকে জোরে বললেন,
''কিরে বিতরে আয়।নাতনীরে দেখতি ননি?"
দাদি ওদের সবাইকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো।সবাই কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে নেয়।পূর্নার হাল খারাপ হচ্ছিলো।বড় মামার কোল থেকে আরেক দাদা দাদি কোলে নিয়ে কতো যে আদর করলো।কিন্তু পাঁচ ছয় ঘন্টার জার্নিতে এতো আদর তো ভালো লাগেনা। পূর্নার ও তাই হলো।এক পর্যায়ে কেঁদে দেয় চিৎকার করে।তখনই আদনান এসে বলল,
''ওর মায়ের কাছে দিয়ে আসি।জার্নি করে অনেক টায়ার্ড ও।"
মামার কোলে উঠেই আদনানের গলা জড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগে পূর্না।আদনান হেসে ভাগনীকে চুমু দিয়ে বলল,
''ওরে আম্মাটা এতো কাঁদেনা।কলিজা ফেঁটে কান্না পাচ্ছে আম্মু?"
সবাই ফ্রেশ হয়ে একটু খেয়ে নেয় রাতে।তারপর ইহসান রাহমানের ঘরে ওদের থাকতে দেয়া হয়।শুনেছে রাফসান নাকি ওর নানীর বাড়ি থাকে।ওরা বেশ খুশিই হলো।সাইমন, বিভান, নিশাদ আদনান, কুঞ্জন এক খাটে শুয়েছে।খাট বেশ বড় আর ওরা সবাই বেশ চিকন তাই কোন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া শীতে এভাবে ঘুমুলে ঠান্ডা লাগেনা।অপরদিকে বেলা,সাঁঝ, লাবনী, হুমায়রা প্রিয়াশা অপর খাটে শুয়ে পড়ে।সাঁঝের কোলের ভেতর পূর্না।
অনেকটা রাত গল্প করে পরে ঘুমিয়ে যায় ওরা।পর দিন অনেক সকালে সবাই উঠে যায়।ব্রাশ করেই হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে।বাড়িটা ভীষন সুন্দর।নিশাদদের প্রজেক্টের মাছ,ইহসানের লাগানো গাছ পালা,ধান ক্ষেত, সরিষার ক্ষেত বেশ মনরোম পরিবেশ ছিলো।বিভান বলল,
''এত সুন্দর বাড়ি তোমাদের। ভীষন শান্তি লাগে এখানে আসলে।"
বেলা হেসে বলল,
''আমাদের বাড়ি অনেক সুন্দর।"
"'হুম আর তুমিও।"
বেলা লজ্জা পেয়ে বলল,
''ছোট ভাইবোনরা আছে।শুনে ফেলবে ওরা।"
বিভান হেসে নিশাদের সাথে এগুতে থাকে।পূর্না বাড়িতে আব্বা আম্মার কোলে ঘুমায়।নিশাদ হঠাৎ বলল,
''এই আপা ডাব খাবি?"
''অনেক ঠান্ডা তো নিশাদ।আর এখন কে পাড়বে?"
''আগে বল খাবি?"
''খেলে তো ভালোই হয়।"
বলতেই নিশাদ পাশে দাঁড়িয়ে থাক ছেলেটাকে বলল,
''এই লেদা গাছে উডি ডাব হাড়।"
ছেলেটা ওদের অবাক করে দিয়ে বলল,
''আন্নে ঢাকার কাক্কা নন?নিশাদ কাক্কা?"
''হ।তুই কেমনে চিনলি?"
''আন্নের চাইচতো বাই রাসেলের হুত(ছেলে) আই।"
নিশাদ লজ্জা পেলো।নিজের চাচাতো ভাইয়ের ছেলেকে চিনলোনা?রাসেল হলো ঐ দাদার বড় নাতী।নিশাদ ছেলেটাকে আদর করে বলল,
''ইস্কুল নাই তোর?"
''ছুটি।আন্নেরা ডাব খাইবেননি?"
''হ।বিদেশী হুয়া জি(ফুফা) কোনাই?"
নিশাদ বিভানকে দেখিয়ে বলল,
''ঐযে ওনি।"
ছেলেটা বিভানের দিকে চেয়ে জোরে বলল,
''আসসালামু আলাইকুম হুয়া জি।ভালা আছেননি?"
ছেলেটার ডাকে বিভান মৃদু হেসে বলল,
''ওয়ালাইকুম আসসালাম।একটু ডাব নিয়ে দাও তো।"
ছেলেটা কিছু না বলেই গাছে উঠে গেলো।তারপর পেড়ে দিলো বেশ কয়েকটি ডাব।ওরা কয়েকটা খেলো আর বাকি গুলো বাড়ি নিয়ে এলো নিশাদ আর আদনান।সাঁঝ আসতে আসতে স্বামীকে ফিসফিস করে বলছিলো,
''সাইমন আমার ভেতরের সব অবশ হয়ে গেছে।"
সাইমন সাঁঝের হাত চেঁপে ধরে বলল,
''বাড়ি এসো উষ্ণতা দিয়ে সচল করে দিবো আবার।"
সাঁঝের গাল দুটো লাল হয়ে এলো।মুহূর্তেই যেন অজানা উষ্ণতায় শরীর ভরে যেতে লাগলো। কিছু না ভেবেই সেখান থেকে সরে এসে বেলার হাত চেঁপে ধরে সাঁঝ।