শাদাব এসে সম্পূর্ণার খাটের কোণেয় গিয়ে বসলো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল," আগের বিয়েটা ভেঙেছে কেন? যদিও আমি কিছুটা শুনেছি তবে আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।"
সম্পূর্ণা কথাটা শুনে চুপ করে আছে দেখে শাদাব বলল," দেখুন সারাজীবন কাটাবেন যেই মানুষটার সাথে তাকেই যদি বিশ্বাস করতে না পারেন তাহলে করবেন কাকে? জানি না মা কেন আপনাকে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলেছে। এখন এসে দেখলাম আপনি পছন্দের যোগ্য মানুষ। কিন্তু আপনার অতীত তো আমায় জানতে হবে তাই না? আমি যেহেতু আগে বিয়ে করেনি লোকে শুনলে কী বলবে বলেন? কিন্তু আমার মা আর বড় ভাই আপনাকে বিয়ে করাবেই। আমরা যারা প্রবাসী তারা পরিবারের সাপোর্টই বিয়ে করতে হয়। কারণ সেখানে তো আর প্রেম করার মতো সময়ও থাকে না। তাই বাড়ি আসলে বাবা মা যা বলে তাই হয়।"
সম্পুর্ণা এখানো নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের কোণ থেকে টপটপ করে পানি ফ্লোরে পড়ছে। শাদাব সেদিকে লক্ষ্য করতেই বলল," আপনি কী এই বিয়েতে রাজি না? যদি না থাকেন বলেন আমি নিষেধ করে দিব।"
সম্পূর্ণা শ্লেষ গলায় বলল," আমি ইচ্ছে করে বিয়েটা ভাঙতে চাইনি। আসোলে সবকিছু সহ্য করলেও কিছু নির্যাতন সহ্য করা যায় না। তাই হয়তো আমার ডিভোর্সটা হয়েছে। কিন্তু এতে যদি আপনার দ্বিমত থাকে তাহলে বিয়েটা করা কী ঠিক হবে?"
শাদাব মুচকি হেসে বলল," আপনি তো ভালোই কথা বলতে পারেন। আমার যা বুঝার বুঝেছি। তাহলে আমি আসছি আপনি কী আমার সাথে যাবেন না এইখানেই থাকবেন?"
-" আমি এইখানেই আছি।আপনি যেতে পারেন।"
শাদাব গিয়ে বসতেই তার বড় ভাবি বলল," ভাইয়া,কেমন দেখলেন?"
শাদাব মুচকি হেসে বলল, " ভালো।"
শাদাবের মা বললেন," তাহলে আপনারা সন্ধ্যায় বাজারেই বসে পাকা কথা বলেন। দেখুন এই বাড়ি ওই বাড়িতে ঝামেলার দরকার নেই। আজমল রাজি হয়ে একগাল হেসে বললেন, " ভাবি ঠিক বলেছেন। তাহলে আজ উঠাই যাক।"
সেদিন যাওয়ার সময় শাদাব তাবিয়ার নাম্বারটা নিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার পরেই রাত আটটায় শাদাব তাবিয়ার ফোনে কল দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সম্পূর্ণার কাছে দিতে বলল," সম্পূর্ণা কথা বলবে না বলবে না বললেও তাবিয়া জোর করেই ফোনটা তার হাতে দিলো। সম্পূর্ণা সালাম দিয়ে," জি বলুন?"
-" কেমন আছেন?"
-" আলহামদুলিল্লাহ। "
-"জিজ্ঞেস করবেন না আমি কেমন আছি?"
-" বিকেলেই তো দেখেছি আপনি ভালোই আছেন।"
-" সে জন্য জিজ্ঞেস করবেন না? এইটা ঠিক বললেন না। যাইহোক, কিছু শুনেছেন?"
-" কী?"
-" আপনার বাবা বাড়ি এখনো যায়নি?"
-" না।"
-" সত্যিই শুনেননি?"
-" বললাম তো না।"
-" রেগে যাচ্ছেন কেন?"
-" স্যরি আসোলে.....
-" ইট'স ওকে আমিই বলছি লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে। বিয়েটা সামনের শুক্রবার হচ্ছে। এখন যেহেতু আশি পার্সেন্ট হয়েই গেল তুমি করে বলা যায় না?"
-" আপনার ইচ্ছে।"
-" আমার তো ইচ্ছে বলার।"
-" তাহলে ঢং করছেন কেন?"
-" এই তুমি কী এইভাবে রসকষহীন কাঠখোট্টা কথা বলো।"
-" বলতে পারছি না। তবে জানি এমন ছিলাম না।"
-" তাহলে নো প্রবলেম আমি ঠিক করে নিবো।"
কথাটা বলেই লাইনটা কেটে দিলো শাদাব। কারণ তার বড় ভাইয়ের বউ আর বোন পিছনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অনেক কথায় শুনেছে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না সবাই মুচকি হেসে চলে গেল। শাদাব লজ্জা পেয়েছে খানিকটা। নিজেকে বেহায়া মনে হচ্ছে।
শাদাবের বড় ভাবি শারমিন এসে ইয়াসমিন বেগমের পাশে বসে বলল," আম্মা একটা কথা বলি?"
-" হ্যাঁ বল।"
-" শাদাব ভাইয়া কেমন পাল্টে গেল না একদিনে?"
-" কেন?"
-" আপনি বলুন। ফ্রান্স থেকে আসার পর কারো সাথে তেমন কথা বলেনি। কেমন গম্ভীর হয়ে থাকতো।কিন্তু এখন দেখি ওই মেয়েটার সাথে কী সুন্দর করে কথা বলছে।"
-" আরে বলুক। বিয়েটা যখন হবেই বললে আর সমস্যা কী?"
-" সে জন্য বলছি না আম্মা। কেমন জানি।"
ইয়াসমিন বেগম কিছু বললেন না। চুপ করে আছেন দেখে শারমিনও কথা বাড়ালো না।
দুইদিন পরে হিমেলের মা সম্পূর্ণার বিয়ের কথা শুনে
দৌড়ে এলেন সাইফুল ইসলামের বাড়ি। কিছুটা পাগলের মতো ছুটেই এলেন। আতিকা বেগমের হাতে পায়ে ধরে বললেন," সম্পূর্ণারে বলেন আমার পোলাটারে এনে দিতে। আমি সত্যি বলতেছি আপনাদের বিয়েতে আমি কিছু করবো না। কাউকে কিছু বলবো না।"
আতিকা বেগম বললেন, " তুই বললেই কী আর না বললেই কী। ছেলে পক্ষ সব জেনেই বিয়ে করতে আসতেছে। তুই এইখান থেকে যা। শুধু শুধু কথা বাড়াস না। আদীলের বাপ আসলে তোরে দেখলে গায়ে হাত তুলবো।"
-" ভাবি, আপনারা তো জানেন আমি কেমন করে পোলাটারে মানুষ করছি। সম্পূর্ণা ফিরে আসছে কিন্তু আমার পোলা তো আসে নাই।আমি কারে নিয়া থাকবো বলেন?"
-" তুই এইখান থেকে যা। আমরা কোথায় থেকে তোর ছেলে এনে দিব?"
-" সম্পূর্নারে বলেন।"
-" হিমেলের মা এখন আমারই রাগ লাগে। যা এখন। কাজের সময় যত আজগুবি কথাবার্তা।"
এমন সময় তাবিয়া এসে," মা, বাবা আসতেছে।"
কথাটা শুনেই হিমেলের মা সেখান থেকে চলে গেল। সাইফুল ইসলাম এসে চেয়ার নিয়ে বসে বললেন," ডেকোরেশনের লোকদের বলে আসছি। বড় বউ, মেজ বউ গিয়ে কী কী কেনাকাটা করা লাগবে নিয়ে আসুক। সাথে আশিকরে নিয়ে যাক। আশিক কোথায়? মেজ বউ আশিকরে একটু ডাকো তো।"
-" বাবা ও তো বাজারে গেছে।"
-" ওহ তাহলে ও আসলে তোমরা বেরিয়ে পড়ো। সম্পূর্ণা গেলে ওকে নিয়ে যাও।"
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। সুন্দর করে বিয়েটাও হলো। বিদায়ের বেলা যেন সম্পূর্ণার চোখ দুটো পুরোই শুকনো ছিল। বড় ভাবিই সবচেয়ে বেশি কেঁদছিল আমার জন্য। মায়াটা বড় অদ্ভুত ছিল তার সাথে। কখনো ননদ হিসেবে দেখেনি। মেজ ভাবির বিয়ে হয়েছে কয়দিনই বা হলো। আমিও তার সাথে তেমন কথা বলতাম না। আর সে বললেও চুপ করে শুনে হ্যাঁ না বলেই উত্তর দিতাম। ভাইয়া মেজ ভাবিকে নিয়ে যাবে লন্ডন। তাই মায়া বাড়িয়ে লাভ কী। থাকুক না যেই যার মতো করে।
ভাবতে ভাবতেই শাদাবদের বাড়ির সামনে গাড়ি থমকে দাঁড়িয়েছে। শাদাবের বড় বোন আমাকে ধরে গেইটের ভিতর ঢুকালো। আড় চোখে যা বুঝলাম দোতলা বাড়ির সামনে অনেক গাছগাছালি। আমাকে ঘরে নিয়ে তার মায়ের রুমে বসিয়েছে। চাচী, জ্যাঠি, ফুফু, দাদী, নানীরা সবাই এসে আমার চারপাশ ঘিরে কেউ দাঁড়িয়ে আবার কেউ বসেছে। হঠাৎই শাদাবের মা সামনে আসতেই কানে ভেসে এলো পা ছুঁয়ে সালাম করতে। আমিও করলাম। আগেরটা ভালোবাসার বিয়ে ছিল। অনেকেই বলে ভালোবাসার বিয়েতে সুখী হওয়া যায় না। এবার তো বাবা মায়ের পছন্দ মতো করেছি দেখা যাক না কত সুখ কপালে আছে।
সালাম করে দাঁড়াতেই তিনি একটা চেইন বের করে আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। একে একে দেখলাম সবাই একটা না একটা কিছু দিয়েই দোয়া করে যাচ্ছে। বেশির ভাগ লোকের দোয়া ছিল একবছরের ভিতর নাতি চাই। তবে এইটা কেমন দোয়া কোন হাদিস থেকে করেছে আমার জানা নাই। হয়তো এইটা কোনো তাদের বানানো নতুন হাদিস। এর ব্যাখ্যা নেই তাই।
সন্ধ্যায় ওরা নাশতা খাচ্ছে সবাই মিলে। আমাকেও এনে দিলো।চা আর মুড়ি মাখানো। ছোলা, চানাচুর, আর মাংসের ঝোল দিয়ে মাখানো। বড় একটা গামলায় এনেছে। আমাকে খেতে বলছে। ক্ষিধে পেট চোঁ চোঁ করছে কিন্তু ইচ্ছে করছে না। শাদাবের বোন চা নিয়ে এলো সবার জন্য। আমাকেও এককাপ দিলো। চা খেলে হয়তো মাথা ব্যথাটা কমে যাবে। এমন সময় শাদাব এসে নিজের ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। সবাই মুচকি হাসছে। শাদাবের ফোন এগিয়ে দেওয়াতে আমি ফোন হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নিচে নামালাম। কানে দিতেই দেখি বড় ভাবি। ভালো আছি কিনা জিজ্ঞেস করতেই বললাম, " ভালো।" কিন্তু মনে মনে বললাম ভালো থাকার জন্যই তো আমাকে বিয়ে দিয়েছো। তাহলে আর জিজ্ঞেস করছো কেন?
কয়েকটা কথা বলেই রেখে দিলাম। দেখি শাদাব দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। কাপটা আমারই ছিল। ফোন বাড়াতেই চায়ের কাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ফোন নিয়ে। সবাই হয়তো বিষয়টা খেয়াল করেনি। কিন্তু আমার অদ্ভুত লাগছে। খুব খুব অদ্ভুত,,,,
.
.
.
চলবে..............................