নীল চিরকুট - পর্ব ৪৫ - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - ধারাবাহিক গল্প


নীল চিরকুট
পর্ব ৪৫
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
.
.
.
দুপুরের রাশভারি সূর্যটা ঘন্টা দুই হলো কোমল আলো ছড়াচ্ছে। শহরের গায়ে আছড়ে পড়ছে বিকেলের মিষ্টি আলো। আরফান কিছুক্ষণ আগেই রাউন্ড শেষ করে নিজস্ব চেম্বারে এসে বসেছে। ক্লান্ত শরীরে দুটো রোগীও দেখেছে। প্রেসক্রাইভ করেছে। তারপর গা এলিয়েছে চেয়ারে। মনটা বোধহয় ভালো নেই তার। কেমন যেন খাপছাড়া মন খারাপ সময়ে-অসময়ে তাড়া দিচ্ছে তাকে। পৃথিবীর সবকিছু রঙহীন, লক্ষ্যহীন বিতৃষ্ণা বলে বোধ হচ্ছে। আরফানের ক্লান্ত চিন্তার মাঝেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সাঈদ। আরও একজন রোগী অপেক্ষা করছে জানিয়ে সসম্ভ্রমে বেরিয়ে গেল। আরফান মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসল। টেবিলে রাখা মোবাইল স্ক্রিনে উঁকি দিল। লক স্ক্রিনে নম্রতার ছবি। আরফান বেশ কিছুক্ষণ নির্ণিমেষ চেয়ে রইল সেই স্ক্রিনে। এই স্নিগ্ধ,সুন্দর মুখটির দিকে চেয়ে থাকতে তার ভালো লাগে। যতবার দেখে ততবার অবাক হয়। মুগ্ধ হয়। ততবার ভালোবাসে। আরফানের ভাবনার মাঝেই দরজা ঠেলে ভেতরে এলো দুজন। আরফান ফোনের দিকে নজর রেখেই বলল,

' বসুন।' 

'বসুন' শব্দটা উচ্চারণ করে বেখেয়ালে সামনের দিকে তাকাল আরফান। চোখ নামিয়ে নিয়ে ফোনটা পাশে রাখতে গিয়েই যেন চমকে উঠল সে। চোখ উঠিয়ে সচেতন চোখে তাকাল। মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে গেল আরফানের। হকচকিয়ে গেল। বিভ্রান্ত হয়ে গেল। মুখোমুখি বসে থাকা নম্রতা, বাবার চোখ বাঁচিয়ে খুব সাবধানে ডানচোখটা টিপে দিতেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল আরফানের মুখ। নম্রতার এমন কাজে বিস্মিত হলো। মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে সরাসরি তাকাল। কিছুটা অস্বস্তি হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল আরফান। যথেষ্ট প্রফেশনাল কন্ঠে বলল,

' পেশেন্ট কে?' 

নম্রতা দ্রুত উত্তর দিল, 

' দুজনই।' 

আরফান সন্দিহান চোখে তাকাল। নম্রতার দুধে-আলতা ফর্সা মুখটা খুব স্নিগ্ধ লাগছে আজ। জলপাই রঙের সুতি সালোয়ার কামিজে ফুটে উঠেছে রং। চুলগুলো ভিন্নভাবে বেঁধেছে বলে কিশোরীদের মতো উচ্ছল দেখাচ্ছে তাকে। আরফান চোখ সরিয়ে নিল। প্রেমিকার বাবার সামনে প্রেমিকার দিকে 'হা' চেয়ে থাকা নিশ্চয় ভালো ছেলের লক্ষ্মণ নয়। আরফান যথা সম্ভব গম্ভীর কন্ঠে বলল,

' ওহ। বেশ! তো সমস্যা বলুন।' 

নুরুল সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

' কিছুদিন যাবৎ শরীরটা খুবই দুর্বল। শুয়ে বসে থেকেও ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। হুটহাট রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে আবার কখনও হুট করেই কমে যাচ্ছে। খবর কাগজ পড়তে গেলেও চোখ ব্যথা করছে। রাতের দিকে প্রচন্ড পা ব্যথার জন্য ঘুমুতে পারছি না। ক্ষুধা লাগছে কিন্তু খেতে পারছি না। বুক পিঠেও ব্যথা করছে আজকাল।' 

আরফান মনোযোগ দিয়ে শুনলো। এক টুকরো কাগজ টেনে নিয়ে বলল,

' চোখের জন্য আলাদা ডাক্তার দেখিয়েছেন?' 

' দেখালাম সেদিন। ঔষধ চলছে। কিন্তু লাভ বিশেষ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বাসার নিচে দাঁড়িয়ে কেউ হাই,হ্যালো করলে দু'তলা থেকে স্পষ্ট দেখতে পারি না।' 

আরফান যেন হোঁচট খেল এবার। বামহাতের আঙ্গুল দুটো কপালে হালকাভাবে বুলিয়ে নিয়ে প্রেসক্রিপশন লেখায় মনোযোগ দিল। শেষ বাক্যটা না শোনার ভাব করে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করল,

' আপনার বয়স কত?' 

' পয়ষট্টি।' 

' আর নাম?'

' নুরুল মাহমুদ।'  

' ডায়াবেটিস আছে আপনার? পরীক্ষা করেছিলেন কখনও?' 

' তা একটু আছে। তবে আন্ডার কন্ট্রোল।' 

আরফান চোখ তুলে তাকাল। 

' লাস্ট কবে পরীক্ষা করেছিলেন?' 

' এইতো বছর দুই আগে।' 

আরফান বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে বলল,

' দুই বছর আগে পরীক্ষা করিয়ে বলছেন ডায়াবেটিস আন্ডার কন্ট্রোল? ডায়াবেটিস প্যাশেন্টদের প্রতিমাসে একবার করে চেকআপ করা উচিত। আমার মনে হয় আপনার ডায়াবেটিসটা বাড়াবাড়ি রকম বেড়ে গিয়েছে। ডায়াবেটিস থেকে হৃদরোগের উপসর্গও দেখা দিতে পারে। খুব শীঘ্রই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন। তার সাথে আরও কিছু টেস্ট দিচ্ছি। রিপোর্টগুলো খুব দ্রুত আমাকে দেখাবেন।'  

নুরুল সাহেব অসন্তুষ্ট চোখে আরফানের দিকে তাকালেন। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

' ডাক্তাররা টেস্ট ফেস্ট ছাড়া কিছু দিতে পারে না নাকি? সামান্য জ্বর হলেও এক গাদা টেস্ট। হাঁচি দিলেও টেস্ট। ইট'স অল এবাউট পলিটিক্স। আজকাল হাসপাতালেও রাজনীতি। টাকা কামানোর রাজনীতি।' 

আরফান অসহায় চোখে তাকাল। কথাটা নুরুল সাহেব না বলে অন্যকেউ বললে নির্ঘাত চটে যেত আরফান। মেজাজ খারাপ হতো। কিন্তু এই মুহূর্তে চটে যাওয়া যাচ্ছে না। প্রেমিকার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে চুপ করে রইল আরফান। 'টেস্ট না করলে রোগ কিভাবে ধরব? ডাক্তাররা তো আর সর্বজান্তা নয়। চোখ বন্ধ করে মন্ত্র আওড়ে রোগ ধরে ফেলার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি' কথাটা বলতে গিয়েও বলল না। স্বাভাবিক গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,

' টেস্টের রিপোর্টগুলো প্রয়োজন।' 

নুরুল সাহেব বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি আরফানের শান্ত দৃষ্টিকে ছিন্নভিন্ন করে শাসিয়ে উঠল, ' খবরদার আমার মেয়ের দিকে তাকাবে না। এইসব ডাক্তার ফাক্তারকে আমি মেয়ে জামাই হিসেবে মানি না। মানবও না।' আরফান হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। প্রেসক্রিপশনটা নুরুল সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

' টেস্টগুলো করে নিবেন।' 

নুরুল সাহেব উত্তর দিলেন না। প্রেসক্রিপশনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

' এবার আমার মেয়েকে দেখুন। শী নিড আ বেটার প্রেসক্রিপশন ফ্রম ইউ।' 

নুরুল সাহেবের ঠেসমারা কথায় কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল আরফান। হালকা চালে নম্রতার দিকে তাকাল। একদম অপরিচিতদের মতো চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,

' কী হয়েছে আপনার মেয়ের?' 

আরফানের কথার প্রত্যুত্তর করার আগেই নুরুল সাহেবের ফোন বাজল। ফোন আর প্রেসক্রিপশনটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন,

' আজকাল আমার মেয়ের রাতে ঘুম টুম হচ্ছে না। মন খারাপ করে বসে থাকছে। ইনসমনিয়া হয়েছে বোধহয়। আপনি প্রেসক্রাইভটা নাহয় সেখান থেকেই শুরু করুন। আমি কলটা এটেন্ট করে ফিরছি।' 

নুরুল সাহেব চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতেই হাপ ছেড়ে বাঁচল আরফান। শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। চোখদুটো নম্রতার চোখে মেলে ধরে বলল,

' আপনি অসুস্থ?' 

নম্রতা ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল, 

' অনেক বেশি।' 

' এমন ডেঞ্জারাস বাবার মেয়েরা আবার অসুস্থও হয়?' 

নম্রতা টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসল। নিষ্পাপ কন্ঠে বলল,

' যে শহরে রোগ বাড়ানো ডাক্তার থাকে সেই শহরে ডেঞ্জারাস বাবার মেয়েরা আরও বেশি বেশি অসুস্থ হয় ডক্টর।' 

আরফান মৃদু হাসল। সোজা হয়ে বসে টেবিলের উপর খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল,

' আচ্ছা? তো আগে কোনো ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন? নাকি এটাই প্রথম?' 

নম্রতা ব্যস্ত হাতে ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করল। আরফানের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,

' হয়েছিলাম তো। ডাক্তারবাবু ঔষধও দিয়েছে। খুবই রেয়ার ঔষধ। ঢাকা শহরের সব দোকান খুঁজেও পাওয়া যায়নি। আপনি কী জানেন? কোথায় পাওয়া যাবে এই ঔষধ?' 

আরফান কপাল কুঁচকে কাগজের টুকরোটা নিল। নীল রঙের কাগজে সিরিয়াল করে লেখা, ' নিষ্প্রভ, নিষ্প্রভ, নিষ্প্রভ'। নিশ্প্রভের পাশে এরো চিন্হ দিয়ে লেখা 1+1+1+1.... Infinity. আরফানকে কপাল কুঁচকে কাগজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ভারি অসহায় কন্ঠে বলল নম্রতা,

' জানেন কোথায় পাব এই ঔষধ? ঔষধের অভাবে দিনদিন মারা যাচ্ছি। এই অধম প্যাশেন্টের মৃত্যু ঠেকাতে কিছু একটা তো করুন ডক্টর।'  

আরফান চোখ তুলে তাকাল। নম্রতা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ছোট্ট ছোট্ট মোলায়েম চুলগুলো গালের উপর এসে পড়ায় ভারি মিষ্টি লাগছে দেখতে। আরফানের চোখদুটো যেন নেচে উঠল এবার। শ্যামবর্ণ মুখটিতে ঈষৎ দুষ্টুমি খেলে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নম্রতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নম্রতার চেয়ারটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে, দুপাশের হাতলে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ল নম্রতার মুখের ওপর। নম্রতার চঞ্চল, উচ্ছল চোখদুটোতে চোখ রেখে মৃদু কন্ঠে বলল,

' ঔষধটা তো নিজেই ভয়ানক রোগে আক্রান্ত নম্রমিতা। রোগযুক্ত ঔষধ সেবন আপনার জন্য হানিকর হয়ে উঠবে না?' 

আরফানের মৃদু স্বরে করা প্রশ্ন আর গরম নিঃশ্বাসে নম্রতার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে উঠল। নাকে ভেসে এলো সব সময়কার সেই অদ্ভুত সুগন্ধ। কয়েক সেকেন্ড আরফানের চোখে নীরব চেয়ে থেকে কম্পিত হৃদয় নিয়ে বলল,

' আমার হানিকর ঔষধই বেশি পছন্দ ডক্টর। এই ঔষধে মৃত্যু হয় হোক। শরীরজুড়ে লাল-নীল ব্যথা আসুক তবুও আমি এই হানিকর ঔষধটাই চাই।'  

আরফান ঘোর লাগা চোখে চেয়ে রইল। নম্রতাকে এতো কাছ থেকে দেখার সুযোগ আগে কখনও হয়নি তার। নম্রতার মিষ্টি দুটো গাল। ফিনফিনে গোলাপের পাঁপড়ির মতো ঠোঁট। বড় বড় চোখের এক রাজ্য মায়া। আরফান ডানহাতটা উঠিয়ে নম্রতার গালের উপর রাখল। মাথাটা আরেকটু নিচু করতেই ফট করে বলে ফেলল নম্রতা,

' আপনার ভিজিটটা একটু বেশি বলে মনে হয় না ডক্টর?' 

এমন একটা পরিস্থিতিতে, এমন অবান্তর কথায় খানিকটা বিরক্ত হলো আরফান। নম্রতা থেকে সরে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোখ ছোট ছোট করে বুকে হাত গুজে নিয়ে বলল,

' আপনি সবসময় আমার ভিজিট নিয়ে ফোঁড়ন কাটেন কেন নম্রতা?' 

নম্রতা কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,

' ফোঁড়ন কাটিনি। সত্য বললাম। আমি ব্যারেস্টারের মেয়ে, মিথ্যা কথা বলি না।' 

আরফান টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

' আচ্ছা?' 

' অবশ্যই। পরিচিত ডাক্তার হওয়া সত্বেও বার বার ফুল প্যামেন্ট করে ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে। রোগ-টোগও সারছে না। ডাক্তারবাবু বড় নির্দয় পুরুষ। এত টাকা দিয়ে করবেন কি?' 

' বউ কিনব।' 

কথাটা বলে ঠোঁট টিপে হাসল আরফান। নম্রতা চোখ বড় বড় করে বলল,

' কি?' 

আরফান হাসি চেপে কপাল কুঁচকাল। আবারও নম্রতার মুখের উপর ঝুঁকে এসে বলল,

' তবে আপনি চাইলে আপনাকেও কিনতে পারি। আমি হৃদয়বান মানুষ। ভালোবাসার বাজারে খুব পুরাতন ক্রেতা। সুন্দরীদের পার্সোনাল ডাক্তার হতে আমার বিশেষ আপত্তি নেই।'  

নম্রতা চোখ গরম করে তাকাল। আরফানের রাগ ভাঙাতে এসে নিজেই ক্ষেপে যাচ্ছে সে। সুন্দরীদের মানে কী? কত শত সুন্দরীর পার্সোনাল ডাক্তার হতে চায় সে? আরফানের পেটে শক্ত একটা আঘাত করে ফুঁসে উঠল নম্রতা,

' কতজন সুন্দরীর পার্সোনাল ডাক্তার হয়েছেন আপনি? পার্সোনাল ডাক্তার হওয়ার খুব শখ?' 

নম্রতার নরম হাতের আঘাতে শক্ত সমর্থ আরফান এক চুলও নড়ল না। হেসে বলল,

' হ্যাঁ, খুব। এখনও কারো পার্সোনাল হইনি যদিও। তবে আপনাকে দিয়ে শুরু করলে মন্দ হয় না। অভিষেকটা নাহয় আপনিই করুন। পরিবর্তীতে বাকি সুন্দরীদের কথা ভেবে দেখা যাবে। করবেন নাকি অভিষেক?' 

কথাটা বলে চোখ টিপল আরফান। নম্রতা অবাক চোখে চেয়ে রইল। এই ডাক্তার তো তার থেকেও দুই ডিগ্রি উপরে। এই লোকের সাথে কিভাবে ফ্লার্টিং করবে নম্রতা? নম্রতা থমথমে মুখে বসে রইল। নম্রতা গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে হেসে গাল টেনে দিল আরফান। কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিতেই দরজা ঠেলে ভেতরে এলো নুরুল সাহেব। আরফান স্প্রিংয়ের মতো সরে গিয়ে তিন-চার হাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। নুরুল সাহেব অতসব খেয়াল করেননি। তবুও অস্বস্তি আর লজ্জায় কাটা হয়ে রইল আরফান। চট করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে মুখ আড়ালের চেষ্টা করল। নুরুল সাহেব খুব স্বাভাবিক বিস্মিয় নিয়ে বললেন,

' ডাক্তার এদিকে তুই ওদিকে চেয়ার ঘুরিয়ে বসে আছিস কেন মা?' 

নম্রতা চেয়ার ঘুরিয়ে মিষ্টি করে হাসল, জবাব দিল না। নুরুল সাহেব জবাবের অপেক্ষা না করে বলল,

' কেমন দেখলেন?' 

আরফান থতমত খেয়ে মাথা তুলে তাকাল। ডানহাতে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,

' ভালো। আই মিন, আপনার মেয়ে ভালো আছে। রক্তচাপটা একটু হাই। বাকিসব ঠিকঠাক। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হলেই ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।' 

নুরুল সাহেব সন্দিহান চোখে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টি বলছে, আরফানকে ডাক্তার হিসেবেও পছন্দ হচ্ছে না তাঁর। আরফান যেন অকূল পাথারে পড়ল। বুকে বেয়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা বড় আফসোস নিয়ে বলল, ' বিয়ের ল্যাঠাটা তোর কপাল থেকে এবার পুরোপুরিই চুকে গেল রে নিষ্প্রভ। চিরকুমারের চিরবস্ত্র পরিধান করে সন্যাসী হওয়া ছাড়া তোর আর কোনো গতি রইল না বাছা।' নুরুল সাহেবরা চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে এক অভাবনীয় কাজ করে বসল নম্রতা। দরজা পর্যন্ত গিয়ে পেছনে তাকিয়ে হুট করেই একটা দুমড়ানো মোচড়ানো কাগজের টুকরো ছুঁড়ে মারল আরফানের টেবিলে। আরফান তাকাতেই ঠোঁট গোল করে চুমু দেখিয়ে বাম চোখ টিপে হেসে ফেলল। সম্পূর্ণ কাজটা ঘটল নুরুল সাহেবের অগোচরে। আরফান প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থেকে নিজের মনে হেসে দিল। কাগজটা তুলে নিতে নিতে বলল, পাগল! 

_

টেবিল ভর্তি খাবারের কোনটিই পছন্দ হচ্ছে না ছোঁয়ার। সেই কখন থেকে প্লেটে চামচের টুংটাং শব্দ তুলে খাবার নাড়াচাড়া করে চলেছে, মুখে দিচ্ছে না। সবকিছু বিস্বাদ লাগছে। প্রতিদিন মাছ-মাংস আর তথা কথিত সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে বিরক্ত ছোঁয়া। ছোঁয়ার হঠাৎ করেই সেদিন দুপুরের কথা মনে পড়ে গেল। খোলা আকাশের নিচে ঘাসের উপর বসে শত পদের ভর্তা দিয়ে খাবার খেয়েছে তারা। ছোঁয়ার যদিও অস্বস্তি হয়েছে। এভাবে বসে খেতে ঘেন্না লেগেছে তবুও কোথাও একটা তৃপ্তি এসেছিল তার। খাওয়া শেষে গলা মিলিয়ে গান গাইতে গিয়ে তার মনে হয়েছে, পৃথিবীটা বড় সুন্দর। বেঁচে থাকাটা বড় মিষ্টি। কিন্তু কি আশ্চর্য! এই পরিষ্কার, ঝকঝকে খাবার টেবিলে বসেও বেঁচে থাকাটাকে তার একঘেয়ে আর বিরক্তিকর লাগছে। ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে অল্প একটু খাবার মুখে তুলল। সিঁথি হক পাশ থেকে আরও কিছুটা খাবার তুলে দিয়ে বলল,

' বেশি করে খাও। তোমাকে আজকাল খুব উইক দেখাচ্ছে। ইউ নিড পার্ফেক্ট মেডিটেশন। সকাল উঠে মেডিটেশন করছ তো?' 

ছোঁয়া ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

' করছি মাম্মা।' 

' লাস্ট উইক কিছু বই দিয়েছিলাম, পড়ে শেষ করেছ ওগুলো?' 

ছোঁয়া অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

' মনোযোগ দিতে পারছি না। তবে জলদি শেষ করে ফেলব মাম্মা।' 

সিঁথি হক যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন,

' মনোযোগ আসছে না কেন? ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া না করলে মনোযোগ আসবে কিভাবে? রহিমা বলছিল, কিছুদিন যাবৎ তুমি ঘুমানোর আগে দুধ এবোয়েড করছ? রহিমাকে দুধ নিয়ে ঝুড়িতে ফেলে দিতে বলেছ। এসব কেন?' 

' রোজ রোজ দুধ খেতে আমার ভালো লাগে না মাম্মা। আই এম নট আ চাইল্ড নাউ।' 

সিঁথি হক চোখ লাল করে তাকালেন। থমথমে কন্ঠে বললেন, 

' ভালো না লাগার কিছু নেই। পড়াশোনায় কনসেনট্রেট করার জন্য দুধ খুব উপকারী।তোমার নিউট্রোশনিস্ট তোমাকে দুধ খেতে সাজেস্ট করেছে তুমি খাবে, ব্যস।' 

ছোঁয়া বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। আরেক চামচ খাবার মুখে তুলে নিয়ে মুখ কুঁচকাল। চশমাটা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

' খাব মাম্মা।' 

সিঁথি বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎই প্রশ্ন করলেন,

' ডু ইউ হ্যাভ এনি বয়ফ্রেন্ড। কাউকে পছন্দ করো?' 

ছোঁয়া উত্তর দিল না। প্রশ্নটা তার মাথার ভেতর ঘুরতে লাগল। কপালে সূক্ষ্ম এক ভাঁজ পড়ল। সিঁথি হক খাবারের গ্রাস মুখে দিয়ে বললেন,

' আই থিংক তোমার এখন একজন পার্ফেক্ট কোম্পানি প্রয়োজন। তোমার ফ্রেন্ডদের মতো থার্ড ক্লাস ছেলেদের সাথে মেশা বন্ধ করে পার্ফেক্ট কারো সাথে টাইম স্পেন্ড করা প্রয়োজন। আমি আর তোমার বাবা তোমার জন্য পার্ফেক্ট কাউকেই খুঁজছি। খুব জলদি পেয়েও যাব। তুমি...' 

সিঁথি হকের বাকি কথাগুলো ছোঁয়ার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাল না। মাথার ভেতর ঘুরে বেড়াত লাগল অগোছালো কিছু প্রশ্ন। মায়ের বলা 'পার্ফেক্ট' শব্দটা মস্তিষ্কে ফুটবলের মতো ঢপ খেতে লাগল। ছোঁয়ার জীবনে সবকিছুই অত্যন্ত গোছাল ও পার্ফেক্ট। ঘরের রঙ থেকে শুরু করে ছোঁয়ার জুতোটা পর্যন্ত পার্ফেক্ট। পার্ফেক্ট তার ক্যারিয়ার। ঘষামাজা সৌন্দর্য। ছোঁয়া জানে তার ভবিষ্যৎ পুরুষও হবে পার্ফেক্ট হাজবেন্ডের বেস্ট উদাহরণ। কিন্তু তবুও কেন গোটা জীবনটাই ইমপার্ফেক্ট তার? মাম্মা তাকে পার্ফেক্ট সব খুঁজে দিলেও পার্ফেক্ট জীবন কেন খুঁজে দিচ্ছে না? এই নিয়মতান্ত্রিক জীবনে কেন নিয়মহীন, বেপরোয়া কিছু ঘটছে না? মাম্মা তার ঢেউহীন জীবনটাকে কেন তরঙ্গে তরঙ্গে সাজিয়ে দিচ্ছে না? নাদিম বলে ছোঁয়া একটা বলদ। হাই লেভেলের জড়বস্তু। এই সকল জড়বস্তুকে লাথি দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। ছোঁয়ারও আজকাল তাই মনে হয়। এই জড়বস্তুর মতো জীবনটাকে কিক দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সব ইচ্ছেয় পূরণ করার জন্য হয় না। অথবা ইচ্ছে পূরণের সাহস বা স্বাধীনতাটাই হয়ত তাকে দেওয়া হয়নি। ছোঁয়া খাঁচায় বন্ধী সাজানো গোছানো টিয়া পাখির মতোই পার্ফেক্ট। যে মুখস্থ বুলি আওড়ে সবাইকে চমকে দিতে জানে। কিন্তু উড়তে জানে না। তাকে বাবা-মা উড়তে শিখায়নি। কিন্তু কেন শেখায়নি?
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন