দুপুর বারোটা বাজে। সূর্য মাথার ওপর চড়ে আছে। প্রচন্ড গরম পরেছে। তীব্র রোদে সবার নাজেহাল অবস্থা। পার্কের সরু রাস্তা দিয়ে হাটছে সৌহার্দ্য, বিহান আর দোলা। দোলাকে আনার কোন পরিকল্পনা ছিলোনা। কিন্তু সৌহার্দ্য বেড় হওয়ার সময় ওর মা বলল যেখানে যাচ্ছে দোলাকে নিয়ে যেতে। সৌহার্দ্য একটু বিরক্ত হলেও না করেনি। কারণ ও তো জানে দোলার সাথে ওর কোন সম্পর্ক হবেনা। আর সেটা দোলাও জানে। তাই এতো চিন্তার প্রয়োজন নেই। সৌহার্দ্য বারবার ঘড়ি দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিহান একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
" তুই হঠাৎ আমাদের এই পার্কে কেন নিয়ে এলি বলবি? কিছু করছিসও না, বলছিসও না। শুধু হেটে যাচ্ছিস। এখানে কেন এলাম সেটাতো বল ইয়ার?"
দোলারও একরাশ অস্বস্তি নিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
" এক্সাক্টলি! এখানে আমরা কেন এলাম সেটাই এখনও বললেন না। এই গরমের মধ্যে কড়া রোদে হাটছি।"
কিন্তু সৌহার্দ্য কোন প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে চারপাশে শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। বিহান আর দোলাও বিরক্ত হয়ে আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না।
এদিকে সিনএনজি থেকে নেমে তুর্বী দ্রুত ভারাটা দিয়ে রিখিয়ার হাত ধরে পার্কের ভেতরে হাটা দিল। রিখিয়া বলল,
" তুর তুমি চেঞ্জ নাওনি ড্রাইভারের থেকে।"
তুর্বী হাটতে হাটতে হাফানো কন্ঠে বলল,
" আরে বাদ দে তো।"
" কী হয়েছে তোমার বলবে? কত করে বললাম এই গরমে বেড় হতে হবেনা। কিন্তু তুমি এলেই। সেই ভোরবেলা বেড় হতে হল তোমার জন্যে। আর এটা কোথায় নিয়ে এলে বলবে?"
তুর্বী বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ঘুরে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
" তুই না একটুও বদলাস নি, ট্রাস্ট মি! একটু ধৈর্য্য ধর!"
বলে হাটা শুরু করল। রিখিয়াও আর উপায় না পেয়ে হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে তুর্বীর সাথে হাটতে শুরু করল। হঠাৎ করেই তুর্বী থেমে গেল। হেসে দিয়ে বলল,
" ঐ তো!"
তুর্বী কথা শুনে রিখিয়া তুর্বীর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে সৌহার্দ্যকে দেখে অবাক হল। একটু হেসে তুর্বীকে কিছু বলবে তার আগেই সৌহার্দ্যর পেছনে তাকিয়ে ওর হাসি মিলিয়ে গেল। সৌহার্দ্যর পেছনে বিহান আর দোলা আছে। দুজনেই হেসে হেসে কথা বলছে। দোলাকে চেনেনা রিখিয়া। বিহানকে দেখে থমকে গেলেও তার সাথে ওর মন খচখচ করছে যে বিহানের সাথে মেয়েটা কে? রিখিয়া কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,
" তুমি ওদের সাথে দেখা করতে এসছো?"
তুর্বী কিছু বলল না। রিখিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। সৌহার্দ্যর দৃষ্টি ইতিমধ্যে ওদের ওপর পরে গেছে। সৌহার্দ্য হেসে হাত নাড়িয়ে ওদের এদিকে আসতে বলল। সৌহার্দ্যকে হাত নাড়তে দেখে তুর্বী আবার রিখিয়ার হাত ধরে সৌহার্দ্যদের দিকে এগিয়ে গেল। বিহান এখনও তাকায়নি। ও দোলার সাথে কথা বলছে। তুর্বী এসে বলল,
" হাই!"
তুর্বীর আওয়াজ শুনে বিহান তাকাল। তুর্বীকে এখানে দেখে বেশ অবাক হল ও। কিন্তু ওর পাশে রিখিয়াকে দেখে প্রায় জমে গেল। রিখিয়াও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের ওপর স্হির হয়ে আছে। আজ দুই বছর পর আবার এভাবে একে ওপরের মুখোমুখি হবে সেটা ভাবতে পারেনি। একজন ভালোবেসে দূরে গেছে আরেকজন দূরে গিয়ে ভালোবেসেছে। কিন্তু ভালোবাসাটাতো সত্যি! বুকের ভেতরে তোলপাড় হয়ে গেলেও রিখিয়া মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। কারণ এই দুই বছরে বিহানের প্রতি নিজের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গেছে ও। শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু বিহান পারছেনা। ওর ইচ্ছা করছে একটাবার রিখিয়াকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সেই অধিকার কী ওর আছে? বিহান দ্রুত চোখ এদিকে ওদিক নাড়িয়ে, আসতে চাওয়া অশ্রুকে আটকে ফেলল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘনঘন ঢোক গিলে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে ও। সৌহার্দ্য রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
" কেমন আছো রিখিয়া?"
" ভালো,আপনি?"
'' এইতো!"
তুর্বী হাসি মুখে এলেও দোলাকে দেখে ওর বেশ রাগ হয়েছে। ওর মনে সাথেসাথেই একটা প্রশ্ন এসছে, 'এখানেও নিজের হবু বউকে নিয়ে আসতে হবে?' কিন্তু পরে নিজেই নিজের ভাবনায় বিরক্ত হচ্ছে। ও তো এরকম ছিলোনা? এরকম হিংসুটে অনুভূতি কেন হচ্ছে ওর মধ্যে? দোলা সৌহার্দ্যকে বলল,
" ওও এদের জন্যেই এখানে ওয়েট করছিলেন? আগে বলবেন তো! কে হয় আপনার?"
" আমার পরিচিত, পুরোনো বন্ধু।"
তুর্বী দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। বিয়ে টেকানোর কী শখ! এক্স গার্লফ্রেন্ডকে বন্ধু বলে পরিচয় দিচ্ছে। বাহ! বিহান আর রিখিয়া কিছুই বলছে না। শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, মাঝেমাঝে একে ওপরের দিকে তাকাচ্ছে। সৌহার্দ্য বলল,
" এই রোদের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবেনা। চল দেখি কোথাও বসা যায় কি-না।"
ওরা পাঁচজন মিলেই হাটতে শুরু করল। বিহান আর রিখিয়া দুজনেই যথেষ্ট দূরত্ব রেখে হাটছে। দুজনেই চুপচাপ আর অন্যমনষ্ক। এদিকে দোলা বেশ চঞ্চল আর মিশুক মেয়ে হওয়াতে কথা বলেই যাচ্ছে। যেহেতু সৌহার্দ্যকেই ও ভালোভাবে চেনে তাই ওর সাথেই কথা বলছে। তুর্বী বারবার কপাল কুচকে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। একপর্যায়ে ওর এসব একটু বেশিই ইরিটেটিং লাগল। তাই সৌহার্দ্যর কাছে গিয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বলল,
" সৌহার্দ্য! হবু বউয়ের সাথে প্রেমালামটা পরেও করতে পারবে। আপাতত যেটা করতে এসছি সেটা করি? সময় নেই।"
সৌহার্দ্য একটু অবাক হয়ে তাকাল তুর্বীর দিকে এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গলা ঝেড়ে বলল,
" ঐতো বেঞ্চ পাওয়া গেছে। চলো আমরা একটু বেঞ্চে গিয়ে বেশি, বেশ গরম এখানে।"
সৌহার্দ্য দোলার হাত ধরে একটু আগে আগে গিয়ে ছোট বেঞ্চটায় বসে পরল। যেখানে দুজনই বসা যাবে। তুর্বী বুঝতে পেরেছে যে সৌহার্দ্য এটা কেন করেছে। তবুও ওর ভালোলাগেনি ব্যাপারটা। ও হনহনে পায়ে গিয়ে বড় বেঞ্চটার এই সাইডে বসে পরল। রিখিয়া তুর্বীর পাশে বসল আর বিহান রিখিয়ার পাশে। ওরা দুজন একদম চুপ হয়ে গেছে। দেখা হওয়ার পর থেকে এখনও কেউই মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করেনি। সৌহার্দ্য ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও বলল,
" কী ব্যাপার বিহান, রিখিয়া? তোরা দুজনে এভাবে চুপ হয়ে গেলি কেন? এভাবে হুট করেই সবার দেখা হওয়াতে অবাক হয়েছ দুজন তাইতো?"
রিখিয়া আর বিহান দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্যতো জানে ওদের অতীত। তাহলে এতো নরমালি কথা বলছে কীকরে? যেন কিছুই হয়নি। সৌহার্দ্য বলল,
" দেখো! আমরা জানি আমাদের অতীতের কিছু তিক্ততা আছে। আর তারজন্যেই আমরা চারজন এই দু-বছর আলাদা আলাদা ছিলাম। কিন্তু এটাতো সত্যি একসময় আমরা চারজন খুব ভালো বন্ধুও ছিলাম? তাহলে কবে কী হয়েছিল তার ওপর ডিপেন্ড করে আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট করার কী দরকার?"
তুর্বী একটু সোজা হয়ে বসে বলল,
" এক্সাক্টলি! আর এইজন্যই আমি আর সৌহার্দ্য মিলে ঠিক করেছি আমরা দেখা করে এটলিস্ট আমাদের মধ্যে যে তিক্ততা তৈরী হয়েছিল সেটুকু অন্তত মিটিয়ে নেব। তোমাদের আগে থেকে বললে হয়ত আসতেনা। তাই এভাবে___"
রিখিয়া এবার বুঝতে পারল যে কেন তুর্বী ওকে নিয়ে এসছে এখানে, আর বিহানও। ওরা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে ফেলল। সবকিছুর মধ্যে একটা কথা ঠিক সত্যিই ভেতরকার তিক্ততাগুলো মিটিয়ে নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে আর দেখা বা কথা না হলেও মনে সংশয় আর থাকবেনা। দোলা ওদের কথার কিছুই বুঝছে না। কারণ ও কিছুই জানেনা। কিন্তু বেশ ভালো লাগছে ওর কথাগুলো শুনতে। রিখিয়া আর বিহানও এবার একটু নরমাল হল। একে ওপরের সাথে কথা না বললেও সৌহার্দ্য তুর্বী আর দোলার সাথে কথাবার্তা বলছে। বেশ অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর পরিবেশটা স্বাভাবিক হল। গুমোট ভাবটা কেটে গেল সবার মধ্যে থেকে। হঠাৎ সৌহার্দ্য বলল,
" দোল? তোমার একটা পার্স কেনার ছিল রাইট? পার্কের বাইরের মলটা থেকেই কিনে আনছি চল। পরে সময় পাবোনা।"
সৌহার্দ্যর কথা কিছুই বুঝতে পারল না দোলা। ও কখন পার্স কিনবে বলল? ও কিছু বলবে তার আগেই সৌহার্দ্য বলল,
" আরে একটার বেশি বেজে গেছে। লাঞ্চ করতে হবে পরে আবার চল।"
কথাটা বলে সৌহার্দ্য দোলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। তুর্বী দাঁতে দাঁত চেপে সেদিকে তাকিয়ে রইল। যদিও এটা প্লানের অংশ। কিন্তু ওদের দুজনকে একসাথে দেখে এতো রাগ হয় কেন ওর? হঠাৎ কিছু মনে পরতেই ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
" রিখু, তোরা বস। আমি এক্ষুনি আসছি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।"
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
" এখন কোথায় যাবে? চল আমিও যাব।"
" আরে তার দরকার নেই। বিহান একা থাকবে নাকি। বস তুই, আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।"
বলে তুর্বী দ্রুত বেড়িয়ে গেল। ওখানে কেবল রিখিয়া আর বিহান রইল। এতক্ষণ নরমার থাকলেও এখন দুজনের মধ্যেই তীব্র অস্বস্তি কাজ করছে। ওরা কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেনা। কিন্তু দুজনেই দুজনকে ফিল করছে। ভালোবাসা আজ দুজনের মধ্যেই আছে। অদ্ভুতভাবে দুজনের্ অনুভূতিটাই আজ গোপন। দুজনেই ভাবছে যে আর সেই অনুভূতি প্রকাশের অধিকার তার নেই। আবার দুজনের মনই বলছে নিজেদের মনের অনুভূতিক্য চিৎকার করে প্রকাশ করতে। এই দীর্ঘ দু-বছরের দুজনেই অনেক কথা জমিয়েছে মনের মধ্যে। একজনের মনে অভিমান আর অভিযোগ। আরেকজনের মনে অনুতাপ আর ভালোবাসা। কিক এতো কথা থাকার পরেও দুজনেই আজ নিশ্চুপ, স্তব্ধ। হঠাৎ করেই বিহান কম্পিত কন্ঠে বলে উঠল,
" রিখিয়া?"
রিখিয়া কেঁপে উঠল। সাথেসাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ও জানে চোখ খুলে রাখলেই কেঁদে ফেলবে ও। বিহান সেটা দেখে একটু হাসল। দু-বছর হয়ে গেছে। তবুও কেন এখনও এতো ভালোবাসে মেয়েটা ওকে? ভালোবাসার কোন কারণই দিতে পারেনি ও রিখিয়াকে। দিয়েছে শুধু একবুক কষ্ট, ঘৃণা করার বিশাল কারণ। তবুও এতোটা ভালোবাসা কেন? ও কী এই ভালোবাসার যোগ্য?
.
.
.
চলবে..................................................