পদ্মপাতা - পর্ব ০৪ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!১০!!

জৈষ্ঠ্যের দুপুর। আশেপাশে প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে আছে।কেমন জানি খা খা করছে।সূর্যটা নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে সে কোনকালে।তার সে কি হাসি!যেনো মেঘদের ব্যঙ্গ করে বলছে, "দেখলি আমার কেমন বিস্তার। " আর মেঘেরা উত্তরে ভেংচিয়ে বলছে,"আসুক অন্ধকার। তোমার দেমাগ কমাবে।"
সূর্য যেন রাগ করে তেজটা আরো বাড়িয়ে দিলো।এবার বুঝ মজা!

তিলোত্তমা পারলে বাড়ির সবগুলো কাজ যেন চাঁদকে দিয়ে করায়।আবিরের সামনে পারেনা তবে আবির যখন থাকেনা তখন আর রক্ষে হয় না চাঁদের। সেও দুরুক্তি করেনা।ছোটমামি যা কাজ দেয় তাই করে।এই যে এখন যেমন থালাবাসনগুলো পরিষ্কার করার কাজ দিয়েছে তাকে।বড়মামি ঘরে ঘুমান।বড়মামা আর আবির এখনো ফিরেনি।প্রমা,রুমা আর দিমাও অলস দুপুর উদযাপন করছে নিজেদের ঘরে।হয়তো ফ্যান ছেড়ে শরীরকে শীতল করছে।কলের পাড়ে বসে থালাবাসন মাজায় ব্যস্ত চাঁদ।এসবে সে ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত।বাড়ির অন্যমেয়েদের মতো তার জীবন না।এ বাড়িতে তার একটা গন্ডি আছে। কারণ সে এতিম। দানব সূর্যটা তার উত্তাপ ক্ষণে ক্ষণে বাড়াচ্ছে। আর কপাল চুইয়ে তড়তড় করে ঘাম বেয়ে পড়ছে চাঁদের। ছোটমামি স্পষ্ট বলেছেন, "এই যে মহারাণী। এই বাড়ির অন্ন যে ধ্বংস করিস তার ঋণ পোষাবি না।সবগুলো থালাবাসন যেন পরিষ্কার পাই।আর বুবু যদি জানতে পারে তাইলে তোর খবর আছে।"

ঘামে ভিজে বাড়ি ফিরলো আবির আর মতিন।আজ অনেকটা ধকল গিয়েছে তাদের উপর দিয়ে।চাঁদপুর শহর বললেও আবিরদের বাড়িটি পড়েছে শহর থেকে কিছুটা ভিতরে গ্রামাঞ্চলের দিকে।আবিরের আজ বাবার সাথে কাজ করে বেড়াতে একটুও বিরক্ত লাগেনি।কিন্তু এখন শরীরে নেমে এসেছে ভয়ংকর ক্লান্তি।সে এভাবে বাবাকে সাহায্য করলেও প্রবল আত্মসম্মানের কারণে পড়াশোনার খরচ বাবার কাছ থেকে নেয়না।নিজে টিউশনি করে সে টাকায় চলে।এই কারণে মতিন চৌধুরী তার সাথে অনেকটা রাগও করেছিলেন। উপরে রাগ দেখালেও ভিতরে ভিতরে তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন ছেলের আত্মসম্মান দেখে।মতিন একমাত্র ছেলের দিকে তাকালেন আড়চোখে সুঠামদেহী ছেলে তার চেয়ে লম্বা হয়ে গিয়েছে। মতিনের অবাক লাগে সেদিন না মাত্র আবির হলো।আদো আদো বুলিতে বাবা ডাকতো।আর এখন তো তার জুতা ছেলের পায়ে লাগে।ছেলেটে বড় হয়ে গিয়েছে। একটা হাসি দিয়ে তিনি ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন।মুখে বললেন,

-গিয়ে গোসল করে নাও।ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।
-জ্বি, বাবা।
মতিন চলে গেলেন।আবিরও বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকার জন্য পা বাড়ালো।অমনি গোয়ালঘরের পাশে কলের পাড় হতে আওয়াজ আসলো।আবিরের মনে হলো সেখানে এখন আবার কে গেলো।বাড়ির ভিতরে বাথরুমের ব্যাবস্থা থাকায় কলের পাড়ে খুব কমই তারা যায়।আবির পা বাড়ালো সেদিকে। সাদা পাঞ্জাবি তার ঘামে গায়ের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। 

!!১১!!

চাঁদ একমনে কাজ করছে।অগোছালো তার কেশ পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আবির থমকালো।তার প্রাণভোমরার মুখ গরমে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঘামগুলোর উপর বড্ড হিংসে হলো তার।কতোটা বেহায়াভাবে কপালের সাথে লেপ্টে আছে!বেহায়ার দল।পরক্ষনেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার।পিছন থেকে একটানে চাঁদকে দাঁড়া করালো।চাঁদ অনেকটা হকচকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরিচিত স্পর্শে থামলো সে।ঢোক গিলে মাথা নিচু করে রইল।

-তুই কাজ করছিস কেন?
-এই এমনি।
-রান্নাঘরে তো পানির ব্যবস্থা আছে।এই গরমে এখানে বসে কাজ করছিস কেনো তুই। 

অনেকটা শান্ত কন্ঠে বললো আবির।চাঁদ এই শান্ত কথার মানে বুঝে।এটা ঝড় হওয়ার পূর্বাভাস।কিন্তু সে আমতা আমতা করে। জবাব খুঁজে পায়না।আবির জিজ্ঞেসা করে,
-ছোটচাচি বলেছে করতে তোকে?
-হ্যা না মানে হ্যা।
-এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব। সোজা উত্তর দে।
-হ্যাঁ।
চাঁদ খেয়াল করে তার আবির ভাইয়ের কালো চোখের মণি দুটি রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।

-চল আমার সাথে।
-কই।
-চুপ আর একটা কথা না।

চাঁদের হাত টেনে ধরে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে আবির।সুবিশাল হল রুমে দাঁড়িয়ে হাক ছাড়ে,
-ছোটচাচি।ছোটচাচি।

 ছেলের চিৎকারে নিজের ঘর থেকে ছোটে আসেন মোহনা।প্রমা, রুমা আর দিমাও হাজির।আনোয়ারা বাড়ি নেই।মতিন গোসলে।মোহনা এগিয়ে এসে বলে,
 -কি হয়েছে আব্বা?
 -মা, আপনে ছোটচাচিকে ডাকেন।

এরমাঝেই এসে উপস্থিত হলো তিলোত্তমা। ভিতরে ভিতরে হকচকিয়ে গেলেও উপরে তিনি শক্ত। 
-কি বলবা আবির?
-আপনি চাঁদকে থালাবাসন ধুতেঁ বলেছেন?
-হ্যাঁ।মেয়ে মানুষ ঘরের কাজ করবোনা।
-প্রমা আর দিমা তো চাঁদের বড় ওদের দিলেন না কেনো?আচ্ছা, তাও মানলাম। এই ভরদুপুরে ওকে বাইরে পাঠালেন কেনো?
তিলোত্তমা জবাব দিতে পারলেন না।চাঁদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আবিরের পিছনে। তার আবির ভাই তাকে নিয়ে সব সময় বাড়াবাড়ি করে।আবির শান্ত সুরে বললো,
-ছোটচাচি, চাঁদ একটা বাচ্চা মেয়ে। আপনি তো বড় তাহলে কেন এতো অবিচার করেন ওর উপর?মেয়েটার কেউ নেই।আমরাই আপন।আশা রাখছি পরেরবার থেকে প্রমা,রুমা আর দিমার মতো চাঁদকেও দেখবেন।বলেই গটগট করে উপরে সিঁড়ি বাইতে লাগলো আবির।আর চাঁদও চললো তার পিছুপিছু। এখানে থাকলে নির্ঘাত ছোটমামি বকা দিবেন।

!!১২!!

তিলোত্তমা যেন তেতে উঠলেন।রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন ছুটন্ত চাঁদের দিকে।মোহনাকে বলে বসলেন,
-দেখলেন বুবু।দেখলেন।আপনার ছেলেরে।
মোহনা স্থির কন্ঠে বলে,
-কোনো ভুল বলেনি আবির।আর ও চাঁদকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে।চাঁদের কথা ভাবে।তোর এই ব্যবহার আশা করিনি আমি।
-আপনিও এই কথা বললেন বুবু।

মোহনা আর কথা বাড়ালোনা। রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো।দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছে কিনা।

আবির নিজের ঘরে ঢুকে কতোক্ষণ থম মেরে খাটে বসে রইল।তার প্রাণপ্রেয়সীকে কি এভাবেই কষ্ট দেয় ছোটচাচি।ব্যথা উঠলো তার বুকে।এই ব্যথা তার প্রাণপ্রেয়সীর কষ্টের ব্যথা।চাঁদকে আপন করে যেদিন ঘরে তুলবে সেদিন চাঁদের সব দুঃখ মুছে দিবে সে।সব।এখন সে চাইলেও অক্ষম। 

সন্ধ্যায় আবিরের ঘরে এসে বসেছে দিমা, রুমা আর চাঁদ।দিমা আর রুমা খাটে বসে পড়ছে।আর চাঁদকে নিজের সামনে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে আবির।চাঁদ খাটে বসতে চেয়েছিল।কিন্তু আবির এক ধমক দিয়ে বসিয়ে রেখেছে এখানে।চাঁদের অভিমান জমলো। রুমা, দিমা তো খাটে বসে পড়ছে।চাঁদকে যখন ধমক দেওয়া হয় তখন দিমা মিটমিটিয়ে হাসছিল। তার মন নেচে উঠে নিজের সাথেই বলে,
"বেশ হয়েছে। "
চাঁদ তাকানোর পর মুখে দুঃখ ফুটিয়ে তুলেছিল সে।যেন চাঁদের দুঃখে সে কত দুঃখী। 

চাঁদের মনে হলো সে কি ময়লা নাকি যে বিছানায় বসলে তা নষ্ট হয়ে যাবে।মুখ ফুলিয়ে প্যারাগ্রাফ পড়ায় মনোযোগ দিলো সে।
আবির সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলে,"আমার বোকা প্রেয়সী।তোমাকে সামনে বসিয়ে রেখে মন ভরে দেখার এ এক নিদারুণ কৌশল তোমার প্রেমিক পুরুষের।"

পড়ার মাঝে হঠাৎ আড়চোখে চাঁদ আবিরকে পর্যবেক্ষণ করছে।আবির আপাতত একটা বইয়ে মুখ গুঁজে আছে।বোকা চাঁদ কি জানে আবির যে তাকেই দেখছে।কালো কুচকুচে চোখের মণি,ঘন ভ্রুযুগল,মৃদু ফর্সা গায়ের রং আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চাঁদের হঠাৎ মনে হলো তার আবির ভাই সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর! 

আবির খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে সম্মোহনী কণ্ঠে বলে,
"এভাবে তাকিয়ো না প্রাণপ্রেয়সী। প্রেমে পড়ে যাবে।"

চাঁদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আবিরের দিকে।আবির স্বাভাবিক ভাবেই বসে আবার বইয়ে মুখ গুঁজলো।আর চাঁদের কিশোরী হৃদপিণ্ড আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো ধুকবুক ধুকবুক।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন