পদ্মপাতা - পর্ব ০৫ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!১৩!!

নির্জন রাত।নিস্তব্ধ চারপাশ। ঝিঁঝিপোকারা এক মনে ডেকে যাচ্ছে।ধুরী দিঘীর ব্যাঙটার আজ যেনো খুশির সীমা রইল না।সে আপন মনে অজানা খুশিতে ডেকেই চলেছে।ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ,ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ।

হল রুমের পাশে আর রান্নাঘরের দরজার দিকটায় অবস্থিত টেবিলটায় বসে চৌধুরী বাড়ির সবাই খেতে বসেছে।মতিন,করিম,আনোয়ারা,তিলোত্তমা, মোহনা, রুমা,দিমা আর প্রমা।রহিমা আর পচুও নিচে বসে খাচ্ছে। চৌধুরী বাড়ির নিয়ম এটাই।সবাই একসাথে খাবে।অন্তত রাতের খাবারটা।মতিন খেয়াল করলেন চাঁদ নেই।

-মোহনা।চাঁদ কই।
-ওর নাকি খারাপ লাগছে। খাবার ঘরে দিয়ে আসলাম।
-আচ্ছা। 

এর মধ্যে তিলোত্তমা ফোড়ন কাটলো।তাচ্ছিল্যের কন্ঠে তিনি বললেন, 
-মহারাণীর ঢং দেখে বাঁচিনা।খাবার ঘরে দিয়ে আসার কী দরকার বুবু।খাইলে খাবে না খাইলে নাই।

আবির মাথা নিচু করে শুনছিল কেবল। বাবা আছে কিছু বলা যাবেনা এখন।মতিন বললেন, 
-আহ্।তিলোত্তমা, খাবার সময় এসব কথা কেন।
-ভাইজান।আপনি আর বুবু এই অলক্ষীরে মাথায় তুলছেন।
-করিম তোর বউকে ভদ্রতা শিখা।

করিম চোখের ইশারায় থামতে বললো তিলোত্তমাকে।তিনি চুপ করে গেলেন।আবির খাওয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো।খাবার খাওয়ার রুচি তার উঠে গিয়েছে। 

চাঁদ নিজের ঘরে বসে আছে।তার দুগ্ধসাদা গালগুলো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আজ আবির ভাই তাকে এসব কী বললো।কখনো হেসে উঠছে সে কখনো হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিচ্ছে। ইস্,কি লজ্জা!

প্রেয়সীর এই লাজুকরূপ যে কারো বুকে তীরের মতো আঘাত করছে।তার প্রেমিকপুরুষ তো মরেই যাবে।আবির তার বুকের ঠিক বা দিকটায় ডান হাতটা ছুঁয়ালো।আর অস্পষ্ট স্বরে বললো,

"ওহে লজ্জাবতী
আর করিওনা লজ্জা
ওহে লাজুকলতা 
তোমার রক্তিম দুটো গাল
মুচকি হাসি 
বুকে লাগে 
বা দিকটায় গভীর ক্ষত করে তো"

চাঁদ বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়। নানুমার ঘরে যাবে।আজ তার কিশোরী মন নতুন কিছুর ছোঁয়া পেয়েছে। তাই সে ভিষণ খুশি।ভিষণ।
আবির দ্রুত পায়ে নিজে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

!!১৪!!

আনোয়ারা বেগম পান ছেঁচছেন।দাঁত কয়েকটা না থাকার দরুণ পান চিবুতে পারেন না।ছেঁচে খেতে হয়।মোটা গড়নের ঢিলেঢালা চামড়ার লাল ফর্সা এই মহিলাটিই চাঁদের দ্বিতীয় মা।চাঁদ আনোয়ারার মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।পরে গুটিগুটি পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে নানুমার পাশে বসলো।আনোয়ারা চমকালেন।একমনে কাজ করছিলেন কিনা।তাই আর আশেপাশের খবর নেই তার।চাঁদ মুচকি হেসে মাথাটা এলিয়ে দিলো তার কোলে।এখানে এতো শান্তি কেন!
আনোয়ারা চাঁদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-বইন।শরীল খারাপ করছিল তোমার।এহন কেমন লাগে?
-ভালো নানুমা।
-বইন ছোটবউ তোরে দিয়া কাম করায়?ঝামেলা হইছে শুনলাম।
-এসব বাদ দাও তো নানুমা।মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।আমি একটু ঘুমাই।তুমি আছো না আমার।আর কিছু লাগে নাকি।

আনোয়ারা হালকা হেসে নাতনীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।আর চোখের সামনে ভেসে উঠলো কয়েক বছর আগের মর্মান্তিক অতীত।

ময়না। চাঁদের মা ছিলেন চৌধুরী বাড়ির ছোটমেয়ে।বড় দুই ভাই আর বড় বোনের অনেক আদুরে ছিলেন তিনি।মা আর বাবাও অনেক আদর করতো।মতিনের যেন চোখের মণি ছিলেন ময়না।বড় মাছের মাথাটা নিজের পাত থেকে তুলে বোনের পাতে তুলে দিতেন।আর বলতেন,"আমি খেলে যে কথা আমার ময়নামণি খেলে একই কথা"।এভাবেই হেসে, খেলে দিন পাড় করছিল তারা।মাঝে আবার মৃত্যু ঘটে আনোয়ারার স্বামী দুলাল চৌধুরীর। ব্যবসার সব ভার পড়ে মতিনের কাঁধে।তখন বোধহয় আবির মাত্র হয়েছিল। ময়না আর আনোয়ারার বোনের ছেলে আব্দুলের প্রেমের খবর ফাঁস হয়।সেদিন মতিন প্রথম ময়নাকে মেরেছিল।চৌধুরী বাড়িতে আত্মীয় তে কখনো বিয়ে হয়না।আর ভাই-বোনের কিসের প্রেম। হোক সেটা খালাতো।ভাই তো ভাই।সেদিন রাতেই পালিয়ে যায় ময়না আর আব্দুল। 

মতিন সেদিন ভিষণ কষ্ট পেয়েছিলেন।ছোটবোনটাকে অনেক ভালোবাসতেন তিনি।তাদের আর মেনে নেননি মতিন।আনোয়ারা তো মা। তাই তিনি মেয়ের সাথে লুকিয়ে দেখা করতেন।বড় বোন দুলালীর সাথেও কথা হতো ময়নার। তবে মতিন আর করিম মেনে নেয়নি।তারা ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু না।মতিনের মন গলেনি।সমাজে তার সম্মান কি ফিরে পাবে সে।

!!১৫!!

প্রায় আট বছর পর ময়না সাথে করে নিয়ে আসলো দুই মাসের এক ফুটফুটে বাচ্চা। নামটা যেমন চাঁদ ঠিক চাঁদের মতোই তার রূপ। মতিন চৌধূরী ময়নাকে বাড়ির ভিতর ঢুকতে দিলেন না।তবে ময়না মতিন চৌধুরীর সামনে চাঁদকে রেখে গেটের বাইরে চলে গেল।মতিন চৌধুরী কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন।অতঃপর চাঁদের টুকরাটাকে কোলে তুলে নিলেন।ঘুচে গেলো ভাই-বোনের দ্বন্দ্ব। 

তবে বিপত্তি ঘটলো বছর ছয়েক আগে।চাঁদের তখন নয় বছর।এই বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল ময়না, আব্দুল আর চাঁদ। যাওয়ার পথে চাঁদ বায়না ধরে করিমের ছেলে কবিরকে না নিয়ে সে যাবেনা।কবিরও তাই।সেও চাঁদের সাথে যাবে।সমবয়সী বন্ধু তারা।তিলোত্তমা ছেলেকে রেডি করে দিলেন।এই একটা মানিক তার।শারীরিক সমস্যার কারণে আর কখনো মা হতে পারবেন না তিনি।করিম প্রথমে না করলেও পরে যেতে দিলো।তবে ঘন্টা দুয়েক পরেই কানে এলো ভোলা যাওয়ার পথে বাসের দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে কবির,ময়না আর আব্দুল। তবে চাঁদ বেঁচে যায়।

তিলোত্তমা সেদিন অনেক মারলেন চাঁদকে।কেউ থামাতে আসেনি।শেষে আবির এগিয়ে এসেছিল।আনোয়ারাও জোর করে মারা থামিয়ে ছিলেন।তিলোত্তমার মতে কবির কেবল চাঁদের কারণে মারা গিয়েছে। করিমেরও তাই মত।সবাই তখন চাঁদকে এতিম খানায় দিতে চাইলো।তবে বাঁধ সাধলো আবির।সে কোনো মতেই চাঁদকে এতিম খানায় দিবেনা।সতেরো বছরের কিশোর আবিরের জেদের কাছে হার মেনে মতিন নিজ বাড়িতে ঠাঁই দিলেন চাঁদকে।বিগত বছরগুলোতে বাড়ির সবাই চাঁদকে মেনে নিলেও তিলোত্তমা আর করিম মেনে নেয়নি। হয়তো নিবেও না। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন আনোয়ারা। নাতনী তার ঘুমে বিভোর। তিনিও ঘুম দিলেন।

আবির আজো ডায়েরি লিখতে বসেছে। সে কতোক্ষণব্যাপী যে তার প্রিয়তমার মুখ কল্পনা করে বসেছিল নিজেও জানেনা।

আধাঁর আর নিস্তব্ধতা পেরিয়ে ধরণীর বুকে নেমে এলো নতুন এক ভোর।এই ভোরে হয়তো কেউ নতুন স্বপ্নের দিকে পা বাড়াবে।কেউ হয়তো আবার এই ভোরে সব হারাবে।জীবন যখন যার সাথে যেমন।ভোরগুলো হয়তো কারো অপেক্ষার অবসান ঘটাবে। আবার কেউ হয়তো রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলবে,"কেন এলিরে তুই? ফিরে যা।"

দরজার ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো আবিরের।কিছুক্ষণ আগেই বেচারা নামাজ পড়ে শুয়েছিল। লাল লাল চক্ষুযুগল ঢলতে ঢলতে দরজা খুলে দিলো সে।সদ্যস্নান সেরে মাথায় গামছা পেঁচানো এক রমণী দাঁড়িয়ে। হাতে তার চায়ের কাপ। 

-আবির ভাই। ধরেন আপনার চা।
আবির এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তার চাঁদের দিকে। সময়টা কি থমকে গিয়েছে।আবিরকে এভাবে তাকাতে দেখে আবার হাক ছাড়ঁলো চাঁদ।

-আবির ভাই।এই আবির ভাই।আপনার চা।ঠান্ডা হলে তো আবার আমাকেই বকবেন।

আবির হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলো।চাঁদ যেন হাফ ছেড়ে বেঁচে গেলো।রওনা দিলো রান্নাঘরের দিকে।সে আবার লুকিয়ে পাটকাঠিদের সাথে দেখা করতে যাবে।অবশ্য লুকিয়ে।

আবির বিড়বিড় করে বললো,
"হরিণী 
তোমার স্নিগ্ধ রূপে 
আমি বিমোহিত 
আমি পুলকিত 
আমি শিহরিত "
.
.
.
চলবে................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন